লেখক : অস্মিতা রায়
অমাবস্যার অন্ধকার মাখা মুকুন্দপুরকে নিস্তব্ধতা আজ যেন গ্রাস করেছে। শান্ত মেঠো রাস্তার ধার দিয়ে শুধু এক ঝাঁক ঝিঁঝিঁ পোকা অনবরত ডেকে চলেছে। অন্ধকার কুপের মধ্যে একখানা টিমটিম করে আলো জ্বলছে শুধুমাত্র আমাদের পৈতৃক বাড়ির উঠোনে। নিমন্ত্রিত লোকজন খাওয়াদাওয়া শেষ করে বাড়িমুখো হতেই দালান জুড়ে ঝুপ করে আঁধার নেমে এল। আজ আমার খুড়তুতো দাদার বাৎসরিক অনুষ্ঠান। তাই বহু বছর বাদে শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে আসা হয়েছে। এককালে ভরা একান্নবর্তী সংসার হলেও আজ খাঁ-খাঁ করছে এই শতাব্দীপ্রাচীন জমিদারবাড়ি। বাড়ির লোক বলতে বড়দাদু, কাকা, কাকিমা, আর জয়ন্তদা ছিল। কিন্তু সেই জয়ন্তদাও আর নেই। মাত্র ষোলটা বছর বয়স। কি যে হয়ে গেল ছেলেটার। জয়ন্তদার মৃত্যুটা আকস্মিক তো বটেই, তার সাথে অস্বাভাবিকও। এই বাড়ির বাকি মানুষদের মতো দাদাও ছোট থেকেই অ্যানিমিয়া রোগে ভুক্ত। একবছর আগে ভোর রাতের দিকে যখন জয়ন্তদার রক্তশূন্য দেহটা বৈঠক ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখা গেছিল, তখন এই বাড়ির অন্দরমহলে আরও একবার কান্নার রোল উঠেছিল। এখানকার কোনো ডাক্তার-বৈদ্যই জয়ন্তদার মৃত্যুর সঠিক কারণ বলে উঠতে পারেনি। বছর বছর এই জমিদারবাড়ি তার পরিবারের কোন না কোন সদস্যের অস্বাভাবিক মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে এসেছে। জয়ন্তদার চলে যাওয়ার পর বংশের প্রদীপ বলতে শুধু আমিই রয়ে গিয়েছি।
এ গ্রামে ঘড়ির কাঁটায় দশটা বাজা মানেই মাঝরাত। আমার এতো তাড়াতাড়ি ঘুমোনোর অভ্যাস নেই। অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে একটা মাত্র লণ্ঠন জ্বলছে। লণ্ঠনের শিখা নিভুনিভু। সোঁদা গন্ধে ঘুম আসা দায়। কানের কাছে একটানা মশার গুণগুণ শব্দ আসছে। গভীর রাত, বৈঠক ঘরের দেওয়ার ঘড়িতে ঢং ঢং করে দু’টোর ঘন্টা বাজল। গা’টা ছমছম করে উঠল আমার। খাটে শুয়ে থেকে এপাশ ওপাশ করছিলাম। হঠাৎ মেঝের দিক থেকে একটা আওয়াজ উঠে এল।
“প্রবাল, একটু জল এনে দিবি বাবা?”
বিদ্যুতের গতিতে খাট থেকে মুখ নিচু করে তাকালাম। বড়দাদু জ্বলজ্বল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কখন যে এই ঘরে এসে মাটিতে বিছানা করে শুয়েছে, ঠিক বুঝতে পারিনি। মশারি থেকে বেরিয়ে কলসী থেকে এক গ্লাস জল নিয়ে বড়দাদুর দিকে এগিয়ে দিয়ে আমি নিচেই বসে রইলাম। ওপরে একা একা শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগছে না। বড়দাদুও একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কি মনে হতে বললাম,
“বড়দাদু, তোমার ওই গল্পটা বলো না!”
“কোন গল্পটারে বাপ?”
“ওই যে শ্মশান থেকে জ্বলন্ত চিতার কাঠ নিয়ে আসার গল্পটা! বাবার কাছে কতবার শুনেছি।”
গল্পের প্রসঙ্গ আসতেই বড়দাদুর শুকিয়ে যাওয়া মুখটা কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
“সে আর এমন কি গল্প। তখন আমাদের বয়স কত, এই পনের-ষোল হবে। পাশের পাড়ার মস্তানদের সাথে বাজি ধরলাম, যে গ্রামের শেষ প্রান্তে থাকা আলোকডাঙ্গির শ্মশানের চিতার কাঠ আনতে পারবে, তাকে সবার সর্দার বলে মান্যতা দেবে। কথা মতো রাত্রি বেলা খাওয়াদাওয়া শেষে মায়ের চোখ এড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমি আর আমার ছোট ভাই বিশ্বম্ভর। মাঘের শীতে অন্ধকার রাস্তায় চাদর মুড়ি দিয়ে হাঁটছি, ভয় যে লাগছে না তা নয়। কিন্তু তখন আমাদের রক্ত গরম, দুইভাই মিলে গল্প করতে করতে পৌঁছলাম আলোকডাঙ্গির শ্মশানে। সেদিনই এই পাড়ার একটা পাগলী মরেছিল। খুব কষ্ট ছিল মেয়েটার জানিস তো। বেঁচে থাকতে শান্তি পায়নি, আর মরে গিয়ে তো – পাড়ার লোকেরা ডাইনি অপবাদ দিয়ে মেয়েটার ঘর পুড়িয়েছিল। বাপের পরিচয় না থাকায় ওর বাচ্চাটাকেও রেহাই দেয়নি। নিজে মুখে কি আর বলব লজ্জার কথা, আমাদের বাপ-ঠাকুরদারাই আগুন লাগাতে গ্রামের লোককে মদত করেছিল। মরতে মরতে পাগলী বলেছিল, নির্বংশ করে ছাড়ব তোদের সব ক’টাকে।” কথাগুলো বলতে বলতে লক্ষ্য করলাম, বড়দাদুর মুখটা কঠিন হয়ে উঠেছে।
“অনেকে বলত এই বংশের কোনো এক জমিদারের জারজ সন্তান ছিল পাগলীর ছেলেটা। নিজেদের মুখে যাতে চুনকালি না লাগে, সেইজন্য এই অপবাদ রটানো হয়েছিল। পাগলী আর ওর বাচ্চা ছেলেটার আধপোড়া দেহটা একই চিতায় ওঠানো হয়েছিল। তাতে কোনরকম আগুন জ্বালিয়েই এই শয়তানগুলো পালিয়েছিল। আমি আর ভাই যখন পৌঁছলাম, চিতার আগুন তখনও নেভেনি। একপাশ দিয়ে মেয়েটার একটা ঝলসানো কালো হাত বেরিয়ে আছে। এদিকে পোড়া মাংসের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছে। গোটা শ্মশান জুড়ে একটা জনমানব নেই। হঠাৎ করে একটা ঝড়ের মতো দমকা হাওয়া উঠল, চিতার আগুন ক্রমশ বেসামাল হয়ে উঠছে। তাড়াতাড়ি মাঝখান থেকে একটা কাঠ টেনে পিছনে ঘুরে এক পা ফেলেছি, সাথে সাথে আমার চাদরে টান পড়ল। যেন চিতার ভেতর থেকে মরাটা আমাকে টেনে ধরেছে। পাশ থেকে ভাই চিৎকার করছে, ‘দাদারে, পালা।’ চাদরটা সেখানে ফেলে রেখেই প্রাণপণে ওই গরম কাঠটা হাতে নিয়ে দৌড় দিলাম।”
মন্ত্রমুগ্ধের মতো বড়দাদুর গল্প শুনছি। লণ্ঠনের কুপিটা নিভে এল, তেল শেষ হয়ে গেছে। অন্ধকারে বড়দাদুর মুখ দেখা যাচ্ছে না।
“আমি তেল নিয়ে আসছি দাদু, তুমি এখানেই বসো। অন্ধকারের মধ্যে আবার এদিক ওদিক যেও না।” বলেই মোবাইলে আলো জ্বালিয়ে তেল আনতে দালান পেরিয়ে বৈঠকঘরে এলাম। বৈঠকঘরের দেওয়াল জুড়ে আমাদের বংশের জমিদারদের ছবি টাঙানো। নিঃসন্দেহে এই জমিদারবাড়িতে পাগলীর অভিশাপ লেগেছে। একটার পর একটা অস্বাভাবিক মৃত্যু যেভাবে আমাদের নির্বংশ করে চলেছে, তাতে ভবিষ্যতে এই দেওয়ালে আর কারও ছবি টাঙানো হবে কি না এটাই সন্দেহ।
বড়মাপের একটা স্টিলের ক্যান থেকে তেল ভরলাম। মাথার মধ্যে বড়দাদুর বলা গল্পটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। চিন্তা করতে করতে দেখি দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলোতে ধুলোর মোটা স্তর পড়ে আছে। কতদিন হল এগুলো মোছা হয়নি? অবশ্য বাড়ির যা অবস্থা, সাজসজ্জা সৌখিনতার অবকাশ এখন আর কারও কাছে নেই। একটা কাপড় তুলে নিয়ে সেগুলোকে মুছতে শুরু করলাম।
মোবাইলের টর্চ দিয়ে এদিক ওদিক দেখছি। অদ্ভূত একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। বড়দাদুর ছবির সাথে তার মুখের কোনো মিল নেই। হয়তো বয়সের ভারে চেহারা পাল্টে গেছে। কই, তার তো কোনো ভাই ছিল না! একটা দিদি ছিল বটে, নাম পার্বতী। তাহলে? বিশ্বম্ভরটা কে? অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে নাম খুঁজেতে শুরু করলাম। পেলাম বটে, বিশ্বম্ভর নারায়ন। কিন্তু সে তো প্রায় দেড়শ বছর আগেই মারা গিয়েছে। তবে..? পাশেই তার দাদা রাজ নারায়ণের ছবি। ধুলো মুছে টর্চ ফেলতেই বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠল। হুবহু যেন বড়দাদুর মুখটা বসানো রয়েছে। মনের মধ্যে কেমন একটা আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে, এক্ষুনি বাবাকে জানাতে পারলে ভালো হতো।
বৈঠক ঘরে ঢোকার সময় দরজাটা ভিজিয়ে দিয়েছিলাম। দড়াম করে দরজা খোলার শব্দে চমকে পিছনে ঘুরে তাকালাম।
“কে? কে ওখানে?”
টর্চের আলোয় দেখলাম বড়দাদু এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এ কি! বড়দাদুর চুল আর নখগুলো ও’রকম অস্বাভাবিকভাবে বড়ো হয়ে উঠেছে কেন? এদিকে হৃৎপিণ্ড ফেটে বেরিয়ে আসার জোগাড়। মনের মধ্যে ঘনিয়ে ওঠা আশঙ্কাটাকে যেন চোখের সামনে সত্যি হতে দেখছি। এক পা এক পা করে বড়দাদু এগিয়ে আসছে আমার দিকে। এক হাত জিভ বেরিয়ে থাকা তার মুখ দিয়ে লালা ঝরছে, কি ভয়ঙ্কর লালসা তাতে, কেমন একটা গোঙানির শব্দ হচ্ছে। মণিদুটো প্রসারিত হয়ে চোখের গহ্বর কুচকুচে কালো হয়ে উঠেছে। “আয়, আয় আমার কাছে। রক্ত, রক্ত চাই আমার। এই বংশের শেষ আলো তুই। আয়, তোকে খেলে পূর্ণ হবে আমার প্রতিশোধ। আয়।”
তবে কি সেই অভিশপ্ত রাতে পাগলীর আত্মাই রাজনারায়ণের মধ্যে দিয়ে এই জমিদার বাড়িতে ঢুকেছিল? দীর্ঘ কয়েকশো বছর ধরে রাজনারায়ণের মানব শরীরের আড়ালে থেকে এই বাড়ির মানুষগুলোকে তিল তিল করে মৃত্যুর মুখে টেনে নিয়ে গেছে?
এর থেকে বেশি কিছু বুঝে ওঠার আগেই হিসহিসে মেয়েলি গলায় হাসতে হাসতে বড়দাদু আমার গলাটা সজোরে টিপে ধরল। লম্বা লম্বা নখ গুলো আমার গলার দু’পাশে বিঁধে গিয়ে রক্ত বেরোতে শুরু করেছে। বড়দাদুকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করলাম। কি পাশবিক শক্তি এই বুড়ো মানুষটার মধ্যে! গলগল করে বেরিয়ে আসা রক্তধারার কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে আসে বড়দাদু। শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, একটা হাড়হিম করা হাসির শব্দ কানে ভাসছে। চোখ গেল দেওয়ালের ছবিগুলোর দিকে। সম্বিৎ হারানোর আগে বুঝলাম, পরের সপ্তাহে ষোলতম জন্মদিনের কেকটা বুঝি আর কাটা হল না আমার।
লেখক পরিচিতি : অস্মিতা রায়
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, প্রতিলিপিতে লেখালেখি করি।