লেখক : শম্পা সাহা
(প্রথম পর্ব)
সিগন্যালের সবুজ বাতিটা জ্বলছে ঊজ্জ্বল হয়ে। হাসনাবাদ লোকাল আজ ঢুকছে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে লোকাল থামলে একটু বেশিই সুবিধা পাওয়া যায়। দরকার পড়লে, ওই গলিটার আশেপাশে সটকে পড়া যায়। এই সময়ে কাজ করে সুখ বেশি। ধরা পড়ার বালাই নেই। সবাই নিত্য নতুন যাত্রী। ভোজাডাঙ্গা চেকপোস্ট পার হয়ে চলে যাবে পাশের দেশ বাংলাদেশে। ট্রেন থামে প্ল্যাটফর্মে। সচকিত হয়ে উঠে শমিত। দূরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করে তার শিকার স্থির করে। মালদার পার্টি মনে হচ্ছে – লোকটার পাশে নতুন বিয়ে করা বউ। গলার হারটা কি সোনার? ধুর! এখন কেউ সোনা পরে নাকি? কোমরে থাকা ছুরির উপস্থিতিটা নিশ্চিত করে নিয়ে পিছু নেয় শমিত। কিন্তু হঠাৎই হাঁটতে গিয়ে বউটার পায়ের গোড়ালি মচকে যায়। ব্যথায় ককিয়ে উঠে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়ে পথের মাঝে। উঃ! হাতের এত কাছে এসেও শিকার ফসকে গেল! রাগে গা জ্বলে ওঠে শমিতের! মনে মনে বলে, “শালা, হারামী! খানকি মাগী!” অন্য শিকার ধরবে কি এখন? মনে হচ্ছে তা সম্ভব নয়। বেশির ভাগ যাত্রীই এখন টোটো স্ট্যাণ্ডে। একবার ধরা পড়লে মাটিতে শুইয়ে হাড়মাস সব এক করে দেবে। কিছুক্ষণ পর আবার অন্য জায়গায় চেষ্টা করতে হবে।
স্টেশনে ঢোকার মুখে হাতের বাঁয়ে, কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটা অশ্বত্থ গাছ। আপাতত, সেটাই এখন ঠিকানা শমিতের। আজ সন্ধ্যায় একটা কাজ আছে তার। বাইক নিয়ে একজন আসবে তার কাছে। তার দেওয়া কোড নম্বর অনুযায়ী, বটতলার মোড়ে ওই চায়ের দোকান থেকে এক কেজির বেশি একটা হেরোইনের প্যাকেট নেবে সে। তারপর, সেই বাইকওয়ালাই তাকে নিয়ে যাবে চেকপোস্টের কাছে ‘মা’ ট্রাকস্ট্যাণ্ডে। সেখানেও কিছু সাংকেতিক কথাবার্তা আর কোড নম্বরের বিনিময়। তারপর, সাদা গুঁড়োর প্যাকেটের হাতবদল। এই কাজের পরিবর্তে কিছু টাকা পাবে সে। টাকাটার খুব বেশি প্রয়োজন তার, ধার নেওয়া টাকা ফেরত পাবার জন্য চন্দন আর হারুন তাকে শাসিয়ে বেড়াচ্ছে। বেলা বাড়ার চাইতেও তাপ তেতে উঠেছে খুব বেশি। চৈত্র না বৈশাখ – কী মাস এটা? কে জানে। অশ্বত্থ গাছের কাছে পৌঁছতেই বিনোদ বলল, “আরে, গুরু, মাল কত আয় হল?”
“কিছু না, শালা! ওই হারামজাদীটার জন্য। হাতটা ফসকে গেল। পা মচকানোর আর সময় পেল না?”
তিনটে সিগারেটের তামাক পাতা ফেলে দিয়ে সাদা পাউডারের গুঁড়ো ভরে শেষ করল অমল। দেশলাই বাক্সে কাঠি ঘষে আগুন জ্বালাল শমিত। অবশিষ্ট মাত্র আর দু’টি কাঠি। জ্বলন্ত কাঠিতে ধরা তিনটে সিগারেট। বিনোদেরটা জ্বলল না। শমিতের সিগারেট থেকে আগুন ধরাতে ধরাতে বিনোদ বলল, “কাল বাবার মানিব্যাগ থেকে ২০০ টাকা সরিয়েছি।”
“শালা! কথটা চেপে রেখেছিস? এতক্ষণ বলিস নি?”
তুখোড় নেশাখোরের মত ধোঁয়াটা শরীরের মধ্যে টেনে নিল শমিত। বিনোদ পারল না। এ লাইনে সে নতুন। ধোঁয়াটা পুরো টেনে নিতে গিয়ে নাক দিয়ে বের হয়ে এল। বলল, “আজ বেশি রাত করে বাড়ি ফেরা যাবে না।”
অমলের গলার স্বর শোনা গেল, “যা শালা! মার কোলে শুয়ে দুদু খা গে।”
কিছুক্ষণ তিনজনেই নিশ্চুপ। অমল আবার বলল, “সিগারেটে আর শালা ঠিক জমে না। মনে হয় এখন ইনজেকশন নিতে হবে।”
এই ব্যাপারে একমত শমিত। মাথাটা এখন আর আগের মত ফাঁকা ফাঁকা লাগে না। সেই যে প্রথম দিন, যেদিন সে গাঁজা টেনেছিল, সেদিন বুকে এক প্রচণ্ড ধাক্কা, দমবন্ধ করা কাশি। তারপর, দু’-তিন দিন পার হয়ে গেলে, আঃ! সে কী অনুভূতি! কোন চাপ নেই। কী যেন বলে? অভিকর্ষজ না মাধ্যাকর্ষণ? কোন বল? সেই বল ছাড়িয়ে, সে উপরে উঠছে… উঠছে…। ভাসছে, শূন্যে ভাসছে! পাখির মত। হাতদু’টো কি তার ডানা হয়ে গিয়েছে? আঃ, কি শান্তি! বাড়িতে বাবা-মা, দাদা-দিদি, স্কুলের শিক্ষক – কোথাও কেউ নেই। ওই চিন্তাক্লিষ্ট, আশান্বিত মুখগুলো আর তাকিয়ে নেই তার দিকে। কোন ক্লাসে পড়ত তখন সে? ছুটির এক দুপুরে খেতে বসেছিল বাবা, দাদা আর সে। মাছের মাথার বাটিটা মা দিয়েছিল বাবাকে। বাবা মাথাটা তার থালায় তুলে দিয়ে বলেছিল, “এখন নয়, আজ তোমার ছোট ছেলে খাক। তারপর, ছেলে বড় হয়ে যখন-ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ-ব্যারিষ্টার হবে, তখন আমি খাব। দেখে নিও, এই ছেলে একদিন তোমাকে সব ফিরিয়ে দেবে। তখন আর চিন্তা কি?”
স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলতেন, “তুমি আমাদের গর্ব শমিত। তোমার মত এমন তুখোড়, মেধাবী ছাত্র এক যুগেও আসেনি এই স্কুলে। এই স্কুল, কলেজ ছেড়ে তুমি যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে উচ্চশিক্ষা নিতে দেশের বাইরে। দেশের নাম ঊজ্জ্বল করবে। আমরা দূর থেকে তাকিয়ে দেখব তোমাকে।”
মেঘের মত, একের পর এক চেতনার মধ্যে ভেসে আসছিল ছবিগুলো। চেতনার সেই জাল ছিন্ন করে ঢুলু-ঢুলু চোখে নেশা জড়ানো কণ্ঠে শমিত বলল, “শালা! শমিত! কে শমিত? কোন শমিত? শমিত এখন তোদের সকলের ধরাছোঁয়ার বাইরে।”
সত্যিই! ক্ষুধা-তৃষ্ণা, শীত-গ্রীষ্ম – কোন কিছুর অনুভূতিই এখন আর স্পর্শ করছে না তাকে। গলিত সোনার মত রোদ, প্রখর তাপ, হাওয়া যেন আগুন। তাকানো যায় না ভালভাবে। স্লিপারের মাঝে মাঝে উত্তপ্ত পাথর। রৌদ্রে চক চক করে রেললাইন। প্রচণ্ড তাপে চাকার ঘর্ষণে, সেখানে আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে। কয়েক গজ দূরে, রেল লাইনটা যেখানে বেঁকে গেছে, তপ্ত বাতাস সেখানে মরিচীকার মত দেখায়। রোদে পোড়া, নিঃস্ব, রিক্ত ডাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিমুল গাছ, আকন্দের ঝোপ, বিবর্ণ ঘাস, শুকনো মাটি।
সময়টা সন্ধ্যা – দিন ও রাত্রির মিলনক্ষণ। পশ্চিমের আকাশে ঘন হচ্ছে অন্ধকার। পূর্ব আকাশে উদীয়মান সন্ধ্যাতারা। বাতাসে আলকাতরার গন্ধ। রাস্তা প্রশস্তকরণের কাজ চলছে। পথের পাশে পাশে স্তুপীকৃত পাথর, পিচ, ড্রাম। দু’-দু’টো রোলার মেশিন। বাইকে চেপে শমিত চলেছে চেকপোস্টের কাছে, হাতে ধরা তার প্যাকেট। ধীরে ধীরে উঁচু হচ্ছে রাস্তা। বাইক উঠছে ব্রিজে। নিচে ইছামতি নদী। নদী বলেই হয়ত এখানকার বাতাস শীতল। বটতলার মোড়ে ওই চায়ের দোকানে প্যাকেটটা যখন সে আনতে গিয়েছিল, ৩/৪ জন কলেজ পড়ুয়া ছেলে ছিল সেখানে। পিঠের ব্যাগপ্যাক নামানো বেঞ্চে। চা-বিস্কুট নিয়ে বসে ওরা আলোচনা করছিল ফিজিক্সের ভেক্টর আর কেমেস্ট্রির টাইট্রেশনের একটা সূত্র নিয়ে। একটা অঙ্ক কিছুতেই মিলছিল না। ওই আলোচনাগুলো সহ্য করতে পারছিল না শমিত। কথা তো নয়, যেন চাবুকের আঘাত! আর চাবুকের ওই আঘাতগুলো যেন সজোরে আছড়ে পড়তে লাগল শমিতের সারা শরীরে। দোকান থেকে বের হয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওই ছেলেদের চলে যাবার জন্য অপেক্ষা করছিল সে। ঘটনাটা আবার মনের মাঝে ফিরে আসতেই চোখটা যেন ঝাপসা হয়ে উঠল শমিতের। মনে হল, অনুভূতিগুলো এখানও মরে যায়নি তাহলে। আজ অমাবস্যা, চাঁদ নেই আকাশে। ঊজ্জ্বল হয়ে আছে গ্রহ, পুড়ছে নক্ষত্র। আকাশ থেকে অন্ধকার চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে মাটিতে। আর, শমিতের বাইকের সাদা উজ্জ্বল আলো সাপের মত হিসহিসিয়ে পথের অন্ধকার চিরে ছুটে চলেছে – আরও গভীর থেকে গভীরতর অন্ধকারে।
আনমনা হয়ে বাড়ির পথে হাঁটছিল অমিত। আজ এখনই বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করছিল না তার। পথ থেকে নেমে গিয়ে, দু’হাত দিয়ে হাঁটুটা ঘিরে ধরে মাঠে বসল সে। মাটি এখনও গরম, তাপ উঠছে। বাতাসেও স্বস্তি নেই। বিস্তীর্ণ মাঠ সামনে। মনের মধ্যে জমে থাকা অপরাধবোধটা দলা পাকিয়ে আছে গলার কাছে। মাসের দশ তারিখ, অথচ স্কুলের বেতনটা আজও হয়নি। ভেবেছিল, মায়ের ইনহেলার আর ওষুধ আজ কিনে নিয়ে যাবে, হ’ল না। সুধাকে ফোন দেবে? ও যদি ওষুধের টাকাটা যোগাড় করতে পারে কোন ভাবে? ভাই-বোন মিলেই তো জোড়াতালি দিয়ে রেখেছে এই সংসারটাকে। চাল-ডাল, তেল-নুন, মাসকাবারি বাজার, নিত্যদিনের মাছ-তরকারি, ওষুধ, পরনের কাপড়, উনুনের কাঠকয়লা – কোনটাকেই তো বাদ দেওয়ার উপায় নেই। সংসারের যেদিকেই চোখ পড়ে, সেদিকেই দেখা যায় দারিদ্রের চিহ্ন দিনের পর দিন সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। এক বছর আগেও কোনও দিন কি ভেবেছিল আজকের এই দিন দেখতে হবে সবাইকে? মানুষ যখন ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে, স্বপ্ন দেখে, তারই অলক্ষ্যে তখন বিধাতা হাসেন। তারপর তার ইচ্ছাতেই, কারও কারও জীবনের আলো নিভিয়ে দেন। নদীর জলে খড়কুটোর মত ভেসে যায় কত স্বপ্ন, কত আশা-আকাঙ্খা! অসময়ে বাবার মৃত্যু, কিংবা শমিতের এই নেশাগ্রস্ততা – কোনটাই তো মেনে নেওয়ার মত নয়!
গ্রামের রতন ঘোষের বিঘার পর বিঘা জমি, চাতাল, ধান কল, পুকুর, তেলের ঘানি। সেখানকার ম্যানেজার ছিলেন বাবা। স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার চলত ছয় সদস্যের পরিবারের। খরচ মিটিয়ে কিছুই সঞ্চয় হত না। সন্তানেরা বড় হবে, মানুষ হবে – এটাই তাঁর চাওয়া ছিল। মনের ভিতরে শমিতকে নিয়ে কত আশা, কত আকাঙ্ক্ষা, কত স্বপ্ন ছিল! কত ঊজ্জ্বল ভবিষ্যৎ শমিতের সামনে! সেই ঊজ্জ্বল ভবিষ্যতের আলোয় শুধু শমিতের জীবনই নয়, আলোকিত হয়ে উঠবে এই পরিবার, এই গ্রাম, এই দেশ। সেই শমিতের নেশাগ্রস্ত হয়ে ওঠা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি বাবা। অসময়েই তাই চলে গেলেন হার্ট অ্যাটাক করে। এভাবে বাবাকে হারাতে হবে, কেউই তা কখনও কল্পনাও করেনি। সকলেই হয়ে পড়ল ভীষণ অসহায়, সম্বলহীন। মাথার উপরে কি বিশাল শূন্যতা! সংসারের বড় ছেলে অমিত, সব দায়িত্ব এখন তার কাঁধে, শোক করার সময় নেই তার। অনেক চেষ্টায় চাকরি হল বয়েজ স্কুলে। আর সুধা! ঘর মোছা, বাসন মাজা, রান্না করা – সেই সাথে ঠাকুমা আর মাকে সামলানো। বিয়ের কথা হচ্ছিল, ছেলেপক্ষ “না” করে দিল। ভাল গান গাইত। বিকালের দিকে দু’-তিন বাড়ি ঘুরে গান শেখাতে শুরু করল। সবসময় মা আর ঠাকুমার কান্নার শব্দ বাড়িতে। একমাত্র সন্তানের মৃত্যুতে দৃষ্টিহীন ঠাকুমা প্রতিনিয়ত নিজের মৃত্যুকামনা করছেন, শোকাচ্ছন্ন মা পাগলপ্রায়! প্রত্যক্ষে হোক আর পরোক্ষেই হোক, যার জন্য সংসারের আজ এই অবস্থা, সেই শমিত কিন্ত ভাবলেশহীন। মায়ের পরনের সাদা শাড়ী, খালি হাত – নেশায় এতটাই আসক্ত যে, এসব স্পর্শও করল না তাকে। নিজের মোবাইল, ঘড়ি বিক্রি হয়ে গেল। এরপর ঘরের জিনিসপত্রও কমতে শুরু করল। মাস দুই আগের ঘটনা। এক দুপুরে বাড়ি আসে শমিত। মুখে বিশ্রী গন্ধ, চোখ লাল। সিগারেট টানতে টানতে ঘরে এসে মাকে বলল, “কিছু টাকা দাও আমাকে।”
এই ছয় মাসে কান্না ছাড়া মায়ের কণ্ঠস্বর শোনা যায়নি, বিছানায় শুয়েছিল মা। উঠে বসে চিৎকার করে উঠল, “সংসারের অবস্থা কি তুই জানিস না? আমি টাকা কোথায় পাব?”
শমিত এবার দৃঢ়কন্ঠে বলল, “কিন্তু, টাকা যে আমার চাই-ই চাই।”
বিছানার তোষকের নিচ থেকে চাবি নিয়ে আলমারির দিকে এগোল শমিত। ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে ছিল সুধা, আলমারি আগলে দাঁড়াল সে। তারপর মিনতি ভরা কণ্ঠে বলল, “টাকাটা তুই নিস না ভাই। দয়া কর, সামান্য এ-কটা টাকা দিয়ে মাসের বাকি দিনগুলো চালাতে হবে।”
সজোরে টেনে, সুধাকে আলমারির সম্মুখ থেকে সরিয়ে দিল শমিত। দুই হাজার রেখে বাকি দু’-হাজার নিল সে। মায়ের চোখ বিস্ফারিত, আগুন জ্বলছে সেখানে। বিছানা থেকে নেমে কাঁপা-কাঁপা শরীরে শমিতের দিকে এগোতে গিয়ে মাথাটা ঘুরে গেল তাঁর। সুধা দৌড়ে এসে সামলে নিল মাকে। তারপর চিৎকার করে বলে উঠল, “বাবাকে খেয়েছিস? মাকে খেতে চাস এখন?”
উত্তেজনায় চড়া গলা মায়ের, “ভগবান! এই ছেলেকে পেটে ধরেছিলাম আমি? এমন ছেলে থাকার চেয়ে না থাকা ভাল।”
টাকাটা নিয়ে ওঘর থেকে নিজের ঘরে চলে যায় শমিত। ব্যাগপ্যাকে নিজের কিছু জামাকাপড় নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবার জন্য সদর দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে। কিছুক্ষণ আগে মুখ থেকে উচ্চারিত কথাগুলো ফিরে আসে মায়ের মনে। রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে এ কি কথা বলে ফেলেছে সে? মা হয়ে মৃত্যুকামনা করল ছেলের! দোষ নিও না ভগবান, ক্ষমা করো। সদর দরজার কাছে এগিয়ে এসে মা ডাকতে লাগলেন, “ছোট খোকা, যাস নে… ফিরে আয় তুই।”
কিন্ত, মায়ের খোকা মায়ের সে ডাক শুনল না। যে বাড়িতে থাকলে প্রতিনিয়ত শুধু রাগ, বিরক্তি, কথা, ধমক, সে বাড়িতে সে আর থাকবে না। এরপর দু’মাস কেটে গিয়েছে। শমিত বাড়ি ফেরেনি। ওর জন্য থানায় মিসিং ডাইরি করা হয়েছে। বাড়ি ফিরলে মা প্রথমেই জিজ্ঞেস করে, “শমিতের কোন খোঁজ পেলি?”
হঠাৎই নিস্তব্ধতা ভেঙে অমিতের কানে এল, এক কন্ঠস্বর, “বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগি… বাবা মহাদেব।”
আগামী দু’দিন পর বছর শেষ। গাজন স্যন্নাসীরা লাল কাপড় পরে শিবের পাটা নিয়ে ভিক্ষাশেষে বাড়ি ফিরছে। তাদের পিছনে পিছনে, ছোট-ছোট, ছেলে-মেয়েরা ছড়া গাইছে,
আমরা দুটি ভাই
শিবের গাজন গাই
ঠাকুমা গেল গয়া কাশী
ডুগডুগি বাজাই।
বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল অমিতের। গত বছর, এই গাজনের মেলায় গিয়েছিল শমিত। সেখান থেকেই নেশার সূত্রপাত। কালী তলার মোড়ে, ফাঁকা মাঠে চড়কের মেলা বসে। এখন সেই মেলা ভাঙে নতুন বছরের পরের দিন। মেলার এত বড় আয়োজন সূজন মণ্ডলই করে। কেন করে, তা গুটিকয়েক মানুষের মত অমিতও বোঝে। কিন্তু কিছু বলার সাহস পায় না। তার ইচ্ছা ছাড়া গ্রামে কিছুই হয় না। জমিজমার সীমানা নিয়ে হোক, আর যে কোন ঘটনাই হোক, সূজন মণ্ডলের কতৃর্ত্বই পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়।
সীমান্তবর্তী গ্রাম তাদের। গ্রামের সীমানা পার হয়ে কয়েক ক্রোশ দূরে এদেশের শেষ সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া। সেই কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে দিনে কিংবা রাতে সুযোগ মত এপাড়ে-ওপাড়ে চলে চোরাচালান। অনেক আগে, সীমানা পার হয়ে এদেশে আসত সরিষার তেল, সুপারি, এবং এদেশ থেকে যেত লবণ, চিনি। তারপর, এদেশ থেকে যেত শাড়ি, গরু। সময়ের সাথে সাথে এসব এখন বাদ। বাংলাদেশ থেকে এখন কী আসে জানা নেই অমিতের। কিন্তু এদেশ থেকে এখন ওদেশে যায় বিদেশী মদ, সিগারেট, গাঁজা, ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল। মাসে মাসে, আবার কখনও দু’মাসে বি.এস.এফ এবং তারও উপরের বড় সাহেবরা এসে অপারেশন চালায়। কিন্তু চোরাকারবারিরা আগে থেকেই তার আভাস পেয়ে যায়। সীমান্তে গোলাগুলি হয়, মারা যায় কেউ কেউ। আবার মাঝে মাঝে ধরাও পরে দু’-এক জন। মাদক চোরাচালান শুরু হবার পর থেকেই এ গ্রাম আর আগের গ্রাম নেই, খুব দ্রুতই অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরেই কোন না কোন কিশোর, তরুণ, যুবক এমনকি মধ্যবয়সীরা পর্যন্ত মাদকাসক্ত। নেশার টাকা যোগাড় করার জন্য এরাই জড়িয়ে পড়ছে মাদক চোরাচালানে। গ্রামে বাড়ছে চুরি, ছিনতাই। স্কুল, কলেজ ছেড়েছে অনেকেই। বই-খাতা অনাদরে পড়ে থেকে থেকে আবর্জনায় পরিণত হয়েছে, ইঁদুরে কেটেছে। আবার চোরাচালান করে অনেকের হাতেই টাকা এসেছে, পাকা ঘর উঠেছে, সাথে বদলে গিয়েছে ঘরের আসবাবপত্রও। নেশার এই মরণ থাবা চলতে থাকলে এই গ্রাম শীঘ্রই তলিয়ে যাবে অন্ধকারে। এই অন্ধকার থেকে গ্রামকে রক্ষা করতে ক্লাবও কিছু করতে পারত, কিন্ত সেখানকার সভাপতি সূজন মণ্ডল। স্কুল কমিটির সেক্রেটারিও সে। স্কুলের হেডমাস্টারের সাথে কথা বলে সকালের অ্যাসেমব্লিতে, ক্লাসে ক্লাসে মাদকের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে কথা বলছে তারা দু’জনে। কিন্তু, এটাই তো পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সূজন মন্ডলের। সেদিন ক্লাস শেষে বের হয়ে দেখা হয়েছিল বারান্দায়। হয়ত সূজন মন্ডলই অপেক্ষা করছিল তার জন্য। বলেছিল, “স্কুলে পড়াতে এসেছ, পড়াও। এত কথার কি দরকার? এই চাকরিটাই তো ভরসা। এটাই যদি না থাকে…”
কথাটা বলে আর দাঁড়ায়নি সূজন মণ্ডল। এই চোখ রাঙানিতে ভয় পেলে চলবে না তার। শমিতের মত আর কাউকে হারিয়ে যেতে দেবে না সে। কোথা থেকে বাতাস এল। সেই বাতাসে শুকনো পাতার সাথে ধুলো উড়ল। আকাশে লালচে আভা, বাতাস বইছে। সামনের তালগাছটায় বাবুই পাখির বাসা ঝুলছে। বাতাসে পাখিদের কিচির মিচির শব্দ। মুনিয়া, তিতির, শালিক, টিয়া ফিরছে গাছে গাছে, তাদের নীড়ে। ক্রমশ, ঘনিয়ে আসছে সন্ধ্যার অন্ধকার। উঠে দাঁড়ায় অমিত। এবার তাকেও ফিরতে হবে ঘরে।
নো ম্যান’স ল্যাণ্ড – অন্তিম পর্ব
লেখক পরিচিতি : শম্পা সাহা
https://www.facebook.com/story.php?story_fbid=1684099225747044&id=100024409471708&rdid=W9SCILjNJtQZF86D#