লেখক : এস. আজাদ (সেখ মহঃ সানি আজাদ)
(এক)
বাইরে একটানা হিম ঝরছে। রাস্তা ড্রেন ছাদ গাছ সবাই বরফের শ্বেত শুভ্র সাজে সেজেছে ও মেতে উঠেছে। সেই রাগে সূর্য ও দেখা দেয়নি কয়েক দিন। তার উত্তাপ হীন জীবনের সাথে টেনসির সাম্প্রতিক আবহাওয়ার অদ্ভুত মিল লক্ষ্য করে রাজীব এক বার ভাবে ফোন করবে না আবার পরক্ষণে ভাবে আয়ান এতো বার করে বলল যখন একবার করা যেতে পারে। ফোনে আয়ানের অসহায়তা উপভোগ করতে মন্দ লাগছিল না রাজীবের তবুও শেষ পর্যন্ত সাবেরাকে ফোনটা করে। প্রাথমিক সৌজন্যতা টুকু সেরে রাজীব মূল প্রসঙ্গে ঢোকে।
— দেখো এরকম একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তুমি আমার সাথে একবার কথা বলতে পারতে।
— কেন? তোমার সাথে কেন? তুমি আমার কে?
এরকম প্রশ্নের মুখোমুখি হবার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলনা রাজীব। সে কোনো দিন ভাবেই নি যে সাবেরা তাকে কোনো দিন এ প্রশ্ন করতে পারে। প্রথমটায় থতমত হয়ে গেলেও একটু সামলে নিয়ে বলে,
— না তা নয়। আমি ঠিক ওভাবে বলিনি। একজন শুভাকাঙ্ক্ষী।
— দরকার নেই ওরকম শুভাকাঙ্ক্ষীর যে শুধু বিদেশ থেকে জ্ঞান দেয়। যখন যেটা বলার ছিল তা পারোনি। এক যুগ ধরে যেটা শোনার অপেক্ষায় ছিলাম তা যখন শুনতে পাইনি এখন আর শোনার কিছু নেই। আমার যা ভালো মনে হবে তাই করবো।
সাবেরার কণ্ঠ নির্গত অক্ষরের বিষে নীলকন্ঠ হতে হতে যতটা সম্ভব শান্ত ভাবে বলে,
— আচ্ছা তুমি বলো, আবহমান কাল ধরে সমাজে যে বিবাহ রীতি চলে আসছে তার মধ্যে কি কোনো ভালো কিছু নাই।
— আছে। বিনা বেতনে পেটভাতায় পাওয়া চব্বিশ ঘন্টার ঝি আর ভালোবাসার নাম করে ইচ্ছে মতো শারীরিক মানসিক নির্যাতন। তুমি কি মনে করো, বিয়েতে নারীর যদি কণা মাত্র উপকার হতো তাহলে তোমরা, পুরুষেরা বিয়ে নামক প্রথা বা প্রতিষ্ঠানটার গুণগান গাইতে! টিকিয়ে রাখতে আবহমান কাল ধরে। আসলে গালভরা নামের আড়ালে শ্রেণী বিভক্ত শোষণ মূলক সমাজে নারী পুরুষের সম্পর্কটাও টিকে আছে শোষণ আর নির্যাতনের উপর। দুর্বলের উপর সবলের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখো। সেটা পারবে না বলে মনের মানুষকে মনের কথা টা পর্যন্ত বলতে পারলে না। কাজের অজুহাতে নিজেকে ঠেলে দিলে একাকীত্বের চরম সীমায়। নিজেকে কি ভাবো বলতো। দ্রষ্টা নাকি স্রষ্টা। বিদেশে কেন থাক তুমি? আমি কিছু জানি না ভেবেছ ? আসলেই তুমি ভালো নাট্যকার নও। তোমার বাতিল চিত্রনাট্যে তুমি একজন তৃতীয় শ্রেণীর অভিনেতা ছাড়া আর কিছু নও।
একটানা অনেক গুলো ভারী ভারী শব্দ উচ্চারণে ক্লান্ত স্বর যন্ত্র কে বিরাম দেবার জন্য সাবেরা থামলে রাজীব বলে,
— তার মনে তুমি বলতে চাইছ, এই যে দুনিয়া জোড়া স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক। এর মধ্যে কোনো ভালো দিক নাই।
— দেখো আমার চাওয়া না চাওয়ার উপর কিছু নির্ভর করছে না। আমি শুধু শান্তিতে একটু নিঃশ্বাস নিতে চাই। কি চেয়েছি আর তোমরা কি দিয়েছ তার হিসাব মেলানোর মতো অলস অকর্মণ্য সময় আমার নেই।
— না আমি ওভাবে বলতে চাইনি। আসলে আয়ান বারো বছরে এই প্রথম ফোন করে এমন ভাবে বলল…
ফোনের ও প্রান্ত থেকে কোনো সারা আসছে না দেখে কান থেকে ফোনটা চোখের সামনে নিয়ে এসে রাজীব দেখে হয় সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে নয়তো সাবেরা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। পছন্দ না হলে ছেড়ে দেয়াটা তার নতুন নয় এক মাত্র ব্যতিক্রম সে। সাবেরা তার একমাত্র স্কুল ফ্রেন্ড যার সাথে তুই-তোকারিটা ঠিক আসে না কিন্তু যোগাযোগ আছে নিয়মিত। যদিও দেখা সাক্ষাত বিশেষ হয় না। যোগাযোগের মাধ্যম ফোন আর ভার্চুয়াল। যদিও রাজীব ঠিক ভার্চুয়াল হতে পারে না, তাই বেশির ভাগ সময় ফোনই করে। একই স্কুলে পড়ার সুবাদে পরিচয় পাশাপাশি গ্রামে বাড়ি। শহরের কলেজে এসে পূর্ব পরিচয়ের সুত্রে বন্ধুত্বের ঘনত্ব বৃদ্ধি। অন্য বন্ধুরা তাদের সম্পর্ক নিয়ে অনেক কিছু ভাবলেও তারা ছিল সব ভাবনা ধারণার উর্দ্ধে। মাইক্রোবায়লজি তে মাস্টার্স করে রাজীব বিদেশী ওষুধ কোম্পানীতে জয়েন করলো আর অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স করে সাবেরা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। গত পনের বছর ধরে ছাত্র-ছাত্রীদের কেমিস্ট্রি পড়ালেও জীবন ও সম্পর্কের কেমিস্ট্রিটা ভালো ভাবে রপ্ত করতে না পারার কারণে আজ ভাঙনের কিনারে নদী। ইংরেজি নতুন বছরের শুরুতেই ভয়াবহ শীত আর প্রবল তুষার পাতে যেমন বিধ্বস্ত রাজীবের কর্মক্ষেত্র টেনসি সহ গোটা আমেরিকা ও ইউরোপের একটা বড়ো অংশ তেমনই তার প্রিয়তম বন্ধুর সংসার ও বিধ্বস্ত দাম্পত্য ইগোতে। আইনি বিচ্ছেদ না হলেও সংসারের ভগ্ন স্তূপের উপর জেগে আছে তাদের একমাত্র সন্তান কনভেন্টের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র সায়ান রহমান।
উত্তর আমেরিকার উত্তরাঞ্চল জুড়ে গত পনের দিন ধরে পারদ হিমাঙ্কের নিচে। স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত। জল নেই বিদ্যুৎ নেই ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন। প্রশাসনের পক্ষে বাইরে না বেরনোর নির্দেশ। প্রায় কুড়ি দিন বহিরজগত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর আজ সকালে ইন্ডিয়া থেকে সাবেরার স্বামী আয়ান ফোন করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, — তুমি একবার বললে সাবেরা হয়তো শুনতেও পারে।
— কেন, কি হয়েছে?
— চার-পাঁচ দিন হলো সাবেরা সায়ান কে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।
— কোথায় আছে ?
— গত বছর যে ফ্লাটটা কেন হলো ওখানেই থাকছে। মায়ের জন্য আমাকে বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে। আমার ফোনও রিসিভ করছে না। আমাকে ফ্লাটে যেতে নিষেধ করেছে। বলেছে ছ’মাস পর ডাউন পেমেন্টের টাকা সুদ সহ ফেরত দেবে যেটা আমি দিয়েছিলাম। ই এম আই তো ওর একাউন্ট থেকে কাটে।
রাজীব প্রথম টায় ভেবেছিল দাম্পত্য কলহ দু-চার দিনের জন্য মায়ের বাড়িতে থেকে রাগ কমলে চলে আসবে। কিন্তু মায়ের বাড়ি যায়নি ছেলেকে নিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা থাকছে শুনে সেও আকাশ থেকে পড়ে।
(দুই)
সাবেরার বিয়ের আগে তাদের চাক্ষুষ পরিচয় না থাকলেও বিয়েতে সশরীরে উপস্থিত থেকে আয়ান ও তার বন্ধুদের সাথে পরিচয় করে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছে। তবে সাবেরা অন্য কারো হয়ে যাওয়াতে কষ্ট যে একেবারে পায়নি তা নয়। নাহলে দেশে ফেরেনা কেন? আর নিজে সংসার করে নি কেন?
দেশের আত্মীয় স্বজনরা জানে এক বিদেশিনীকে সে বিয়ে করেছে। কিন্তু আসল সত্যটা হলো সাবেরা যখন তাকে জানায় সে উদীয়মান লোক সংগীত শিল্পী আয়ানের প্রেমে পড়েছে। তখন সে নিজেকে আড়াল করার জন্য বিদেশিনীর প্রেমের গল্পটা সাবেরাকে বলে। কথায় বলে ‘গল্পের গরু স্বর্গের ঘাস খায়’ আর এতো পাশাপাশি গ্রাম।
প্রাকৃতিক অবস্থার একটু উন্নতিতে নেটওয়ার্ক আর একটু স্টেবল হতেই পরদিন সাবেরাকে আবার ফোন করে রাজীব। সাবেরার কাছে সব শুনে তার যতটা কষ্ট পাওয়া বা অবাক হওয়ার দরকার ছিল, তার থেকে বেশি নিজেকে ধন্যবাদ দেয় সংসার না করার সিদ্ধান্তের জন্য। আয়ান সারাদিন গান-বাজনা নিয়ে থাকে, সংসারে কোন দায়িত্ব পালন করা তো দূরের কথা বরং সময় অসময়ে সহ শিল্পী বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে এসে উৎপাত বাড়িয়ে তোলে। যতদিন আয়ানের মা সুস্থ ছিল ততদিন বিশেষ অসুবিধা হয়নি। তিনি ছেলের সব অন্যায় আবদার সামলাতেন সাথে নাতি কেও।
শ্বাশুড়ীর সাথে সাবেরার সম্পর্ক বিশেষ খারাপ ছিল না। বেকার ছেলের চাকরি করা বউয়ের সাথে শ্বাশুড়ীর যেমন সম্পর্ক থাকার কথা ঠিক তেমনই। তাকে অতিক্রমের কোনো চেষ্টা কোনো পক্ষেই দিক থেকে দেখা যায়নি। মাস ছ’য়েক আগে বাথরুমে পড়ে গিয়ে হিপ জয়েন্ট ফ্র্যাকচার হওয়ার পর থেকে শুরু হয় নিত্য অশান্তি। সময় নেই অসময় নেই তার বন্ধুদের চা তেষ্টা নিবারণ করো। আজ তিনজন বন্ধুর টিফিনের ব্যবস্থা তো কাল চারজন দুপুরে খাবে। কোন কোন দিন আবার জলসা সেরে রাত বারোটা একটায় দু-তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে হাজির। ওদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা কর। সে ও তো মানুষ। তার ও তো শরীর।
রোজ ভোর পাঁচটায় উঠে রান্না সেরে নিজের ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে রেডি করা। সকাল বেলা সে খাবে না, তাকে আদর করে ভুলিয়ে কখনো বা জোর করে খাওয়ানো তারপর টিফিন দিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে তাদের মা ছেলের চা নাস্তার ব্যবস্থা করে কোনো রকমে নাকে মুখে দুটো গুঁজে আটটা পঞ্চাশের মধ্যে না বেরুলে ন’টা পঁচিশের লোকাল মিস। সারাদিন স্কুল করে ফিরতে ফিরতে সাড়ে পাঁচটা। বাড়ি ফিরে টেবিল থেকে জলের বোতলটা হাতে নিয়ে দেখে বেশির ভাগ দিনই ফাঁকা। তখন মনে হওয়া কি খুব অন্যায় যে আয়ান বোতলে একটু জল ভরে রাখবে। বাইরের পোশাক ছাড়ার আগেই ছেলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্কুলের গল্প করবে। গোল গোল চোখ পাকিয়ে বলবে মিস বলেছে রোজ কেক বিস্কুট না দিয়ে ব্যালেন্স ফুড দিতে। মানে হোম মেড খাবার দিতে। জামা-কাপড় ছেড়ে রান্না ঘর ঢুকতেই ছেলের বায়না দুধ কর্নফেলেক্স খাবেনা পাস্তা করে দিতে হবে। পাশের ঘর থেকে শ্বাশুড়ী বলবে ‘রোজ রোজ একই নাস্তা খেতে ইচ্ছা করে না। কাল নাস্তায় অন্য কিছু দিয়ো’। আয়ান কে বললে সে বলবে ‘ঠিকই তো বলেছে রোজ রোজ একই খাবার কার আর মুখে রোচে। তার উপর মা অসুস্থ কদিন ই বা আর বাঁচবে, বয়স ও হয়েছে এক এক দিন একটু অন্য কিছু দিতেই পারো’।
হ্যাঁ দিতে পারে। সবার ইচ্ছে মতো সব কিছু দিতে পারে। তাহলে তাকে স্কুল ছাড়তে হবে। ঘর চলবে কি করে? দোদুল্য মান মধ্যবিত্তের জিজ্ঞাসা। আয়ানের তো কোনো নির্দিষ্ট আয় নেই।
মাচায় মাচায় গান করে বেড়ানো শিল্পীর আবার নির্দিষ্ট আয়! ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’
ছেলের পড়াশোনার খরচ, মায়ের চিকিৎসা, তার নিজের শখ আহ্লাদ, ঈদ কুরবানীতে বাপ-বেটার ব্রান্ডেড জামা জুতো, বছরে একবার বেড়াতে যাওয়া। তার উপর নিজের আব্বু-মায়ের জন্য ও মাসে মাসে কিছু পাঠাতে হয়। সব ছেড়ে সময়ের চাহিদা অস্বীকার করে উল্টো দিকে হাঁটা। তা সে পারবে না।
(তিন)
প্রতিদিনের ছোট ছোট কিসসা সাবেরা কে বড্ড ক্লান্ত করে তুলেছিল। আয়ানের কোনো হেলদোল নেই। কোনো কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না, কিন্তু মায়ের একটু হেরফের হলেই আর রক্ষা নেই। তার মনো ভাবনা বউ একটা গেলে পাঁচটা আসবে। যেমন করে সাবেরা এসেছিল, কিন্তু মা তো আর আসবে না। সে শিল্পী মানুষ রঙিন আলোর নিচে তার অধিষ্ঠান। মাচা থেকে নামলেই আলোর দিকে ধেয়ে আসা কাঁচ পোকার গিজ গিজ করে পুড়বে বলে। কেউ কেউ আবার ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ক্লান্ত হয়ে পদপিষ্ঠ হয় ভিড়ে। তাদের খবর রাখার দায় শিল্পীর নেই। সে শিল্পী, সমাজ পরিবার সংসার সভ্যতা উচ্ছন্নে যাক তাতে তার কি? শুধু সময় মতো খাবার টেবিলে খাবার আর শয্যায় শরীর না পেলে পৃথিবীটা কে ভালো করে ঝাঁকিয়ে উল্টে দেয়। সাথে সাবেরা কেও।
সাবেরা দের স্কুলের সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষ উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে গান করতে গিয়ে পরিচয়। সেই সূত্রে তাদের ছোট শহরের সংকীর্ণ পথে ঘাটে দেখা, ক্রমে ভালোলাগা। ভালোলাগা দ্রুত ভালোবাসায় রূপ বদল করে রপান্তর ঘটায় সংসারে বিবাহের প্রথম বছরের উদ্দাম বাধাহীন প্রেম আজ সামনে দাড়িয়ে ভেংচি কাটে। সেই ভেংচি কাটা প্রেমের সামনে সাবেরার যেমন অসহায় লাগে তেমনি অকর্মণ্য জীবনে ভালো বেতনের চাকরি করা বউয়ের ছাতা উড়ে যাওয়ায় আলস্য কুণ্ডলী ভেঙে এক গলা অসহায়তা নিয়ে তার কাল্পনিক প্রতিদ্বন্দী রাজীবকে ফোন করতে লজ্জা, দ্বিধা, সঙ্কোচের মাফলার ছুড়ে ফেলে দূরে অনেক দূরে কোনো গহীন জঙ্গলে।
আয়ানদের পৈতৃক বাড়িতে ভাগে পাওয়া দুটো ঘরে তাদের খুব অসুবিধা হচ্ছিল ছেলেটাও বড়ো হচ্ছে আয়ানের বন্ধু বান্ধবের আসা যাওয়া লেগেই আছে। কোনো কোনো দিন এমন হয়েছে সাবেরা কে শ্বাশুড়ীর সাথে শুতে হয়েছে। আয়ানের আব্বা বেঁচে নেই থাকলে কি হতো জানিনা কিন্তু বাপ দাদাদের স্মৃতি গন্ধে আচ্ছন্ন তার বড়ো আব্বা কোনো মতে রঙ চটা, প্লাস্টার খসা ছাদের কোনায় কোনায় বটবৃক্ষের ছায়ায় ঘেরা শীতল শান্তি কুঞ্জ ছেড়ে বেরতে পারছেন না। অনেক বার করে প্রোমোটারদের ফিরিয়ে দিলেও প্রোমোটার লাভের আশা এখনও ছাড়েনি।
সাবেরা শেষ পর্যন্ত আয়ানকে রাজি করিয়ে গত বছর পুরনো বাড়ির কাছাকাছি একটা তিন কামরার ফ্ল্যাট নিয়েছে। এটা নেওয়া না থাকলে সাবেরা কে ভাড়া বাড়িতে উঠতে হতো সেটা আবার আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে খুবই দৃষ্টিকটু হতো। নিজের দূরদর্শিতার জন্য মাঝে মাঝে নিজেকে সাধুবাদ জানায় সাবেরা। অন্যদিকে আয়ান ভাবে যদি হুট করে ফ্ল্যাট কেনার সিদ্ধান্ত না নিয়ে বসতো তাহলে বোধ হয় ভালো হতো। দেখা যেত সাবেরার দৌড় কত। আর টাকাগুলো তার থাকতো। চাকরি করে বলে নিজেকে কি যেন ভাবে। সেই বা কম কিসে? মাসে গড়ে কমপক্ষে দু-তিনটে অনুষ্ঠান তার বাঁধা। করোনার জন্য মাঝখানে দু বছর একটু খারাপ গেছে এই যা, এখন বাজারটা একটু একটু করে স্বাভাবিক হচ্ছে। রোজগার তারাও তো নেহাত মন্দ নয়। গান করে যা পেয়েছে তার সবটা তো সাবেরার হাতেই তুলে দিয়েছে। সে তো নিজের জন্য আলাদা করে কিছু রাখেনি? তাহলে সাবেরা আলাদা করে ভাবে কেন? সেতো কোনো দিন হিসাব চায় নি। মেয়েদের বেশি লেখাপড়া করতে দেয়াই ঠিক নয়। আগের দিনই ভালো ছিল। মেয়েদের বেশি পড়াশোনা করার সুযোগ ছিল না ঠিকই বিনিময়ে সংসারে শান্তি ছিল। পরিবারে বড়দের প্রতি নারীদের শ্রদ্ধা ভক্তি ছিল। এখন আর শ্রদ্ধা ভক্তির কথা না বলাই ভালো। বলতে গেলেই নারীবাদীরা রে রে করে তাড়া করবে। বলবে ‘শ্রদ্ধা ভক্তি কি শুধুমাত্র এক পক্ষের জন্য? অন্য পক্ষের কোন দায় নেই?’ থাকবে না কেন? আগে কি মানুষ সংসার করেনি? ঝগড়াঝাঁটি কথা কাটাকাটি কার না সংসারে হয়। তাই বলে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে? যদি সাবেরা চাকরি না করতো তাহলে আর যাই হোক অন্তত এরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারত না। আয়ান কোনো রকমে নিজের ঝুলে পড়া মুখোশ টা স্বস্থানে বসিয়ে নিজের পক্ষে যুক্তি জাল বিছিয়ে সমাজ ও পরিবারের চোখে নিজেকে ধোয়া আর সাবেরাকে আধোয়া তুলসী পাতা প্রতিপন্ন করে মস্তিষ্কের জ্বরগ্রস্থ কোষ গুলোর উত্তাপ কমাতে চায়। এরকম এলোমেলো ভাবনার মাঝখানে ছেলের মুখটা মনে পড়ায় আয়ানের দু চোখের কোনা চিকচিক করে উঠলো। আবেগের বাড়বাড়ন্ত তার পছন্দ না হলেও ছেলের জন্য মাঝে মাঝে নিজেকেই সামাল দিতে হচ্ছে নিজেকে। বড্ড পীড়া দিচ্ছে পুরোনো স্মৃতি। এতদিনের প্রেম আর উচ্ছলে ওঠা যৌবনের শূন্য বিছানায় দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে বিনিদ্র রাত জাগে আয়ান তবুও ভালোবাসার কাছে আত্মসমর্পণ নৈব নৈব চ।
লেখক পরিচিতি : এস. আজাদ (সেখ মহঃ সানি আজাদ)
লেখক পরিচিতি : জন্ম : ১৯৮৩। পেশা : মাধ্যমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষক। নেশা : বই পড়া, বেড়ানো। কাটোয়া কলেজ পড়তে পড়তে সম্পাদনা করেছেন মাসিক দেয়াল পত্রিকা 'প্রগত'। ছাপার অক্ষরে তিন বছর সম্পাদনা করেছেন ত্রৈমাসিক লিটিল ম্যাগাজিন 'প্রগত'। বর্ধমান থেকে প্রকাশিত লিটিল ম্যাগাজিন 'ফরিয়াদ' পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সহ-সম্পাদক। জীবনানন্দের কবিতা পড়ে কবিতার প্রতি প্রেম। কবিতা লেখার নেশায় পেয়েছিল সুদূর অতীতে ছাত্রাবস্থায়। পরে বুঝেছেন ‘সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি’। মাঝখানে দীর্ঘ বিরতির পর আবার শুরু করেছেন সাহিত্য চর্চা। এখন মূলত ছোট গল্প ও অনু গল্প লেখেন দু-একটা কবিতা ও লেখেন কখনো কখনো, প্রবন্ধ মাঝে মধ্যে। অজ গ্রামের দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। বাবা একজন প্রান্তিক চাষী। পড়াশোনার পাশাপাশি করেছেন শ্রমসাধ্য কৃষি কাজ। জীবন কে দেখেছেন একেবারে ভিতর থেকে।