অফিসার্স স্টাইল

লেখক : আলো রাণী ভট্টাচার্য্য ঘোষ

আজ থেকে বছর পঞ্চাশ আগেকার কথা। ইণ্ডিয়ান নেভির নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে একদল তরুণ যুবক তৎকালীন বম্বেতে গেল নেভির ট্রেনিং নিতে। বেশিরভাগই বাবা-মায়ের দুধুভাতু ছেলে। কারও বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভাল নয়, টাকা চাই। কারও ছেলে বদসঙ্গে পড়ে উচ্ছন্নে যাচ্ছে, তাই দে পাঠিয়ে। দেশমাতৃকার সেবার জন্য যাচ্ছে, এমন সংখ্যা হাতে গোনা যায়। যাই হোক, সবাই একসাথে হ’ল। আলাপ পরিচয় সাঙ্গ হবার পর নির্দিষ্ট দিন থেকে ট্রেনিং শুরু হ’ল। বাপরে বাপ! সে কী ট্রেনিং! সবাই একেবারে নাকের জলে, চোখের জলে। ঘুম থেকে ওঠা থেকে ঘুমোতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ট্রেনিং। কঠিন ডিসিপ্লিন। একটু ভুলচুক হলেই কঠোর শাস্তি। ছেলেগুলো বাড়ির কথা ভাবে আর মনে করে, আগে কী সুন্দর দিন কাটাতাম। ছেলেগুলোর মধ্যে কেউ ছিল রগচটা, কেউ ছিল ডানপিটে, আবার কেউ বা খুব মিনমিনে টাইপের। কিছুদিন গেল তাদের এই পরিবেশে একটু ধাতস্থ হতে। একটু একটু করে সিনিয়র অফিসারদের সঙ্গে পরিচয় হতে থাকে। অবসর সময়ে তারা গেট অফ ইণ্ডিয়ার কাছে চলে যায়, সমুদ্র দেখে। মেয়েদেরও দেখে। হাতে টাকা পাওয়ার পর কেউ কেউ লাল জলের স্বাদ পেতে থাকে লুকিয়ে চুরিয়ে। একঘেয়ে মোনোটোনাস জীবনে ঐটুকুই তাদের বৈচিত্র্য। মন খুলে হাসিটা তারা প্রায় ভুলেই গিয়েছে।

যাই হোক, এভাবেই জীবন কাটতে থাকে। নেভিতে চতুর্থ শ্রেণীর স্টাফও থাকে। তারা ঝাড়ু দেওয়া, টয়লেট পরিষ্কার করা, অফিসারদের জামাকাপড় কাচা ইত্যাদি কাজ করে থাকে। মাহিনা সামান্যই, কিন্তু দেশে পরিবারদের ভরণপোষণের জন্য তারা এই শহরে এসে এই সব কাজ করে থাকে। এদের জীবনেও আনন্দের উপকরণ খুব কম। তা এদের মধ্যে দু’জনের নাম উল্লেখ করছি। একজনের নাম রাম রতন আর একজনের নাম নওসাদ। ভিন্নধর্মী হলেও তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব। এক সাথে খাওয়াদাওয়া, একসাথে ঘোরাফেরা করে। সবার সঙ্গে ওদের ব্যবহারও খুব ভাল। সবাই পছন্দ করে ওদের। তা একদিন হয়েছে কী, ওদের অফ টাইমে ঐ নতুন ছেলেদের কারও কাছ থেকে একটা রামের বোতল জোগাড় করে ওরা চলে গিয়েছে জুহু বীচে। সেখানে একটু খানাপিনা করে আকণ্ঠ মদ্যপান করে মাঝরাতে এসে নেভির ক্যাম্পাসে ঢোকে। তারপর সামান্য তুচ্ছ কারণে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া শুরু করে। চিৎকার চেঁচামেচি, শেষ পর্যন্ত হাতাহাতিও হয়। তারপর যে যার ঘরে ঢোকে। তবে রাম রতন চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়লেও নওসাদ বেশ খানিকক্ষণ চেঁচামেচি করে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরদিন সকাল। নেভির ক্যাম্পাসে এত বড় ইনডিসিপ্লিন! অফিসারদের মিটিং বসে। এখানে বলে রাখা ভাল, নেভির নিজস্ব কোর্টরুম, বিচারপতি ও উকিলের ব্যবস্থা আছে। সেই বিচারশালায় ওদের বিচার হবে। সকাল হওয়ার পর ওদের নেশার ঘোর কেটে গিয়েছে। নিজেদের বোধ, বুদ্ধি ফিরে এসেছে। ওরা জানে, এবার ওদের বিচারশালায় যেতে হবে, বিচার হবে, শাস্তি নিশ্চিত। চাকরিটাও চলে যাবে। দুজনেই অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। কে ওদের সাহায্য করবে, কার কাছে যাবে? কোন আইনজীবী ওদের সাহায্য করবেন? ওদের মিষ্ট ব্যবহার ও বন্ধুপ্রীতি অনেকের কাছেই প্রশংসার্হ ছিল। ওদের এই অসহায় অবস্থায় দেখে অনেকেই ওদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠছিল, কিন্তু কীভাবে কী করা যায় কারও মাথাতেই আসছিল না। বিচারক যে বেজায় কড়া!

হঠাৎই একজন অফিসার ইশারায় ওদের কাছে ডাকলেন। ওরা ভয়ে ভয়ে তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তিনি গতকাল রাতে ঠিক কী হয়েছিল জানতে চাইলেন। ওরা অকপটে সব কথা সরাসরি তাঁকে বলল। সব শুনে অফিসার ওদের বললেন, “জাজ যখন জানতে চাইবেন, তখন তোমরা শুধু বলবে, হম অফিসার্স স্টাইল ফলো কর রহে থে। এর বেশি আর কিছু বলবে না।” ওরা ঘাড় নেড়ে স্বীকৃতি জানাল, এবং স্যালুট করে বাইরে বেরিয়ে এল।

যথাসময়ে কোর্টরুমে ডাক পড়ল। ওরা বলির পাঁঠার মত কাঁপতে কাঁপতে জাজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গুরুগম্ভীর জাজ ওদের গত রাতের ইনডিসিপ্লিনড্ আচরণের কারণ জানতে চাইলেন। ওরা সমস্বরে বলে উঠল, “হুজুর, হম সির্ফ অফিসার্স স্টাইল ফলো করনে কি কোশিস কর রহে থে।” বিচারপতির তখন বিষম খাওয়ার অবস্থা। কেঁচো খুঁড়তে কেউটে না বেরিয়ে আসে এবার। তিনি “কেস ডিসমিস” বলে বেরিয়ে গেলেন।
এরপর কি হ’ল? এরপর হ’ল হাসির পালা। সবাই মিলে, নতুন ছেলেরা মিলে হাসল।

আপনারাও হাসুন, প্রাণখোলা, অনাবিল হাসি। আসলে গল্প তো গল্পই হয়। কোনও গোষ্ঠী বা ব্যক্তিবিশেষকে আহত করা গল্পের উদ্দেশ্য হয় না।
After all fun is fun, nothing else.


লেখক পরিচিতি : আলো রাণী ভট্টাচার্য্য ঘোষ
রিষড়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা। হুগলি জেলার কোন্নগরের বাসিন্দা কবি। বই পড়া, পড়ানো ওঁর নেশা। এতেই তিনি আনন্দ পান৷ মাঝে মাঝে নিজের মতো করে কিছু কিছু লেখেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

মাসিক দীপায়ন প্রতিযোগিতা

মাসিক দীপায়ন পুরস্কার pop up