লেখক : আলো রাণী ভট্টাচার্য্য ঘোষ
সকাল থেকে ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি হয়ে চলছে। গত দেড় মাস ধরেই চলছে। প্রথম দিকে বৃষ্টি শুরু হ’লেই সাথে সাথে বাজ পড়তে শুরু করে। আগে এ’রকম ছিল না। বর্ষা শেষ হওয়ার দিকে ভাদ্রমাস নাগাদ বৃষ্টির সঙ্গে বাজ পড়ত ঘন ঘন। বাড়িতে, আশপাশের বাড়িতেও তখন শাঁখ বাজানো শুরু হয়ে যেত। আমার ছেলেবেলার কথা বলছি। প্রকৃতির একটা নিজস্ব ছন্দ ছিল। গ্রীষ্মকালের পর বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত পরপর আসত। তাদের উপস্থিতি টের পাওয়া যেত বেশ। আর এখন প্রকৃতি হয়েছে খামখেয়ালি। গত বছর গরমে হাঁসফাঁস। তিন মাস বৃষ্টি নেই। আর এবার তার উল্টো। আগে এত ঘন ঘন হড়পা বানের কথা শোনা যেত? অবশ্য মানুষের কাজই এর জন্য দায়ী। কিন্তু কত প্রাণ যে অকালে চলে যাচ্ছে। এর প্রতিকার কি? আমার জানা নেই। শুধু বুঝি সভ্যতা এগিয়ে চলেছে। গত মাসেইতো খবরের কাগজে জানলাম একদিনে বিভিন্ন জেলায় বাজ পড়ে ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সানু, সিন্চন, সৌরভ, কৃশানু, স্নেহা, রঞ্জনা, রশ্মি – এরা সবাই লঞ্চে করে শেওড়াফুলি ঘাট পেরিয়ে বারাসাতে যায় কলেজে পড়তে। গঙ্গার এপারে বিভিন্ন জায়গা থেকে যায় এরা। একই সময়ে একই লঞ্চ ধরে যায়, এবং ফেরেও প্রায় একই লঞ্চে। অফিস ফেরত যাত্রী, কলেজ পড়ুয়া, সাধারণ যাত্রী সবাই ঘরে ফেরে। নিত্যযাত্রীদের তাই পরস্পর মুখ চেনা।
সেদিনও সবাই যে যার কাজে বেরিয়েছিল। সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার ছিল। দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ শুরু হ’ল বৃষ্টি। ঝমঝম ঝমঝম করে একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়ে চলে। সঙ্গে মেঘের গম্ভীর গর্জন। বিকেলের দিকে একটু ধরে আসছে মনে হয়। কিন্তু পাঁচটার পর আবার তেড়ে বৃষ্টি আর মুহুর্মুহু বাজ পড়তে থাকে। সেদিন সবাই ফেরিঘাটে লঞ্চ ছাড়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য লঞ্চ দেরিতে ছাড়ছিল। নিত্যযাত্রী ও অন্যান্য যাত্রীরা সকলেই অস্থির হয়ে উঠেছিল ঘরে ফেরার জন্য। যাই হোক, বেশ দেরিতে লঞ্চভর্তি যাত্রী নিয়ে অবশেষে লঞ্চ ছাড়ল। শিন্চনদের দলটার সবাই ছিল। রশ্মি বসার জায়গা পেয়েছিল। যারা বসার জায়গা পেয়েছে, তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করেছে। কেউ শেয়ার মার্কেট, কেউ অফিসের বসের সঙ্গে ঝামেলা, কেউ পারিবারিক সমস্যা নিয়ে অনর্গল কথা বলে চলেছে। লঞ্চ দু’মিনিট এগিয়েছে কি এগোয়নি, হঠাৎ ঝমঝম করে প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হ’ল, সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। গঙ্গায় প্রবল ঢেউ, লঞ্চটি মোচার খোলার মতো ঢেউয়ের মাথায় উঠছে আর নামছে। যাত্রীরা একদম চুপ। এরপর হঠাৎই লঞ্চটা একটা ঘুরপাক খেল, আর যেদিক থেকে ছেড়েছিল সেই দিকে চলতে লাগল। বিহারী সারেং মাতৃভাষায় চিৎকার করে উঠলো, “ইয়ে কেয়া হুয়া, ইয়ে কেয়া তাজ্জব কি বাত!” যাত্রীরা হৈচৈ করতে লাগল। সারেংকে তারা এই মারে তো সেই মারে। রশ্মির পাশে একজন মুণ্ডিতমস্তক সন্ন্যাসী বসে ছিলেন, কেউ অত খেয়াল করেনি। গম্ভীর স্বরে তিনি বলে উঠলেন, “ডরো মত।” ঠিক তখনই প্রবল গর্জনে বাজ পড়তে লাগল। একটা নয়, তিরিশ সেকেণ্ড বা মিনিটখানেক ব্যবধানে তিনটে বাজ, তিনটে আগুনের গোলা সগর্জনে গঙ্গাগর্ভে নেমে এল, ঠিক যেমন শত্রুপক্ষের কামানের গোলা ছুটে আসে লক্ষ্যবস্তুর উপর আঘাত হানতে। বিস্ময়ের ব্যাপার হ’ল, ঠিক যেখানটিতে লঞ্চটা থাকার কথা ছিল, ঠিক সেইখানটিতেই। কী ঘটতে চলেছিল সেটা ভেবে সবাই বাকরহিত।
যাই হোক, তারপর সারেং লঞ্চ ঘুরিয়ে শেওড়াফুলি ঘাটের কাছে পৌঁছে গেল। রশ্মি বারবার সেই সন্ন্যাসীকে খুঁজছিল, যিনি তার পাশে বসে এক মনে জপ করে চলেছিলেন। কিন্তু ভিড়ের মাঝে কোথায় যে তিনি হারিয়ে গেলেন, রশ্মি আর দেখা পেল না।
লেখক পরিচিতি : আলো রাণী ভট্টাচার্য্য ঘোষ
রিষড়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা। হুগলি জেলার কোন্নগরের বাসিন্দা কবি। বই পড়া, পড়ানো ওঁর নেশা। এতেই তিনি আনন্দ পান৷ মাঝে মাঝে নিজের মতো করে কিছু কিছু লেখেন।