অন্যরকম গল্প ১

লেখক : মৌ চক্রবর্তী

চন্দনা সকালেই খেয়াল করেছে। এই বছরখানেকের গল্প। সে দেখে। ওর কাপড় – জামা মেলা। ওর সাবান কাচা। ওর উঁচু গোড়ালির কাঁপ। কোমরে নাইটির জায়গাটা ভিজে লেগে যায়। বাসনের পাঁজা তুলে রান্নাঘরে। সন্ধ্যাটা ওর নিজের। বুড়ি মালকিন, তার খিটখিটে মেয়েটা যতই চেল্লাক, ও নড়ে না। তখনই প্লেন উড়ে যায়। ডানায় আলো। ওরকমই একটা উড়োজাহাজে ওরও তো ওড়ার কথা ছিল। সব এলোমেলো হয়ে গেল বাবাটা চলে যেতেই। প্রথমে দশদিন অজ্ঞান। তারপর শেষ। মায়ের মুখটা আগেই চুপসে সাদা, ঠোঁটের কোণে শুধু হাসি।  বেঁচে থাকলে সেই কলকল করে হাসত।  কলঘরের থেকে গন্ধ সাবান গায়ে গান গাইত, ঝিঙেফুল, কুমড়ো ফুলের নাম করে ওকে ডাকত। চুমো খেত পাগলের মতন। পাখির মতন হবি, তাই ওর নাম দিয়েছিল চন্দনা। সন্ধ্যের আকাশের এটাই মুশকিল পাখিদের আর চেনা যায় না। কলকাতার পাখিগুলো যেন কেমন। খুব ঘোলাটে। দু একটা পাখি কদাচিৎ বারান্দায় এলে চন্দনা জিজ্ঞেস করে, তোরা কি স্নান করিস না? কাক স্নান তো করতেই পারিস।

পাখিগুলো তেমন। ফুড়ুৎ উড়ে যায়। চন্দনা খেয়াল করে ছাদের সঙ্গে ওর কেমন যেন একটা সখ্যতা হয়ে গেছে। সিঁড়ির নিচে ওর দুটো গাছ রাখা। জলে আলোয় মায়ায় ও দুটো বেড়েছে। হ্যাঁ, চার বছরে ওর ফুল বাগান করাটা পাড়ার সব্বাই জিজ্ঞেস করে। ওর ভাল্লাগে। বোঝে, এমন বাগান কারোর বাড়িতে সহজে হয় না। লোক ডেকে করায় কেউ কেউ। শহরে এটাই রেওয়াজ। এমনি করে কতজন ওর বাগান করা দেখে। সেও দেখে। কিন্তু সামনে থেকে না। লুকিয়ে। ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে পায়রার মতন। চন্দনা চায় দেখুক। ওর ফরসা পা দেখুক। ওর চোখের পাশের তিল কাছে এসেই দেখুক। কাজের মেয়ে বলে কি ওর ইচ্ছে থাকতে নেই।  এটাই তো ওর বয়স। সতেরো হল। ওর মায়ের মতন শরীরের গড়ন পেয়েছে। সব্বাই বলত, ওর বাবা তো দেখেই ফিদা। তাই কানাকড়িটি নেয়নি বিয়েতে। মন্দিরে বিয়ে। বকখালিতে হনিমুন। ওর বাবা সোজা লোক। নেতা ছিল ইউনিয়নের।

এই যে সে, আড়াল থেকে মেয়েদের দেখে।  ওরকম দেখলে কেমন যেন ন্যাতার মতন মনেহয়। চন্দনা বুঝতে পারছে হাওয়ায় ওর মন তাজা হয়ে যাচ্ছে। শীতের শেষ বলে দিন কত বড় হয়। মানুষের কত কাজ। সব সেরে ছাদে ওঠার সময়টার জন্যে মুকিয়ে থাকে। সে দেখছে। হাতে কিন্তু বই। মন ওর দিকে। চোখ নড়ছে। সে ওকে দেখছে। চন্দনার সঙ্গে চোখাচোখি হল।  ও হাত নেড়ে ডাকল। সে কি অদ্ভুত রে বাবা। পালিয়ে গেল অমনি।

চন্দনার জেদ চেপে যায়। ও ভেবে ফেলে কি করবে। ছাদের পাশের ছোট্ট ঘরে ওর যাবতীয় সংসার। ও টুকরো কাগজে লিখে ফেলে, তারপর সোজা ঐ বাড়ির গেটে। কলিংবেল বাজতেই বেরিয়ে এল সে। ও হাত বাড়িয়ে দিল, সে নীল কাগজটা। চন্দনা দাঁড়ায় না। সে পড়ে লেখাটা, ঘুলঘুলি  দিয়ে তাকিয়েছ অনেক। এবার জানলায় এলে মন্দ কি। আরও ভাল হয় যদি খোলা আকাশের নিচে এসে উপরদিকে তাকানো যায়। দেখা মানে অনেক বড় কিছু। দেখা হল  বৃহৎ, পরিসরহীন, মাত্রাহীন, এক অসীম। তাকানো ব্যাপারটা কেমন যেন ছোট ক্ষুদ্র এক দৃষ্টি। বাকিটা ব্যক্তিগত। – ইতি চন্দনা।  সে দেখে,  চন্দনা পাখির মতন উড়ে যাচ্ছে , নাকি হেঁটেই পেরিয়ে গেল ঐ বাগানবাড়ি।

লেখক পরিচিতি : মৌ চক্রবর্তী
লেখক, গবেষক । কবিতা ভাল লাগা। আর গল্পও।

2 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন