লেখক : ইন্দ্রাণী তুলি
সবুজে সবুজ ‘স্নেহনীড়’এ পা রেখেই আপ্লুত হয়ে গেলেন বাসন্তী রুদ্র। তাঁর নজর কাড়লো রঙ-বিরঙ্গী ফুলে ভরা বাগানটা। শীতের রোদ পোয়াতে সেখানে জমায়েত আশ্রমের আবাসিকবৃন্দ। পার্কের সীমানা ঘেরা ঝাঁপালো বৃক্ষরাজির ফাঁকে-ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে দুধসাদা একতলা কটেজের সারি।
বৃদ্ধাশ্রম এত সুন্দর! হতেই হবে, ‘যত গুড় ঢালবে তত মিঠে’
জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে, আতিথ্য-মূল্যের বিনিময়ে কয়েকদিন সেখানে কাটিয়ে, পাকাপাকি আশ্রয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যবস্থা আছে।
ছিমছাম, বাহুল্যবর্জিত অতিথিশালাতে স্থান পেলেন বাসন্তী দেবী। দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের পরে চোখ লেগে গিয়েছিল। মন্দিরা চা এনে ডাকতেই উঠে বসলেন তিনি।
“কী কাণ্ড! তোমাদের যত্নআত্তি যে এই অনিদ্রা-রোগীকে দিনের বেলাতেই ঘুম পাড়িয়ে ফেলল।” চা খেয়ে মন্দিরাকে নিয়েই তিনি চললেন আশ্রম-চত্বরের বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করতে।
কুটিরগুলোর পেছনে টলটলে জলের পুকুর, হাঁস চরছে।
একদিকে পুরুষ, অন্যদিকে মহিলা আশ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা। স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকতে পারেন। অনেকেই চেয়ার নিয়ে তাঁদের ঘরের সামনে বসে আছেন, হাসিমুখে দু’চার কথা, নমস্কার বিনিময় করতে করতে এগিয়ে চললেন বাসন্তী। পুরুষ-মহল্লার একটি কটেজ থেকে উর্দিধারী কর্মচারীদের বেরিয়ে আসতে দেখে কৌতুহলী চোখে মন্দিরার দিকে তাকাতে, সে বলল “এই ঘরে ড্যানিয়েল দাদু থাকেন। সপ্তাহ-খানেক হলো উনি খুব অসুস্থ। চব্বিশ-ঘন্টার পরিচারিকা আছে।”
বাসন্তী একটু আনমনা হলেন। নামটা তাঁকে নিয়ে গেল তাঁর কিশোর কালে।
হাসলেন তিনি।
-কত ড্যানিয়েল আছে এই পৃথিবীতে, কে জানে ইনি তিনিই কি না!
“কেমন বয়েস হবে?”
“ঠিক জানি না মাসিমা, আশির আশেপাশে মনে হয়।”
-তাহলে… সম্ভাবনা তো থেকেই যাচ্ছে।
হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষার পরে বাসন্তী যখন কী করি কী করি করে হেদিয়ে মরছে; প্রিয় বন্ধু, বাবা এসে দাঁড়িয়েছিলেন।
“তুই তো ইংরেজি সাহিত্য পড়বি। ক্রিয়েটিভ-ইংলিশ কোর্সের খোঁজ পেয়েছি, লেগে পড়।”
একটু ভয়ে ভয়েই ক্লাসে পৌঁছেছিল বাসন্তী।
-কে জানে বাবা কত সব হোমরা চোমরারা থাকবে! কিন্তু অতি মিশুকে বাসন্তী চট করেই মিশে গিয়েছিল তথাকথিত ক্লাস-ফেলোদের সঙ্গে।
সবথেকে ভালো লেগেছিল কোর্স-কাণ্ডারী মিসেস মিটারকে।
লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট! ছোটখাটো-গোলগাল মধ্যবয়সী সেই মহিলা প্রথম দর্শনেই তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের মন জয় করে নিয়েছিলেন। তর তর করে এগিয়ে চলছিল ইংরেজি লেখা-পড়া-বলার চর্চা। আজ রাইটিং-কম্পিটিশন, কাল ডিবেট, পরশু ড্রামা।
বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো, যেদিন জানা গেল তাঁর শিক্ষার্থীদের অনাথ করে চলে গিয়েছেন মিসেস মিটার।
হতবাক রইল হরিদাসের বুলবুল ভাজার মতো মিলে মিশে এক হয়ে যাওয়া একদল বিভিন্ন বয়েসী ছেলে মেয়ের দল। ভালবাসার মানুষটির জন্যে একটা বিদায়ী-সম্বর্ধনার আয়োজনও করা গেল না।
কর্মকর্তারা জানালেন, সুযোগ্য স্টীয়র্সম্যান’এর ব্যবস্থা হয়ে গেছে, ক্লাস যথারীতিই চলতে থাকবে। তাঁরা আশ্বাস দিলেন, আগের থেকেও ভালো বই খারাপ চলবে না ক্রিয়েটিভ-ইংলিশের ক্লাস।
নতুন গাইড’এর আগমনে, ব্যাজার মুখে উঠে দাঁড়াল সকলে।
‘আগে দর্শন ধারী পিছে গুণ বিচারী’
ঘন-কৃষ্ণবর্ণের, কুৎসিত-দর্শন, বেঢপ চেহারার মানুষটিকে দেখে হতোদ্যম হয়ে পড়ল, মুহ্যমান কিশোরের দল।
দক্ষ হাতে হাল ধরলেন মিস্টার ড্যানিয়েল উইলিয়ামস। তাঁর ব্যারিটোন স্বর, ইংরেজি সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের পরিচয় পেয়ে আনন্দের বন্যায় ভেসে গেল ছাত্র-ছাত্রীরা, একমুহূর্তেই মূল্যহীন হয়ে গেল চেহারার আকর্ষণ।
ইংরিজি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার সঙ্গে পরিচয় করিয়েই ক্ষান্ত হলেন না মিস্টার ড্যানিয়েল, ছাত্র-ছাত্রীদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা প্রতিভার প্রকাশে একনিষ্ঠ আগ্রহ দেখালেন তিনি।
প্রথম দিন ক্লাসে ঢুকে তাঁর বলা কথাগুলো এখনো কানে বাজছে, আজ ষাটের কোঠায় দাঁড়িয়ে থাকা সেদিনের সেই সপ্তদশীর।
“আমি জানি, আজ আমাকে গ্রহণ করতে তোমরা কতটা দ্বিধাগ্রস্ত। তোমাদের অবস্থা এখন অনেকটাই এক মাঝি বিহীন নৌকার মতো। সামনেই বীভৎস ঘূর্ণি… বাঁচবে কীভাবে?”
বড় সুন্দর হাসিতে সেই কুরূপ মানুষটি একমুহূর্তেই সকলের মন জয় করে নিতে সমর্থ হয়েছিলেন।
প্রায় বাইশ বছর বয়েসের তফাতের মিস্টার ড্যানিয়েল কখন আর কীভাবে বাসন্তীর ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছিলেন, অপরিণত আর কাঁচাবুদ্ধির মেয়েটা বুঝতেও পারেনি। বাবার উদারতায় তাদের বাড়ির পরিবেশ ছিল মুক্ত, কো-এডুকেশন কলেজ-বাতাবরণ আরো বেশি সপ্রতিভ করে তুলেছিল বাসন্তীকে তাই মিস্টার ড্যানিয়েলের তার সঙ্গে একান্তে কথা বলা; কখনো-সখনো সিনেমা, ভিক্টোরিয়া-মেমোরিয়ালে যেতে চাওয়া বা পছন্দসই রেস্তোরাঁতে খাওয়া কোনটাকেই অশোভন মনে হয়নি তার।
ব্যাপারটা ব্যাঁকা পথ ধরল যখন ছুটির দিনে ড্যানিয়েল স্যরের বিশেষ অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে, একাই ‘ক্রিয়েটিভ’এ পৌঁছল বাসন্তী। ক্লাসরুমে, স্যরের সঙ্গে নিজেকে একদম একা পেয়ে তার বুকটা একটু কেঁপে উঠল। আত্মরক্ষার ক্ষমতা তার আছে আর রুমের বাইরে কর্মকর্তারাও আছেন… কী হবে? ঘটনাটা কিন্তু ঘটল অভাবনীয় ভাবে।
ক্লাসে আর কেউ থাকবে না জেনেই এসেছিল বাসন্তী কিন্তু ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের ইঙ্গিতে, কাজ আছে বলে তৎক্ষনাৎই বেরিয়ে যেতেও চেয়েছিল।
দুঃখিত ভাবে মিস্টার ড্যানিয়েল বলেছিলেন “ইউ আর দ্য বেস্ট অফ দ্য লট ডিয়ার… আলাদা করে কিছু শেখাব… প্লীজ, একটুক্ষণ থাক…”
অধীরভাবে বাসন্তীর হাতদুটোকে আঁকড়ে ধরেছিলেন তিনি।
অপূর্ব সুন্দর ভরাট গলায় গেয়ে উঠেছিলেন “আমি যামিনী, তুমি শশী হে… ভাতিছ গগন মাঝে”
তখন গানের অর্থটা ঠিক বোধগম্য না হলেও পরে বুঝতে পেরে কেঁপে উঠেছিল মেয়েটার কিশোর হৃদয়।
পকেট থেকে একটা সোনার আংটি বার করে বাসন্তীর আঙুলে পরিয়ে দিতে, তার বিস্ময় পরিপূর্ণ রূপ পাওয়ার আগেই নিজের হাতের আঙুলে পিন ফুটিয়ে সেই রক্তবিন্দু বাসন্তীর কুমারী সিঁথিতে টেনে দিয়ে, হাঁটু গেড়ে বাসন্তীর সামনে বসে পড়েছিলেন ড্যানিয়েল।
“আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে আছে কিন্তু আমি শুধু তোমাকেই ভালবাসি। আমাকে ফিরিয়ে দিও না।”
কিংকর্তব্যবিমুঢ় বাসন্তী তাঁর চোখে চোখ রেখেই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়েছিল… আংটিটা ফিরিয়ে দিতে চেয়েও পারেনি কিন্তু মিস্টার ড্যানিয়েলের ব্যথিত দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে গিয়েছিল।
আর কখনও দেখা হয়নি তাদের।
তারপরে তো কত জল বয়ে গেছে পতিতপাবনী গঙ্গা দিয়ে।
বাবার বন্ধুর সুযোগ্য পুত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বাসন্তীর কিন্তু সেই মানুষটা যে নররূপী-রাক্ষস সে ধারণা তো কারোও ছিলই না।
অনেক চেষ্টায় মুক্তি পেয়ে, বাবা-মা’র কাছে ফিরে এসেছিল ক্ষতবিক্ষত মেয়েটা। অসম্পূর্ণ পড়াশোনা শেষ করে, কলেজে পড়াতে শুরু করেছিল।
এ’সবই কি ড্যানিয়েল-স্যরের দীর্ঘশ্বাসের প্রভাব?
মেয়ের দুর্দশা সহ্য করতে না পেরে,
সেরিব্রাল-স্ট্রোক’এ আক্রান্ত বাবা অসময়েই চলে গিয়েছিলেন।
ক’দিন আগে মা’ও ছেড়ে যাওয়ায়, আশ্রমে থাকবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাসন্তী।
মন্দিরা খবর আনল, “ড্যানিয়েল দাদুর এম-আর-আই আর সেরিব্রো-স্পাইনাল ফ্লুইডের টেস্ট হয়েছে।”
“চল তোমাদের অসুস্থ দাদুকে একবার দেখে আসি।”
তারা কটেজ-৫’এর সামনে পৌঁছতেই, গলায় স্টেথোস্কোপ ঝোলানো ডাক্তার বাবু বেরিয়ে এলেন। মন্দিরার সঙ্গে ড্যানিয়েল’এর আধো অন্ধকার ঘরটাতে ঢুকলেন বাসন্তী।
“অসুস্থ মানুষ, জানলাগুলো বন্ধ কেন, আলো হাওয়া খেলা দরকার…”
স্বভাবগত সপ্রতিভতায় কথাগুলো বলতেই, স্কুলের নন্দিতার কথা মনে পড়ল।
‘ফোঁপর দালাল!’
নরম স্বভাবের আয়া শেফালী
বলল “জানলা খোলাই থাকে মাসিমা, মশার ভয়ে সন্ধ্যেবেলা বন্ধ রাখি।”
প্রশংসার হাসি হাসলেন বাসন্তী।
“রাগ করিস না মা, বুড়ো হয়েছি তো।”
ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দিল শেফালী।
আকুলভাবে ড্যানিয়েল’এর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন বাসন্তী। অক্সিজেন-মাস্কের আড়ালে থাকা চেহারাটা স্পষ্ট হলো না।
প্রায় রোজই খোঁজ নিতে আসেন বাসন্তী।
পায়ের আওয়াজে মুখ তুললেন ডাক্তার বাবু, তাঁর চোখে জিজ্ঞাসা। হাত জোড় করে অভিবাদন জানালেন বাসন্তী।
“আমি বাসন্তী। স্নেহনীড়ের নতুন আশ্রমিক, উনি অসুস্থ তাই খোঁজ নিতে এসেছি। কেমন আছেন এখন?”
“ধীরে ধীরে হলেও উন্নতি হচ্ছে। নিয়মিত ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে হবে।”
অক্সিজেন-মাস্কটা খুলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর।
শেফালী বলল “মাসিমা, বসুন।”
শীর্ণকায় শরীরটা বিশেষ সাহায্য করল না। গায়ের রঙ পরিষ্কার না হলেও সে’রকম কালোও নয়। কাশির দমকে চোখ খুললেন ড্যানিয়েল। বাসন্তীর হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়ার যোগাড়।
‘আমি যামিনী, তুমি শশী হে…’
হে ঈশ্বর কত ছোট এই পৃথিবী।
ষাট বছর পার করা, তেতাল্লিশ বছর আগের সেই সপ্তদশীকে উনি চিনতে পারবেন, সে’তো দূরাশা। বুক কাঁপল বাসন্তীর। উনি কি সত্যিই তাকে ভালবেসেছিলেন?
মুগ্ধাকে ঘটনাটা জানিয়েছিল বাসন্তী। খুব রেগে সে বলেছিল “ঠামা বলেন ‘কত সাধ যায় লো চিতে, মলের আগায় চুটকি দিতে’ বামন হয়ে চাঁদে হাত। পড়ত আমার পাল্লায়, এমন এক আপার কাট ঝাড়তাম…”
“কে জানে, উনি হয়তো সত্যিই আমাকে ভালবেসে ছিলেন।”
অষ্টাদশীর গাল রঙিন হয়েছিল।
“ভালবাসা! মাই ফুট। তুইও কি ওই এক চুটকি সিন্দুর, তাও আবার নিজের রক্তের… মোহে ফেঁসে গেলি? এ যে সুনীলের কবিতা ‘রক্তে যেন কেউ প্রেমের বীজ বুনে দিয়েছিল কৈশোরে’ তুই কিশোরী হলেও ওটা তো বুড়ো ভাম।”
এ’ভাবে তো কখনই ভাবতে পারেনি বাসন্তী, সারাজীবন সেই জন্যেই হয়তো খেসারত দিতে হলো।
পরেরদিন আবার দেখা হয়ে গেল ডাক্তারের সঙ্গে।
“আসুন, আজ উনি অনেকটাই ভালো আছেন।”
“ডক্টর, এই কড়া ওষুধগুলোর সাইড-এফেক্ট আছে নিশ্চয়ই?”
“সব ওষুধেরই পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া থাকে কিন্তু সুস্থ থাকতে হলে, এর তো কোনও বিকল্প নেই ম্যাডাম।”
স্যালাইন চলছে, ড্যানিয়েল’এর চোখ বন্ধ। মাথার কাছে বসে তাঁর দিকে তকিয়ে থাকেন বাসন্তী। কে জানে মানুষটা সত্যিই তাকে ভালবেসে ছিলেন কি না, বাবা মা’র পরে তো আর কারও ভালবাসা পাওয়ার সুযোগ হয়নি… আজ এই অসহায়, নির্বান্ধব পুরুষটিকে যদি একটু সাহচর্য দেওয়া যায়। প্রতিদানের কোনো প্রত্যাশা নেই, এক অচেনা অতিথির মতো পাশে থেকে কিছুটা সময় দান, যা আজ বাসন্তীর কাছে অঢেল।
কখনও সখনও শেফালীকে ছুটি দিয়ে ড্যানিয়েল’এর মাথা ধুইয়ে মুছিয়ে, ওষুধ খাইয়ে দেন বাসন্তী। উনি কিছুই বুঝতে পারেন না, ওঁর কাছে শেফালী আর বাসন্তী আজ মিলে মিশে একাকার।
-বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল, ড্যানিয়েলের শারীরিক অবস্থার সেরকম কোনো উন্নতি তো নজরে আসছে না।
বাসন্তীর চোখ ভিজে উঠল, নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, শেফালী ঘরে ঢুকতে, নিজের কটেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া সারা হলে, একটা বই হতে খানিক্ষণ গড়িয়ে নেওয়ার অভ্যেস তাঁর। বইয়ের তাকের দিকে হাত বাড়িয়েও, ফিরে এসে বেডসাইড টেবল থেকে ল্যাপটপটা তুলে নিয়ে বিছানায় বসে, গুগল সার্চ করে ‘মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস’ সম্বন্ধে জানার আগ্রহ নিয়ে ঝুঁকে পড়লেন বাসন্তী।
কানে শোনা নামটা ঠিক ভাবে বানান করে লিখতে পারবেন তো?
মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস; সংক্ষেপে ‘এম এস’ একধরনের ডি-মায়েলিনেটিং রোগ। ইংরেজি নিয়ে পড়াশোনা করলেও ডাক্তারী শব্দটা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি, অনেক শব্দেরই অর্থ তাঁর হৃদয়ঙ্গম হলো না।
যতটুকু বোঝা গেল, এই রোগে আক্রান্ত মানুষের মস্তিষ্ক আর স্নায়ুরজ্জু ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার কারণে স্নায়ুতন্ত্রের অংশবিশেষ অন্যান্য স্নায়ুর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে বাধা পায় এবং নানারকম শারীরিক ও মানসিক উপসর্গের সৃষ্টি করে। মাংসপেশির দুর্বলতার কারণে অঙ্গসঞ্চালনে সমন্বয়ের অভাব দেখা যায়। আংশিক দৃষ্টিহীনতা, পুরুষত্বহীনতাও এই রোগের প্রতিক্রিয়ারই অংশ। রোগের কারণ এখনো নির্দিষ্ট করে উঠতে পারেননি গবেষকরা… জিনগত বা ভাইরাসের আক্রমণে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিষেধকও নেই বললেই চলে। যে ধরনের ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়ে থাকে তার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া কখনও কখনও আক্রান্তের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। অল্পবয়সীদের ক্ষেত্রে পরিণতি ভালো হলেও আয়ুষ্কাল বছর দশেক কম হয়েই যায়।
খানিক্ষণ থম মেরে বসে থাকলেন বাসন্তী। বছর দশেক বয়েস কমে যাওয়াটা তো বিশেষ চিন্তার কারণ নয়। আশি বছর পেরনো একজন মানুষ আর কতদিনই বা বাঁচবেন… তবে যে ক’দিন থাকবেন, সুস্থভাবে নিজের পায়ে হেঁটে চলে নিজের কাজকর্ম করতে পারা’টাই তো কাম্য।
ড্যানিয়েল’এর পাশে বসে নানারকম ইতিবাচক জীবনের গল্প শোনান বাসন্তী। একজন সুদক্ষ সাইকায়াট্রিস্টের জায়গা নিয়ে ড্যানিয়েলকে তাঁর মানসিক ট্রমা থেকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন।
ঘরে বাসন্তী দেবীর উপস্থিতি টের পেয়ে ডক্টর রক্ষিত বাইরে খানিক্ষণ অপেক্ষা করলেন। বাসন্তী দেবীর জীবনমুখী কাহিনীগুলো তাঁকেও আচ্ছন্ন করে ফেলে।
ঘরে ঢুকে হাসিমুখে ডাক্তার বললেন “মিস্টার ড্যানিয়েল… আজ তো আপনাকে উঠে বসতে হবে, চেষ্টা করুন।”
আওয়াজের উৎসের দিকে অর্থহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ড্যানিয়েল।
“ডক্টর, আপনি ইঞ্জেকশন দিয়ে যাওয়ার পরেই ওঁর শরীরের অস্বস্তি ভীষণভাবে বেড়ে যায়, ছটফট করতে থাকেন। মুখে কিছুই বলতে পারেন না তাই আরো বেশি কষ্টকর লাগে সেই দৃশ্য।”
“ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ইঞ্জেকশনের পরে এই ধরনের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক… আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, ধীরে ধীরে সেই শারীরিক অস্বস্তি থেকে মুক্ত হয়ে যান উনি।”
আশ্বাস দিতে বাসন্তীর হাতে হাত রাখলেন ডাক্তার রক্ষিত।
ইঞ্জেকশন দিয়ে চলে গেছেন ডাক্তার। বেশ খানিক্ষণ এপাশ ওপাশ করে, অবশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন ড্যানিয়েল। তাঁর মুখের ওপরে ঝুঁকে পড়ে আলতো হাতে তাঁর চোখ আর কপালের ওপরে পড়ে থাকা চুলের গোছা সরিয়ে দিয়ে, জলভরা চোখে তাঁর কপালে নিজের কাঁপতে থাকা ঠোঁটজোড়া ঠেকিয়েই উঠে দাঁড়ালেন বাসন্তী, বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
৫-নম্বর কটেজে ঢুকে বাসন্তী দেখলেন একটা চেয়ারে বসে আছেন ড্যানিয়েল উইলিয়ামস। উত্তেজিত হয়ে ডাক্তারের হাতদুটো ধরে ধন্যবাদ জানালেন তিনি।
“এবারে ওয়াকার ধরে ধীরে ধীরে হাঁটাতে হবে ওঁকে। হুইল চেয়ার তো থাকবেই… বাইরে বেরতে হলে কিন্তু নিজের ওপরে আস্থা রাখতে হবে আর তাই নিজের পায়ে হাঁটা খুব জরুরি।”
কে জানে কেন বাসন্তীর মনের মধ্যে তুফান উঠল।
শেফালীকে ওয়াকার আনতে বললেন বাসন্তী। ডাক্তার, শেফালী আর বাসন্তী সকলে মিলে চেয়ার থেকে ড্যানিয়েলকে উঠিয়ে ওয়াকার ধরে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন। পা সোজা থাকছিল না মানুষটার, ভেঙে ভেঙে যাচ্ছিল।
ডক্টর রক্ষিত বললেন “আজ এ’টুকুই থাক, কাল আবার চেষ্টা করা যাবে।”
পরের দিন এক পা, দু’পা এগোতে সক্ষম হলেন ড্যানিয়েল।
ষাট বছর বয়েসের বাসন্তীর হৃদয় উদ্বেল হলো, বর্ষার প্রথম মেঘ দর্শনে পেখম মেলে নেচে ওঠা ময়ূরের মতো… তেতাল্লিশ বছর আগের সেই কৈশোর যেন ফিরে এল।
দু’পা হেঁটেই ভীষণ রকম ক্লান্ত হয়ে পড়লেন ড্যানিয়েল, তাঁকে ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন ডক্টর অমিত্রসূদন রক্ষিত।
কর্মকর্তাদের বলে মেল-অ্যাটেন্ড্যান্টের ব্যবস্থা করলেন বাসন্তী, যে শেফালী আর বাসন্তীকে সাহায্য করবে। ব্যস্ত ডাক্তার বাবুর কাছে এতটা সময় নেই।
নিজের কটেজের বাইরে বেরিয়ে বসেছেন ড্যানিয়েল উইলিয়ামস। পড়ন্ত সূর্যের নরম রোদের স্বর্ণাভ প্রভা তাঁর অসুন্দর মুখে এনে দিয়েছে এক স্বর্গীয় জ্যোতি।
তাঁর শারীরিক অবস্থার বেশ খানিকটা উন্নতি হয়েছে তবে সাহায্য ছাড়া এক পা’ও চলতে পারেন না। সন্ধ্যের আঁধার ঘনিয়ে আসতেই দুলাল আর শেফালীর সাহায্যে ঘরে ঢুকে, বিছানাতে গা এলিয়ে দিলেন ড্যানিয়েল।
“তুমি একটু বসবে মাসিমা, আমি ওঁর স্যুপটা নিয়ে আসি।”
বাসন্তী মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাতেই শেফালী বেরিয়ে গেল। আঁচলে বাঁধা পুরিয়াটা সন্তর্পণে খুললেন বাসন্তী।
ড্যানিয়েল’এর দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তিনি একদৃষ্টিতে বাসন্তীর দিকেই তাকিয়ে আছেন তবে সেই নজরে পরিচিতির কোনও লক্ষণই নেই।
শরীরের পাশে এলিয়ে পড়ে থাকা ড্যানিয়েলের হাতটা তুলে, তাঁর আঙুল সিঁদুরে ডুবিয়ে নিজের সাদা চুলের ভেতরে ছুঁইয়ে দিলেন বাসন্তী।
শেফালী ঘরে ঢুকতে, ধীরে ধীরে ড্যানিয়েলকে স্যুপ খাইয়ে, সযত্নে তাঁর মুখ মুছিয়ে দিয়ে নিজের কটেজে ফিরে গেলেন ড্যানিয়েল-প্রেয়সী।
সকালের চা নিয়ে এসে ড্যানিয়েল দাদুর প্রাণহীন দেহটা দেখে, চেঁচামেচি করে লোক জড় করল শেফালী।
ডাক্তার রক্ষিত এসে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে যেতে, ড্যানিয়েল’এর ছেলেকে খবর পাঠিয়ে, তাঁর সৎকারে ব্যস্ত হয়ে পড়ল আশ্রমবাসীরা।
স্নানের জলে সিঁদুরের ছোঁয়াটুকু ধুয়ে ফেললেন বাসন্তী।
লেখক পরিচিতি : ইন্দ্রাণী তুলি
ইন্দ্রাণী তুলি ওরফে ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য বাংলা এবং ইংরিজি দুই ভাষাতেই লেখালিখি এবং অনুবাদ করেন। অবসর সময়ে পড়াশোনা, আঁকাজোকা করতে আর বেড়াতে ভালবাসেন তিনি। তাঁর লেখা প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুই এবং ই-বুক- পাঁচটি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালিখি করেন ইন্দ্রাণী, অনেক প্রকাশনা সংস্থার প্রকাশিত সংকলনে তাঁর রচনা আদৃত হয়েছে। 'জীবনানন্দ দাশ অ্যাওয়ার্ড'এর মতো বহু শিরোপাতে ভূষিত ইন্দ্রাণী তুলি।