লেখক : নয়ন আলী নাঈম
“মামা, আপনার প্রতিদিন ফুল নিয়ে এই একই জায়গায় দাড়িয়ে থাকার মানে বুঝলাম না।”
“বিষণ্ণতার রাস্তায় ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অপেক্ষায় আছি ভালবাসার, ভাল লাগার মানুষটির জন্য।”
“মামা কই আপনার ভালবাসার মানুষ।”
“এই তো, আসবে বলে কথা দিয়েছে, এখনও আসছে না।”
“মামা প্রতিদিনই তো একই কথা বলেন, কই মামি তো আসছে না।”
“সে বলেছে আসবে, তার মানে খুব শীঘ্রই আসবে। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি না।”
“মামা এটা ২০২৪ সাল। আপনাকে গত ৩ বছর ধরে এই একই জায়গায় প্রতিদিন বিকেলে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি। মামা বিষয়টা কি খুলে বলবেন?”
“আপনার মামির অপেক্ষায় আছি। সে বলেছে, সে আসবে। আসবে বলে সেই যে গেল, এখনও এল না। অসম্ভব ভালবাসি তাকে। জানেন, গোলাপ ফুল আপনার মামির খুব পছন্দ। বলেছিল, নাঈম আমার জন্য পোলাপ আনবে। ঠিক ৪ টায় চলে আসবে।”
লক্ষ্য করলাম, কথাগুলো বলতে বলতে চোখের অশ্রুতে মামার সদ্য গাল ভিজে যাচ্ছে। মামার কথায় বেশ অবাক হলাম। একটা মানুষ কতটা ভালবাসলে দীর্ঘ তিন বছর ধরে ভালবাসার মানুষটার জন্য অপেক্ষা করতে পারে।
“মামা তিন বছর ধরে অপেক্ষাই করছেন, আর কত অপেক্ষা করবেন? আপনার বিরক্ত লাগে না?”
আমার কথায় মামা মুচকি হাসল। এই হাসি বুঝিয়ে দিচ্ছে, কতটা বিষণ্ণতা নিয়েও মানুষ হাসতে পারে। হাসিটা বড্ড গভীর, খুব বড় হাহাকার লুকিয়ে আছে। “হাসালে ভাগনে, ভালবাসার মানুষটার জন্য অপেক্ষা করতে বিরক্ত নয়, বরং আলাদা এক ভাল লাগা কাজ করে। জানেন, আপনার মামির জন্য অপেক্ষা করতে আমার খুব ভাল লাগে। এই বুঝি আসবে আর ফুলগুলো হাতে নিয়ে বলবে, বড্ড ভালবাসি। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত অপেক্ষা করে যাব তার জন্য। আমার বিশ্বাস সে আসবে, মাথায় ঠাডা মেরে বলবে – ভালবাসি।”
“মামিকে মনে হয় খুব ভালবাসেন, তাই না?”
“জানেন, আপনার মামিই আমার ভাল লাগার কারণ। তাকে তো বড্ড বেশি ভালবাসি।”
“মামা…”
আমাদের কথা বলার মাঝেই একটা বৃদ্ধা মহিলা এসে মামাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল। মামা চিৎকার করে বলছে, “আমাকে ছেড়ে দাও, কিছুক্ষণের মধ্যেই তাসনিয়া আসবে, ও আমাকে দেখতে না পেলে রাগ করবে। মেয়েটা যে বড্ড রাগী আর অভিমানি। ছেড়ে দাও আমায়।”
বৃদ্ধা মহিলাটার কাছে গিয়ে বললাম, “আপনি ওনাকে এভাবে নিয়ে যাচ্ছেন কেন? আর তাসনিয়া কে?”
“আর বলোনা বাবা, তাসনিয়া ওর গার্লফ্রেন্ড। তিন বছর আগেই ওর সাথে দেখা করতে আসবে বলে, রাস্তা দিয়ে আসতে গিয়ে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। তখন থেকে ফুল নিয়ে প্রতিদিন বিকেলে এই রাস্তায় দাড়িয়ে থাকে।”
বৃদ্ধা মহিলাটার কথায় মামা বলে উঠল, “না মা, তাসনিয়া মারা যায়নি। দেখবে একদিন ও আসবে।”
বৃদ্ধা মহিলাটা মামার কথায় পাত্তা না দিয়ে একটা গাড়িতে উঠিয়ে মামাকে নিয়ে চলে গেল।
আমিও হেঁটে হেঁটে আমার রিকশাটার কাছে গিয়ে, রিকশায় উঠে মুচকি হাসি নিয়ে খুব জোরে বললাম, “ভালবাসা এত কাঁদায় কেন? শুনেছি ভালবাসা সত্যিকারের হলে সফলতা পায়। তবে মামার ভালবাসা কেন সফলতা পেল না? মামা তো মামিকে সত্যিকারের ভালবাসে, নাহলে মৃত মামির জন্য এতদিন অপেক্ষা করবে কেন?”
রাস্তার ধারে একটা ফুলের দোকানে রিকশা দাঁড় করিয়ে একগুচ্ছ গোলাপ ফুল নিয়ে আবারও রিকশা নিয়ে চলতে লাগলাম।
সোজা কবরস্থানে এসে একটা কবরের নিকট গেলাম – বোর্ডে লেখা আছে “মরহুমা তাসনিয়া তামান্না”। মামার ভালবাসার মানুষ আর ভালবাসার মানুষের নাম একই।
গোলাপগুলো কবরের উপর রেখে চোখের জলে চুমু দিলাম কয়েশতবার।
হাঁটু গেড়ে বসে সুরা ফাতিহা, ইখলাস ও দরুদে শরীফ পাঠ করে বলতে লাগলাম,
“আল্লাহুম্মাগফিরলি হাইয়্যেনা ওয়া মাইয়্যিতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গায়িইবিনা ও ছাগীরিনা ও কাবীরিনা ও যাকারিনা ও উনছানা। আল্লাহুম্মা মান আহইয়াইতাহু মিন্না ফাআহয়িহি আলাল ইসলামী ওয়া মান তাওয়াফ ফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফ ফাহু আলাল ঈমান বেরাহমাতিকা ইয়া আর হামার রাহীমিন।”
লেখক পরিচিতি : নয়ন আলী নাঈম
নয়ন আলী নাঈম একজন উদীয়মান বাংলা সাহিত্যিক, যিনি মূলত গল্প, উপন্যাস ও কবিতা রচনায় সক্রিয়। তিনি সামাজিক, রোমান্টিক ও থ্রিলারধর্মী লেখার জন্য পরিচিত। তার উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে আছে “ছদ্দবেশি মাফিয়া কিং”, “তিনশত বাসর” ও “প্রতিশোধি খুনি”। বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে এবং পাঠকের মাঝে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।