Out-of-the-World

লেখক : ড: অভীক সিনহা

গোয়াতে থাকি বলে অনেকেরই মনে হয় যে আমি হয়ত দিনরাত হাতে বিয়ারের বোতল, পিঠে ট্যাটু, আর পরনে ফাটা বারমুডা নিয়ে রোদ্দুর রায়ের অবতার সেজে সমুদ্রতটে কেলিয়ে পড়ে থাকি । কিন্তু আসলে তো তা নয় । থাকি এক পাহাড়ের উপরে, যেটা সমুদ্র থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূর । মানে চেষ্টা করলেও ঢেউয়ের আওয়াজ তো দুরস্ত, সমুদ্রের জলের নোনাগন্ধের ছিটেফোঁটাটুকুও পাওয়া যায় না । সপ্তাহের ছ’টা দিন কাটে ছাত্রছাত্রীদের খিস্তি করে, আর রবিবারটা কাটে মাছের বাজারে দরদাম করতে গিয়ে মাছওয়ালাদের কাছে খিস্তি খেয়ে । মানে, যাকে বলে একেবারে পুরদস্তুর গতের সাংসারিক জীবন । কিন্তু হঠাৎ করে এইসব কথাগুলো আজ বলছি কেন ?
এই কথাগুলো শুনে নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন যে আমার সাথে একটা নতুন কেত্তন হয়েছে, যেটা আমার সাথে প্রায়শঃই হয়ে থাকে । তো আর ভনিতা না করে সোজা গল্পে আসি । সেদিন কোন একটা কারণে একটু মাথাটা গরম ছিল । যদিও সেটা নতুন কিছু নয়, কিন্তু সেদিন হয়ত একটু বেশিই ছিল । কলেজে নিজের কেবিনে চুপ করে বসে আছি আর ফেসবুকটা খুলে খুচখুচ করছি । এমন সময় টুং করে মেসেঞ্জারে ভেসে উঠল এক মেসেজ, “আরে অভীকদা, কেমন আছেন ?” সত্যি কথা বলতে কি, কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না । কিন্তু মাঝেমাঝে শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরেই একটু খেজুরে আলাপ চালিয়ে যেতে হয় । তাই আমিও উত্তর করলাম, “ভাল আছি দাদা । আপনি কেমন আছেন ?” যদিও উত্তরটা জানা, তবুও জিজ্ঞেস করতে হয় । উল্টোদিক থেকে উত্তর আসল, “আরে দাদা, আপনার আশীর্বাদে ব্যাপক আছি ।” নিজের আশীর্বাদের গুণ দেখে একটু চমৎকৃত হলাম । কিন্তু কিছু বলবার আগেই আবার প্রশ্নবাণ ভেসে আসল, “দাদা কি আজকাল গোয়াতে আছেন নাকি ?” এবারে আমার একটু মাথা গরম হতে শুরু করল । প্রোফাইলে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে Lives in Goa, তারপরেও এইসব অহেতুক প্রশ্ন শুনতে হয় । যথাসম্ভব ভদ্রতা বজায় রেখে উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ এই আর কি…”
ভদ্রলোক যেন উল্টোদিকে এই উত্তরের অপেক্ষাতেই ছিলেন । আমার কথা শুনে ওনার যেন বিস্ময়ের বাঁধ ভেঙে গেল । “আরে দাদা করেছেন কি !!! মানে আমি তো ভাবতেই পারছি না…” আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম “কেলো হয়ে গেল, এ শালা আজ মাথা চিবিয়ে দেবে, কি কুক্ষণে রিপ্লাই করেছিলাম ।” এইসব ভাবছি, আর উল্টোদিকে ভদ্রলোক তো মুখে ফেনা তুলে আবেগঘন প্রগলভতায় বকে চলেছেন, “আহা, ওই সমুদ্রসৈকতে অস্তগামী সূর্য্যের প্রতিফলন, জীবনের চলমান গতিকে যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য…” আমি এইসব দেখছি আর মনে মনে বলছি, “তোমাকে শালা আমি চিনি না ? তুমি শালা কলকাতা থেকে পয়সা খরচা করে গোয়া আসবে শুধু সি-বীচে বসে সূর্যাস্ত দেখতে ?” মনে মনে চরম খিস্তি করছি, আর বুঝতে পারছি যে এইরকম আর পাঁচমিনিট চললে নিজেকে সামলে রাখাটা একটু কঠিন হয়ে যাবে । ঠিক এইরকম সময়ে ভদ্রলোক একটি ডায়লগ দিয়ে বসলেন, “আপনি তো একেবারে Out-of-the-World জায়গাতে আছেন মশাই ।”
“আপনি ভুল করছেন ।” আমি কথাটা বলতেই ভদ্রলোক একটু থতমত খেয়ে গেলেন, “ভুল ? মানে… ঠিক কোন ব্যাপারটা…” আমি তখন মুচকি হেসে ভদ্রলোককে উত্তর দিলাম,
“ওই Out-of-the-World ব্যাপারটা । আমি গোয়াতে থাকি, গয়াতে নয়”
না, প্রায় দু’মাস হয়ে গিয়েছে, ভদ্রলোক আর জ্বালাতে আসেন নি ।

লেখক পরিচিতি : ড: অভীক সিনহা
লেখকের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে । পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষক, যুক্ত আছেন গোয়া ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের সাথে । তবে ভালবাসাটা আজও লেখালিখি, পেন্সিল স্কেচ, যন্ত্রসংগীত, এবং নিত্যনতুন রান্নাবান্নার সাথেই রয়ে গিয়েছে । তাঁর লেখা প্রথম বই "R.E.CALL: এক Recollian-এর গল্প" প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে । দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখালিখির সূত্রপাত হলেও এখন প্রবন্ধ এবং গল্পতেই মনোনিবেশ করেছেন ।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।