লেখক : সোনাই ঢালী
“বিনি, এই বিনি। উফ, এত জোরে হাঁটছিস কেন? এই বিনি, দাঁড়া বলছি।”
“আমার দাঁড়ানোর সময় নেই এখন। আমার পিছনে আসিস না। কাজ মিটিয়ে ঠিক সময়ে চলে আসব আমি।”
“উফ, পাগল মেয়ে একটা”, জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিল মিতু, ছুটতে ছুটতে দাঁড়িয়ে পড়েছে এখন ও। দূরের রাস্তার বাঁক ধরে ডানদিকে অদৃশ্য হয়ে গেল বিনির নীল রঙের ফ্রকটা।
“এবার আমি কি করব? মাকে গিয়ে যদি বলি বিনি কোথায় আমি জানিনা, তাহলে তো রাতে আবারও মারবে মা বিনিকে। ধুৎ, ভাল লাগে না।” মনে মনে নিজেকেই কথাগুলো বলে কেঁদে ফেললো সে।
ভাবতেই ভাবতেই বাড়ি ফিরে গেল মিতু। সন্ধ্যে হতে বিনি যখন বাড়ি ফিরল, তখন ওকে দেখেই মিলিদেবী চিৎকার করে উঠলেন।
“কোথায় গিয়েছিলি তুই?”
“ডাক্তারের কাছে, পাবলোর ওষুধ আনতে।”
“টাকা কোথায় পেয়েছিস? তোর বাবাকে বলেছিস, তাই না? তোকে খরচ দিতেই আমি হিমসিম খাচ্ছি, আবার জুটিয়েছিস ওকে।”
“অহনা দিদি দিয়েছিল টাকা।”
“কেন দিল?”
“ছবি এঁকে দিয়েছিলাম।”
“ও, আজকাল তাহলে এইসব হচ্ছে। বার করে দেব পাবলোকে। ওকে যেন বাড়ির ত্রিসীমানায় না দেখি। এই বলে রাখলাম।”
বিনি আর পাবলো দু’জনেই কাঁদতে লাগল। সেই রাতে দু’জনের খাওয়া হ’ল না আর। মিতু নিজের ভাগ থেকে দেবে বলে ওর খাওয়ার পুরো সময় জুড়ে নিজে দাঁড়িয়ে থাকলেন মিলিদেবী। রাতের বেলা পাবলোর মাথায় হাত দিয়ে বলল, “খুব খিদে পেয়েছ বল?”
পাবলো কুঁই কুঁই করে ওর আরও কাছে ঘেঁষে এল।
“দেখিস তোকে সুস্থ করে তুলবই। মা এখন রাগ করছে। পরে তোকে আর আমাকে দুজনকেই ভালবাসবে দেখিস।”
প্রাঞ্জল স্যার বিনির মা চলে যাওয়ার পর বিয়ে করতে চাননি। কিন্তু সামাজিক চাপ ছিল। আর বিনিকে সামলাতে পারছিলেন না অফিস সামলে। মিলিদেবীর মা প্রায় জোর করেই… কিন্তু মিলিদেবী বিনিকে নিজের সন্তানের মতন আগলে রাখতে পারেননি। প্রাঞ্জল বাবু সময় দিতে পারেন না ট্রান্সফারের চাকরির জন্যে। এর মধ্যেই বিনি জঙ্গলের ফুলের মতন বড় হচ্ছে।
পাবলোকে ছোট থেকে বড় করেছে বিনি। বিনির মা শখ করে এনেছিলেন পাবলোর মাকে। লুসি ছিল তার নাম। বিনির মা চলে যাওয়ার পর লুসির যত্ন কমে যায়। পাবলো জন্মানোর সময় ওর মা লুসি অসুস্থ হয়ে মারা যায়। ওকে কোলে করে সেই প্রথম থেকে বিনিই বাঁচিয়ে রেখেছে। তখন থেকেই একসাথে। ওর দুঃখের সময় পাবলো ওর কোলে এসে বসে থাকে চুপ করে।
“স্যার, আসব?”
“এসো এসো বিনি। আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। বসো।”
“স্যার, আমি বেশিক্ষণ বসতে পারব না। বাড়ি ফিরতে হবে।”
“সে তো ফিরবে। তোমায় আজ ডেকেছি একটা বিশেষ কারণে। তুমি রাস্তায় যে রং তুলি দিয়ে ছবি আঁকছিলে তিলোত্তমার, সেসব শিখলে কোথায়?”
“শিখিনি তো। পারি এমনি এমনি।”
“তোমায় এমন ছবি দিলে তুমি ওই বড় সাদা কাগজে আঁকতে পারবে?”
নিজের স্টুডিওতে রাখা পোট্রেট দেখিয়ে বললেন হেমলক বাবু। ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল বিনি।
তিলোত্তমার জন্যে যে আন্দোলন হচ্ছিল, সেখানে গিয়ে হেমলক বাবুর নজরে পড়ে বিনি। মেয়েটি কি অবলীলায় এঁকে চলেছে স্ট্রিট আর্ট। অহনা ওনার ছাত্রী। জিজ্ঞেস করতে সে বলেছিল, “স্যার, মেয়েটা খুব গুণী। আমার যখন খুব চাপ থাকে, ওকে বলি কিছু ছবি দেখে দেখে এঁকে দিতে, ও তখন দেয়। আসলে ওর একটা পোষা কুকুর আছে, তার অসুখ। মাঝে মাঝে আমি ওর চিকিৎসার জন্য টাকা দিই, কিন্তু নেয় না। বলে, ছবি এঁকে দিই, তার জন্য দিও।”
“ওর একটু ট্রেনিং হলেই সেরার সেরা হবে।” বলেছিলেন হেমলক বাবু। তারপর ডেকে নেন নিজের কাছে।
“বিনি, তুমি পাবলোর চিকিৎসা করতে চাও তাই তো?”
“হ্যাঁ।”
“আমি তোমায় আঁকা শেখাব। আরও ভাল কি করে আঁকতে পারবে, সেইসব শেখাব।”
বিনির চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।
“সামনে একটা কম্পিটিশন আছে। এন্ট্রি ফি তোমার হয়ে আমি দেব। কিন্তু তোমায় জিতে আসতে হবে। ওখানে পুরস্কার হিসেবে অর্থ দেবে, সেই অর্থ দিয়েই পাবলোর চিকিৎসা করাতে পারবে তুমি।”
সেইদিন থেকে বিনি একমনে রোজ গিয়ে আঁকার স্টুডিওতে আঁকা শিখত। একমাস পরে প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয় বিনি। মিলিদেবী প্রথমে অসুবিধে সৃষ্টি করলেও পরে সৎ মেয়ের গুণে মুগ্ধ হয়েছিলেন। বুঝেছিলেন, এই মেয়েকে ঈশ্বর পাঠিয়েছেন। পুরস্কারের অর্থ দিয়ে পাবলোর চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করেছিল বিনি। পাবলোর দুই বছরের জন্মদিন উপলক্ষে পাবলো আর বিনির একটা ছবি এঁকেছিল আর দেখিয়ে বলেছিল, “কিরে পাবলো, এবার খুশি তো?”
“খুব খুব ভৌ ভৌ…”
লেখক পরিচিতি : সোনাই ঢালী
পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, টেকনো গ্রুপ এ শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত। বাড়ি কলকাতায়, বাবা এবং মা এর সাথে থাকি। লেখালিখি করতে সহজ ভাবেই ভালো লাগে। ছাপার উদ্দেশ্যে নয়, জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত বিশেষ ভাবে উদযাপন করতে শব্দ বেঁধে থাকি।