পিছু পিছু কে আসে

লেখক : ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী

পৃথিবীর যে কোন শহরেই অন্ধকার গলি থাকে। সেই সব গলিতে বেশি রাতে হাঁটলেই গা ছমছম করে। গা ছমছম করাটাই স্বাভাবিক, তাতে কোন অস্বাভাবিকতা নেই। বরঞ্চ মনে প্রেম, দুঃখ, করুণা জাগলেই অস্বাভাবিক। ছোট শহর হ’লে তো কথাই নেই। যত রাজ্যের অতিপ্রাকৃত জিনিস সেই সব গলিতে ভিড় করে থাকবে। বড় বড় বারান্দাওয়ালা বাড়ি থাকবে, সেখানে কাউকে মাথা নিচু আর পা উঁচু করে ঝুলে থাকতে দেখা যাবে, কিংবা ভূতের সিনেমার মত কিছু একটা ধাঁ করে সামনে দিয়ে ক্রস করে চলে যাবে, কিংবা কেউ একটা রাস্তার পাশে চাদর ঢেকে দিয়ে বসে থাকবে – আরও কত কি। আপনার তখন হগ সাহেবের মার্কেট কিংবা কাশীর গলির কথা মনে পরে যাবে। কিছু করার নেই। এমন দুর্দিন আমার হবে কেই বা জানত। নতুন শহরে বন্ধুর বাড়ি আসতে গিয়ে এমন একটা গলি কেন বেছে নিলাম কে জানে, তাও আবার বন্ধুর বারণ করা সত্ত্বেও। আসলে বারণ করাতে আকর্ষণটা আরও বেড়ে গিয়েছে।

আজ প্রায় তিন-চার বছর পর সুজয়ের সাথে দেখা হচ্ছে। অফিসের কাজে এই শহরে আসা, কাল দুপুরে চলে যাব। এখানে এই প্রথম আসা, এতদিনের বন্ধু, এত কাছ থেকে দেখা হবে না, তা হতেই পারে না। তাই শহরে আসবার আগে বন্ধুকে ফোন করলাম। হাতে এত শর্ট টাইম, তাই আজ রাতে দেখা করা ছাড়া কোন উপায় নেই। কালকে ওর বাড়ির থেকে এয়ারপোর্টে রওনা দেব। সুজয়ের বাড়িটা শহরের এক প্রান্তে। অফিসের কাজ শেষ করতে সাতটা বাজল। আর সেখান থেকে সুজয়ের বাড়ি আসতে প্রায় দু’ঘণ্টা। সুজয় বলে দিয়েছিল যে, এই গলিটা দিয়ে না আসতে। জিজ্ঞেস করাতে অতিপ্রাকৃতের ইঙ্গিত সে আমায় দিয়েছিল। তাতেই আরও কৌতূহল বেড়ে যায়, আর আমি সেই গলিটাই ধরলাম। অনেকটা সেই বাংলা ভূতের ছোটগল্পের মত ব্যাপারটা হয়ে যাচ্ছে। দু’টো পথ – একটা ঠিক পথ, আরেকটা ভৌতিক পথ। কপালের ফেরে সবাই ভৌতিক পথটাই ধরে। নিজের ক্ষেত্রে এমন ক্লিশে ব্যাপারটা হবে কল্পনাই করিনি। কিন্তু কী আর করা যাবে। যখন এই রাস্তা ধরে ফেলেছি, তখন এ রাস্তা দিয়েই যেতে হবে।

যাচ্ছিলাম ভালই, কিন্তু ভয়টা এমন চেপে বসল যে, তা আর বলার নয়। কেন জানিনা মনে হচ্ছে যে কেউ পিছন পিছন আসছে। সত্যি সত্যি একটা গা ছমছমে ব্যাপার আমায় পেয়ে বসল। একবার মনে হল পিছন ফিরে তাকাই, তারপর মনে হল কী দরকার। সামনে এগিয়ে যাওয়াই ভাল। কিছুটা এগোতে বুঝতে পারছি একটা পায়ের শব্দ আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কোন লোক হতে পারে বা চোর ডাকাত হতে পারে। কিন্তু ভয়ের ধরণটা একটু অন্য রকম হতে লাগল, মনে হল কোন কিছু অতিপ্রাকৃত। হয়ত সুজয় আগের থেকে এরকম একটা ইঙ্গিত দিয়েছিল বলে যেন মাথায় চেপে বসছে। কি জানি। আমি সন্তর্পণে এগিয়ে যেতে লাগলাম, পিছনে পায়ের শব্দ দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগল। সামনে একটা জনমনিষ্যি নেই যে চিৎকার করলে শুনতে পাবে। কী করব ভেবে না পেয়ে হাতের মুঠো শক্ত করলাম, কিছু না হলেও নিজের বেসিক আত্মরক্ষাটা তো করতে হবে। কে হতে পারে, এই চিন্তায় মাথার মধ্যে দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যেতে লাগল, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগল, শার্টের কলার দেখলাম ভিজে গেছে। ছোটবেলার থেকে যাবতীয় যা অতিলৌকিক গল্প পড়েছিলাম, তা মাথায় ভিড় করতে লাগল। কত রকমের সম্ভাবনা উঁকি মারতে লাগল।

এসব কথা ভাবতেই পায়ের শব্দটা একবারে পিছনে এসে দাঁড়াল। বুকের ভিতরটায় যেন কেউ তখন হামানদিস্তার মত পেটাচ্ছে। ভাবলাম যা হবার হবে, একবার ঘুরে দাঁড়াই। ঠিক তখনই পিছন থেকে কেউ বলে উঠল, “দাদা, আগুন আছে? সিগারেটটা জ্বালাব।” মনে হল ভিতর থেকে এক দারুণ জ্বর চলে গেল। যেহুতু সিগারেট খাই, তাই দেশলাই আমার পকেটেই থাকে। পিছনে একটা লোক এসে দাঁড়িয়েছে, অন্ধকারে তাকে দেখা যাচ্ছে না। আমি পকেট থেকে দেশলাই বের করে আগুন জ্বালালাম। আর জ্বালাতেই ভয়াবহ কাণ্ডটা ঘটল, লোকটা হুশ করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। কী হল? আমি চিত্রপটের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। সারা শরীরের মধ্যে দিয়ে অদ্ভুত শিরশিরানি বয়ে যেতে লাগল। একটা জলজ্যান্ত মানুষ যে একটু আগে কথা বলল, আগুন চাইল সিগারেট জ্বালানোর জন্য, সে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

কিছুক্ষণ পরে সম্বিৎ ফিরে পেলাম, নিজেকে সামলে নিয়ে সুজয়ের বাড়ির দিকে হাঁটা লাগলাম। মাথা কাজ করছিল না, ঠিকানাটা মনে পড়ছিল না। খালি ভাবছিলাম, এ কেমন অশরীরী, যে সিগারেট জ্বালানোর জন্য দেশলাই চাইল আর তারপরে হাওয়া হয়ে গেল। অনেক কষ্টে শীতকালের বিকেলে ঘর্মাক্ত অবস্থায় সুজয়ের বাড়িতে গিয়ে পৌছালাম। আমার মানসিক অবস্থার প্রতিফলনটা নিশ্চয়ই চেহারার উপর পড়েছিল। তাই সুজয় দরজা খুলেই আমায় দেখে বলল, “এ কী অবস্থা তোর? আয়, ভিতরে আয়।”
প্রত্যেকটা গল্পের একটা সমাপ্তি বা ক্লোজার আমরা খুঁজি। কখনও কখনও পাই, আর কখনও কখনও পাই না। লোকে ভূতের গল্প পড়ে, কিন্তু আজকের ঘটনার সম্মুখীন হলে তারা কি করবে, সেটা জানতে খুব কৌতূহল জাগছে। একটু ধাতস্থ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে ছাদে সিগারেট জ্বালিয়ে সব ঘটনা সুজয়কে বলি। জানতে চাই, “ব্যাপারটা কী বল তো?”
“তোকে আগেই বলেছিলাম ওই রাস্তা দিয়ে আসিস না। তুই তো আমার কথা শুনলি না। বেশি না, এই তিন চার বছর আগের কথা। ওই গলিতে এক ভদ্রলোক থাকতেন, খুবই অসুস্থ ছিলেন। সিগারেট খেয়ে খেয়ে শরীরটা একেবারে ঝাঁঝরা করে ফেলেছিলেন। মাঝে মাঝে হাসপাতালে যেতে হত। বাড়িতে এলেই শুরু হয়ে যেত লুকিয়ে সিগারেট খাওয়া। বাড়িতে তারপর সিগারেট রাখা বন্ধ হয়ে গেল।”
“তারপর?”
“তারপর ফাঁক পেলেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়ত, আর অচেনা লোক দেখলে সিগারেট বা আগুন জ্বলানোর জন্য দেশলাই চাইত। এরকম করতে করতে মাঝ রাস্তায় ম্যাসিভ অ্যাট্যাক।”
অ্যাট্যাক? মানে, হার্ট অ্যাট্যাক?”
“হ্যাঁ। তারপরে সব শেষ। তবে এখনও সিগারেটের লোভে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, লোকজনের থেকে চেয়ে বেরোচ্ছেন। কারও ক্ষতি করেন না, শান্তশিষ্ট মানুষ ছিলেন একসময়ে। লোভ মৃত্যুর পরেও যায় না, বুঝলি?”
“বুঝলাম। কিন্তু একটা জিনিস বুঝলাম না, আগুন চেয়ে সিগারেট না ধরিয়ে ভ্যানিশ হয়ে গেলেন কেন? সুখটান মেরেই তো যেতে পারতেন।”
“খুব সিম্পল, ভূত হওয়ার পরে তো আর আগুন সহ্য করতে পারেন না। তাই লুপে পড়ে যাচ্ছেন।”
“লুপে মানে?”
“এই ধর, আগুন সহ্য করতে পারেন না বলে সিগারেট খাওয়া হচ্ছে না। আর সিগারেটটা খাওয়া না হ’লে অতৃপ্তি থেকে যাচ্ছে, মর্ত্যের মায়া কাটিয়ে যেতে পারছেন না।”
মনে মনে ভাবলাম, অকাট্য যুক্তি। কত রকম ভৌতিক গল্প শুনেছি, কিন্তু নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা গল্পের মত শোনাবে, তা কখনও ভাবিনি। ভূত, সিগারেট, দেশলাই একটা বিরাট লুপের মধ্যে পড়ে গেল। এবার থেকে সিগারেট খেতে গেলে খুব চাপে পড়ে যাব। সতর্কীকরণের মত মনে হবে কথাটা, “দাদা, আগুন আছে? সিগারেটটা জ্বালাব।”


লেখক পরিচিতি : ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী
ইন্দ্রনীল চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৭৮। লেখালেখির শুরু একুশ-দশের গোড়ায়। পেশায় ইইইট-হায়দ্রাবাদে কর্মরত গবেষক ও সহযোগী অধ্যাপক। দুটি কবিতার বই। কবিতা, অনুগল্প, অনুবাদের মাধ্যমে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা লেখির শুরু। কবিতার লেখার পাশাপাশি রয়েছেচলচ্চিত্রের প্রতি অনুরাগ। নিজের কবিতা প্রসঙ্গে ইন্দ্রনীল উবাচ - যেটুকু বলা হল কবিতায় তার বাইরে আসল কবিতাটুকু রয়ে গেল।

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।