পরিণতি

লেখক : অর্পিতা চক্রবর্তী

ঠিকানা অনুয়ায়ী ঠিক বাড়িতেই এসেছে পুলক। বাড়িটা বেশ বড়, শুধু রক্ষণাবেক্ষণের একটু অভাব আর সেটা দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছে। দরজাটা একবার না, বেশ কয়েকবার খটখট করাতে ভিতর থেকে একটা ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসল। ঐ তো ওখানে একটা কলিংবেল, তবে সেটাও ভেঙে ঝুলে পড়েছে। দরজার আওয়াজ শুনে ভিতর থেকে বয়স্ক একজন কাশতে কাশতে বেরিয়ে এলেন। দরজাটা খুললেন। ছানিপড়া ঝাপসা চোখে বলে উঠলেন, “কে, কে তুমি?”
“দাদু, আমি পুলক, পুলক গোস্বামী। পলাশপুর থেকে এসেছি। যদি আমার ভুল না হয় তবে আপনি নিশ্চয়ই সনাতন গোস্বামী? আমার দাদু।”
“আজ্ঞে, আমি সনাতন গোস্বামী, কিন্তু তুমি কে? তুমি তো দেখছি আমার জন্মভিটা থেকে এসেছ।”
“জ্যাঠাদাদু, আমি আসলে আপনার ছোটভাই শশাঙ্ক গোস্বামীর ছেলে শশীশেখর গোস্বামী, তার একমাত্র ছেলে পুলক গোস্বামী। ছোটবেলা থেকেই ব্যাঙ্গালোরে মানুষ হয়েছি। আপনি আমাকে খুব ছোট থাকতে কয়েকবার দেখেছিলেন। আমার দাদু একটি পত্র পাঠিয়েছেন আপনার উদ্দেশ্যে। যদি অভয় দেন, তো পড়ে শোনাই।”
মুহূর্তে দাদুর ফোকলা গালে হাসির রেখা খেলে গেল। “তা বেশ সে হবেখন। তুমি আগে ভেতরে এস দেখি।”
ঘরে প্রবেশ করল পুলক। ঘরে একটা পুরনো আমলের খাট, চারিদিকে অগোছালো কিছু জিনিসপত্র। একটা পুরনো চেয়ার আর প্রচুর বই। পুলক পত্রখানি এগিয়ে দিল দাদুর দিকে। দাদু বলল, “তুমি পড়ো আমি শুনি।”
পুলক পড়ছে আর দাদু শুনছে। ঘরটার মধ্যে যেন এক অদ্ভুত নীরবতা। দাদু হঠাৎ করেই পুলকের হাত থেকে চিঠিটা টেনে নিয়ে ওটার উপর হাত বোলাতে লাগলেন। ওনার চোখদুটো বেশ ঝাপসা। নাতি নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে দাদুর হাতের উপর নিজের হাতটা রাখল। আজ বহুবছর পর আবার মুখোমুখি গোস্বামী বাড়ির দুই প্রজন্ম, শুধু মাঝখানে বয়ে গেছে সময়ের চোরা স্রোত।
পুলক বলল, “দাদু, আমি গোবিন্দপুর পোস্ট অফিসের হেডপোস্টমাস্টার হিসেবে নিযুক্ত হয়ে এখানে এসেছি। আমার দাদুর কাছে আমি তোমার অনেক কথা শুনেছি। আমি আজ থেকেই নতুন অফিসে কাজে যোগ দিলাম। পোস্ট অফিসের পাশে একটা বাড়ি ভাড়া করেছি। আসলে আমার বেড়ে ওঠা-পড়াশোনা সবটাই ব্যাঙ্গালোরে। আমি মা-বাবার মুখে তোমার গল্প অনেক শুনেছি। তুমি তো বহু বছর আগেই পলাশপুর ছেড়েছ, তাই না? আচ্ছা দাদু, তোমার ও বাড়ির কথা মনে পড়ে?”
দাদু নাতির পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, “করে দাদুভাই, খুব করে। সেই কবেকার কথা। আমাদের মা-বাবা সব একে একে চলে গেল। তোমার তিন পিসির বিয়ের দায়িত্ব পড়ল আমার উপর। সব ভাইবোনদের সংসার গোছাতে গোছাতে আমার নিজের সংসার আর গোছানো হ’ল না। অবশ্য এ বিষয়ে আমার তেমন কোন আফসোস নেই। ইস্কুল মাস্টারের চাকরি নিয়ে চলে আসলাম এই গোবিন্দপুরে। প্রথম প্রথম বাড়ির সবার সাথে যোগাযোগ ছিল। কিন্তু তারপর সব বিছিন্ন হয়ে গেল। শুধু আমার ছোটভাই, মানে তোমার দাদু, আমার কথা ভোলেনি। বছরে দুইবার বাংলা নববর্ষ আর বিজয়া দশমীতে আমাকে প্রণাম জানিয়ে সবার কুশল সংবাদ জানিয়ে অদ্যবধি পত্র লেখেন। দাঁড়াও, তোমায় দেখাই।”
বলে দাদু আলমারি থেকে একটা মাঝারি মাপের বাক্স বের করে আনল, আর সেখান থেকে বেরোল অনেকগুলো হলদে হয়ে যাওয়া চিঠি। দাদু বলল, “আচ্ছা দাদুভাই, তুমি আমার ঘরে আজ প্রথম এসেছ। তা বলো দেখি, তুমি কি খেতে ভালোবাসো? আমার ঘরে তো তেমন কিছু নেই। তুমি একটু বসো, আমি বরং বাজার থেকে একটু মিষ্টি নিয়ে আসি।”
পুলক বলল, “দাদু, ওটা আমি নিয়েই এসেছি। বাবার কাছে শুনেছি তুমি নাকি রসগোল্লা খেতে খুব ভালবাস। আমাকে শুধু তোমার রান্নাঘরে একবার নিয়ে চলো। আমার দুটো প্লেট লাগবে। আজ আমরা দু’জনে একসাথে মিষ্টিমুখ করব। তাছাড়া আমি তো এখন থেকে এই গ্রামেই থাকব। চলে আসব মাঝে মাঝে। তবে তোমাকেও যেতে হবে আমার বাড়িতে। আচ্ছা, তুমি বরং এক কাজ করো, তোমার জিনিসপত্র গোছাও আর আমার সাথে আমার বাড়ি চলো। আমরা দু’জন আজ থেকে একসাথেই থাকব।”
দাদু হেসে বলল, “দাদুভাই, তুমি বলাতেই আমি খুশি। তোমার বাড়িতে যাব বৈকি। তবে তুমি এস। তোমার যখন খুশি তখন এস। আমি আমার জীবনের শেষ ক’টা দিন এ বাড়িতেই কাটিয়ে দেব।”
এদিকে দু’জন গল্প করতে করতে ঘড়ির কাঁটা তখন অনেকদূর পৌঁছে গিয়েছে। হঠাৎ দাদু বলে উঠল, “তা বুঝলে দাদুভাই, গল্প করতে করতে আজ বেশ রাত হয়ে গেল। তুমি বরং আজ রাতে আমার বাড়িতেই থেকে যাও। অজানা অচেনা গাঁয়ের পথ, তার মধ্যে তুমি শহরের ছেলে, কিছুই চেনো না। আমার ঘরে চাল-ডাল সবই আছে। আজ রাতে না হয় আমরা খিচুড়ি বনভোজন করব। সাথে পাঁপড় ভাজা। কি, চলবে তো? আমি কিন্তু স্ব-পাকে আহার করি। তবে একজন আছে জানো, আমার গিন্নি মা, এই পাশেই থাকে। সারাক্ষণ আমাকে শাসনে-বারণে রাখে। তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব কোন এক সময়।”

সেদিন রাতের বনভোজনটা ছিল দারুণ। গরম গরম খিচুড়ি সাথে পাঁপড় ভাজা। আজ এক নতুন জীবনে পা রাখল পুলক। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বেসরকারি চাকরি পেয়েও ছেড়ে দিয়েছিল, কারণ ওর কাছে জব স্যাটিসফ্যাকশনটাই ছিল বড় কথা। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান পুলক, স্বভাবে খুব শান্ত। বাবা সরকারি কর্মচারী, মা সাধারণ গৃহবধূ, সচ্ছল পরিবার। সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল পুলক। মেধা আর কঠিন অধ্যবসায়ের জোরে পেয়ে গিয়েছিল চাকরিটা। শহুরে ছেলে গ্রামে গিয়ে কি করে থাকবে, এই নিয়ে চিন্তিত মা-বাবা যখন জানতে পারলেন ছেলে যেখানে যাচ্ছে সেখানে আছে গোস্বামী বাড়ির বড় ছেলে সনাতন গোস্বামী, তখন সত্যি আর কোন চিন্তা থাকল না।
রাত পার হয়ে ভোরের আলো ফুটল। পুলক ঘুমোচ্ছে। জ্যাঠাদাদুর ডাকে ঘুম ভাঙল পুলকের। ও কোনরকমে নাকে মুখে গুঁজে রেডি হয়ে নিল। দাদু কিন্তু ঠিক সময়মত টিফিনবাক্সে খাবার গুছিয়ে রেডি। ঠিক যেন মায়ের মত। পুলক সবে দাদুর বাড়ি থেকে বেরতে যাবে, হঠাৎ দরজা খুলে ঘরে ঢুকল জবা। দু’জনের মুখোমুখি ধাক্কা। অবশ্য ধাক্কা লাগলেও দু’জন দু’জনকে সামলে নিয়েছিল বেশ সুন্দরভাবেই। জবা বলল, “কে আপনি? আমার দাদুর ঘরে কি করছেন?”
পুলক কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ জবা বলে উঠল, “শহরের শিক্ষিত ভদ্রলোকদের আমি বিলক্ষণ চিনি। আচ্ছা দাদু, আমি একদিনের জন্য মামাবাড়ি গেছিলাম, এর মধ্যে এ কোন উৎপাত জোটালে বলো তো তুমি?” জবা যেন একটা আস্ত সুপার সাইক্লোন।
পুলক বলল, “দাদু, আমি আসছি। তুমি এই অসভ্য মেয়েটিকে আমার পরিচয়টুকু দিয়ে দিও।”
কথাটা শুনে জবা যথেষ্ট প্রস্তুতিপূর্বক এগিয়ে গেল আর বলল, “আমি জবা, কোন অসভ্য নই। কোন অসভ্যতা করিও নি। শুধু ভাল জামাকাপড় পড়লেই বুঝি সভ্য হওয়া যায়?” সর্বনাশ এ ঝগড়া যেন আর থামতেই চায় না। শেষ পর্যন্ত দাদুর মধ্যস্থতায় পুলক সে যাত্রায় রক্ষা পেল। কিন্তু যেতে যেতে মুখ ভ্যাংচাল…দু’জনেই।

চাকরির দ্বিতীয় দিন। পোস্ট অফিসের অবস্থা মন্দের ভাল। কাজের চাপ যথেষ্ট। মাত্র তিনজন স্টাফ নিয়ে চলছে পোস্ট অফিস। গ্ৰামের মানুষজন যথেষ্ট সহজ সরল। এক কথা তিনবার থেকে চারবারে বোঝে। দেখতে দেখতে পুলক গোস্বামী তার ব্যবহারে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ওদিকে বাড়িওয়ালা বেচারাম সরকার নতুন যুবক ভাড়াটিয়া পেয়ে বেজায় খুশি। কারণ বাড়িতে তার তিন কন্যা – অপলা, সবলা আর চপলা। ওদিকে ভাড়াবাড়িতে রান্নাঘরের কাজের জন্য পাওয়া গিয়েছে সুমি পিসিকে। পিসির তিনকুলে কেউ নেই। পুলকের সংসারের দায়িত্ব পেয়ে পিসিও বেজায় খুশি। এমতাবস্থায় পুলকের মা-বাবাও কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন। একদিকে দাদু, অন্যদিকে পিসি – আপাতত এই দুই অভিভাবকের অধীনস্থ পুলক গোস্বামী। সারা সপ্তাহ অফিস। ছুটির দিনে দাদু-নাতি মিলে গ্ৰাম পরিদর্শন, এসব নিয়ে দিনগুলো বেশ কাটছিল। জবার সাথে পরিচয় হয়েছে পুলকের। ওদের ঝগড়াটা অবশ্য কারণে-অকারণেই শুরু হয়ে যায়। জ্যাঠাদাদু চেষ্টা করেছিলেন মধ্যস্থতা করবার, কিন্তু না – দু’টো যেন দুই মেরু। অবশ্য এখানেও একটা ইয়ে, মানে খটকা আছে। পুলক কী কী খেতে ভালবাসে, ইতিমধ্যে সবটাই জেনে গিয়েছে জবা। তাই সে আসার আগে তার পছন্দের খাবার ঠিক দাদুর বাড়িতে চলে আসে। দিন যত যেতে লাগল, দাদু যেন কোথাও একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছিল। এদিকে গোটা গোবিন্দপুরে তখন একটাই নাম – পুলক গোস্বামী। শিক্ষিত, বিনয়ী, উঁচু বংশ। মোটকথা, পাত্র হিসাবে সুপাত্র এবং তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।ইতিমধ্যে পুলকের বাবা-মা এসে ছেলের নতুন সংসার দেখে গিয়েছে। ওদিকে দাদুও মাঝে মাঝেই চলে আসে তার আদরের নাতির কাছে। বর্তমানে একটা স্মার্টফোন আছে দাদুর। পুলক কিনে দিয়েছে। দাদুর ছানি অপারেশন করিয়েছে নাতি তার নিজদায়িত্বে। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। তাও সেদিন হঠাৎ করেই ঘটে গেল একটা অনর্থ।
জবাকে দেখতে আসছে পাত্রপক্ষ। পাশের গ্রামের ছেলে, বড় ব্যবসায়ী, পড়াশোনা খুব বিশেষ করেনি। একান্নবর্তী পরিবার। ছেলে দেখতে শুনতে মোটামুটি। বিকেল চারটে নাগাদ পাত্রপক্ষ আসল। একটা লাল রঙের শাড়ি পড়েছে জবা। পুলকের দাদুও আজ নিমন্ত্রিত জবাদের বাড়িতে। আসলে উনি এই গাঁয়ের একজন বেশ গণ্যমান্য ব্যক্তি। পাত্রপক্ষের এক দেখায় পছন্দ হয়ে গেল জবাকে।
“তবে এবার আসা যাক আসল কথায়, মানে ঐ দেনা পাওনার বিষয়ে।” পাত্রের মা প্রথম শুরু করলেন, “আপনারা আপনাদের মেয়েকে যেভাবে ইচ্ছা সাজিয়ে দেবেন। সে ব্যাপারে আমাদের কিছু বলার নেই। শুধু ঐ সীতাহারের সাথে আরও একটি চাঁপা হার দিলে ভালো হয়। তাতে গলাটা বেশ ভরাট লাগে। আর ইয়ে, মানে কানের ঝুমকোটা একটু বেশি ঝুল দিয়ে বানাবেন। আসলে আপনাদের মেয়ের মুখখানা বেশ গোল তো, তাই বলছিলাম। হাতে শাঁখা-বাঁধানো, পলা-বাঁধানো আর যা ইচ্ছা হয় দেবেন। তবে কয়েক গাছা সরু চুড়ি অবশ্যই দেবেন সবসময় পরার জন্য। আসলে কি জানেন তো, দিনকাল ভাল না। ভারি গহনা পড়ে তো আজকাল আর বাইরে যাতায়াত করা যায় না। দেখুন, আপনারা যা দেবেন তা ওদেরই থাকবে। আমরা আর কতদিন? আমাদের তো ঐ একটিই সবেধন নীলমণি। আর আমাদের যা আছে, তাও তো ওদেরই থাকবে। জামাইকে আংটি বোতাম ছাড়া আপনাদের যা ইচ্ছা হয় দেবেন। আসলে আমাদের পরিবার কিন্তু বেশ বড়, আর আমাদের বাড়ির অন্যান্য বৌমারা কিন্তু সারাদিন গয়নায় মোড়া থাকে। ভবিষ্যতে আপনাদের মেয়েকেও তো ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে হবে, তাই বলছিলাম।”
এতক্ষণ ছেলের মায়ের তালিকা শোনা গেল। এবার আসা যাক ছেলের তালিকা নিয়ে। ছেলের অবশ্য বেশি কিছু দাবিদাওয়া নেই। শুধু ঐ একটা বুলেট গাড়ি, একটা সোনার চেন আর হাতের ব্রেসলেট নিয়ে তার অত মাথাব্যথা নেই। ওটা হ’লে ভাল, তবে না হ’লেও কোন অসুবিধা নেই।
এতক্ষণ সব শুনে ছেলের বাবা এবার মুখ খুললেন। “বলি সবই তো শুনলেন। আমার অবশ্য এসব জিনিসপত্র নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। আমার শুধু একশ জন বরযাত্রী আসবে। দেখবেন তাদের খাতির যত্নে যেন কোন ত্রুটি না হয়। তবে অগ্ৰহায়নের প্রথম ডেটটা হলেই ভালই হয় কি বলেন? তবে এই বিষয়টি অবশ্য আমরা আপনাদের উপরই ছাড়লাম। আমাদের তো সবকিছুই গোছানো আছে, কিন্তু আপনাদের তো একটু সময় দিতেই হবে।” একগাল হাসি নিয়ে ছেলের বাবা এবার জবার দিকে চেয়ে বলল, “মা তোমার যদি কিছু বলার থাকে বলো, বা তুমি যদি আমার ছেলের সাথে আলাদা করে কথা বলতে চাও, বলতে পারো। আমরা খুব স্বাধীনচেতা মানুষ। তুমি যদি ভবিষ্যতে পড়াশোনা করতে চাও করতে পারো। আমাদের ঘরে ঠাকুর চাকরের কোন অভাব নেই। আমি আর আমার ছেলে সারাদিন বাইরে ব্যাস্ত থাকি, তুমি পড়াশোনা করলে তোমার সময়টাও কেটে যাবে। কি বলেন বেয়াই মশাই।”
হঠাৎ করেই ঘরের মধ্যে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। শুধু মিষ্টি চিবনোর আওয়াজটা ছিল বেশ জোরালো। পাত্রপক্ষের কথা শুনে জবার মা-বাবার মুখের কথা যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। হঠাৎ জবা চারপাশটা চোখ বুলিয়ে চেয়ার ছেড়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল আর বলল, “আমার কিছু বলার আছে, যদি অনুমতি দেন তবে বলি।”
ছেলের বাবা বলল, “তা বেশ বলো, তোমার কি বলার আছে।”
“আসলে ইয়ে, মানে আমি জবা, আর এনারা দুজন আমার মা-বাবা। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা আমাকে খুব কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়েছে। আমি গ্ৰ্যাজুয়েশন কমপ্লিট করার পর এম.এ. পড়তে চেয়েছিলাম, কিন্তু তাতে নাকি আমি বেশি শিক্ষিত হয়ে যেতাম, আর বিয়ের বাজারে পাত্রের অভাব পড়ত। তা বেশ, মেনে নিলাম এবং পড়াশোনায় ইতি টানলাম। আপনারা আজ এসেছেন আমাকে দেখতে। তাই আজ কিছু কথা আমরাও আছে। আপনারা তো শুনলাম খুব স্বাধীনচেতা মানুষ। তাহলে প্রথমেই বলি, আমি কিন্তু বিয়ের পর এম.এ. কমপ্লিট করব আর তারপর কোন চাকরি পেলে সেটাও করব। শুনলাম আপনাদের বাড়িতে ঠাকুর-চাকর-অর্থ সবই আছে, সুতরাং আপত্তির কোন কারণ নেই নিশ্চয়ই। আমার দ্বিতীয় বক্তব্য, আপনি তো আমার হবু শাশুড়ি মা। আমার মা আমাকে দু’টো হার দেবে (আপনার কথা মত)। তা আপনি আমাকে কী দিয়ে আর্শীবাদ করছেন জানতে পারি? আসলে আপনাদের বাড়ির বৌমাদের সাথে পাল্লা দিতে হবে কিনা, তাই বলছিলাম। ঠিক আছে, আপনি বরং একটা কাজ করুন। আমাকে একটা ডায়মণ্ড নেকলেস সেট আর আড়াই প্যাঁচের একটা লোহা বাঁধানো দেবেন। তারপর আপনারা শুধু দেখবেন, আপনাদের বাড়িতে আমাকে দেখতে কেমন ভিড় জমে যায়। আমার তৃতীয় বক্তব্য, আমার হবু স্বামীর সাথে। না না, পার্সোনাল বলার মত কিছু নেই। যা বলব প্রকাশ্যেই বলব। আমার হবু পতিদেব, আপনি কিন্তু আমাকে একটা আংটি (প্ল্যাটিনাম) দেবেন। আসলে সোনা, ডায়মণ্ড সবই যখন হচ্ছে, তখন ওটাই বা বাদ যায় কেন বলুন। আসলে আমি ইয়ে, মানে সেই আংটিটার কথা বলছি। আশা করি আপনার বুঝতে খুব বিশেষ অসুবিধা হচ্ছে না। আমার চতুর্থ বক্তব্য, আমার হবু শ্বশুর মহাশয়ের কাছে। আমাদের পক্ষ থেকে কিন্তু দেড়শ জন কন্যাযাত্রী যাবে, দেখবেন তাদের আদরযত্নে যেন কোন ত্রুটি না থাকে। আসলে আমি এই গাঁয়ে জন্মেছি, বড় হয়েছি। তাই কাকে ছেড়ে কাকে বাদ দিই বলুন। যাহোক, আমার বক্তব্য আপাতত এইটুকুই। আসলে আমি একটু স্পষ্ট কথা বলতে ভালবাসি। আপনারা দয়া করে কিছু মনে করবেন না। তাহলে এবার আপনারা একটু ভাল করে মিষ্টি মুখ করুন। শুভ কাজ বলে কথা।”
এতক্ষণ ধরে চলা “আসলে আর ইয়ে” শুনে শুনে পাত্রপক্ষের মিষ্টি খাওয়া তখন মাথায় উঠেছে। এ মেয়ে না আগুনের গোলা! সহবত শিক্ষা একেবারেই নেই। তবে এবার বোধহয় পাত্রপক্ষের কেটে পড়াই ভাল। আপাতত জবার বিয়ের গল্প এখানেই শেষ হ’ল। তবে যোগ্য পাত্রের সন্ধান এখনও চলছে। দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গড়ায়।

গোবিন্দপুর গ্রামের প্রতিটি ঘরে এখন একটাই নাম – “জবা”। সে যা করেছে, তা কেউ করতে পারে না। তা এত কাণ্ডের পর জবার বিয়েটা আদৌ হবে তো? এদিকে এতকিছু ঘটে যাওয়াতে একজন কিন্তু বেজায় খুশি হয়েছে। হঠাৎ করেই পুলক বাবুর মনে পুলক বুঝি আর ধরে না। কিন্তু কথা হচ্ছে, এর মধ্যে আনন্দের ঠিক কি আছে? একটা মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেছে, সেটা নিশ্চয়ই কোন সুখবর নয়।

সেদিন ছিল রবিবার ছুটির দিন, দাদুর বাড়িতে নাতি এসে উপস্থিত। আজ দাদু আর নাতি সারাটা দিন একসাথে কাটাবে। প্রতিবেশী জবা কখন যেন টুক করে এসে একবাটি পায়েস দিয়ে গিয়েছে। আর পুলকবাবু পরম তৃপ্তিতে সেই পায়েসের বাটি এবং সাথে নিজের হাত সবটুকুই চেটে চেটে খাচ্ছে। হঠাৎ দাদু বলল, “তা দাদুভাই পায়েস কেমন খেলে?”
পুলক বলল, “অমৃত।”
দাদু বলল, “সবই তো ভাল। শুধু আমার এই এত গুণী নাতনীর একটা ভাল পাত্র কোথায় পাই বলো দেখি?”
পুলকের সোজাসাপ্টা উত্তর, “তোমার ঐ ক্ষেপি পাত্রীর জন্য কুমোরটুলিতে যেতে হবে। তবে হ্যাঁ, মানতে হবে সাহস আছে ম্যাডামের, অ্যাণ্ড আই লাইক ইট।”
দাদু বলল, “তুমি কি কিছু বললে দাদুভাই? আজকাল বয়সের ভারে কানে একটু খাটো হয়ে যাচ্ছি তো, তাই বললাম।”
পুলক বলল, “কই আমি তো কিছু বলিনি।”
দাদু বলল, “ও তা হবে হয়ত। তবে আমি যেন কোথাও একটা গন্ধ পাচ্ছি? তুমিও কি পাচ্ছ দাদুভাই?”
পুলক বলল, “কিসের গন্ধ দাদু, আমি তো কিছু পাচ্ছি না।”
দাদু বলল, “আমি পাচ্ছি। আসলে বয়স হয়েছে তো, তাই কানের সাথে সাথে নাকটাও বুঝি গিয়েছে।”

দুই অসম বয়সী দাদু আর নাতির বন্ধুত্বটা কিন্তু বড়ই মধুর। আপাতত রাতের খাওয়া সেরে দু’জনেই খাটে শুয়ে আছে। ওদের মাথার দিকের জানালাটা খোলা। পূর্ণিমা রাতের চাঁদমামা ততক্ষণে জানলার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকে সোজা বিছানায় নিজের স্থান করে নিয়েছে। পুলক বলল, “আচ্ছা দাদু, ঐ চাঁদ দেখে তোমার কারও কথা মনে পড়ে? ধরো এমন কেউ, যে ঐ চাঁদের মতোই স্নিগ্ধ, যাকে দেখার পর আর কাউকে দেখতে ইচ্ছা করে না। যাকে দেখে অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করে, কিন্তু বলতে গেলে কোথায় যেন সব আটকে যায়।”
দাদু একদম চুপ। তার অভিজ্ঞতা বলছে নাতির একটা বেশ কঠিন অসুখ হয়েছে আর সেটা সারিয়ে তুলতে হবে। বিষয়টি বেশ গুরুগম্ভীর। দাদু বলল, “বুঝলে ইয়ং ম্যান, তোমার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে তুমি প্রেমে পড়েছ, শুধু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছ না। তবে এই বুড়োকে বিশ্বাস করে বলতে পারো।”
পুলক বলল, “বলব দাদু, তোমাকেই বলব। জানো দাদু, এখানে আসার পর থেকে সারা গ্রামের অবিবাহিতা মেয়েরা আমার জন্য পাগল। শুধু একজন আছে, যার বড্ড গুমর। সে চায় আমি তার কাছে ধরা দিই। আমিও তার কাছে ধরা দিতে চাই। কিন্তু তার সামনে গেলেই সে এমন ক্ষেপি পাগলি হয়ে তেড়ে আসে, যে আমি নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারি না। মাথাটা গরম হয়ে যায়, ঝগড়া লেগে যায়। আমি জানি তার উপরটা খুব শক্ত, কিন্তু ভিতরটা নরম। সে সবার থেকে আলাদা। আর সেই জন্যই তো আমি তার প্রেমে পড়েছি।”
দাদু এবার সটান উঠে বসল। “তাই নাকি? তা সে কে শুনি? মানে তার নামটা কী? আচ্ছা, আমি কি তাকে চিনি?”
পুলকও এতক্ষণে নড়েচড়ে বসেছে। “নাম মানে ইসে, তুমি চেনো তাকে।”
দাদু বলল, “তা আমি তো এই গোটা গ্রামের সবাইকে চিনি। তুমি ঠিক কার কথা বলছ দাদুভাই? ঠিক আছে তুমি আমাকে শুধু মেয়েটির নাম বলো, আমি ঠিক খুঁজে বের করব তাকে।”
পুলক বলল, “আমি তো তাকে ক্ষেপি বলেই ডাকি। সে অবশ্য তোমার খুব আদুরে, তোমার দিদিভাই, জবা ম্যাডাম।”

এরপরে…জবা আর পুলকের শুভ পরিণয় অনুষ্ঠিত হতে চলেছে আগামী ৭ই ফাল্গুন। পাত্রপক্ষের শুধু একটি মাত্র দাবি, এই বিবাহের মাধ্যমে একটি মিষ্টি মধুর সম্পর্কের সূচনা হোক। তবে এবারের আলোচ্য বিষয় হল, পুলক আর জবার বিবাহের ভেনু নিয়ে, মেনু নিয়ে নাহয় পরে কথা হবে। বিবাহ বাসর গোবিন্দপুর গ্রামে জবাদের পৈতৃক বাসভবন। প্রথম প্রীতিভোজ ব্যাঙ্গালোর, পুলকদের বাড়ির পাশের কমিউনিটি হল। দ্বিতীয় প্রীতিভোজ পলাশপুর গ্ৰাম, পুলকদের পৈতৃক ভিটায়।তৃতীয় প্রীতিভোজ গোবিন্দপুর গ্ৰাম, সনাতন গোস্বামীর বাড়ির ফাঁকা জমিতে। আর এই অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত থাকবে গোটা গ্ৰামবাসী এবং এই অনুষ্ঠানের সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করবেন মাননীয় সনাতন গোস্বামী মহাশয় পুলকের জ্যাঠাদাদু। নাতির বিয়ে বলে কথা। দাদুর আনন্দ বুঝি আর ধরে না। তবে লাখ কথার এক কথা এবং শেষ কথাটি হ’ল, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে, তিন বিধাতা নিয়ে।


লেখক পরিচিতি : অর্পিতা চক্রবর্তী
আমি অর্পিতা চক্রবর্তী। খুব সাধারণ একজন গৃহবধূ। মনের খেয়ালে আর কল্পনায় করি শব্দের আঁকিবুকি। নানা বিষয়ের উপর লিখতে আমার ভালো লাগে। তবে প্রতিটি লেখার মাঝে রেখে যাই একটি নিঃশব্দ বার্তা। একাধিক পত্র পত্রিকার সাথে আমার পথ চলা। ইতিমধ্যে আমার স্বরচিত বই "নীড় ভাঙা ঢেউ" প্রকাশিত হয়েছে "নীরব আলো পত্রিকার" হাত ধরে যা "হাজার দুয়ারী সাহিত্য সম্মান 2025" এ সম্মানিত হয়েছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

মাসিক দীপায়ন প্রতিযোগিতা

মাসিক দীপায়ন পুরস্কার pop up