প্রজাপতি

লেখক : মানব মন্ডল

জীবনে প্রচুর কিছু না পেলেও যেটুকু পেয়েছে তাতেই সন্তুষ্ট অভি। তবে কেরিয়ারটা গোছাতে একটু বেশি দেড়ি হয়ে গেছে। আজকাল বাড়ির লোকজন খুব বেশি বিয়ের কথা নিয়ে ভাবছে। ওর ভাই এর বিয়েটা দেখাশোনা করেই হয়েছে। কিন্তু ওর জন্য ওর মা বাবা তেমন ভাবে পাত্রীর সন্ধান করেননি। প্রথম জীবনটা আসলে ও বাউন্ডুলে ছিলো। বিদেশে চাকরি করে ওর অর্থনৈতিক অবস্থাটা একটু শক্তপক্ত হয়েছে।  কিন্তু চলে গেছে সময়।

ছুটিতে ও কোন দিনই বেশি দিন বাড়িতে থাকে নি। তাই কোনো মেয়ের সাথে কোন সম্পর্ক আছে কিনা কিছুই বুঝতে পারেনি বাড়ির লোকজন। কিন্তু সবাই ধরে নিয়েছিল সম্পর্ক আছেই কারো না কারো সাথে। কারণ কলেজ জীবনে ওর অনেক মেয়ে বন্ধু ছিল। শেষ পর্যন্ত আজ খেতে বসতেই বাবা বললো-“দিয়ার বাড়ির নম্বারটা দে না, একটু কথা বলবো।”
খুব সাধারণ ভাবেই অভি বললো, “আজ দেখা হবে। কি বলতে হবে বলে দেবো। “
রূপা বললো ” দাদা সব কথা তো তুমি বলবে এরকম হতে পারে না, বাবা মা তোমাদের বিয়ের কথা বলবে।”
অভির হেঁচকি উঠলো। ওর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরলো।  “তোমরা কি পাগল হয়ে গেছো? ও আমার ভালো বন্ধু। “
রূপা বললো – “ভালো বন্ধুই তো ভালো জীবন সঙ্গী হয়। তুমি বিয়ে করবে না কেন?”
বাবা বললো – “আমাদের কি শান্তিতে মরতেও দিবি না তুই। বিয়ের কথা বললে পালিয়ে যাস কেন? তোর যে কোন বান্ধবীকে বিয়ে কর আমাদের তো কোনো আপত্তি নেই। তবে বিয়ে কর। “

অভি খাওয়া শেষ করে উঠে চলে যেতেই পারতো প্রতিদিনের মতো। কিন্তু আজ কি মনে হলো চুপ করে বসলো।  তারপর বললো-  “আজকাল এই সোস্যাল মিডিয়ার জন্য ছেলে মেয়েদের বন্ধুত্বটা খুব সস্তা হয়ে গেছে।  তোমাদের যুগে একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে পাঁচ বছর লেগে যেতো। এখন পাঁচ মিনিট ও লাগেনা।  চেনা হোক বা অচেনা, প্রোফাইল চেক করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দাও। একসেপ্ট করলেই কথাবার্তা শুরু। প্রশয়, ঘনিষ্ঠতা সবই হয়।  কারণ সম্পর্ক গড়তে যেমন সময় লাগে না, ভাঙতেও সময় লাগে না। ব্লক করে দিলেই হল। বিয়ে ডিভোর্স সব যেন ড্রাইভিং লাইসেন্স এর মতো হয়ে গেছে। স্বাক্ষর করো, অ্যাপ্লিকেসান করো, সার্টিফিকেট পেয়ে গেলেই হয়ে গেলো।”

লম্বা চওড়া ভাষণ শুনে সবাই চুপ করে গেলো।

অভি ঘর থেকে বেড়োনোর আগে আজ আয়নায় মুখ দেখলো হঠাৎই। ওর জুলপির কাছে কানের পাশে কয়েকটি চুল বেশ সাদা হয়ে গেছে।  বাড়ি থেকে বেড়িয়ে কিছুটা গেলেই মঠ।  মঠের সন্যাসীগুলো সবাই নেড়া। ওদের বয়স ঠিক বোঝা যায় না। অভি মনে মনে ভাবলো নেড়া হবার এটাই এডভানটেজ, বয়েস বোঝা যায় না।

কফি হাউজে ঢোকার আগে একটা টুপি কিনলো।  চৈতালি আসলো। অভি কফির সাথে স্যান্ডুইচ অর্ডার দিচ্ছিল। ও দিতে দিলো না।  চৈতালি ওর পাশের বাড়ির মেয়ে তবু ওরা দেখা করে গোপনে।  কিন্তু তাবলে প্রেম নয়।  এল আই সি এজেন্ট চৈতালির কাছ থেকে একটা-দুটো পলিসি করে অভি। ওর টার্গেট পূরণ করতে। ফিক্সড ডিপোজিটের মতো।  ফলে রিন্যুয়াল প্রিমিয়ামের অজুহাতে যে দেখা হয় তেমন নয়। তবু দেখা করে ওরা। আজ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে “ও” জিজ্ঞেস করে ফেললো চৈতালিকে, কবে বিয়ে করবে? চৈতালি জানালো দুই বছর পর। অভির মনে পরে গেলো ওর দুটো চুল পেকে গেছে। তবু চেস্টা করেও সরাসরি বলতে পারলো না “তুই কি আমায় বিয়ে করবি?” ও ওদের সম্পর্কটা নিয়ে কিছুই বুঝতে পারে না।

আজ বিল এসেছিল ৬৯ টাকা। অভি টিপস হিসেবে পুরোটাই দিয়ে দিচ্ছিল।  ওর চোখ পাকানো দেখে প্রথমে কুড়ি দিতে গিয়েও পরে দশ টাকা দিতে বাধ্য হলো।  অন্তত চৈতালি ওকে বেহিসাবি হতে দেয় না। শাসনে রাখে। এটাকে ও ভালোবাসা বলে ধরে নিতে পারে না।  কারণ একবার ও চৈতালিকে ভ্যালেনটাইনস ডেতে দেখা করতে চাওয়ায় বলে দিয়েছিলো, “ভুলে যেও না তুমি আমার কাকার বন্ধু। “

অভি স্কুটির চাবি খুলতে যাচ্ছে, চৈতালি বললো- “নতুন স্কুটি কিনে একবারও তো চড়তে বললে না!”

“তোর সময় আছে কিনা জানি না।  তাই বলিনি। “
চৈতালি বললো- “তোমার সাথে সময় কাটাতে আমার ভালো লাগে। তাই আমি তোমার সাথে দেখা করতে এলে হাতে সময় নিয়েই আসি। “

অভির মনে মনে লাড্ডু ফুটল। কিন্তু আফশোস হল বাইক কিনলো না কেন। ওর মনে যা আসে চৈতালিকে তা ও বলে দেয়। যদিও জানে না কেন এটা করে। অভি বললো- ” জানিস আমার বুলেট কেনার ইচ্ছাই ছিলো।  তেলের যা দাম, তাই ব্যাটারির গাড়ি কিনলাম। “

ও বললো- “ভালো করছো। তোমাকে আমি বলেছিলাম আমার বুলেট পছন্দ।  তাই কি বলছো তোমার বুলেট কেনার ইচ্ছা ছিল! কাকিমার ভাই জানো বুলেট কিনেছেন। আমাকে অনেকবার ঘুরতে যেতে বলছে, আমি  যাইনি।  অপ্রয়োজনে খরচ করাটা আমার পছন্দ নয়।  তাছাড়া যেকোনো মেয়ে স্কুটিতে বসতে চাইবে। বাইকে বসলে তোমরা বারবার ব্রেক মেরো কেন সব মেয়েদের সেটা জানা আছে। “

অভি বললো- “সেটা অন্য প্রসঙ্গ।  কিন্তু এর পিছনের সিটে তুইই প্রথম মেয়ে যে বসলি। মা অনেকদিন কালিঘাট মন্দিরে নিয়ে যেতে বলছে, কাল  নিয়ে যাব। “

“সেটা জানি।  ছাদ থেকে সেইদিন দেখলাম বনি তোমাকে বলল বাসস্ট্যান্ড ছেড়ে দিতে। তুমি দিলে না। অথচ কিছুক্ষন পরেই দেখলাম তোমার পিছনে বাপ্পাদা বসে কোথাও যাচ্ছে। তবে তোমার মাকে কালিঘাট নিয়ে গেলে আমার আপত্তি থাকতো না বোধহয়।”

সময় আজ বড় তাড়াতাড়ি দৌড়ে চলে গেল। যাইহোক পাড়াতে জানাজানি হয়ে যেতে পারে তাই ওকে মঠের পিছনে ছেড়ে দিল। মঠের জানালা দিয়ে দেখলো একটা সন্যাসী ধ্যানে বসে আছে।  ঠোঁটে একটা মিষ্টি হাসির রেখা। অভি বুঝতে পারে না এই মঠের বাসিন্দারা অতো শান্তিতে থাকে কি করে! লোকজন বলে ধর্ম একটা ব্যবসা। কিন্তু এদের তো কোনো ভক্ত নেই, দান পাত্র নেই। কিভাবে চলে এটা!

আজ সোমবার সকাল।  রবিবারগুলোতে কাগজ নেওয়া হচ্ছে আজকাল। বোধহয় পাত্রীর বিজ্ঞাপনের জন্য। খুব অস্বস্তিতে পড়েছে আজ অভি।  অভিও আজ একটু বিয়ের ব্যপারে চিন্তিত। কারণ ও দেখল ওর বুকের কয়েকটি চুলও পেকে গেছে। ছোটবেলা থেকেই কোন প্রশ্ন ওর মনকে ব্যকুল করলে ও মঠের মহারাজ এর কাছে চলে যায়। আজও তাই করলো।  রঙহীন এক পোশাক পরে কাটিয়ে দেওয়া মানুষগুলোর জীবনটা যেন চিন্তা শূন্য রঙীন।

মহারাজ বললেন, “দেখ, টেবিলের উপর একটা বই আছে। নিয়ে আয়তো। ” বছর দশক আগে ওর ছাপানো একটা কবিতার বই। নিজের লেখা বই দেখে ওর মনটা খুশিতে ভরে উঠল। মহারাজ বললো, “বইয়ের নাম রেখেছিস আদর। ছবিটাও তোর আঁকা, ফুলের ওপর প্রজাপতি।  প্রজাপতি তো তোর প্রিয়, শুঁয়োপোকা কেমন লাগে?”
 ভি বললো- “কাঁটাগুলো সবচেয়ে বাজে লাগে। “
মহারাজ বললেন, “শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হবার সময় হঠাৎই ও নিজেকে একা করে ফেলে।  গুটির মধ্যে সারা জগত থেকে নিজেকে আলাদা করে নেয়।  ঐ সময় ও নিজেকে জানে। সাধনা হলো নিজেকে জানা। প্রজাপতির সাথে ফুলের বন্ধুত্ব হয় কেন জানিস? ফুল কারণে-অকারণে হাসে। ওর এই নিঃস্বার্থ হাসিই হয়তো প্রজাপতিকে আকর্ষণ করে। মৌমাছিরা মধু সঞ্চয় করে রাখে। যদিও সেটা ওরা পরে দখল করতে পারে কিনা জানিনা। তবে প্রজাপতি ওসব করে না। আমাদের মতো নিশ্চিন্তে ভেসে বেড়ায় আকাশে। একা হয়েও আমরা সুখী কারণ আমরা নিজেদের জানতে চেষ্টা করছি। “

অভি কথাগুলো কতটা বুঝতে পারল কে জানে! তবে প্রজাপতি হবার ওর বড়ো সাধ। চঞ্চল অথচ ছন্দ আছে ওর জীবনে। কিন্তু কোনো ব্যস্ততা নেই প্রজাপতির।

লেখক পরিচিতি : মানব মন্ডল
মানব মন্ডল, ভাষা আন্দোলনের কর্মী হিসেবে কিছু বর্ষীয়ান সাহিত্যদের সাথে পরিচয়, স্বপ

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।