রাস্তাপার

 লেখক : ইচ্ছেমৃত্যু

রাস্তাটা পার হতেই হবে এই পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ডের মধ্যে, না হলে আবার তিন মিনিট দাঁড়িয়ে থাকা। অবশ্য এই পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ডটা নামেই – সিগ্ন্যাল হওয়ার দশ সেকেন্ড পরও গাড়ি চলবে আর ওদিকে সিগ্ন্যাল চেঞ্জ হতে না হতেই ছুটতে শুরু করবে স্টার্ট হয়ে থাকা গাড়িগুলো। কম বয়সীদের পক্ষে তবু এই পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড সময় অনেক কিন্তু আমার মত বাষট্টি বছরের খোঁড়া বুড়োর পক্ষে নিতান্তই অল্প। তাই তটস্থ হয়ে থাকতে হয় পরের সিগ্ন্যাল পাওয়ার জন্য, ফলে টেনশন ক্রমশই বাড়তে থাকে, সঙ্গে বাড়তে থাকে ভিড়। সবাই উন্মুখ – সিগ্ন্যাল হলেই রাস্তাপারের দৌড়। ওদিকে আবার ঘুমটিতে রাখা এফ. এম.–এ গান বাজছে ‘বাস স্টপে কেউ নেই কোথাও’। এই সব ব্যান্ডগুলো কী যে বলে মাথামুন্ডুহীন তার ঠিক নেই! এই অ্যাতো লোক রয়েছে ভিড় করে আর তোদের মনে হয় কিনা ‘বাস স্টপে কেউ নেই কোথাও, কেউ নেই কোথাও’! বলিহারি যাই বাবা! অবশ্য তেমন ভেবে দেখলে মন্দ বলছে না, নিজের ছেলেই তো কেউকেটা হওয়ার পর ‘কেউ’ রইল না, না হলে কি বৌমা সাহস পায় এই বুড়োকে রাস্তার ও পারের বাজার থেকে জিনিস কিনে আনতে পাঠাতে!
 
নাহ্‌, সিগ্ন্যালের দিকে মন দিতে হবে, আর বিশ সেকেন্ড পরেই পাওয়া যাবে রাস্তাপারের সঙ্কেত। এদিকে ভিড়টাও জমে আসছে, আমার আগে দুটো চ্যাংড়া ছোঁড়া দাঁড়িয়ে গ্যালো – মানে আমার ভাগে সময় আরও  কিছু কমে গ্যালো। যাই হোক আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড বাকি, পুরো মনোযোগ এখন রাস্তা আর সবুজ সঙ্কেতের দিকে – পাঁচ, চার, তিন, দুই, এক – সবুজ আলো – বাঁদিকের হাতে হঠাৎ হ্যাঁচকা টান। ঘুরে দেখি একটা বছর চার পাঁচেকের বাচ্চা ভিক্ষা চাইছে। মাথাটা গ্যালো গরম হয়ে – ‘যা ভাগ, সময় নেই সময় নেই তোদের শুধু এই করা! ভাগ-ভাগ!’ ছেলেটা বোধ হয় এরকম রাগ কোনদিন কারও দ্যাখেনি, ভয় পেয়ে দৌড়ে চলে গ্যাল অনেকটা। দুয়েকটা মন্তব্য উড়ে এল, ‘বাবা! একটা বা দুটো টাকা দিতে কি হয়! আর না দিবি দিবি, এত জোরে বকে! অতটুকু বাচ্চা!’ মন্তব্যকারীকে দেখতে পেলাম না ভিড়ে, তবে মনে মনে লজ্জা লাগল। ডান হাতের ক্র্যাচ বাগিয়ে আবার রাস্তা পার হওয়ার তোড়জোড় করতে গিয়ে দেখি আর মাত্র পনেরো সেকেন্ড বাকি রাস্তাপারের জন্য। নাহ্‌, এবারে হল না! আবার একশ আশি সেকেন্ড – তিন মিনিট।
 
মনটা পড়ে রইল ওই চার পাঁচ বছরের বাচ্চাটাতে আর হ্যাঁচকা টানটা ফিরিয়ে নিয়ে গ্যালো পঁচিশ বছর আগের এক ভয়ঙ্কর স্মৃতিতে। সেদিনও ঠিক এরকমই এই রাস্তার মোড়ে রাস্তাপারের জন্য দাঁড়িয়ে, তখন অবশ্য এত বেশি ভিড় বা গাড়িও ছিল না, তবে গুরুরত্বপূর্ণ রাস্তা ব’লে সিগ্ন্যাল ব্যবস্থা ছিল – সেটা একজন ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে থেকে সামাল দিত। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশের ইশারার অপেক্ষা করছি, সঙ্গে বাঁদিকে স্ত্রী, ডানদিকে ডানপিটে ছেলে, তখন বছর পাঁচেকের। হঠাৎ ডান হাতে টান, ঘুরতেই দেখি একটা বাচ্চা ভিখারি হাত ধরে টানছে, আর তখন চোখে পড়ে খোকা হাত ছেড়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেছে বেশ কিছুটা – এগিয়ে আসা গাড়ির বিপদ সম্পর্কে কোনও ধারণা ছাড়াই। ছুট্‌টে সরিয়ে আনতে যাই – খোকাকে বাঁচাতে পারি, নিজেকেও; শুধু ডান পা-টাকে বাঁচাতে পারি না। সেই খোকার বৌ এখন বুড়ো, খোঁড়া শ্বশুরকে বাজারে পাঠায়; একা! খোকা জেনেও না জেনে থাকার ভাণ করে থাকে। রাণু বেঁচে থাকতে আর কোনদিন রাস্তাটা একা পাড় হতে হয়নি। প্রথমদিকে নিজে সঙ্গে এসেছে আর খোকা বড় হতে খোকাকে সঙ্গে পাঠিয়েছে। খোকার বিয়ের পর রাণু আবার আমার সঙ্গী হত, তখন সে-ও ঝারা হাত পা! তখন আমার বেশ ভালই লাগত ওপারের থেকে বাজার করে আনতে। কিন্তু রাণুর চলে যাওয়ার পর…
 
নাহ্‌, এবার বর্তমানে ফেরা দরকার। আড়াই মিনিট হয়ে গ্যাছে, ভিড় বাড়ছে, বাড়ছে উৎকন্ঠা আর ওদিকে এখনও ব্যান্ড গেয়ে চলেছে ‘বাসস্টপে কেউ নেই কোথাও, কেউ নেই কোথাও’। ডানদিকে ক্র্যাচটা ভাল করে বাগিয়ে ধরে নিয়ে দাঁড়াই। এবার একদম রাস্তার মুখেই, আমার আগে আর কেউ নেই। সিগ্ন্যাল হলেই লক্ষ্যে দেব হাঁটা। সময় হয়ে এসেছে – পাঁচ, চার, তিন, দুই, এক – সবুজ আলো – ডান হাত ধরে টান। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুরে তাকাই – ‘বাবা, তুমি একা? এখানে? চল তোমাকে রাস্তাপার করে দিই’। খোকা হাত ধরে রাস্তাপার করাতে থাকে, ওদিকে তখন গানটা শেষ হয়ে গেছে।


লেখকের কথা: ইচ্ছেমৃত্যু
জন্ম বর্ধমানের বর্ধিষ্ণু গ্রামে। পেশায় নরম তারের কারিগর আর নেশায় – রীতিমত নেশাড়ু, কী যে নেই তাতে – টুকটাক পড়াশোনা, ইচ্ছে হলে লেখা – সে কবিতা, গল্প, রম্যরচনা, নিবন্ধ যা কিছু হতে পারে, ছবি তোলা, বাগান করা এবং ইত্যাদি। তবে সব পরিচয় এসে শেষ হয় সৃষ্টিতে – পাঠক যেভাবে চিনবেন চিনে নেবেন।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

2 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।