লেখক : রাহুল দাস
গত সপ্তাহে এসেছি বোলপুর, অর্থাৎ শান্তিনিকেতনে। আমি প্রায়শঃই চলে আসি এখানে; নাগরিক সভ্যতার বিষবাষ্পে যখন দম আটকে আসে, সামাজিক দূষণ দেখতে দেখতে যখন চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে, মন যখন হতাশ হয়ে উদ্ভ্রান্ত পাগলের মতন লাগে, যখন দরকার পড়ে এক মুঠো শান্তির, তখনই আমি চলে আসি রবি ঠাকুরের একান্ত কাছে, ‘আমাদের শান্তিনিকেতন’-এ।
এরই মধ্যে একদিন হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। অ্যালার্ম ঘড়িটা দেখলাম শান্ত হয়ে প্রহর গুনছে। এখনও আমায় ডেকে দেওয়ার সময় হয়নি তার, তবুও সে সময় জানিয়ে দিলো তিনটে বেজে চল্লিশ। পুনরায় ঘুমানোর চেষ্টা ব্যর্থ হবে জেনে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। ফ্রেশ হয়ে সেই পছন্দের সাদা রঙের বোতামের কাছে কাজ করা পাঞ্জাবিটা পড়ে নিলাম। তার দেওয়া প্রথম উপহার ছিল; আজও সেটি গায়ে জড়ালে তাকে উপলব্ধি করি, মনে হয় সে যেন আমারই কাছে, হৃদয়ের কাছে রয়েছে।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। হেমন্তের শিশির ভেজা ভোরবেলা, চারিদিকে তখনও আঁধার কেটে সকালের পবিত্র ঊষাময়ী আলো এসে পৌঁছায়নি, ল্যাম্পপোস্টের আলো গুলি হালকা কুয়াশার মাঝে এক আলোআঁধারি পরিবেশ রচনা করেছে, তার মধ্যে শান্তিনিকেতনের নিজস্ব সৌন্দর্য্য। সব মিলিয়ে এক মায়াবী পরিবেশ, প্রকৃতির এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করছিলাম।
কখন যে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে এসেছি বুঝতে পারিনি। খালি মনে হচ্ছিল এমন নির্জনতা, নীরবতা কতদিন পাইনি। চারিদিক ছাতিম ফুলের গন্ধে ভরে গেছে । ছাতিমের মাতাল গন্ধে কেমন জানি ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছি, হঠাৎ চমকে উঠলাম। দূরের নির্জন আলো আঁধারির মাঝে এক পরিচিত মূর্তি দাড়িয়ে আছে।
তখনও পুরোপুরি ভোরের আলো ফোটেনি। হালকা কুয়াশার মাঝেও স্পষ্ট দেখলাম সে দাঁড়িয়ে, আমার প্রথম এবং সর্বোচ্চ ভালোবাসার মানুষ। সে আমায় ডাকলো তার দেওয়া ডাকনাম ধরে, “রুবি! ও রুবি, কতক্ষণ ধরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি বলতো!” আমি নির্বাক শ্রোতা। কিছু বলার আগেই সে বললো, “চলো এবার, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছো কেনো, আগে কখনো আমায় দেখোনি?” আমিও কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছি। আমি বললাম “হ্যাঁ হ্যাঁ, চলো। তোমাকে এতক্ষণ এরকম একাকী জায়গায় আমার অপেক্ষা করানোর জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।”
আমরা একসাথে হাঁটা শুরু করলাম ধীরগতিতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি এতদিন ছিলে কোথায় বলতো? তুমি জানো তো আমার একা থাকতে ভালো লাগে না।” “একদিন সবাইকে একা হয়ে যেতে হবে রুবি। একা থাকা অভ্যাস করো। এই পৃথিবীতে সবাই এসেছে একা, আবার প্রকৃতির নিয়মে একাই চলে যাবে। মাঝে যাদের সাথে দেখা, পরিচয়, সবই তো জীবনযাত্রার এক একটি মাইলস্টোন।” আমি একটু বিরক্তির সুরে বললাম, “এটা তোমার দর্শনের ক্লাস নয়, ম্যাডাম। এইসব তুমি ছাড়ো তো। তোমায় আমি আর কোথাও যেতে দেবো না, হ্যাঁ, কোথাও যেতে দেবো না।” সুন্দর মুখে এক ফালি চাঁদের মতন হাসি ফুটে উঠলো। সে বললো, “আমি কোথায় গেছিলাম বলতো, আমি তো সর্বদা তোমার পাশেই আছি। চলো ঐদিকে যাওয়া যাক।”
হাঁটছি, কিন্তু মনের ভিতর কেমন জানি ছেড়ে যাওয়ার ভয়, কোনো কিছু হারানোর ভয় ঘিরে ধরছে। একটু সামনে যেতেই আমি তার সেই কোমল হাতটি ধরতে গেলাম, তখনই একটা বিহান বেলার পাখি মিষ্টি ভাবে ডেকে উঠলো। দেখলাম আমি একা, একা দাড়িয়ে আছি। মণিদীপা আমার পাশে নেই। আমি অনুসন্ধিৎসুভাবে চারিদিকে খুঁজলাম তাকে, কিন্তু পেলাম না।
ভোরের আলো ফুটে গেছে, চাষীবন্ধুরা মাঠে এসেছে, সবাই নিজেদের কাজে ব্যাস্ত হয়ে উঠছে বেলার সাথে তাল মিলিয়ে। আমি উদভ্রান্তের মতন ঘরে ফিরছি। শান্তিনিকেতনের মধুর সকাল যেন আমায় এক নিমিষের মধ্যে নিয়ে গেলো বিরহ বেদনার অন্তঃপুরে। তবে নিজের কাছের মানুষের জন্য বিরহও যেন মধুর হয়ে ওঠে। রবি ঠাকুরের সেই গানটা মাথায় আসছিল, “ বিরহ মধুর হলো আজি..।” আমি ধীরে ধীরে ঘরের দিকে ফিরলাম।
আমি ঘরে এসে বেসিন থেকে চোখে মুখে হালকা জলের ঝাপটা দিলাম। চোখে মুখে জল দিতেই কেমন জানি ঘোরটা কেটে গেলো, মনে হলো কোনো ভারী বস্তু শরীর থেকে যেন নেমে মিশে গেলো মাটিতে। হালকা লাগছিল খুব। একতলার বারান্দার দিকে গেলাম ধীর পায়ে। বারান্দায় যেতে যেতে বলরামদাকে ডাক দিয়ে এক কাপ চা দিতে বললাম, যদিও বলাইদা বলেই ডাকি সবসময়।
বারান্দায় গিয়ে দেখলাম সামনের ছোট্ট গাছে কয়েকটা পাখি বসে অজানা ভাষায় কোনো গান গাইছে, তবে সুরটা বড়ই মিঠে। বলাইদা চা আনতে আনতে আমি রেডিওটা চালিয়ে দিয়ে সেই রকিং চেয়ারে এসে বসলাম। বসে বসে ভাবছি কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো, আর নিজেকে কেমন জানি বোকা বোকা লাগছে। যে মানুষটা আজকে এক বছর হলো আমায় ছেড়ে গেছে, নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে আমায়, সে মানুষটা আসবে কোত্থেকে? গত বছর দুরারোগ্য ক্যান্সারে মণিদীপা ছেড়ে গেছে আমায়। ওর মুখে অনেকদিন শুনেছি মৃত্যুর পরে সব মিশে যায় পঞ্চভূতে। আবার ওই পঞ্চভূতেই নাকি দেহ গড়ে। দর্শনের দিদিমণির কোন কথা বুঝতাম, আবার কোন কথা জিজ্ঞেস করলে হেসে উড়িয়ে দিত। হয়তো মণি পাড়ি দিয়েছে কোন এক অজানা দেশে, না ফেরার দেশে। সে কিছুক্ষণ আগে আমার সাথে থাকবে কিভাবে !
আসলে ভালোবাসা মনে হয় এমনিই হয়। যাকে অন্তর দিয়ে, নিজের সর্বস্ব দিয়ে উজাড় করে ভালোবাসা যায়, সে হয়তো কখনোই ছেড়ে যায় না। সে হয়তো তার দু’দিনের ঘর ছেড়েছে ঠিকই, কিন্তু আমায় ছেড়ে সে এখনও যায়নি, সেটা আমি বুঝতে পারি। সর্বোপরি সে ছেড়ে যেতে পারে না, সে আমার হৃদয়ের মণিকোঠায় বাস করছে নিভৃতে, নিরালায়।
রেডিওটা গুন গুন করে বাজছে। শান্তিনিকেতনের শান্ত, স্নিগ্ধ এক সকাল বেলায় রেডিওতে রবি ঠাকুরের গান বাজছে। সব মিলিয়ে আমি বার বার হারিয়ে যাচ্ছি আমার সেই ভাবনার জগতে। আমি এই ঘোরের মধ্যে থেকে বেরনোর জন্য খবরের কাগজটা মুখের সামনে খুলে বসলাম। রবিবাসরীয়তে ডুবে গেছি, খেয়াল নেই বেলা কত হলো। হঠাৎ দরজার কাছ থেকে বলাইদার ডাক কানে এলো, “রবিন, সকাল গড়িয়ে তো দুপুর হইলো, জলখাবার খাইয়া আর লাভ নাই তুমার। তুমি একবারে দুপুরের খাওয়া খাইও! আমি কাগজ থেকে মুখ তুলে বললাম, “বলাইদা, আসছি আমি, তুমি যাও। তুমি খেয়েছো ?” উত্তর এলো,“না! এমন কোনদিন হইছে যে তুমার আগে আমি খাইছি। আর কথা বাড়াইও না দেখি, তুমি তাড়াতাড়ি আইসো তো। আমি নীচে গেলাম।”
বলাইদা বিড়বিড় করতে করতে নীচে নেমে গেলো । এই মানুষটা সেই কত বছর ধরে যে আমায় আগলে রেখেছে। কি স্নেহ, মায়া এনার মধ্যে বলে শেষ করা যায়না। মণি খালি বলতো, “বলাইদা, তুমি তোমার রবিনকে একটু ছাড়ো, এত মায়া ভালো না! একটু ওকে বড়ো হতে দাও!” বলাইদা হেসে বলেছিল, “ও আমার কাছে সারাজীবন ছোটই থাকবে গো দিদিমণি।”
চেয়ার ছেড়ে উঠছি নীচে আসবো দেখে, হঠাৎ রেডিওর দিকে মন গেলো। রেডিওতে শুনলাম, “আকাশবাণী গীতাঞ্জলির এবারের নিবেদন রবীন্দ্রনাথের আরেকটি গান।” গানটি শুরু হলো। গানের কিছু কথা কানে যেনো বড্ড বাঁধলো –
“আমার প্রাণের ‘পরে চলে গেল কে
বসন্তের বাতাসটুকুর মতো।
সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে-
ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত।
সে চলে গেল, বলে গেল না – সে কোথায় গেল ফিরে এল না..”
আমি ভাবতে লাগলাম, আমার মনের ভাবনা কিভাবে মিলে গেলো গানটির সাথে। এই বুঝি হয়, মানুষ সর্বদা যা ভাবে, তাইই ঘটে তার সাথে। এক্ষেত্রেও বুঝি তাই ঘটেছে।
মাথায় আকাশকুসুম আসছিল, তাকে তোয়াক্কা না করে নীচে যাচ্ছি জলখাবার খেতে, হতঠাৎ কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কেউ বলে উঠলো, “আমি তো কোথাও যাইনি, এইতো আমি তোমার সাথে, তোমারই মাঝে রয়েছি। বলেছিলাম তো সকালে, প্রমাণ পেলে তো এবার! আর একাকী নয়, মন খারাপকে ছুটি দিয়ে দাও তো দেখি। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হওয়ার আগেই নীচ থেকে বলাইদার ডাক, চমকটা কেটে গেলো।
যতই আমি সিড়ি ভেঙে নীচে যেতে লাগলাম, স্বরটা ধীরে ধীরে দূরে যেতে আরম্ভ করলো। শুধু একটা কথারই প্রতিধ্বনি হতে থাকলো, “এইতো আমি, এখানেই আছি”। আমি নীচে যেতেই শব্দটুকু শান্তিনিকেতনের বাতাসে মিশে গেলো। আমার আর শেষবারের মতন উত্তরটুকু দেওয়া হলো না।
ভালো থেকো মণি।
লেখক পরিচিতি : রাহুল দাস
বর্তমানে ছাত্র। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ইতিহাস বিভাগে পাঠরত। ভালো লাগে বই পড়তে, ঘুরতে, আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে চর্চা করতে, আর টুকটাক লেখালেখি।
খুব সুন্দর 😌
সত্যিই খুব সুন্দর হয়েছে।লেখার বাঁধুনি খুব ভালো।কোনো জড়তা বা জটিলতা নেই লেখায়।