লেখক : ইলা সূত্রধর
হঠাৎ হাত ধরে টানতেই সম্বিত ফিরে এলো নিরুপমার। তাকিয়ে দেখল সামনে দিয়ে একটা গাড়ি হুস করে চলে গেল। নিরু আজকাল এমনই আনমনা হয়ে থাকে । নেহা শাসনের সুরে বলল — “আর একটু হলেই চাপা পড়ে যেতিস। একটু দেখে শুনে রাস্তা পার হবি তো! দেখছিস না ট্রাফিক সিগনালের সবুজ আলোটা জ্বলছে। আর হু হু করে গাড়ি আপ ডাউন করছে !”
নেহা নিরুপমার ছোট্ট বেলার বন্ধু। পাশাপাশি ওদের বাড়ি। দু’জনেই একসাথে পড়াশুনা করত। ছোট বেলা থেকেই দু’জনের হরিহর আত্মা। একই সাথে পুকুরে স্নান করা, একসাথে স্কুলে যাওয়া, টিফিন খাওয়া, খেলা করা, গল্প করা, কোচিং-এ টিউশন পড়তে যাওয়া এমনকি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকও দু’জন একসাথে পাশ করেছে। আবার বিকেল হলেই একসাথে ঘুরতে যাওয়া। এসব না হলে দু’জনেরই পেটের ভাত হজম হতো না।
অথচ এত মিল থাকা সত্ত্বেও সেদিন নিরু একটি কথা লুকিয়ে গেছে নেহার কাছে। কিংবা হয়ত লজ্জায় বলতে পারেনি নিবিড়ের কথাটা। ওদের সাথেই পড়াশোনা করত। দেখতে দেখতে ওর সাথেই কখন একটা মানসিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারপর আস্তে আস্তে সেই সম্পর্ক অনেকটা দূর এগোতে থাকে। নিবিড় মাঝে মাঝেই বলত — “নিরু চলো এই চেনা পরিচিত লোকচক্ষুর আড়াল থেকে দূরে কোথাও ঘুরে আসি।” কিন্তু সে পরিস্থিতি কোথায়। সবাই সবাইকে চেনে। তার উপর সব সময় জোঁকের মতো নেহা ওর সাথে সাথে লেগে আছে। এড়াই কি করে ! আসলে নেহার এই বন্ধু প্রীতিও নিরু আর নিবিড়ের সম্পর্কের অনেকটাই অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে। নেহা কখনোই কোন ছেলেকে তাদের ত্রিসীমানায় ঘেষতে দিত না। কিন্তু নিরু তো নিবিড়কে একান্তভাবে ভালোবাসে। উপায় কিছু খুঁজে পাচ্ছিল না। একদিন সুযোগও এসে গেল তাদের হাতের মুঠোয়। কি একটা কারণ বশত নেহা সেদিন স্কুলে যায়নি। অর্থাৎ সারাদিন নেহা সঙ্গে থাকবে না। তাই এই সুবর্ণ সুযোগ আর কিছুতেই হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। অতএব নিরু সকালে উঠে স্নান খাওয়া সেরে স্কুল যাওয়ার নাম করে আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। তাড়াতাড়ি বেরোবার জন্য এবং আজকের প্রস্তুতি অন্যরকম দেখে মায়ের যেন একটু সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু সংসারের হাজার কাজের ভিড়ে পরবর্তী কালে বিষয়টা একেবারে ভুলেই গিয়েছিল। সেটা আবার দানা বাঁধল উঠল যখন বিকেল পেড়িয়ে সন্ধ্যে থেকে রাত হয়ে গেছে। মায়ের কপালে ক্রমশঃ চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করল। অস্থিরতা ও উত্তেজনায় কেবল ঘর আর উঠোনে পায়চারি করতে লাগল। অনেকটা রাত হয়ে গেল। অবশেষে নিরু ফিরল। বাড়ির গেটের সামনে মা রক্তচক্ষু নিয়ে দাড়িয়ে ছিল। অতপর মায়ের জেরার সামনে ও নানান রকম কথার ফাঁদে নিরু আর কিছুই গোপন রাখতে পারল না। অপরাধ বোধে আর ভয়ে সব বলে ফেলল। সেদিন মায়ের পা জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। সেদিন মা ওকে ঘরে নিয়ে গিয়ে কড়া ভাষায় বলল — “আজ থেকে আমার নির্দেশ ছাড়া ঘর থেকে এক পাও এগোবে না !” এর ফল স্বরূপ পরদিন থেকে নিরুর বাইরে বেরোনো একদম বন্ধ যায়। কিন্তু প্রেম তো কোনো বাধাই মানে না। নিরুর মনে পড়ে গেল সেদিনের ঘুরতে যাওয়ার কথা। নিবিড়ের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ি। তরতাজা যৌবনের স্বাদ সেই প্রথম পেয়েছিল কোন পুরুষের কাছ থেকে। উদ্দাম শরীরের সেই আকর্ষণ সেই নেশা ভুলবে কি করে নিরু। পৃথিবীর সমস্ত ভালোলাগা ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এখন নিবিড়। তাই নিরু একদিন সুযোগ বুঝে নিবিড়ের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল সেই দূর সম্পর্কের আত্মীয়র বাড়ি। অপরের বাড়ি আর কতদিন। বাধ্য হয়েই দু তিন বাদে নিবিড় নিজের বাড়িতে নিরুকে নিয়ে হাজির। অভাবী পরিবার।বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। সবদিন আবার কাজও জোটে না। স্বামী স্ত্রী আর দুই ছেলেমেয়ে এই চার জনের সংসারে কোন মতে দিন অতিবাহিত হয়। তার ওপর নিরুপমা এসে ঘাড়ে জুটেছে। একদিকে নিরুর বাপের বাড়ির স্বচ্ছল অবস্থা অন্যদিকে নিবিড়ের পরিবারের দারিদ্র্য এই অসম বন্টন মনে হয় বেশিদিন মানা সম্ভবপর নয়। তার উপর নিবিড় পুরোপুরি বেকার। তাই প্রেমে বাধা না মানলেও পেট ওদের বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ছেলে নিবিড় তো কোনো কাজ শেখেনি। পড়াশোনা শিখে চাকরি করবে ভেবেছিল। কিন্তু সে আর হোলো কোথায়। সংসারে অভাব অনটন বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অশান্তিও বাড়ছে। এভাবেই চলল প্রায় ছয় সাত মাস।
একদিন নিরু নিবিড়কে ওর বাবার সঙ্গে কাজে যেতে বলল । উত্তরে নিবিড় বলল — “আমি উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে এখন রাজমিস্ত্রির জোগাড় দারের কাজ করব”। নিরু বলল — “কেন না ? তাছাড়া সংসার চলবে কি করে? প্রতিদিন এতো অভাব অনটন আর সহ্য করতে পারছি না।” এভাবে এককথা দু’কথা হতে হতে চরম অশান্তি সৃষ্টি হয়। রাতে কারও খাওয়া দাওয়া কিছু হলো না। পরদিন সকালে উঠে নিবিড় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। সেই যে বেরিয়ে গেল আর ফিরে এলো না। একদিন দুদিন করতে করতে একমাস দু’মাস কেটেই চলছে নিবিড়ের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। নিবিড় নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। এবার পুত্র সন্তানকে হারিয়ে শাশুড়ি সব দোষ নিরুর উপর চাপিয়ে দিয়ে চরম অশান্তি শুরু করে দিল। এবং একদিন নিরুকে বাড়ি থেকে বের করে দিল। অসহায় নিরু কি করবে কোথায় যাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা। ভাবতে ভাবতে বান্ধবী নেহার কথা মনে পড়ল। তখন কাঁদতে কাঁদতে নেহাদের বাড়িতে আসে। এদিকে প্রানের বান্ধবী নিরুর এভাবে পালিয়ে বিয়ে করা নেহাও মেনে নিতে পারেনি। সাথিহারা হয়ে মনের দুঃখে নেহাও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর আর কলেজে ভর্তিই হয়নি। রাগে দুঃখে অভিমানে এতদিনে একবার ও নিরুর সঙ্গে দেখা করেনি।
যাহোক এতোদিন পরে প্রানের বান্ধবী ফিরে আসায় নেহাও যেন প্রাণ ফিরে পেল। দুই বান্ধবী মিলে অনেক কান্নাকাটি করে নিরু নিজের ভুল স্বীকার করে বলল,–“আমায় ক্ষমা করে দে ! আমি তোকে ও কিছু জানাইনি, আমার খুব ভুল হয়ে গেছে ।”
দুই দিন নিরুকে নিজের বাড়িতে রাখার পর, নেহা ওকে সঙ্গে করে ওদের বাড়িতে নিয়ে আসে। প্রথমে তো নিরুর বাবা কিছুতেই মেনে নেবে না। নেহার অনেক কাকুতি মিনতি করাতে আর নিরুর অঝোরে কান্না দেখে মাতৃহৃদয় আর কঠিন হতে পারল না। তাই মা ওর বাবাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে মানিয়ে নিতে বলল। ওদের আদরের হৃদয়ের নিরুকে বাবা মা বুকে জড়িয়ে ধরলো।
নেহা আর নিরু দুই বান্ধবী আবার কলেজে ভর্তি হলো। কিন্তু নিরু আর আগের মতো প্রাণোচ্ছ্বল রইল না। মাঝে মাঝেই কেমন যেন আনমনা হয়ে কোথায় হারিয়ে যায়। ঠিক সেদিনও কলেজে যাওয়ার সময় ওমনি আনমনা হয়ে হাঁটছিল। নেহাত সঙ্গে নেহা ছিল তাই এযাত্রায় বেঁচে গেল। ট্রাফিক সিগন্যাল এ সবুজ আলো না লাল আলো নাকি হলুদ আলো জ্বলছে সেদিকে নিরুর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। নেহা জিজ্ঞেস করল — “বলত রাস্তায় লাল, হলুদ ও সবুজ আলো জ্বলা ও নেভার কারণ কি জানিস ?” নিরু উত্তর দিল — “লাল আলো জ্বলার অর্থ রাস্তায় গাড়ি বন্ধ থাকবে। আর সবুজ আলো জ্বলার অর্থ রাস্তায় গাড়ি চলতে শুরু করবে। আর হলুদ আলো কেন জ্বলে সে তো আমার জানা নেই।” নেহা বলল — “হলুদ আলোর অর্থ হল আগাম সংকেত সতর্ক করে দেওয়ার। এখন রাস্তায় গাড়ি আর এগোবে না। পাশাপাশি পথচারীদের সর্তক করে দেওয়ার জন্য হলুদ আলো জ্বালান হয়।”
কথাটা শুনেই নিরু আবার আনমনা হয়ে পড়ে। মনে মনে ভাবে, মা-বাবা আমাকে অনেক সর্তক করেছিল, কিন্তু কই আমি তো শুনিনি।সত্যিই মানুষের জীবন কখনো কখনো যেন ট্রাফিক সিগন্যালের মতো সংকেত বা সতর্ক করে দিয়ে যায়। আমি ভুল রাস্তায় চলতে গেছি তাই তো আমার জীবনে এতো বড় একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেল।
দূর্ঘটনা না ঘটনা আজো হিসাব মেলাতে পারেনা নিরুপমা। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এমনকি বাড়ির সবার নাছোরবান্দা অনুরোধ স্বত্বেও নিরু আর এজীবনে বিয়েতে বসল না। পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামের একটা স্কুলে নিরুপমা দেবী এখন শিক্ষকতা করেন। বছর পঞ্চাশের তিনি এখন সহকারী প্রধান শিক্ষিকা। চুলের গোড়ায় পাক ধরেছে। আজ প্রায় তিরিশ বত্রিশ বছর বাদেও সেই ঘটনার কথা কিছুতেই ভুলতে পারছেনা নিরু। তার জন্যই মনের মানুষটা আজও নিরুদ্দেশ। সে অপরাধ বোধ এখনও কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। তাই মানুষটাকে আজও মনে মনে খুঁজে বেড়ায়। এর মধ্যে একদিন খবরটা নেহাই দিয়ে গেল — ” নিরু তোর নিবিড়ের সন্ধান পাওয়া গেছে ! সে এখন ট্রাইব্যাল এড়িয়ার একটা চার্চের ফাদার।” সেই মতো আজ তার সাথে দেখা করতে চলেছে নিরুপমা। ঝাড়খণ্ডের জামশেদপুরের কাছে নিমডির আদিবাসী অঞ্চল। লাল মাটির দেশ। চান্দ্রিল লেক পাড় হয়ে চলেছে। পথে বৃষ্টি নেমেছে মুষলধারে। লেভেল ক্রসিং-এ গাড়ি দাড়িয়ে আছে। গাড়ির বাঁদিকের জানলার কাচটা নামাতেই বৃষ্টির ছাট গাড়ির ভিতরটা ভিজিয়ে দিল। ড্রাইভার বলে উঠল — “ম্যাডাম একেবারে ভিজে যাবেন কাচটা তুলে দিন।” আজ সে বাধা কিছুতেই মানল না নিরুপমা। দূরের সিগনাল সবুজ আলোটা আজ আবার জ্বলে উঠেছে। অসংখ্য বৃষ্টির জলকণাগুলো সেই সবুজ আলোয় মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। সেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির মধ্যে আপের দূরপাল্লার ট্রেনটা মনের ভিতর আবেগটাকে নাড়িয়ে দিয়ে চলে গেল !
লেখক পরিচিতি : ইলা সূত্রধর
নাম- ইলা সূত্রধর ; জন্ম- ২৭ এপ্রিল ১৯৭২ ; বাংলাদেশের রাজশাহি জেলা; শৈশবেই পিতা মাতার হাত ধরে দেশ ছাড়া, বর্তমানে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট নিবাসী, একজন গৃহবধূ; সংসারের একঘেয়েমি কাটাতে লেখালেখি ।
পাঠ সংখ্যাঃ 70
ভালো লাগলো।
ভালো লাগলো…