সে ছিল

লেখক : দেবাশিস চৌধুরী

অফিস থেকে ফিরে ঘামে ভেজা জামাটা কোন রকমে ছেড়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয় কিংশুক। সারাটা দিনের পরিশ্রমের ধকলটা যেন তার সমস্ত শক্তি নিংড়ে নিয়ে ছিল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সিলিঙে বনবন করে ঘোরা পাখাটার দিকে। ঘূর্ণায়মান পাখাটার ব্লেডগুলো আলাদা করে দেখার চেষ্টা করছিল।

একটা মিষ্টি সুগন্ধের ঘ্রাণ পেল আচমকা। বেশ জোরালো মন মাতানো গন্ধটা। অনেকটা কোন লেডিজ প্রসাধনের মতন। গন্ধটা ক্রমে তীব্র হতে থাকল। মনে হল খুব কাছেই কোন মহিলার যেন উপস্থিতি। তার একাকী এই এক কামরাওলা ভাড়া বাড়িটাতে।

ধড়মড় করে বিছানাতে উঠে বসে আশেপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। কই কেউ তো নেই। ঘরেতে আসবাবপত্রও তেমন নেই যে তার আড়ালে কেউ লুকিয়ে থাকবে। এই সিঙ্গল খাটটা, একটা ছোট টেবিল আর দুটো চেয়ার ছাড়া আর কিছুই তেমন নেই ঘরটাতে। খাট থেকে নেমে তার তলাটা একবার উঁকি মেরে দেখে নিল কিংশুক। না, এখানেও কেউ নেই। খানিকটা নিরাশ হল যেন। সুগন্ধটা তখনও পরিষ্কার ভাবে নাকে আসছিল।

ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হয়। সুগন্ধটা এইখানে আরও তীব্র। ছোট রান্নাঘরেও কাউকে আবিষ্কার করতে পারল না। তবে কি এটা তার মনের ভুল? সে কি স্বপ্ন দেখছে নাকি তাহলে? নিজের গায়ে চিমটি কেটে পরখ করে দেখল একবার। নাঃ, এ তো বাস্তব। তাহলে কি বাড়ির বাইরে কেউ …।

দ্রুত পা ফেলে বাড়ির বাইরেটাতে এসে দাঁড়াল। গন্ধটা এখানে কিন্তু এতটুকুও পাওয়া যাচ্ছিল না। কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতন ঐ স্থানেই দাঁড়িয়ে রইল কিংশুক। ব্যাপারটার কোন ব্যাখা যেন ছিল না তার কাছে। পুনরায় ঘরেতে প্রবেশ করতে আবার সুগন্ধটার তীব্র ঘ্রাণ তার নাকে এল।

মূর্ছা যাবার মতন অবস্থা তখন তার। স্পষ্ট বুঝতে পারছিল ঘরেতে কোন অশরীরীর উপস্থিতি। ভূতে ও তেমন একটা বিশ্বাস করে না বটে, তবে একেবারে অগ্রাহ্যও করে না তাঁদের অস্তিত্ব। মনে সাহস সঞ্চয় করে স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘ঘরেতে কেউ আছেন?’

শান্ত চারিপাশ। কোন জবাব এল না কোথাও থেকে। শুধু জানলার পর্দাগুলো জোরে একবার দুলে উঠে স্থির হয়ে যায়। কিংশুক সেটা লক্ষ্য করে ছিল। আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কে আপনি? জবাব দিন। আপনি কি কোন মহিলা?’

পর্দাটা আবার নড়ে উঠল। খানিকটা আশ্চর্য হল কিংশুক। ভাবল পাখার হাওয়ায় দুলছে বুঝি পর্দাটা। এগিয়ে গিয়ে পাখার সুইচটা বন্ধ করে দেয়। ঐ স্থানে দাঁড়িয়েই আবার প্রশ্ন করে, ‘আপনি কি এই ঘরেতে উপস্থিত আছেন এখন?’

প্রশ্নটা করেই কিংশুক উদগ্রীব হয়ে তাকায় জানলার পর্দাগুলোর দিকে। অবাক হয়ে দেখে যে তার প্রশ্ন শেষ হবার পর মুহুর্তেই পর্দাগুলো আবার দুলতে থাকে। হতবাক হয়ে স্থানুর মতন দাঁড়িয়ে থাকে কিংশুক। এইবার ও নিঃসন্দেহ হয় যে এই ঘরেতে কোন অশরীরীর আগমন হয়েছে। কোন কথা না বলে খাটেতে গিয়ে ধপাস করে বসে পড়ে। দেওয়ালে হেলান দিয়ে আকাশকুসুম কল্পনা করতে থাকে। তার একাকীত্ব জীবনে ভাল সাথীই জুটেছে তাহলে, শেষমেশ এক অশরীরী। মন্দ নয়।

নিজের অজান্তে কখন বলতে থাকে, ‘তোমার নামটা আমি জানি না। তুমি বলতেও তো পারবে না। তবে আমার মনে হয় এত সুন্দর সুগন্ধ যার, বাস্তবে সে নিশ্চয় খুব সুন্দরী। তাই না? আমি ভুল বলিনি তো?’

কোন জবাব কোথাও থেকে এল না। তার আশাও করেনি কিংশুক। শুধু জানলার পর্দাগুলো দুলে উঠল। এইবার বেশ জোরে। যেন খিলখিল করে হেসে উঠল অশরীরী।

উত্তরের মাধ্যমটা আবিষ্কার করতে পেরে বেশ মজা লাগল কিংশুকের। ‘হুম, ঠিক ধরে ছিলাম। মিষ্টি সুগন্ধ, সুন্দরী… তাহলে তোমার নাম নিশ্চয় বকুল। হ্যাঁ, হ্যাঁ বকুল ছাড়া আর কিই বা হতে পারে। আমি ঠিক বলিনি?’

আবার পর্দাগুলো জোরে ঝাপটা মারতে থাকল। অশরীরীর যেন খুশির সীমা নেই। তার প্রকাশ যেন উপছে ছড়িয়ে পড়ছিল ছোট ঘরটাতে। সহসা ঘরটা যেন আনন্দ মুখরিত হয়ে উঠল। কিংশুকের একঘেয়ে অন্ধকারময় জীবনে যেন দুম করে আলোর বন্যা এসে ভাসিয়ে দিল সব কিছু। জীবনে এতটা সুখ সে কখনোই অনুভব করেনি। সজোরে প্রাণ খুলে হেসে উঠল ও, অনেকদিন বাদে।

‘তুমি তো আমাকে ডাকতেও পারবে না আবার কথাও বলতে পারবে না আমার সাথে। সে যাক গে, তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আমার কথা শুনতে যে পাচ্ছ তাই যথেষ্ট। আমিই না হয় বলব। তুমি শুধু তোমার প্রতিক্রিয়া জানিও। ঠিক যেমনটা পর্দা নাড়িয়ে জানিয়ে আসছ।’

খানিক থেমে কিংশুক আবার বলতে থাকল, ‘জানো বকুল, কেউ আমার সাথে কথা বলে না। সবাই এড়িয়ে যায়। আমি নাকি ভীষণ একঘেয়ে এক প্রাণী, অসামাজিক। সত্যিই কি আমি তাই? বলো না তুমি?’

কিংশুক লক্ষ্য করে পর্দাটা একপাশ থেকে অপরপাশে মৃদু দুলছে। ঠিক যেন কেউ মাথা নাড়িয়ে না বলছে। খুশি হয় সে। বলে, ‘দেখো, এই ক্ষণিকের পরিচয়ে তুমি আমাকে ঠিক চিনতে পারলে। অথচ এই পৃথিবীতে অন্য কেউ কোনদিনও আমাকে চিনতে পারল না। আমি চট করে মানুষজনের সাথে মিশতে পারি না, সময় লাগে আমার। এটাই কোনদিনও কাউকে বোঝাতে পারিনি। সবাই তাচ্ছিল্য করে আমাকে। তাই তো সব সময় নিজেকে গুটিয়ে রাখি। তবে আর নয়। এখন আমি আর কাউকে তোয়াক্কা করি না। এখন আমি আমার নতুন সাথী পেয়ে গেছি। ঠিক আমার মনের মতন। আমার প্রিয় বান্ধবী, বকুলকে। তুমি আমাকে পছন্দ কর তো বকুল?’

আগের মতন নড়ে উঠল আবার পর্দাটা। তাই দেখে স্বস্তি পেল কিংশুক। মনটা একটা অজানা খুশিতে ভরে উঠল ওর। এতটা খুশি, আনন্দ ওর জীবনে আগে কখনও আসেনি। সন্ধের প্রতিটা ক্ষণ উপভোগ করতে থাকল। তার জীবনের প্রথম প্রেম। প্রথম কোন নারীর সান্নিধ্য লাভ করল ও। যে পৃথিবীটা এক সময় ওর একঘেয়ে, বাসের অযোগ্য মনে হত, সেটাই যেন ওর কাছে স্বর্গের মতন লাগছিল এখন। এই সন্ধেটা যেন তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে না যায়, মনে মনে এমন কামনাই করছিল কিংশুক।

‘জানো বকুল অফিসে কেউ আমার সাথে কথা বলে না। আমার বস তো যেন সব সময় আমার ওপর খিঁচিয়ে থাকে। সবাই কটূ কথা বলে আমায়। আমি নাকি অকর্মা, আমার দ্বারা নাকি কিছুই হবে না। অথচ আমাকে দিয়ে সবাই নিজেদের কাজগুলো করিয়ে নেয়। আমি মুখ ফুটে কাউকে মানা করতে পারি না। আমি খুব বোকা, তাই না বকুল?’

কিছুক্ষণ দুলতে থাকা পর্দাটা দেখার পর কিংশুক বলল, ‘তুমি হাসছ বকুল? মজা পাচ্ছ। তাই না? আমি নিশ্চিত জানি আর যে যা খুশি আমার সম্বন্ধে ভাবুক না কেন, তুমি আমাকে মন্দ ভাবো না। ঠিক বলিনি? তোমার আর আমার মনের মিল খুব। তাই তো তোমাকে এত ভাল লাগে আমার।’

খানিকটা ক্ষণ কিংশুক চুপ করে তাকিয়ে থাকে পর্দাটার দিকে। ‘তোমার চোখ দুটৌ খুব সুন্দর বকুল। ঠিক যেন নীল ঝিলের মতন। মনে হয় এমন ঝিলে শরীরটাকে ডুবিয়ে দিই। তারপর ডুবতেই থাকি। গভীরে আরও গভীরে, আরও অনেক গভীরে। কখনই না ভেসে উঠি উপরে। এই ঝিলে ডুবতেও আনন্দ।’

‘আর কতক্ষণ বকবক করবে? রাতে খাবে না কিছু? তুমি তো রান্না করতে পারবে না। কাজটি তো আমাকেই করতে হবে। ভীষণ ক্ষিদে পেয়ে গেছে। বলো কি খাবে? রান্নার হাতটা আমার নেহাত মন্দ নয়। খেলে পরে আঙ্গুল চাটবে, এমন গ্যারান্টি আমি জোর গলায় দিতে পারি। বুঝলেন ম্যাডাম।’

জামাকাপড়টা বদলে, স্নান সেরে কিংশুক রান্নাঘরেতে এল। চড়া সুগন্ধে, ও বকুলের উপস্থিতি অনুভব করতে পারল সেখানে। মনটা অজানা এক খুশিতে পুলকিত হয়ে উঠল। অনেক পদ রান্না করার ইচ্ছে হচ্ছিল ওর। কিন্তু তার রাঁধার রসদ সীমিত। নিজের জন্য কখনও পঞ্চব্যঞ্জন রান্না করার তাগিদ অনুভব করেনি কোনদিনও। স্রেফ পেটটা ভরাবার জন্য বাঁধাধরা সামান্যই রান্না করে রোজ। ভালমন্দ খাওয়ার অভ্যাস ও ইচ্ছেটা কবে চলে গিয়ে ছিল তার জীবন থেকে। 

কিন্তু আজ তার জীবনে পরিবর্তন এসেছে। সব কিছু নতুন ভাবে ভাবতে যেন অনুপ্রেরণা দিচ্ছিল কোন এক অজ্ঞাত শক্তি। আচমকা কোথা থেকে দমকা বাতাসের মতন অযাচিত ভাবে তার জীবনে প্রবেশ করে ছিল বসন্ত। তার প্রথম প্রেম। নিজের এই পরিবর্তনে বেশ অবাক লাগছিল ওর। এসব কিছুই যে তার জীবনে বকুলের প্রবেশের ফলে সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না ওর। জীবনটা যে কত সুন্দর এই প্রথমবার যেন টের পেল কিংশুক। হয়ত এইখান থেকেই বাঁক নেবে তার জীবনধারা। এরপর থেকে যা ঘটতে থাকবে হয়ত সবই তার হিতের জন্য।

‘গরীবের ঘর বকুল। ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। নুন আনতে পান্তা ফুরাবার মতন অবস্থা আমার সংসারের। তবে তুমি যখন এসে পড়েছ আমার জীবনে, তখন সব কিছু বদলে ফেলব। খুব খারাপ লাগছে বকুল জানো, বড় মুখ করে জিজ্ঞেস করলাম তোমাকে। আর বাস্তবে কিছুই খাওয়াতে পারছি না। আজকের দিনটা একটু মানিয়ে নাও। কথা দিচ্ছি, কাল তোমাকে অনেক কিছু রেঁধে খাওয়াব।’

দুজনের মতন রান্না করল কিংশুক। সামান্য কিছুই রাঁধতে সমর্থ হয়ে ছিল। দুটো প্লেটে খাবার সাজিয়ে এসে বসল টেবিলে। দুটো গ্লাসে জল ঢেলে বলল, ‘নাও বকুল শুরূ করো। জানি না, আমার হাতের রান্না তোমার কেমন লাগবে। খারাপ লাগলে মানিয়ে নিও। জানি, মুখ ফুটে তুমি কোন নালিশ করবে না। তেমন মেয়েই তুমি নও।’

খেতে খেতে জানলার পর্দাগুলোর দিকে তাকায় কিংশুক। দেখে বেশ বেগে দুলছে সেগুলো। আনন্দে চকচক করে ওঠে ওর মুখমণ্ডল। ‘আমার রান্না তোমার ভাল লেগেছে। জেনে খুশি হলাম বকুল। অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে। জানো, কেউ আমার বাড়িতে কোনদিনও আসেনি। তোমার আগে কাউকে আমি নিজের হাতের রান্না খাওয়াইনি কখনও। আজ সত্যিই আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। তুমি খুব ভাল বকুল। আমাকে ছেড়ে কখনও চলে যাবে না তো?’

আবার পর্দাগুলোর দিকে ফিরে তাকায় কিংশুক। পর্দাগুলো মৃদু দুলে যেন ঘাড় নাড়ছিল। খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কিংশুকের মুখ। ‘আমি জানতাম। আমি ঠিক জানতাম যে তুমি কোনদিনও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না। আমি বড় নিঃসঙ্গ বকুল। একদিন আমাদের সংসার হবে, নিজস্ব ঘর হবে। দেখো আমরা দুজনে খুব সুখে থাকব। খুব ভালবাসব আমি তোমাকে, ঠিক যেমনটা তুমি আমাকে বাসো। সারাটা জীবন এই দুটো হাত দিয়ে আগলে রাখব তোমাকে। দুনিয়ার কোন শক্তি আমাদের আলাদা করতে পারবে না। দেখে নিও তুমি।’

বিছানাতে শুতে না শুতেই কিংশুকের চোখে ঘুম এসে যায়। অজানা কারুর যেন স্পর্শ অনুভব করতে পারছিল সারা শরীরে। নরম আঙ্গুলের স্পর্শে শরীরের সব ক্লান্তি যেন নিমেষে দূর হয়ে গেল ওর। একটা পরিতৃপ্তির ছোঁয়ায় জুড়িয়ে গেল তার মন ও প্রাণ। তার সমস্ত সত্তা যেন বারেবারে তাকে জানান দিচ্ছিল যে বকুল আছে। তার খুব নিকটে, চিরদিনের জন্য।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে বেশ তরতাজা লাগছিল কিংশুকের। অন্যান্য দিনের মতন গতানুগতিক মনে হচ্ছিল না জীবনটা। বিছানাতে উঠে বসে জিজ্ঞেস করে, ‘বকুল উঠে পড়েছ?’

ভোরের নরম সূর্যের আলো তখন প্রবেশ করছিল ঘরেতে। অন্য রকম লাগছিল যেন ঘরটা। বেশ বড় আর উজ্জ্বল। ভাল করে তাকাল জানলার পর্দাগুলোর দিকে। কই আগে তো এতটা পরিষ্কার লাগত না ওগুলো। রাতারাতি বদলে গেল কি ভাবে? তবে কি বকুলের ছোঁয়ায়? নিশ্চয় তাই। তার ঘরে লক্ষ্মীর আগমন হয়েছে যে। জীবনের সব কিছু এরপর বদলে যাবে। দ্রুত উন্নতির সোপান বেয়ে সে প্রমাণ করবে নিজের যোগ্যতা। অকর্মণ্য বলে যারা তাকে একদিন ভর্ৎসনা করত, তাদের যোগ্য জবাব দেবে এইবার।

সকালের জলখাবারটাও দুজনের মতন বানিয়ে টেবিলে খেতে বসল কিংশুক। ‘আমি অফিসে চলে গেলে তোমার নিশ্চয় খুব একলা লাগবে। তাই না বকুল? একটু মানিয়ে নিও। কথা দিচ্ছি, তাড়াতাড়ি ফিরব। তারপর দুজনে মিলে সিনেমা দেখতে যাব। হাত ধরাধরি করে হলেতে বসব। তুমি সিনেমা দেখো। আমি কিন্তু শুধু দেখব তোমাকে। শুধুই তোমাকে। এরপর আমরা বাইরে কোথাও খাব। আমার অনেক দিনের সাধ। আর তুমি সঙ্গী হলে তো অতি অবশ্যই। না বলতে পারবে না কিন্তু। আমি চলি। অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে। সাবধানে থাকবে তুমি।’

দরজাতে তালা লাগিয়ে কিংশুক কয়েক পা এগিয়ে বাড়ির দিকে মুখটা করে অদৃশ্য কারুর উদ্দেশ্যে হাত নাড়ে। তার জীবনের প্রথম সাথী বকুলের দিকে।

সন্ধেতে অফিস থেকে ফিরে বিরক্ত ভাবে কোনরকমে জামাটা খুলে ছুঁড়ে আছড়ে ফেলে মাটিতে। জুতো জোড়াও পা থেকে টেনে খুলে আছড়ে মারে সেই সাথে। শরীরটাকে এলিয়ে দেয় বিছানাতে। একটা হাত আড়াআড়ি ভাবে কপালের উপর রেখে চোখ বন্ধ করে মড়ার মতন একভাবে শুয়ে থাকে।

কিচ্ছু যেন ভাল লাগছিল না ওর। সারা দিনের বিচ্ছিন্ন কয়েকটা ঘটনা মনে পড়ে যেতে থাকল। বকুলের চিন্তায় এতটাই মশগুল ছিল যে কাজে বিরাট কতকগুলি ভুল করে ফেলে অফিসে। তার ফলে ওর বস ক্ষেপে গিয়ে ওকে চাকরি থেকে তৎক্ষণাৎ বরখাস্ত করে দেয়। অফিসের কেউই ওকে সমর্থন জানিয়ে এগিয়ে আসেনি প্রতিবাদ করতে। সবারই যেন এক ধারণা – আপদ বিদায় হয়েছে। সে নাকি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল অফিসের বোঝা। সহকর্মীদের বিদ্রুপ, লাঞ্ছনার ভাষা তখনও যেন ওর কানে বাজছিল। রোজই কোন না কোন ভাবে, কারুর না কারুর কাছে অপমানিত হয়ে এসে ছিল। কিন্তু এতটা চূড়ান্ত এর আগে কখনোই হয়নি।

হঠাৎ তার নাকে আসে গত সন্ধের সেই সুগন্ধটা। চোখটা খুলতেই দেখতে পায় জানলার পর্দাগুলো মৃদুমন্দ দুলছে। বুঝতে পারে বকুলের উপস্থিতি। নিজের রাগটা আর সামলাতে পারল না কিংশুক। রাগটা যেন আগ্নেয়গিরির লাভার মতন ফেটে বাইরে বেরিয়ে এল।

চিৎকার করে বলে উঠল, ‘কেন এসেছ আমার জীবনে? এলেই বা যদি, শরীর নিয়ে এলে না কেন? আমাকে নিয়ে কি খেলা খেলতে এসেছ? চলে যাও তুমি। আমার জীবনে কোন স্থান নেই তোমার। এই মুহুর্তে আমার জীবন থেকে বেরিয়ে যাও। আমি কোন দয়ার পাত্র নই যে আমাকে দয়া দেখাতে এসেছ তুমি। চাই না তোমাকে আর। না তোমাকে আর না তোমার দয়াকে। চলে যাও তুমি।’

এক নিঃশ্বাসে রাগটা প্রকাশ করে কিংশুক আবার আগের মতন চোখ দুটো বন্ধ করে, ডান হাতটা রাখে কপালের উপর। রান্নাঘরে জোরে বাসন পড়ার শব্দে চমকে ওঠে ও। চোখ মেলে দেখে সামনেই জানলার পর্দাগুলো বিশ্রীভাবে উড়ছে আর ঝাপট মারছে। সারা ঘরটা যেন উথালপাতাল হয়ে যাচ্ছে তার দোলায়।

কিছুক্ষণ পর আর কোন সুগন্ধ তার নাকে এল না। পর্দাগুলোও আর নড়ছিল না আগের মতন। স্থির ভাবে জানলার উপরের রডটা থেকে নীচে ঝুলছিল শুধু। অসম্ভব রকমের নিঃস্তব্ধতায় যেন ছেয়ে গিয়ে ছিল সারা ঘরটা। সম্বিত ফিরে পায় কিংশুক। একি করে ফেলেছে ও? বিনা দোষে এতগুলো রূঢ় কথা শোনাল নির্দোষ বকুলকে? তবে কি ও এই ঘর, তার একাকীত্ব জীবন ছেড়ে বরাবরের মতন অভিমান করে চলে গেল?

আর অপেক্ষা করতে পারল না কিংশুক। খাট থেকে লাফিয়ে নেমে ছুটে গেল রান্নাঘরে। দেখতে পেল দুটো স্টীলের খাওয়ার থালা মাটিতে পড়ে। লেডিজ প্রসাধনের সেই সুগন্ধের ঘ্রাণটা সেখানে পেল না কিংশুক। ছিটকে ফিরে এল ঘরেতে। সুগন্ধটা সেখানেও আর নেই। পাগলের মতন সারা ঘরের প্রতিটি কোণায় খুঁজে বেড়াতে লাগল সুগন্ধটা। না, বকুল কোথাও নেই। 

পা চালিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল কিংশুক। কোন রকম গন্ধই সেখানে পেল না। বিফল হয়ে ত্রস্ত পায়ে ঘরে ফিরে এসে দরজাটা ভেজিয়ে ঐখানেই বসে পড়ে, কপাটে হেলান দিয়ে। দুই চোখ বেয়ে দরদর করে নামে জলের ধারা।

‘আমি ভুল করে ফেলেছি বকুল। আমাকে মাফ করে দাও। একটি বারের জন্য মাফ করে দাও। আমাকে ছেড়ে চলে যেও না। প্লীজ, ফিরে এসো বকুল। আমি তোমাকে ভালবাসি। খুব, খুব ভালবাসি। এই পৃথিবীতে আমি বড্ড একলা। একটিবারের জন্য ফিরে এসো বকুল। আমাকে ছেড়ে চলে যেও না।’

বুক ভরা আশা নিয়ে জানলার পর্দাগুলোর দিকে তাকায় কিংশুক। এতটুকু প্রতিক্রিয়া নজরে পড়ল না। স্থির হয়ে আগের মতনই ঝুলছিল পর্দাগুলো। কিংশুক স্পষ্ট বুঝতে পারল যে তার জীবনের ক্ষণস্থায়ী বসন্তের অবসান হয়েছে। বোধহয় চিরদিনের মতন।


লেখক পরিচিতি : দেবাশিস চৌধুরী
প্রবাসীর কলম থেকে

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।