লেখক : অর্পিতা
নয়ন জানলাটা বন্ধ করে দিল। কিন্তু ততক্ষণে ঝোড়ো হাওয়া ঘরে ঢুকে ওলটপালট করে দিয়েছে সবকিছু। বিকেল থেকেই গুমোট হয়ে ছিল চরিপাশ৷ যেন অভিমানে আকাশ বুক বেঁধেছে । আশে পাশের বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ শুরু হতে না হতেই ধুলো ঝড় শুরু হয়ে গেল৷ নয়ন কাছের দোকানটায় গেছিল ম্যাগী কিনতে৷ উল্টে পড়া ফুলদানি ঠিক করে, বিছানাটা একবার ঝেড়ে নিল নয়ন৷ বৈশাখ মাসের ঝড়, কত আম পড়বে। কাঁচা আম খেতে নয়ন খুব ভালোবাসে, মনটা আম আম করে উঠল৷ ম্যাগীর প্যাকেট দুটো রেখে দেয় রান্নাঘরে ; খিদে খিদে পাচ্ছিল বলেই কিনে আনা অথচ এখন খেতে ইচ্ছে করছে না৷
সবুজ ওড়নাটা খুলে রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ল নয়ন৷ টিং টিং টিং টিং ঘন্টার শব্দ পাচ্ছে সন্ধ্যে নামার শব্দ। সমুদ্রের কথা মনে পড়ে গেল৷ কুহ্… কুহ্… কুহ… কোকিলটা সেই কখন থেকে ডেকেই যাচ্ছে অসহ্য! বাইরে ঝড়ের বেগটা কমেছে ; বিছানার পাশের জানলাটা আলগা করে খুলল নয়ন, বৃষ্টি শুরু হয়েছে গুঁড়ো বৃষ্টি ওর চোখে এসে লাগল৷ ভালো লাগছে৷ আজ শনিবার সারাদিন ঘরেই আছে, অন্যান্যদিন দুপুর বেলায় একটা এন জি ও তে চার ঘন্টার ক্লাস করায় ৷ দুপুরবেলায় শুয়ে ঘুমিয়ে মুটিয়ে যাওয়ার থেকে অনেক ভালো লাগে কাজটা করতে, মাইনে হয়ত বেশী নয় তবুও কাজটা করতে ভালোবাসে ৷ একটা বড় নিঃশ্বাস ভিতর থেকে বেড়িয়ে এল ৷ বেশীদিন নয়, মাস সাতেক হল কাজটা করছে। পাখার তিনটে ব্লেডকে ঘুরতে ঘুরতে আস্তে হতে হতে থেমে গেল, লোডসেডিং। নীল অন্ধকারে ঘরের ভিতরটায় সন্ধে নামছে। উঠে মোমবাতি জ্বালতে মোটে ইচ্ছে হল না। নয়ন শুয়ে থাকল একই ভাবে। থেমে যাওয়া সিলিং ফ্যানটা দেখতে দেখতে মনে হল পাখার তিনটে ব্লেড যেন ও সমুদ্র আর মিহির৷ ভাবতেই হাসি পেল, সমুদ্রকে বৃত্তে বন্দী করা যায় নাকী! জানলার কাছটায় সরে এসে কাঁচটা সামান্য সরিয়ে দিল নয়ন বৃষ্টির তেজ কমেছে ঝিরঝিরে ভেজা হাওয়া উড়ছে৷ থাকুক খোলা৷
পায়ে পায়ে রান্নাঘরে গেল ; মোবাইলের আলোয় মোমবাতি আর দেশলাই খুঁজে টেবিলের উপরটায় জ্বালিয়ে রাখল৷ ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়ল৷
– হ্যাঁ যাই৷
মোবাইলে আলো জ্বেলে দরজাটা খুলে দিল নয়ন৷
– একদম ভিজে গেছো তো।
– ব্যাগটা ধর, সে আর বলতে! এমন করে বৃষ্টি নামল, অটোতে আসতে আসতেই কতটা ভিজে গেলাম তারপর আবার হাঁটতে হাঁটতে আরও খানিকটা৷
নয়ন ব্যাগটা জায়গা মতন রেখে মিহিরের হাতে তোয়ালে টা দিয়ে বলল, ” স্নান করে নাও না হলে বৃষ্টির জল বসে ঠান্ডা লেগে যাবে৷ “
ভোজা শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে লন্ড্রি ব্যাগে ফেলে দিয়ে বেল্ট খুলতে খুলতে মিহির একটু বিরক্তি নিয়ে বলল,” ধুস! সারাদিন পর খাটাখাটুনি করে এসে যদি এই অন্ধকারে বসে থাকতে হয় ভালো লাগে নাকী”!
– এক্ষুনি চলে আসবে, তুমি যাও আমি চায়ের জল বসাচ্ছি।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মিহির বাথরুমে গেল। যতক্ষণ নয়ন ঘরে একা ছিল অন্ধকারটাকে এতটা গুমোট লাগছিল না। বরং নিজের সঙ্গে ভাবনার তারগুলো নিয়ে সুর তুলতে ভালো লাগছিল৷ মিহিরের অস্তিত্ব বড্ড প্রকট হয়ে উঠেছে ঘরে৷ বাথরুম থেকে জল ঢালার শব্দ আসছে৷ লন্ড্রি ব্যাগে ঘাম আর বৃষ্টি ভেজা জামা কাপড় থেকে মিহিরের শরীরের গন্ধটুকু ছড়িয়ে পড়ছে তাদের পাঁচশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে৷ আর অন্ধকার ভালো লাগছে না৷ বৃষ্টিও থেমে গেছে৷ কেন যে কারেন্ট আসছে না! অসোয়াস্তি লাগে নয়নের৷ চায়ের জল চাপায় নয়ন। সাঁ সাঁ করে জল ফুটছে৷
-” কি গো, একটু কিছু খেতে দিও খুব খিদে পাচ্ছে। ” মিহির লাল চেকের গামছা দিয়ে গা মুছছে ।
– ম্যাগী খাবে?
– খিদে পেয়েছে যা দেবে দাও ; তুমিও খাবে তো?
নয়ন আস্তে করে বলে, ” হুম৷ “
****
বছর খানেক আগের কথা নন্দন থেকে সিনেমা দেখে বের হচ্ছে নয়ন ; পিছন থেকে কাঁধে টোকা পড়ল । মিহিরের অফিসের কাজ থেকে ফুরসত মেলে না ; সেটাই নয়নের কাছে সাপে বর হয়েছে। একা একা ঘুরতে সিনেমা দেখতে বরাবরই পছন্দ করত নয়ন৷ তাই বিয়ের পরও অভ্যাসটা পাল্টাতে হচ্ছে না দেখে মনে মনে খু্শীই হয়েছিল৷ একলা যাপনের দুপুরগুলো নিজের মতন, নিজের সঙ্গে ভাগ করে নিত নয়ন৷ কোন দিন সিনেমা দেখে, কখনও বা বই পড়ে৷ আবার কোন কোন দিন কিছু না করে বিছানায় শুয়ে সবুজ দেওয়ালটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কেটে যেত সময়৷ তবে সবটাই গন্ডীর মধ্যে। শিকল ভাঙার উচ্ছ্বাসটুকু ছিল না৷
নয়ন পিছন ঘুরতেই দেখতে পায় সমুদ্রকে৷
– কি রে! কেমন আছিস?
– কত দিন পর দেখা রে! তুই কেমন আছিস বল!
সানগ্লাসটা মাথায় তুলে সমুদ্র হাসে, ” আমি? দারুণ আছি। তুই তো জানিস আমি সব সময় ভালো থাকি৷ “
হাসলে সমুদ্র কে খুব সুন্দর দেখায়, নয়ন খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকল সমুদ্রের দিকে, “কাকু কাকীমা ভালো আছেন? ফিরলি কবে বল…? “
– সব কথা কি এখানে দাঁড়িয়ে বলবি? চল বসি কোথাও।
নয়ন কব্জি উল্টিয়ে ঘড়ি দেখল। মিহিরের ছুটি হতে এখনও ঘন্টা দুয়েক বাকী। সমুদ্রও চট করে ঘড়ি দেখে, “তোর কোনও কাজ থাকলে থাক অন্য একদিন প্ল্যান কর দেখা করি। আমি কিছুদিন কলকাতাতেই আছি। “
নয়ন একটু ইতস্তত করল, এত দিন পর দেখা কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে অথচ ঘড়ি ধরে কথা বতে খুব অসোয়াস্তি হয়৷ এর থেকে অন্য একদিন দেখা করাই ভালো৷ নয়ন হেসে বলেছিল, ‘নম্বরটা দে, আজ সত্যিই তাড়া আছে। ‘
নন্দনের গেট থেকে দুজন বেড়িয়ে এল৷ সেদিন বাসে করে ঘরে ফেরার সময় নয়নের ফেসবুকে টুক করে সবুজ আলো জ্বলে উঠল, সমুদ্র ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছে। সকালে মিহির অফিস চলে গেলে টুকটাক ঘরের কাজ সেরে নয়ন শুয়ে পড়ত বিছানায় ফোনটা হাতে নিয়ে নীল আইকনে ক্লিক করেই টুক করে ঢুকে পড়ত সমুদ্রের প্রফাইলে৷ একটার পর একটা ছবি, ক্যাপশন পড়তে পড়তে কেটে যেত ঘন্টার পর ঘন্টা। একটা নেশায় পেয়ে বসল নয়নকে৷ সমুদ্রের হাসি হাসি মুখ, ওর ঝকঝকে চেহারা, কখনও অফিসের ল্যাপটপের সামনে বসে কখনও নিজের ফ্ল্যাটে একলা যাপনের ছবি, নয়ন দেখতে লাগল। কখনও ব্যঙ্গালোর কখনও মুম্বাই কখনও ওড়িশা কখনও বিদেশ সফরের ছবি, নয়ন গিলতে লাগল৷ নয়নের পাশে ওটা কে? ট্যাগ খুঁজে তার প্রোফাইলটাও ঘেঁটে এল খানিকটা৷ দেখতে দেখতে নয়ন মেসেজ করে সমুদ্রকে, হাই…।
রিপ্লাই ভেসে আসে, কী রে দেখা করবি আজ? নাকি ব্যস্ত?
নয়ন তাড়াতাড়ি উত্তর দেয়, না আমি ফ্রি তোর তো অফিস আছে!
বেশ কিছুক্ষন পর উত্তর আসে, আছে কিন্তু ম্যানেজ করে নেব, আজ বাইরে কফি খেতে ইচ্ছে করছে, ভাবছিলাম একাই যাব তুই পিং করলি।
ফোন রেখে নয়ন তাড়াতাড়ি আলমারি খোলে কোন শাড়িটা পরবে আজ, শাড়িগুলো নিয়ে খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে। কোনওটা পরতে গিয়েও খুলে ফেলে! রঙটা বড্ড গাঢ়, কোনওটা বড্ড সাদামাটা৷ ঝুমকো পরতে গিয়ে খুলে রাখে সাজটা বেশী হয়ে গেলে কী ভাববে সমুদ্র। ঘড়ির দিকে চোখ পরতেই ঝটপট তৈরী হয়! দেরী করে গেলে সমুদ্র অপেক্ষা করবে ওর জন্য, কাজের মানুষ৷ নয়নের মতন অঢেল সময় কোথায় ওর!
বিনবিনে শীততাপনিয়ন্ত্রিত কফি ঘর মুখোমুখি সমুদ্র আর নয়ন। কফির মগে আঙুল দিয়ে অস্থির ভাবে নাড়াচাড়া করছিল নয়ন।
– “দেখ নয়ন, আমার যা কাজ কখনই এক জায়গায় বেশীদিন থাকিনি। কোন পুরনো বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে আমার তেমন ভাবে যোগাযোগ নেই। কোন পিছুটান আমি রাখিনি৷ কলকাতায় ফিরলে মা বাবার সঙ্গে একটু দেখা হয় ব্যাস৷ তুই যদি এখন এমনি মন খারাপ করিস ভালো লাগবে বল? “
নয়ন নীচের ঠোঁট কামড়ায়, “জানিস তোকে আমি খুব হিংসা করি। এত ভালো চাকরি, যা ইচ্ছে করতে পারার স্বাধীনতা কি নেই বলতো তোর জীবনে? “
সমুদ্র হাসে, “কিন্তু আমার তো তোকে দেখে হিংসা হয়৷ কি সুন্দর ঘর বর নিয়ে সংসার করছিস৷ আমার মতন যাযাবর হয়ে দিন কাটাতে হয় না৷ দিনের শেষে তোর কোলবালিশটা তোর জন্য অপেক্ষা করে৷”
নয়ন অবাক হয়ে তাকাল। সাগরিকা আর ও সেই স্কুলবেলার বান্ধবী। সাগরিকার ডাক নাম সাগর হবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু সাগরিকা ব্যতিক্রমী তাই ওর নাম সমুদ্র। নয়নের গন্ডী বদ্ধ জীবনের ঠিক উল্টোপিঠ সমুদ্রের জীবন, উচ্ছ্বাসময় ঠিক সমুদ্রের মতনই৷ নয়ন কিংবা নয়নের মতন মেয়েরা এমন জীবনটাই চায়। সমুদ্রকে দেখে নয়নের সুপ্ত জীবন পিপাসা জেগে উঠেছিল। সমুদ্রের মতন হতে চেয়ে কখনও ভাবেনি সমুদ্র কখনও নয়নের মতন জীবন চাইতে পারে৷ নয়নের মতন একটা সাদামাটা জীবন৷ ঘর সংসার তুলসী গাছে জল দেওয়া শাঁখে ফুঁ দেওয়ার জীবন৷ নয়ন সেদিন কিছু বলেনি, সমুদ্রকে বিদায় জানিয়ে চলে এসেছিল ঘরে৷ কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার আগে সমুদ্রের রেফারেন্সেই নয়ন এনজিওতে কাজটা পায়৷ নয়নেকে মুক্তির স্বাদটুকু সমুদ্র দিয়ে গেছে।
***
মিহির কাঁটা চামচে ম্যাগীটা ঘোরাতে লাগল৷ মাঝে মাঝে নয়নকে বুঝতে পারে না মিহির৷ আজকাল একটু বেশীই অবাক লাগে ওকে দেখে৷ ওদের ঘরের দেওয়ালে বড় করে বিয়ের ছবি বাঁধানো আছে৷ লাল বেনারসি কপালে চন্দনের ফোঁটা হাসি হাসি মুখ, ওই মেয়েটার সঙ্গে আজকের নয়ন মেলে না কিছুতেই। সঙ্গে থেকেও সঙ্গে থাকে না নয়ন৷ মাঝে মাঝে এমন করে ওর দিকে তাকায় মনে হয় মিহিরের চোখ ছড়িয়ে অনেক দূরের কিছু দেখছে৷ মিহির নয়নের দিকে তাকাল, নয়নের মুখে নীল আলো ছড়িয়ে আছে, ম্যাগীতে এখনও হাত দেয়নি। ফোনে মগ্ন৷
– কি গো, চুপচাপ বসে আছ৷ ম্যাগীটা খাও…।
মিহিরের কথায় ভাবনার জাল ছিঁড়ে যায় নয়নের।
সমুদ্রের প্রোফাইলে টুক করে একবার ঘুরে এল নয়ন, হাসি হাসি মুখে কফির কাপ হাতে ছবি দিয়েছে, একলা যাপনের ছবি৷
– হুম খাচ্ছি তো৷
মিহির গরম ম্যাগীটা মুখে পুরে হুসহাস শব্দ করতে করতে বলে, ”এই যাহ্! দেখেছ একদম ভুলে গেছি৷”
– কী?
– আরে তোমার জন্য কাঁচা আম এনেছি৷ ব্যাগেই রয়ে গেছে৷ তুমি খাও আমি বের করে আনি৷
– মিহির থাক না, অন্ধকারে হোঁচট খাবে… কি গো…।
মিহির মোবাইলের আলো জ্বেলে ঘরের মধ্যে চলে যায়। নয়নের হঠাৎ করে মিহিরকে ভালো লাগে আবার করে৷ মনে পড়ে যায় সমুদ্রের শেষ কথাটুকু, দিনের শেষে নয়নের জন্য অপেক্ষারা অপেক্ষা করে থাকে। নয়নের ঠোঁটে আলগা হাসি খেলে যায়। নাহ্, অন্ধকারটা এখন আর মোটেও গুমোট লাগছে না৷
***
লেখক পরিচিতি : অর্পিতা
পরিচয়হীনতাই আমার পরিচয়।
পাঠ সংখ্যাঃ 388
অসাধারণ
খুব সুন্দর… তোমার সব লেখা আমি পড়তে চাই…
ভালোলাগা গুলো ফুরায় না।সময়ের সাথে সাথে শুধু চাপা পরে যায়।
দারুণ…. এই অনুভূতি
Asadharan
বাহ্… খুব ভালো লাগলো…
অসাধারণ
আহা বেশ হয়েছে।।। ছোট ছোট ঘটনা গুলোই এভাবে বাঁচিয়ে রাখে আমাদের।।।