লেখক : অর্পিতা চক্রবর্তী
(প্রথম পর্ব)
“মনিমা, ও মনিমা, আমাকে এবার পুজোতে একটা নতুন জামা কিনে দেবে গো? একটা জামা দাও না। আমার তো মাত্র দুটোই ভালো জামা তারমধ্যে একটা আবার ছোট হয়ে গেছে।”
“তা বলি আমার মাথাটা না খেয়ে যখন তোমার বাপটা আসে, ওনাকে বলতে পারো না? একটা মা-মরা অপয়াকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে উনি গেছেন মুম্বাইতে। মাস গেলে ক’টা টাকা পাঠিয়েই কর্তব্য শেষ। এই নে, আপাতত এই মুড়ি-বাতাসাটুকু খেয়ে আমায় উদ্ধার কর দেখি। হাতে আমার মেলা কাজ। উত্তরের আকাশটা বেশ কালো করেছে। জামা কাপড়গুলো তুলতে হবে, বৃষ্টি আসলে সব ভিজে যাবে।”
ছোট্ট পরী এক ছুটে চলল জামাকাপড় তুলতে। ওর মুড়ি বাতাসা পড়ে রইল ঘরের এক কোণে।
পরীর বয়স মাত্র ছয়, বাবা মুম্বাইতে একটা দোকানে কাজ করে। ওর মা যখন মারা যায়, তখন ওর বয়স ছিল মাত্র পাঁচ। এরপর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পরীর নতুন মা, অর্থাৎ মনিমায়ের আর্বিভাব ঘটল। প্রথম প্রথম মেয়েটা আদর পেলেও খুব বেশি দিন সুখের মুখ দেখতে পেল না বেচারি। তবু ছোট্ট পরী সব কিছু মানিয়ে গুছিয়ে চলতে বেশ শিখে গেছে। সারাটা দিন সংসারের ফরমায়েশ খেটে ঠিক দুপুরবেলা সবাই যখন একটু বিশ্রাম করে, তখন ও এক দৌড় দিয়ে চলে যায় জমিদার বাড়ির দুর্গা দালানে। সেখানে তৈরি হচ্ছে মা দুর্গার মূর্তি, সামনেই দুর্গাপুজো। পরী জানে, পুজোর ছুটিতে ওর বাবা ঠিক আসবে, আর ওর জন্য একটা হলেও জামা নিয়ে আসবে। তবে আজ ওর মনটা খুব খারাপ। ও আজ পড়তে বসেছিল, কিন্তু পেনের কালি শেষ হয়ে গেছে। মনিমা ওকে একটার বেশি পেন কিনে দেয় না। বেচারি আজ সবকটা অঙ্ক শেষ করতেও পারল না। আজকাল আবার রোজ স্কুলে গেলে মনিমা বকাবকি করে। ইদানিং ছোট্ট পরী মনের দুঃখে চলে আসে এই দুর্গা দালানে, আর এসে মায়ের খড়ের কাঠামোর সাথেই কথা বলে। কি আর করা যাবে, ওর কথা শোনার মত একটা মানুষও আজ এই পৃথিবীতে আর নেই।
“তা পরী মা, তুমি আজও ইস্কুলে যাওনি?”
“না গো দাদু, আমি আজও ইস্কুলে যাইনি। কি করে যাব বলো? আমার যে অঙ্ক করা হয়নি। এবার বাবা আসলে বলব আমাকে কয়েকটা পেন কিনে দিতে।”
“তা তোমার বুঝি পেন নেই?”
“নেই তো, আমার তো মাত্র একটাই পেন।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি আর দুঃখ করো না, আমি আমার হাতের কাজটুকু সেরে নিয়ে তোমার সাথে গপ্প করব।”
“ঠিক আছে কুমোর দাদু। তুমি বরং মা দুর্গাকে তাড়াতাড়ি তৈরি করো। মাকে আমার অনেক কথা বলার আছে।”
“তাই বুঝি? তাহলে তুমি এখন থেকেই ওনার সাথে কথা বলতে পার।”
“কথা তো বলতে চাই গো। কিন্তু ওনার তো মুখ চোখ কিছুই নেই।”
দাদু একগাল হেসে বলল, “আর মাত্র কয়েকটা দিনের অপেক্ষা। তারপর দেখবে, আমাদের দুর্গা মা কেমন সেজেগুজে ওনার ছেলে মেয়েদের নিয়ে চলে আসবে এই দুর্গা দালানে।”
ছোট্ট পরী দাদুর কথা শুনে খুব আহ্লাদিত হয়ে বলল, “জানো তো দাদু, দুর্গা মা আসলে খুব পচা। ও আমার মাকে অনেক দূরে নিয়ে চলে গেছে। আমার বাবাও এখানে থাকে না। আমার মনিমা আমাকে একটুও ভালবাসে না, খালি কাজ করতে বলে। আমার পড়াশোনা করতে খুব ভাল লাগে। কিন্তু আমার তো খাতা-পেন কিচ্ছু নেই। সব বইগুলো ছেঁড়া। আমি যে এখন কি করি?”
নিজের প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে কখন যেনো কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে ছোট্ট পরী। হঠাৎ কাউর হাতের স্পর্শে ওর ঘুম ভাঙলো।
“কে গো তুমি? কি সুন্দর দেখতে তোমায়। তোমাকে আগে কোনদিন দেখিনি তো এখানে।”
“আমি উমা গো উমা, ঐ পাশের গাঁয়ে থাকি। তুমি আমাকে চিনবে না, কিন্তু আমি তোমাকে চিনি।”
“তুমি আমাকে চেনো বুঝি?”
“আচ্ছা বেশ, তবে বলো তো আমার নাম কি?”
“তুমি হ’লে আমার পরী মা। কি, ঠিক বললাম তো?”
“ঠিক, ঠিক, একদম ঠিক বলেছো। তাহলে এবার বলো তো, আমার মা এখন কোথায় আছে?”
“তোমার মা? তোমার মা তো আমার কাছে, আমার ঘরে আছে।”
“সত্যি বলছ, তোমার ঘরে আমার মা আছে? তাহলে আমাকে একবার নিয়ে যাবে গো তোমার ঘরে? আমি কথা দিচ্ছি, আমি একটুও দুষ্টুমি করবো না।”
“বেশ, নিয়ে যাব। তার আগে এই নাও তোমার পেন আর পেন্সিল। আর এই ব্যাগে তোমার সব নতুন বই আছে। তুমি কিন্তু এবার থেকে মন দিয়ে পড়াশোনা করবে, আর ভবিষ্যতে একটা বড় চাকরি করে মানুষের মত মানুষ হবে।”
ছোট্ট পরীর আনন্দ বুঝি আর ধরে না। “তুমি খুব ভালো গো। আচ্ছা তোমাকে আমি কি বলে ডাকবো?”
“আজ থেকে আমি তোমার উমা মাসি, আর তুমি হলে আমার ছোট্ট পরী মা। ব্যাস আর কোন কথা নয়, এবার তুমি বাড়ি যাবে। ঐ দেখ, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমাকেও বাড়ি যেতে হবে। তোমার কুমোর দাদুও বাড়ি চলে গেছে। তুমি কিন্তু কাল থেকে রোজ ইস্কুলে যাবে। এবার থেকে তোমার যা যা লাগবে, তুমি আমাকে বলবে, আমি সব নিয়ে আসব। এখন চলি। আবার দেখা হবে খুব শিগগিরই।”
নতুন বই-পেন-পেন্সিল পেয়ে আনন্দে আত্মহারা পরী আবার নতুন করে শুরু করল পড়াশোনা। মুকুন্দপুর গ্রামে চলছে বেশ সাজ সাজ রব। শোনা যাচ্ছে, দুই-একদিনের মধ্যেই নতুন বিডিও ম্যাডাম আসছেন।
সাদা সরকারি গাড়ি থেকে নামছেন নতুন বিডিও ম্যাডাম। পরনে কাঁচা হলুদ রংয়ের শাড়ি, মাথার চুলগুলো একটা ক্লিপ দিয়ে আটকানো, চোখে একটা দামি সানগ্লাস, হাতে স্মার্ট ওয়াচ। সব মিলিয়ে এক নজরে ম্যাডাম শুধু সুন্দরী নন, ব্যক্তিত্বময়ী একজন নারী।
কাজে যুক্ত হয়েই উনি বসে পড়েছেন ফাইল সামলাতে। গ্রামের বহু মানুষ আজ এসেছে ওনার সাথে দেখা করতে। এসেছে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা। তবে ম্যাডামের অর্ডার, উনি সবার আগে স্থানীয় সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলবেন, তারপর অন্যান্যদের সাথে।
সারা দিনের কর্মব্যস্ততায় আজ বড্ড ক্লান্ত ঈশানী চ্যাটার্জী। নতুন অফিস কোয়ার্টারটা বেশ বড়। সামনে একফালি সবুজ ঘাসের গালিচা। বিছানায় ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিয়েই সে ফোন ঘোরাল,
“হ্যালো মামনি, আমি একদম ঠিক আছি। তোমরা চিন্তা করো না। সামনের সপ্তাহে তোমরা আসছ এখানে, অ্যাণ্ড দ্যাটস মাই ফাইনাল ডিসিশন।”
“ওকে ম্যাডাম, আপনার ডিসিশন শিরোধার্য।”
ঈশানী কপট রাগ দেখিয়ে বলল, “মামনি, এবার কিন্তু আমি রেগে যাচ্ছি। তোমাদের কাছে আমি আজও তোমাদের ঈশু, ওসব ম্যাডাম-ট্যাডাম কিছু না।”
“আচ্ছা বাবা, ঘাট হয়েছে। এবার আর কোন কথা নয়। রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়। কাল সকালে আবার কথা হবে।”
শতসহস্র ক্লান্তিকে জয় করে পরীর নতুন পরিচয়, সে আজ ঈশানী চ্যাটার্জী, মুকুন্দপুরের বিডিও ম্যাডাম। কেউ হয়ত আজ আর ওকে চিনতেও পারছে না, কিন্তু এই গ্রামের সাথে রয়ে গেছে ওর আত্মিক যোগ।
নতুন বিডিও ম্যাডাম আজ বেরিয়েছেন গ্ৰাম পরিদর্শনে। কত মানুষ আজ তার ধারে কাছে ঘুরঘুর করছে। সেদিনের পর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। গাড়িতে যেতে যেতে মনে পড়ছে সবকিছু। পরীর বয়স তখন ছয় থেকে একটু বেশি, ও চলে যাচ্ছে ওর বাবার সাথে মুম্বাইতে। মনিমা সেদিন খুব খুশি হয়েছিল বাবার সিদ্ধান্তে। শুধু ছোট্ট মেয়েটা একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছিল। ও জানত, এটাই ওর জন্মভিটা। একদিন এই ভিটা থেকেই ওর মা চলে গিয়েছিল ঐ না ফেরার দেশে। তারপর মাত্র দেড় বছরের মাথায় পরীও চলে গেল মুম্বাইতে।
“ম্যাডাম, আপনি বলছিলেন এখানকার দ্রষ্টব্য স্থানগুলো দেখবেন, তাই গাড়ি দাঁড় করালাম। এই হ’ল আমাদের পুরনো জমিদার বাড়ি। এখানে দুর্গা দালানে আগে দুর্গাপুজো হত। তবে বর্তমানে জায়গাটি পরিত্যক্ত।”
ঈশানী তৎক্ষণাৎ ড্রাইভারকে গাড়ি দাঁড় করাতে বলে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। “আমি একটু আসছি। আপনি এখানেই অপেক্ষা করুন।”
এই সেই দুর্গা দালান, যেখানে কুমোর দাদু মায়ের মূর্তি গড়ত। আর এই তো সেই সিঁড়ি, যেখানে এসেছিল উমা মাসি। ঈশানী ঐ মাটি স্পর্শ করে প্রণাম করে বলল, “মা আমি এসেছি, তোমার পরী ফিরে এসেছে। তোমাকে দেওয়া কথা আমি রেখেছি। আমি পড়াশোনা করে নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছি। সেদিন তোমার দেওয়া খাতা-পেন আমাকে নতুন পথ দেখিয়েছিল। সেদিন তুমি কথা দিয়েছিলে তুমি আসবে, আমি ডাকলেই তুমি আসবে, আমাকে আমার মায়ের সাথে দেখা করাবে। আমি এসেছি মা, এবার যে তোমার পালা। আজ আমি আমার উমা মাসিকে একটি বার, শুধু একটি বার দেখতে চাই।”
ঈশানী দেখল দুর্গা দালানে একটি অর্ধসমাপ্ত মায়ের কাঠামো। ও এক ছুটে সেখানে গেল, এই তো সেই কাঠামো। “কুমোর দাদু সেদিন বলেছিল, কাঠামোর মধ্যেও তুমি আছো। আর আজ আমি বিশ্বাস করি তুমি আছ, এখানেই আছ। একটি বার শুধু একটি বার এসো উমা মাসি।”
আবার সেই চেনা অনুভূতি, সেই সুঘ্রাণ, কিন্তু কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না।
“এই তো আমি, তোমার উমা মাসি, আমি যে তোমার অপেক্ষায় আজও বসে আছি। তুমি কথা রেখেছ, এবার যে আমার কথা রাখার পালা।”
পরীর দু’চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে।
“উমা মাসি, তুমি একটিবার আমার সামনে এসো। আমি তোমাকে দেখতে চাই, তোমাকে একটু স্পর্শ করতে চাই।”
“এই তো আমি পরী সোনা। তোমার আশেপাশেই আছি আর চিরকাল থাকব। তুমি আমাকে দেখতে চাও? তবে এই দুর্গা দালানেই শুরু করো নতুন করে দুর্গাপুজো। আমি কথা দিচ্ছি আমি আসব। আমাকে যে আসতেই হবে।”
পরী ওর চোখের জল মুছে একগাল হাসি হেসে বলল, “ঠিক আছে, উমা মাসি। তুমি যা চাইবে, তাই হবে। এবার এই দুর্গা দালানেই হবে দুর্গাপুজো। আমি কথা দিচ্ছি।”
বিডিও ম্যাডামের গাড়ি এখন ছুটে চলেছে গ্রামের পথে পথে। যদিও অধিকাংশ জায়গায় গাড়ি ঢোকে না, তবে সেটা মন্দের ভাল, অন্তত পরীর জন্য।
ঈশানী শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে ওর জন্মভিটাতে। না, বাড়িটা আর কোথাও আগের মত নেই। কাঁচা বাড়ি ভেঙে হয়েছে পাকা বাড়ি। কিন্তু মনিমা কোথায়? তাকে তো দেখা যাচ্ছে না।
ঐ তো, ঘরের দরজা খুলে বেড়িয়ে আসছে মনিমা। না পরী আর ধরা দেবে না। আজ সে শুধুই বিডিও ম্যাডাম। সানগ্লাসের আড়ালে চোখ দুটো ওর ঘুরছে পরীর, হয়ত সে খুঁজছে তার ফেলে আসা শৈশবকে।
“বৌদি ও বৌদি, উনি হলেন আমাদের নতুন বিডিও ম্যাডাম। গ্ৰাম পরিদর্শনে বেড়িয়েছেন।”
“নমস্কার, আমি ঈশানী চ্যাটার্জী।”
“নমস্কার, আমি রত্না সান্যাল। আমার কি সৌভাগ্য আপনি আমার বাড়িতে এসেছেন। দয়া করে ভিতরে আসুন। আমাকে একটু আপনার সেবা করার সুযোগ দিন।”
পরী লোভ সম্বরণ করতে পারল না। আতিথেয়তা গ্ৰহণ করতে ভিতরে প্রবেশ করল।
“বসুন ম্যাডাম, আপনি এখানে বসুন।”
চোখের সানগ্লাসটা খুলে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল পরী। যদিও কিছুই আর আগের মত নেই, শুধু একটি ছাড়া। পরীর চোখ পড়ল ওর বাবার ছবিতে।
“তা উনি কে? আপনার স্বামী?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ ম্যাডাম, উনি আমার স্বামী। আজ থেকে বহু বছর আগে উনি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। উনি কর্মসূত্রে মুম্বাই নিবাসী ছিলেন।”
“আর আপনাদের ছেলে মেয়ে?”
“আজ্ঞে, আমার কোন সন্তানাদি নেই। তবে ওনার প্রথমা স্ত্রীর একটি মেয়ে ছিল, নাম ছিল পরী। পরীর যখন সাড়ে ছয় বছর বয়স, তখন ও ওর বাবার সাথে মুম্বাই চলে যায়।”
“আর আপনি?”
“না, আমি যাইনি। এখানেই ছিলাম। এরপর ছোট্ট পরী মুম্বাই শহরে হারিয়ে যায়। ওর বাবা ওর অনেক খোঁজ করেছিল, কিন্তু ওকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।”
“তারপর আপনার স্বামী আর ফিরে আসেননি?”
“ফিরেছিলেন, তবে শেষ বারের মত। মেয়েকে হারিয়ে উনি শোকে পাথর হয়ে যান। এরপর অবশ্য ওনাকে আর ধরে রাখতে পারিনি।”
“খুবই দুঃখজনক। তারপর আপনাদের সেই মেয়ের কি হ’ল?”
“জানি না, কিচ্ছু জানি না।”
“ওর খোঁজ করেছিলেন?”
“না, আমি এই গ্ৰামে থেকে আর কি করতে পারি বলুন?”
“বুঝতে পারছি। কিন্তু একটা মেয়ে কর্পূরের মত উবে গেল, আর আপনার তা নিয়ে কোনদিন কোন মাথাব্যথা হ’ল না। যাক গে, সেটা আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে ওর যদি কোন ছবি থাকে, আমাকে দিতে পারেন। আমি আমার মত করে একবার ওকে খোঁজার চেষ্টা করে দেখতে পারি।”
মনিমা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে বলল, “সে তো বহু বছর আগের কথা। এতদিন পর পরীকে খুঁজে পেলেও আমি চিনব কি করে? তাছাড়া আমার বিয়ের পর ও আমার কাছে বেশিদিন থাকেও নি।”
পরী ওরফে ঈশানী বলল, “বুঝতে পারছি আপনার সমস্যাটা ঠিক কোথায়। শুধু একটা কথা বলুন তো। ও যদি আপনার নিজের মেয়ে হত, তবে আপনি ঠিক কি করতেন? যাক গে, বিষয়টা আপনার ব্যক্তিগত, আর আমার এখানে কোন ভূমিকা থাকার কথাও নয়।”
মনিমা অত্যন্ত লজ্জিত স্বরে বলল, “আমি দেখছি ওর কোন ছবি পাওয়া যায় কি না। আপনি একটু বসুন।”
অনেক খুঁজে খেটে বেরোল পরীর ছোটবেলার একটা ছবি, সাথে ওর বাবা আর মা। মনিমা সযত্নে এবং না বুঝেই ছবিখানা তুলে দিল পরীর হাতে। আজ এতগুলো বছর পর এমন একটা ছবি, যা রত্নের চেয়ে কোন অংশে কম নয় পরীর কাছে। তবে আর না, এখান থেকে এবার উঠতে হবে। পরী ছবিটাকে ব্যাগে ভরে সবে উঠতে যাবে হঠাৎ করেই মনিমা বলল, “আপনি আমাদের নতুন বিডিও ম্যাডাম, আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ। আমাদের সর্বমঙ্গলা ইস্কুলের অবস্থা খুব খারাপ। আপনি একবার দেখলেই বুঝবেন। আমি ঐ ইস্কুলে কাজ করি। আমার স্বামী চলে যাওয়ার পর গ্রামের কিছু মানুষের সহায়তায় কাজটা পাই। আমি পড়াশোনা বিশেষ জানি না। ইস্কুলে পড়ানো ব্যাতীত অন্যান্য যে সব কাজ থাকে, সেগুলো করি। আমার একার পেট চলে যায় কোনমতে।”
সর্বমঙ্গলা স্কুল! নামটা যেন কানে বাজছে পরীর। ওটা তো ওর স্কুল।
“ঠিক আছে, আমি বিষয়টা দেখছি। এখন আসছি।”
সারা দিনের কাজের শেষে নিজের ঘরে ফিরে এসেছে ঈশানী। হাতে ওর সেই ছবি, যা আজ থেকে বহু বছর আগে তোলা। বাবা-মা আর ছোট্ট পরী। ছবিটাকে বুকের উপর জড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদছে পরী। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। মামনির ফোন।
“কি রে মা, আজ সারাদিন তোর একটাও ফোন নেই। তুই ঠিক আছিস তো?”
“আছি মামনি, আমি একদম ঠিক আছি। তোমাকে হোয়াটসঅ্যাপে একটা ছবি পাঠাচ্ছি? দেখে বলো তো ছবিটা চিনতে পারছ কি না?”
মামনি ছবিটা দেখেই ফোন ঘোরাল, “ঈশু, আজ তুই মনিমার কাছে গিয়েছিলি? ও তোকে চিনতে পেরেছে?”
“না মামনি, আমি ধরা দিইনি, আর দেবও না। তুমি আর বাপি তাড়াতাড়ি চলে এস। আমার আর কিছু ভালো লাগছে না।”
“ঠিক আছে আমরা আসছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসছি।”
ঈশানী আজ গেছে সর্বমঙ্গলা স্কুল ভিজিট করতে। এই সেই স্কুল, যেখানে এসে সে চিনেছিল অক্ষর। ওর সাক্ষর হওয়ার প্রথম সোপান ছিল এই স্কুল। দু’চোখে অজস্র স্মৃতির ঝাঁপি যেন এক লহমায় তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল সেই শৈশবে।
“ম্যাডাম, সবই তো দেখলেন। কীভাবে স্কুলটাকে বাঁচানো যায় বলুন তো।”
পরী ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে এই গ্রামের বর্তমান জমিদার, শ্রী নিতাই সরকার। যদিও জমিদারি ঐ নামেই, তবু গ্রামের মানুষ ওনাকে বেশ মান্যিগণ্যি করে।
“আমি বিষয়টি দেখেছি। আচ্ছা, স্কুলের বর্তমান ছাত্রছাত্রী মোট কত? আর শিক্ষক-শিক্ষিকা কতজন আছে? আমাকে একটু বিস্তারিত জানান।”
নিতাইবাবু মাথা চুলকে বলল, “খুব সামান্য। যে ক’জন আসে, মিড-ডে মিলের লোভে।”
ম্যাডাম একগাল হেসে বলল, “পেটের ক্ষিদে যে বড় ভয়ঙ্কর সরকার বাবু। আগে মানুষ পেট ভরে খেতে পাক, ওদের মাথার উপরের ছাদটুকু সুরক্ষিত হোক, তারপর তো পড়াশোনা। তবে আমি দেখেছি, স্কুলটাকে একটা ঠিকঠাক জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায় কি না। বাই দ্য ওয়ে, আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
জমিদার মহাশয় বিগলিত হয়ে বললেন, “বেশ তো, তাহলে আমাদের বাড়িতে চলুন। সেখানে বসে কথা হবে, আলাপ হবে বাড়ির সবার সাথে।”
“বেশ, তবে চলুন।”
আর মাত্র কিছু দিনের মধ্যেই শারদোৎসব। জমিদার বাড়ির গিন্নিমায়েরা বেশ পরিপাটি হয়ে চলে এসেছে নতুন বিডিও ম্যাডামের সাথে আলাপ করতে। জমিদার বাড়ির সাদড় অভ্যর্থনা গ্ৰহণ করে ঈশানী কোন ভূমিকা ছাড়াই সোজাসুজি প্রবেশ করলো ওর বক্তব্যে।
“আপনাদের পুরনো বাড়িতে আমি গিয়েছিলাম। শুনলাম, ওখানে আগে দুর্গাপুজো হত। আমি চাই পুজোটা আবার ওখানেই শুরু হোক। অবশ্য এ ব্যাপারে আপনাদের মতামত খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
জমিদার বাড়ির প্রত্যেকেই হতবাক হয়ে যায় ম্যাডামের প্রস্তাবে। বড় গিন্নিমা হঠাৎ করেই বলে ওঠেন, “কিন্তু ও বাড়ি যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে…”
“হ্যাঁ, আমি দেখেছি। কিন্তু মা যেমন সৃষ্টি করতে পারেন, তেমন ধ্বংস করতেও পারেন। সুতরাং, আমি ঈশানী চ্যাটার্জী কথা দিচ্ছি, যদি আপনাদের অনুমতি এবং সকলের সহোযোগিতা পাই, তবে সব ঠিক হয়ে যাবে, এবং দুর্গাপুজো ওখানেই হবে। তাহলে আজ উঠি। তবে আপনাদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকলাম।
নমস্কার।”
ধীরে ধীরে পুরনো জমিদার বাড়ি সেজে উঠেছে নতুন রূপে। শুরু হয়ে গেছে মায়ের মূর্তি নির্মাণের কাজ। এবারে দুর্গোৎসবে এক নতুন মাত্রা পেতে চলেছে মুকুন্দপুর গ্ৰাম। ঈশানী ভীষণ রকম ব্যস্ত। অফিসের কাজ, গ্রামের উন্নয়ন, সাথে দুর্গা পুজোর গুরুদায়িত্ব। ওদিকে বাপি-মামনিও চলে এসেছে ঈশানীর কাছে।
আজ মায়ের বোধন। গ্রামের মানুষেরা পুজোর কাজে সকলেই হাতে হাত লাগিয়েছে। মনিমা এসে দূর থেকে দেখছিল সবটুকু। পরী এগিয়ে গিয়ে বলল, “দূরে কেন, এদিকে আসুন। আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দি, এনারা হলেন মিস্টার অ্যান্ড মিসেস চ্যাটার্জী, আমার মামনি আর বাপি। আর ইনি হলেন রত্না সান্যাল। জানো তো বাপি, ওনার মেয়ে খুব ছোটবেলায় মুম্বাইতে হারিয়ে যায়।”
লেখক পরিচিতি : অর্পিতা চক্রবর্তী
আমি অর্পিতা চক্রবর্তী। খুব সাধারণ একজন গৃহবধূ। মনের খেয়ালে আর কল্পনায় করি শব্দের আঁকিবুকি। নানা বিষয়ের উপর লিখতে আমার ভালো লাগে। তবে প্রতিটি লেখার মাঝে রেখে যাই একটি নিঃশব্দ বার্তা। একাধিক পত্র পত্রিকার সাথে আমার পথ চলা। ইতিমধ্যে আমার স্বরচিত বই "নীড় ভাঙা ঢেউ" প্রকাশিত হয়েছে "নীরব আলো পত্রিকার" হাত ধরে।