শিকড়ের টানে

লেখক : অর্পিতা চক্রবর্তী

শিকড়ের টানে – প্রথম পর্ব

(শেষ পর্ব)

মায়ের পুজো শুরু হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে ষষ্ঠী থেকে দশমী এসে গেল। অনেক বছর পর গ্রামের মেয়ে-বৌ থেকে শুরু করে প্রত্যেকে আনন্দে মেতে উঠেছে। এখন সকলের একটাই প্রার্থনা – এই পুজো যেন কোনও মতে বন্ধ না হয়।
আজ মায়ের বিসর্জন। চলছে সিঁদুর খেলা। দেখতে দেখতে কেটে গেল চার রাত্রি-পাঁচ দিন। দুর্গা দালান শূন্য। পরী আবার সেই সিঁড়িতে এসে বসল।
“উমা মাসি, কোথায় তুমি? তোমার পরী কিন্তু কথা রেখেছে। তবে আজ যে তোমাকে দেখতে বড্ড ইচ্ছা করছে গো। একটি বার এসে আমার কাছে একটু বসো না গো।”
হঠাৎ করেই যেন সন্ধ্যা নেমে আসল। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পরী ওর হাতের মোবাইলটা সবে অন করতে যাবে, হঠাৎ করেই ওর অনুভূতিতে ভেসে উঠল সেই মুখ।
“এই তো পরী মা, আমি এসেছি।”
“উমা মাসি, তুমি এসেছো? এস, বসো আমার কাছে। আজ আমি তোমাকে প্রাণ ভরে দেখি। জানো মাসি, আমার মায়ের মুখটা আমার কাছে খুব আবছা। কিন্তু যতটুকু মনে পড়ছে, আমার মা’কে দেখতে ঠিক তোমার মতই ছিল। আচ্ছা, তুমিই কি আমার সেই মা?”
“হ্যাঁ পরী, আমি মা, আমি তোমার মা, এই গোটা বিশ্বের মা, আমি সৃষ্টি, আমি সংহার। আমি দুর্বলের বল, সবলের প্রেরণা। আমি তোমার অন্তরে বাস করি। আজ তোমাকে আমার কিছু দেওয়ার আছে। বলো, তোমার কি চাই?”
“তুমি আমাকে সত্যিই কিছু দেবে মা? তবে দাও… আমি তোমাকে মাতৃরূপে আমার অন্তরে অনুভব করতে চাই। আমার সব ভুল শুধরে তুমি আমাকে মানুষ করো মা, নাশ করো আমার অহমিকা। যখন যখন আমি ভুল পথে পরিচালিত হব, তখন তখন তুমি হবে আমার পথপ্রদর্শক। আমাকে তুমি শুদ্ধভক্তি প্রদান করো মা। আমার জীবনের শুরু থেকে শেষ অবধি শুধু একটাই নাম রয়ে যাবে, আমার উমা মাসি।”
“বেশ, তবে তাই হোক। তোমার উমা মাসি আজ থেকে তোমার অস্তিত্বে বিরাজ করবে।”
কেটে গেছে বেশ কয়েক ঘণ্টা। দুর্গা দালান আলোকিত করে রেখেছে আকাশের চাঁদ মামা। ঈশানী আজ তৃপ্ত। একরাশ ভাললাগা নিয়ে ও পৌঁছে গিয়েছে ওর বাড়িতে। কিন্তু মামনি আর বাপির মুখটা আজ এত থমথমে কেন?
“ঈশু তুই এসেছিস মা? তোকে আরও একটু কষ্ট করতে হবে। চল আমাদের সাথে।”

পরী ওর মামনি আর বাপিকে নিয়ে চলে এসেছে ওদের পুরনো ঠিকানায়। মনিমায়ের অবস্থা বিশেষ ভাল না। যখন তখন কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। উনি কিছুই খেতে পারছে না। পরী ওনাকে জোর করে একটু দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু না, খাওয়া আর ওনার গলা দিয়ে নামছে না, শুধু চোখ দিয়ে জল পড়ছে। ঈশানী সযত্নে মনিমায়ের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিয়ে বলল, “মনিমা, এই দুধটুকু খেয়ে নাও, লক্ষ্মীটি।”
রত্না সান্যালের চোখ দু’টো তখনও জলে ভেজা, ঠোঁট দুটো কাঁপছে।
“হ্যাঁ, মনিমা, আমি পরী, তোমাদের সেই পরী। সেদিন আমার বাবা আমাকে তুলে দিয়েছিল এই প্রতুল চ্যাটার্জী এবং তাঁর স্ত্রী কাবেরী চ্যাটার্জীর হাতে। এরপর মুম্বাই শহরে আমি আমার মামনি আর বাপির স্নেহের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠি। আজ আমি আইনত ঈশানী চ্যাটার্জী। সেদিন বাবা আমাকে চ্যাটার্জী বাড়িতে রেখে যখন চলে যাচ্ছিল, আমি তখন খুব কাঁদছিলাম। বাবা সেদিন আমার হাতটা ধরে বলেছিল, ‘তোকে ভাল রাখব বলে কথা দিয়েছিলাম তোর মাকে, কিন্তু পারিনি। আজ থেকে ওনারা তোর মামনি আর বাপি। তুই আমার ঔরসজাত সন্তান। কিন্তু আমি তোর অক্ষম বাবা, তোকে ভাল রাখতে পারিনি। পারিস তো আমাকে ক্ষমা করিস। ওনারা খুব ভাল মানুষ, তোকে ভালো রাখবে। তুই কথা দে মা, তুই অনেক বড় হবি। মানুষের মত মানুষ হবি।’ আমি কথা রেখেছি মনিমা, বাবাকে দেওয়া কথা আমি রেখেছি। সেদিনের পর বাবা আর কোনদিনও ফিরে আসেনি। বাবার সাথে আমার আর দেখা হয়নি। আমি জানি, তুমি কোনদিন আমাকে ভালোবাসোনি। কিন্তু আমি তোমাকে মায়ের মতই ভালবেসেছিলাম।”
মনিমায়ের চোখ দুটো জলে ভিজে গেছে। হাতদুটো জোড় করে উনি খুব কষ্ট করে শুধু এটুকু বললেন, “ক্ষমা কর পরী মা, ক্ষমা।”
মনিমা ঘুমিয়ে পড়েছে, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তার শরীর। পরী নিজে হাতে ওনার শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছে।

মুকুন্দপুর গ্ৰামখানি আজ ছবির মতো সুন্দর। বিডিও ম্যাডামের কল্যাণে রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে সর্বমঙ্গলা স্কুল – সব যেন ছবির মতো সেজে উঠেছে। ঈশানী চেষ্টা করেছে মানুষের দুঃখ ভাগ করে নিতে।
বছরখানেক কোথা দিয়ে যেন কেটে গেলো এই মুকুন্দপুরে। এবার ওকে যেতে হবে অন্যত্র, বদলির অর্ডার এসে গেছে। গোটা মুকুন্দপুরে সবার চোখে আজ জল। সবাই এসেছে ঈশানী চ্যাটার্জীর সাথে দেখা করতে।
ঈশানী বাইরে এসে একগাল হাসি হেসে বলল, “আমি কিন্তু হাসতে হাসতে বিদায় নিতে চাই। আর তাছাড়া আমার বদলি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমি তো তোমাদের সেই পরী, যাকে বারবার ফিরে আসতে হয়েছে এই গ্ৰামে। এই মুকুন্দপুরে আমার পৈতৃক বাড়িটা রইল। তোমরা সবাই মিলে ওর দেখাশোনা করবে। আমি মাঝে মাঝেই চলে আসব। এছাড়াও প্রতি বছর দুর্গাপুজোর দিনগুলো আমরা সবাই মিলে একসাথে কাটাব। আজ আসি। সবাই ভালো থেক।”
পরী ওরফে ঈশানী চ্যাটার্জীর গাড়িটা রওনা দিয়ে দিয়েছে ওর নতুন গন্তব্যে। ঈশানী রুমাল দিয়ে চোখের কোণটা মুছে মনে মনে বলল, “চলি উমা মাসি, তোমার সাথে আমার আবার দেখা হবে নতুন এক ঠিকানায়। তবে আজ তোমার পরী তোমাকে কথা দিচ্ছে, আমি একবার না, শতবার ফিরে আসব তোমার টানে, তোমার কাছে, এই মুকুন্দপুরে।”


লেখক পরিচিতি : অর্পিতা চক্রবর্তী
আমি অর্পিতা চক্রবর্তী। খুব সাধারণ একজন গৃহবধূ। মনের খেয়ালে আর কল্পনায় করি শব্দের আঁকিবুকি। নানা বিষয়ের উপর লিখতে আমার ভালো লাগে। তবে প্রতিটি লেখার মাঝে রেখে যাই একটি নিঃশব্দ বার্তা। একাধিক পত্র পত্রিকার সাথে আমার পথ চলা। ইতিমধ্যে আমার স্বরচিত বই "নীড় ভাঙা ঢেউ" প্রকাশিত হয়েছে "নীরব আলো পত্রিকার" হাত ধরে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।