পার্বতী ওয়েডস্ শিব

লেখক : তনুশ্রী ঘোষ

শিব-পার্বতীর বিবাহের দিন যত এগিয়ে আসছে, ততই যেন ত্রিভুবনে আনন্দের বাঁধ ভেঙে পড়ছে। সুন্দরী গিরিনন্দিনী গৌরীর প্রেমে বেসামাল মহাদেবকেও দ্বিতীয় বিবাহ না করবার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হ’ল, পার্বতীর প্রেম, সৌন্দর্য ও তপস্যার কাছে হার মেনে। যাই হোক, মহাদেব শীঘ্র মিটিং ডাকলেন। নারদ, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-ইন্দ্রসহ সাত ঋষিগণকে। ভৃগু, বৃহস্পতির মত প্রাজ্ঞদেবতাগণ মিটিংয়ের সভাপতিত্ব করলেন। ত্রিভুবন আলোকিত করা এ বিবাহের সমস্ত দায়িত্ব যাবতীয় প্যাকেজ চিত্রগুপ্ত তাঁর কম্পিউটারে লিপিবদ্ধ করলেন। মেনু, ভেনু, ক্যাটারিং, ব্যাণ্ডপার্টি, কনসার্ট, মকটেল পার্টি, ককটেল পার্টি ইত্যাদির সমস্ত দায়িত্ববণ্টন করেছিলেন তরুণ দেবতাদের মধ্যে। একেবারে নবীন দেবগণ সিভিক ভলেন্টিয়ারের দায়িত্বে পেলেন। মহাদেব নির্দেশ দিলেন নারদকে, “যাও, ত্রিভুবনের সকলকে নিমন্ত্রণ করে এস, কেউ যেন বাদ না পড়ে। সকল দেবদেবীগণ, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র, যক্ষ, গন্ধর্ব থেকে অপ্সরা, মুনিঋষি, ভূত-প্রেত, দত্যিদানো, পিশাচ – কেউ যেন বাদ না পড়ে। সকলকে নিয়েই তো আমার সংসার।”

মহাদেবের নির্দেশ মোতাবেক নারদ কার্ড ছাপাতে চিত্রগুপ্তের কাছে আবেদন করলে তিনি হিমশিম খেয়ে গেলেন তিনদিনের মধ্যে এত কার্ড ছাপাতে গিয়ে। তাঁর কম্পিউটার গেল বিগড়ে, সার্ভার ডাউন – ব্যাস, গোটা দিন নষ্ট। মহাদেবের কাছে খবর পৌঁছে দিল ভৃঙ্গী। তিনি তো রেগে আগুন। শেষে ঢেঁকিবাহন নারদ তাঁকে ঠাণ্ডা করে কথা দিলেন, একদিনেই তিনি বোঁ-বোঁ করে ত্রিভুবন নিমন্ত্রণ করে দেবেন। সপ্তঋষির উপর দায়িত্ব পৌরোহিত্য এবং ব্যবস্থাপনার। বিশ্বকর্মা ছিলেন দু’তরফের ডেকরেটিংয়ের দায়িত্বে। অপূর্ব সুন্দর করে তিনি সাজিয়েছিলেন এই হাই-প্রোফাইল বিয়ের অনুষ্ঠানমঞ্চ। আকাশের অগণিত তারা তাদের সমস্ত আলো নিক্ষেপ করেছিলেন হর-গৌরীর বাসভূমিতে।

অবশেষে এক অজানা আকর্ষণে সকলেই শিবপুরীতে হাজির হলেন বরযাত্রী হয়ে। শিবশম্ভু এবার রওনা হবেন। গন্ধমাদন জেড-প্লাস ক্যাটেগরি তৈরি করে রেখেছেন, তাঁকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য। স্বর্গের দেবী অপ্সরাগণ তাঁকে ঠাট্টা করতে করতে সাজিয়ে দিচ্ছেন। নানা মণি-মুক্তমালা, চন্দন, আতর শ্রীঅঙ্গে দেওয়া মাত্র তিনি খুলে ফেলছেন। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই তাঁকে কোন অলংকার পড়াতে ব্যর্থ হলেন সকলে। ছটফট করতে করতে তিনি ডাক দিলেন তাঁর অনুচরদের। ব্যাস, তারা এসেই গঞ্জিকা সেবন করিয়ে দিলেন শিববাবাজীকে। ইচ্ছেমত ছাইভস্ম মাখিয়ে গায়ে অসংখ্য সর্প জড়িয়ে দিয়ে সদ্য কাটা বাঘছাল পরিয়ে দিলেন। এক হাতে ত্রিশূল অন্য হাতে ডমরু। “what a relief, ওঃ” – গদ গদ মহাদেব, আর সমবেত চিৎকারে আকাশ বাতাস ধ্বনিত হতে লাগলো, “হর হর ব্যোম ব্যোম, হর হর ব্যোম ব্যোম”।

বিশাল বরযাত্রী এগিয়ে চলেছে দলে দলে, থরে থরে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র, বায়ু, বরুণ, কুবের, যক্ষ, সূর্য, বৃহস্পতি এবং সপ্তঋষি প্রথম সারিতে, ক্রমে গন্ধর্ব, কিন্নর- কিন্নরী, নাগাধিপতি, অপ্সরা, ভূত-প্রেত, শিবের অনুচর, জীবজন্তু, পিশাচ, এবং বরকর্তা নারদ। দেখতে দেখতে মহা উল্লাসে শিবের অনুচরেরা গিরিরাজের রাজসভায় উপস্থিত হচ্ছেন। গিরিরাজ যথাসাধ্য তাঁদের আপ্যায়ন করতে লাগলেন। ওদিকে পরমাসুন্দরী উমা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন, একটিবার যদি প্রাণেশ্বরকে দেখা যেত কৌশলে (তখন তো আর স্মার্টফোন ছিল না)। কন্যাপক্ষ বরযাত্রীর ওপর পুষ্পবৃষ্টি শুরু করেছেন। মাতা মেনকা ও সকল পুরনারী বর দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। মেনকার ধৈর্য্যের বাঁধ মানে না। সবার আগে জামাই দেখবেন বলে নারদকে নিয়ে তিনি ছাদে উঠেছেন। এদিকে বরযাত্রীদের মধ্যে প্রথমেই এলেন ব্রহ্মা, তারপর একে একে বিষ্ণু, চন্দ্র, সূর্য, বরুণদেবদের দেখে সকলেই নতমস্তকে প্রণাম করলেন। সুদর্শন দেবরাজ ইন্দ্রকে দেখে সকলেই চিৎকার করে উঠলেন, “ঐ জামাইবাবাজি শম্ভু নিশ্চয়” আহা! কি সুন্দর। মেয়েরা এ কথা বলামাত্রই নারদ বললেন, “আহা! উনি আশুতোষ নন, আপনাদের জামাই এর চেয়েও সুন্দর। একবার দেখলে চোখ ফেরাতে পারবেন না।” এরপর গন্ধর্বরাজ বিশ্বাবসু এলেন তাঁর পুরো অর্কেস্ট্রা পার্টি নিয়ে, অপরূপ সুন্দর চেহারা, অতীব সুকন্ঠের অধিকারী তিনি। মেনকা আবার চিৎকার করে উঠলেন, “ঐ বুঝি বাবাজীবন, আহা! কী অপরূপ দেহবল্লরী।” নারদ বললেন, “না, না এ কেন শিব হতে যাবে? এ যে তাঁর বাজনাদার।” চুপ করে গেলেন মেনকা। “না জানি আমার জামাই কত সুন্দর, তার বাজনাদারই যদি এমন সুন্দর হয়।” মনে মনে বললেন মেনকা। এরপর একে একে এলেন যক্ষ, কুবের, এবং মদনদেব। তিনি আবার গন্ধর্বরাজের থেকেও দ্বিগুণ সুন্দর, কন্দর্পকান্তি। মেনকা বললেন, “তবে এই শিব।” নারদ বললেন, “না।” শুনে মেনকা আরও আশ্চর্য হলেন। মেনকা দেখলেন একে একে প্রবেশ করলেন যম, বরুণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয় প্রমুখ দেবতাগণ। মেনকা অবাক হয়ে ভাবতে থাকেন, “এত সুন্দরের চেয়েও চেয়েও সুন্দর, না জানি কে সেই পরম সুন্দর!”

এদিকে বহুশিষ্য পরিবেষ্টিত হয়ে স্বাস্থ্যালোচনা করতে করতে ভৃগু ও দেবগুরু বৃহস্পতি বিবাহমঞ্চে প্রবেশ করলেন। শঙ্খ বাজিয়ে পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন গিরি নাগরিকগণ। হঠাৎ প্রচণ্ড বিকট শব্দ! ভেরির আওয়াজে কান ঝালাপালা করে “ব্যোম ব্যোম” শব্দে আকাশবাতাস মুখরিত করে অসংখ্য ভূতপ্রেত সঙ্গী করে শিবের প্রবেশ। ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে আকাশ ঝাপসা করে গঞ্জিকা সেবন করতে করতে শিবের প্রবেশ। প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলায় বিবাহবাসর লণ্ডভণ্ড হওয়ার জোগাড়। তৎক্ষণাৎ নারদকে ডেকে ব্রহ্মা ধমক দিয়ে বললেন, “সেই সিভিক ভলেণ্টিয়ার মুনিগুলো গেল কোথায়? শীঘ্র গোলমাল থামাতে বল।” ঠিক তখনই উল্টোমাথা ডিগবাজী কিম্ভূতকিমাকার ভূত-প্রেত সঙ্গে করে শিব বাবাজি উপস্থিত। পাঁচটা মাথা, দশটা হাত, তিনটে চোখ, ষাঁড়ের পিঠে ঐ রকম চেহারা! কানে বড় বড় ফুল গোঁজা, মুণ্ডমালা পরা আস্ত মাতাল শিবকে দেখে নারদ বলে ওঠেন, “ঐ আপনার জামাই, ত্রিভুবনপতি শম্ভুনাথ। যান বরণ করে নিয়ে আসুন।” এই না শুনে মেনকা বলেন, “এই উমার বর? হায়রে!!! কী কুক্ষণে এমন মেয়ে পেটে ধরেছিলুম।” বলেই মূর্ছা গেলেন। জামাইবাবাজিকে বরণ না করেই শাশুড়ির অজ্ঞান হয়ে যাওয়া দেখে নারদ ছুটলেন শিবের কাছে। শিব অনেক বাতাস করে তাঁর দৈবশক্তিবলে মেনকার জ্ঞান ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু জ্ঞান ফিরতেই মেজাজী শাশুড়ি আবার চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগলেন। ঘটক নারদকে তাড়া করতে উদ্যত হলে বিষ্ণু মেনকাকে বোঝাতে আসেন শিব আসলে কে।

এদিকে মেনকার তাড়া খেয়ে নারদ শিবের কাছে হাতজোড় করে বলতে থাকেন, “বিয়ের ঘটকালি করতে এসে এমন অপমান আর সইতে পারিনে মহাদেব। আপনি যা হয় করেন দেবাদিদেব, না হলে দেবকূলের আর মান রইবে না।” দেবর্ষির কথা বিবেচনা করে শাশুড়ির মন ভোলাতে শিব তখন সহস্রসূর্যের প্রভাময় মূর্তি ধারণ করলেন। সহসা শাশুড়ি জামাইয়ের জ্যোতির্ময় বদনমণ্ডল দর্শন করে লজ্জায় অধোবদন হয়ে অশোভন আচরণহেতু অনুশোচনা করতে লাগলেন।

এমন সময় ইভেণ্ট ম্যানেজার নারদ আর দেরী না করে শিবের মাথায় টোপর পরিয়ে এক্কেবারে বিবাহ মঞ্চে বসিয়ে দিলেন। সখী জয়া-বিজয়া পার্বতীকে অসামান্য সুন্দর করে সাজিয়ে সেই সন্নিধানে এনে সযত্নে বসিয়ে দিলেন। ত্রিভুবন ভেসে গেল হর-গৌরীর হাই প্রোফাইল বিবাহে। সপ্তঋষির মন্ত্র উচ্চারণে ত্রিভুবন গমগম করতে লাগল, স্বর্গ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল, মঙ্গলশঙ্খে ধ্বনিত হতে লাগল আকাশ বাতাস। দেবতারা কনসার্টে মেতে উঠলেন। ইন্দ্রের বাঁশি, বিষ্ণুর মৃদঙ্গ, গন্ধর্বের অসামান্য সুরালাপ, কমলাসুন্দরীর সংগীতে, নৃত্যে যখন বিবাহবাসর জমজমাট, ঠিক তখনই বিকট শব্দে শিঙা ফুঁকে ডিগবাজি দিতে দিতে ফুটেজ নিয়ে নিল শিবের অনুচরেরা। ভূতপ্রেত, দত্যিদানো, পিশাচ, বিদ্যাধর, নাপিত বর-কনেকে ঘিরে ডমরু বাজিয়ে জয়ধ্বনি করতে লাগল, “হর হর ব্যোম ব্যোম ব্যোম, হর হর ব্যোম ব্যোম”। এভাবেই শিব-পার্বতীর শুভদৃষ্টি সম্পন্ন হল।


লেখক পরিচিতি : তনুশ্রী ঘোষ
পোস্ট গ্রাজুয়েশন যাদবপুর ইউনিভার্সিটি। রানার পত্রিকার সম্পাদক, সাহিত্য প্রেমী পরিবেশ কর্মী ও মানুষের পাশে থেকে মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

দীপায়ন ৩ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে ছবিতে ক্লিক করুন