শূন্যতা

লেখক : প্রিয়াংকা রাণী শীল

মিতুর যখন ঘুমটা ভাঙলো তখন সকালের রৌদ্র উঠে গিয়েছে। আজ সকালটা ভারি মিষ্টি লাগছে তার কাছে। মিতু চোখ খুলে দেখলো তার রুমটা যেন অদ্ভূত আলোতে আলোকিত হয়ে আছে। মিতু তখনও বিছানা থেকে উঠেনি। মাথা উঠাতে গিয়ে মিতু অনুভব করলো বেশ কষ্ট হচ্ছে , মাথাটা ভারি ভারি লাগছে। কোন রকমে মাথা উঠিয়ে বসলো মিতু। সামনে খোলা জানালা। সেই জানালা দিয়ে সকালের রৌদ্রের আলোটা ঘরে প্রবেশ করছে। আলোটা যেন আজ বড্ড চোখ ধাঁধানো। চোখ ধাঁধানো আলোতে মিতু যেন কাউকে দেখতে পাচ্ছে। মিতু এবার বিছানা থেকে নামতে চাইলো । কিন্তু নামতে গিয়ে পায়ে একটা অদ্ভূত ব্যথা অনুভব করায় ” উঃ” বলে চিৎকার দিলো।
সাথে সাথে জানালার কাছ থেকে কেউ একজন এসে তাকে ধরতে ধরতে বললো,
“একি! তুই উঠতে গেলি কেন?”

মিতু এবার তাকিয়ে দেখলো তার বাবা ; দেখলো তার বাবা তাকে আবার যত্ন করে বিছানায় শুইয়ে দিচ্ছে।
“বাবা, তুমি! তুমি এতক্ষণ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলে !”
“হ্যাঁ রে, আমি।”
“কিন্তু তুমি এলে কখন?”
“অনেক সকালে রে………।”
“আমি তো টেরই পেলাম না।”
মধ্যবয়স্ক ভারি চেহারার মানুষটা এবার হাসে। বলে,”তুই ঘুমুচ্ছিলি না।”

মিতু বিছানায় আবার মাথা দেয়। শরীরটা যেন বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার।
” তুমি এবার অনেক দিন পর এলে , বাবা। “
মানুষটা বলে, ” হ্যাঁ রে মা, অনেক দিন পর । “
” এবার অফিসের কাজে কোথায় গিয়েছিলে ? আমেরিকা, লণ্ডন নাকি ইউরোপের কোনো দেশে?”
মানুষটা একটু হেসে বলে , ” এবার আরও দূরে।”

মিতু এবার একটু রেগে বলে, “প্রায়ই অফিসের কাজে এখানে ওখানে চলে যাও। আসো অনেক দিন পরে। এবার তো এলে এক মাস পরে।”
মানুষটা এবার বলে,” কি করবো রে মা? কাজ তো করতে হয়।” পরে বলে,” কিন্তু তুই বলতো, তুই তোর শরীরের এ অবস্থা করলি কেন?”
মিতু একটু নিজের শরীরে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে,”হ্যাঁ, শরীরটা বেশ ক্লান্ত লাগছে। কেন এমন লাগছে তাও বুঝতে পারছি না? পায়েও কোন জোর পাচ্ছি না।মনে হচ্ছে পায়ে হাঁটার শক্তিও নেই।”
” না খেয়ে শরীরের এমন হাল করেছিস।”
“কি করবো? তুমি তো বাসায় থাকো না। তোমাকে ছাড়া খেতে কি ভালো লাগে বাবা , বলো ?”
“কিন্তু তা বললে কি হয়? তুই এ সংসারের বড়ো মেয়ে না………। তোকে তো অনেক কিছু বুঝতে হবে । বাস্তবতাকে মেনে নিতে জানতে হবে।”

মিতু এবার তার বাবার হাতটা নিজের কপালে দিয়ে বলে, “একটু আদর করে দাও না বাবা……।”
মানুষটা এবার পরম যত্নে মিতুর কপালে হাত বুলায়। মিতু বলে,” ইস,বাবা! মনে হচ্ছে, কতদিন যেনো তোমার হাতের পরশ পাই না।”
মিতুর মনে হলো সে বুঝি আবারও ঘুমিয়ে পড়বে। মানুষটা তখন বললো, “তুই কি আবার ঘুমিয়ে পড়লি?”
” খুব ঘুম পাচ্ছে ……বাবা।”
” এতো ঘুমোস না……। সারাদিন এভাবে শুয়ে আর ঘুমিয়ে কাটালে কি হবে রে?”
” হুম,তা ঠিক । কিন্তু বাবা , কেন যেনো পায়ে ভর দিতে পারছি না ! “
” পারবি………। সারাদিন শুয়ে থেকে এ দশা হয়েছে।” “দাঁড়া,আমি তোকে ধরছি……” বলে মানুষটা মিতুকে ধরে বিছানা থেকে নামালো। মিতু মানুষটার হাত ধরে আস্তে আস্তে পায়ে ভর দিয়ে সামনে এগোতে থাকে।
” এইতো পারছিস।”
মিতু হাসে।বলে, ” তুমি আছো না , বাবা। তাই হয়তো পারছি।”
মানুষটা তখন ধীরে ধীরে বলে,” আমি কি সারাজীবন থাকবো তোর কাছে।  বাস্তবতাকে মেনে নিতে শিখ, মা । বাস্তবতাকে মেনে নিতে শিখ। “
“রাখো তো বাবা,তোমার সব ভারি ভারি কথা।” মিতু বিরক্তি প্রকাশ করে।

রুম থেকে বের হওয়ার পর মিতু যেন বাড়িতে একটা শোরগোল টের পেলো। মিতু মানুষটাকে জিজ্ঞেস করলো, “এতো শোরগোল কেন বাবা?”
মানুষটা নিশ্চুপ।
মিতু দেখতে পাচ্ছে ঝাপসা ঝাপসা। “মা কোথায় বাবা?”
মানুষটা নিরুত্তর………
“তোমার  ছোট মেয়ে টুনটুন, আমার দুষ্টু বোনটা কই?”
মানুষটা তখনও নিরুত্তর………

হাঁটতে হাঁটতে মিতু কখন সদর দরজার কাছাকাছি চলে এলো তা সে নিজেই জানে না। সেখানে এসে মিতু আচমকা যেন থেমে গেলো। মিতু দেখলো, তাজা ফুলের মালা দেয়া তার বাবার ছবি, সামনে সাদা শাড়ি পরিহিত তার মা। ক্লান্ত , পরিশ্রান্ত তার মায়ের মুখ। ধূপের গন্ধে ভরে আছে সারা বাড়ি । তার সাথে ধ্বনিত হচ্ছে পণ্ডিতমশাইয়ের  মণ্ত্র উচ্চারণ ।

মিতুর পা কাঁপছে। তার সমস্ত শরীরে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। মিতু যেন পারছে না আর দাঁড়িয়ে থাকতে। মিতু
হঠাৎ শুনতে পেলো , কেউ একজন বলছে, “একি! মিতু এখানে এলো কি করে? এই কে আছো? ওকে ধরো……… ও পড়ে যাবে……… ওর হুইল চেয়ারটা কোথায়? নিয়ে আসো তাড়াতাড়ি………।”

শোরগোল যেনো বেড়ে গেলো বাড়িতে। মিতুর কাছে আসছে একজনের পর একজন। মিতু তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। সমস্ত শব্দ তার কানে আসছে অস্পষ্ট হয়ে; শুধু ………চেনা কণ্ঠের কয়েকটি শব্দ স্পষ্ট হয়ে তার কানে বাজছে বার বার………”বাস্তবতাকে মেনে নিতে শিখ, মা। বাস্তবতাকে মেনে নিতে শিখ………” ।

মিতুর চোখ জলে ভিজে যাচ্ছে বারবার;  সে কাঁদছে ……… অঝোরে কাঁদছে ……… অনুভব করছে ভয়ংকর এক শূন্যতা………।


লেখক পরিচিতি : প্রিয়াংকা রাণী শীল
আমি প্রিয়াংকা।জন্ম বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। পড়াশোনা করেছি চট্টগ্রামেই। গল্প, উপন্যাস পড়তে ভালবাসি। আর ভালবাসি গল্প লিখতে। পড়াশোনা করা অবস্থায় স্কুল,কলেজ ম্যাগাজিনে তিনবার আমার লেখা গল্প ছাপানো হয়েছিল।বর্তমানে বাস করছি ইতালিতে। আমার লেখা গল্প পড়ে ভালো না খারাপ লাগলো তা জানালে অনেক বেশি ভালো লাগবে।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

4 Comments

  1. সুমন

    শূণ্যতা চিরন্তন। শূণ্যতা-ই মানুষের জীবন একেক সময় একেক ভাবে ধরা দেয়। মানুষের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে পূর্ণতাকে ভুলে আবারও নুতন রূপে নতুন সাজে শূণ্যতাকে অংকের মত কষতে থাকে। যেন, পূর্ণতা সাময়িক বটে কিন্তু শূণ্যতা অনাদি ………. অনন্ত !!! তোমার লিখা সত্যিই সুন্দর।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।