শূন্যতার ইতিকথা

লেখক : রঞ্জিতা মুখোপাধ্যায়

আজ তৃণার স্কুল ছুটি। সকালবেলা ঘুম ভাঙার তাড়া নেই, আজ সারাদিনের কাজের তাড়া নেই, আজ তার ছুটি। কিন্তু সকালবেলার ঘুম ভাঙানি ভাবনাগুলো আজ মোটেই সুখকর নয়। একটা দমকা হাওয়ার মত কিছু এলোমেলো ভাবনা মনটাকে এক অজানা অনুভূতি, এক অসীম শূন্যতায় ভরে দিচ্ছে বারংবার। আজকের আবহাওয়াও যেন এই বিষাদ মনটাকে বড্ড বেশি সঙ্গ দিচ্ছে। শীতের সকাল, তার উপরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি, আকাশও যেন খুশি হতে ভুলে গেছে, চারিদিক ধূসর। আজ যেন দিনটা বেশ অন্যরকম। বড্ড মন খারাপের দিন আজ। এই ভাবনার দৌড়ে মনকে ভাসিয়েই রান্নাঘরে গিয়ে নিজের জন্য এক কাপ গরম আদা দেওয়া চা বানালো তৃণা। স্মৃতির বারান্দা বেয়ে তার মন মাঝেমাঝেই হয়ে যাচ্ছে বেশ আনমনা। আজ তার স্মৃতির বারান্দাটা বড্ড খালি খালি লাগছে, সেখানে আজ যেন এক আজব শূন্যতা। এইসব ভাবনার মাঝে সে নিজেকে এক প্রকার জোর করেই কাজের মধ্যে সঁপে দেওয়ার চেষ্টা করল। আজ সে ৪৫ বছরের দোরগোড়ায়। মাঝেমাঝেই তার বাবার কথা খুব মনে পড়ে, বাবার সঙ্গে কাটানো দিনগুলো স্মৃতির সরণী বেয়ে ঘুরপাক খায়। তৃণার বাবা “নেই” শব্দটার মধ্যে ঢুকে গেছেন আজ প্রায় ১২ বছর হয়ে গেল। বাবা-মেয়ের সম্পর্ক ছিল অসম্ভব গভীর, এক কাছের বন্ধুর, এক পরম আশ্রয়স্থল। বাবা চলে যাওয়ার পর তৃণা বুঝেছে, পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন শূন্যতা হলো কাছের মানুষকে হারানো, পরম বন্ধুকে হারানোর বেদনা।

এরপর থেকেই তৃণা বদলেছে, কারণ বাবার মত করে কেউ তাকে বোঝেনা যে। রঙিন সম্পর্কগুলোকে ফিকে হতে দেখেছে সে এক লহমায়। একদিন এমন ছিল, বাবার সাথে সারাদিনের সমস্ত কথা গড়গড় করে না বললে তার পেটের ভাতই হজম হতো না। বাবা মুচকি হেসে সব শুনতেন, মনোযোগ দিয়ে, মতামত দিতেন যত্ন করে। আর তৃণার মনে হতো কখন সে সারাদিনের সব কথা তার বাবার সাথে গল্প করবে। কিন্তু আজ গল্পগুলো হয়ত আছে, কিন্তু সেই গল্পের মনোযোগী শ্রোতাটি আর নেই।

এখন অনেকগুলো বছরের কেটে যাওয়া দিনগুলো বাবা ছাড়া অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু আজকাল মাঝেমাঝেই মনে হয় তৃণার – বয়স বাড়ছে, পুরনো শখটা আবার ঝালিয়ে নেওয়া দরকার। সেও বাবা চলে যাওয়ার সাথে সাথে মনোযোগী শ্রোতার অভাবে কেমন যেন হারিয়ে গেল। এই ভাবনার ফাঁকে তৃণা বইয়ের তাক থেকে পুরনো ডাইরিটা হঠাৎই বার করে প্রতিটা পাতায় হাত বোলাতে লাগল। একসময় সে লিখত, ভালোবাসত সে লিখতে। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে তার শখগুলোর জানালা বন্ধ করে দিয়েছে সে। কিন্তু, আজ তার মনের জানালাগুলো হঠাৎই সব আগল খুলে তাকে আহ্বান জানাল। হ্যাঁ, সে লিখবে, আবার শুরু করবে সে তার লেখনী। ডায়েরি খুলে কলম ধরল তৃণা আজ আবার ১২ বছর পর।

“জীবন ঘিরে থাকে শূন্যতা। এই শূন্যতা শব্দটির পূরণ হয় না। কিন্তু এই শূন্যতার মধ্যেই, একে কেন্দ্র করেই হয়ত নতুন কিছু সৃষ্টি জন্ম নেয়। শুধু দরকার ভালো কিছু করার উদ্যোগ, চেষ্টা, সর্বোপরি মনের বদ্ধ দ্বারের জানলা খুলে সুন্দর ভাবনার উপস্থাপন।”

তৃণা লিখতে লিখতে অনুভব করল, তার কষ্টগুলো কাগজের উপর এক এক ফোঁটা হয়ে গলে পড়ছে। কলমের আঁচড় আরো জোরালো হয়ে শব্দের বিনুনি গেঁথে চলেছে।

সকালের হাত ধরে সময় গড়িয়ে এখন প্রায় দিনের শেষ। তৃণা কলম থামিয়ে ডায়েরির পাতা বন্ধ করে নিজের মনকে নিয়ে আবার একটু নাড়াচাড়া করল। সকালের শূন্যতা এখন কোথাও এক আবেগকে নিয়ে এসেছে, যা ভালোলাগার আবেগ, ভালোবাসার আবেগ। বাইরের বারান্দা দিয়ে বিকেলের পড়ন্ত আলোয় সূর্যাস্তের সাক্ষী হয়ে থাকতে থাকতে মন এক বার্তা নিয়ে এল তৃণার কাছেই। হারানোর শূন্যতা থাকে, থাকবেই। কিন্তু সেই শূন্যতার মধ্যে নতুন কিছু তৈরি হয়, তাকে তৈরি করতে হয়। এই সকল ভাবনার মাঝেই হঠাৎ তৃণা অনুভব করে তার জীবনের পথচলা যে এখনও অনেক বাকি। আর এই পথ চলা দিয়েই তৈরি হবে তার জীবনের বাকি গল্প। এই পথ চলার ভাবনাতে আবারও তার বাবার কথাই তার মনে পড়ল, “তুই পারবি মামনি, জীবনে কিছু হারিয়ে গেলে সেই কিছুকে নতুন দিয়ে গড়ে নিয়ে ভরতে হয়। সেটা তুই ঠিক পারবি।”

আজ সে অনুভব করেছে বাবার বলা কথাগুলো কতটা প্রাসঙ্গিক, কতটা যুক্তিসঙ্গত। সত্যিই আবার সামনের দিনগুলোতে নতুন করে নতুন গল্প শুরু করার সময় এসেছে। স্মৃতির বারান্দাতে আজ তাই পুরনোর সাথে সাথে নতুনের ঠাঁই পাবার সময় এসেছে বৈকি।


লেখক পরিচিতি : রঞ্জিতা মুখোপাধ্যায়
আমি একজন হোমমেকার। রান্না করা ও লেখালেখি আমার ভালবাসার জায়গা। এই বিষয়ে স্বীকৃতি পেয়েছি, তাই উৎসাহের সাথে ভালবাসার জায়গাগুলিকে নিয়ে এগিয়ে চলতে ভালবাসি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।