শুয়োর কবি

লেখক : রাজীব চক্রবর্ত্তী

উসকো খুসকো চুল, এক মুখ দাড়ি, ঢোলা পোষাকের লোকটার পরিচয় ছিল শুয়োর কবি। এই অদ্ভুত নামের একটা ইতিহাস আছে। বন্ধুদের মতে, কলেজে পড়ার সময়ই তার কবিতার রোগ ধরে। বন্ধুদের জোর করে কবিতা শোনাত। শুনতে না চাইলেও পিছু ছাড়ত না। বন্ধুরা রেগে বলত, “তোর তো শালা শুয়োরের মত গোঁ। কবিতা শোনানোর জন্য ঘোঁতঘোঁত করেই যাস।” কোনও এক ফিচেল বন্ধু বলে উঠল, “ও আমাদের শুয়োর কবি।” নামটা বন্ধু মহল লুফে নিল। পরে যখন লিটল ম্যাগাজিনে তার কবিতা বের হতে লাগল, তখন দেখা গেল শুয়োর শব্দের প্রতি তার বেশ ভালবাসা জন্মেছে। অধিকাংশ কবিতাতেই বরাহর নানান রূপ। তার কবিতায় ‘রাজসভা’ হয়ে উঠত শুয়োরের খোঁয়াড়। কোনও কবিতায় আবার লিখেছে – বরাহ নন্দন বোঝে না মায়ের প্রসব বেদনা। এত শুয়োরের ছড়াছড়িতে দিনে দিনে সেই অদ্ভুত নামটাই তার পরিচয় হয়ে গেল। কবিও নাম পাল্টে ফেলল। কিছু কবিতা জড়ো করে যখন বই হ’ল, কাব্য সংকলনের নাম রাখল “শুয়োর কথা”। কবির নামের জায়গায় লেখা শুয়োর কবি।

কবির ইচ্ছে হ’ল শুয়োরের খামার দেখার। এক শীতের রাতে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ প্রান্তরের মাঝে দ্বীপের মত জেগে থাকা একটা কাঠের ছোট বাড়ির কাছে পৌঁছল কবি। ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে জোব্বার পকেটে থেকে বের করে আনল চ্যাপ্টা একটা বোতল। ঢকঢক করে তরল গরল ঢেলে দিল গলায়। তারপর ঘাসের উপর শুয়ে পড়ল। তারা ভরা আকাশ দেখে বিড়বিড় করে উঠল,

পথের খোঁজে মাতাল কবি
এসেছে শুয়োরের খোঁয়ারে …

নেশা আর একটু গাঢ় হ’লে উঠে দাঁড়াল। টলোমলো পায়ে এল খামারের দরজার সামনে। জড়ানো গলায় হেঁকে উঠল, “কেউ আছেন? দরজাটা খুলুন। আমি শুয়োর দেখব।”
কোনও উত্তর নেই। কবি দু’বার দরজায় লাথি মেরে বিড়বিড় করে উঠল, “শালা, সব শুয়োরের বাচ্চা ঘুমাচ্ছে। খোঁয়াড়ের কেয়ারটেকারেরও পাত্তা নেই।” অগত্যা কবি হাঁটা লাগাল খোয়ারের পিছন দিকে। যদি ফাঁকফোকর কিছু থাকে!

কাঠের ঘরের দেয়াল বেয়ে উঠল কবি। দেয়াল আর ছাদের সংযোগস্থলে একটু ফাঁক, কোনওমতে সেখান দিয়ে মাথা গলাল। ঘরের ভিতরে নানা মাপের, নানা রঙের শুয়োর দেখে কবি পুলকিত হ’ল। যে দেয়াল দিয়ে উঁকি মেরেছে, তার নিচেই একটা মা শুয়োর প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কবি জড়ানো গলায় আপন মনে বিড়বিড় করল, “শুয়োরেরা জানে না, কত যন্ত্রণার পথ পেরিয়ে আলো দেখা যায়!”

একটু পরেই একটা বাচ্চা প্রসব করল মা শুয়োরটা। কবি উৎসাহী হয়ে উঠল। মাথাটা ঝুঁকিয়ে দিল ঘরের ভিতরে। হাতের উপর ভর দিয়ে শরীরের অনেকটা অংশ ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। এর মধ্যে আরেকটা শূকরছানাও ভূমিষ্ঠ হয়েছে। তৃতীয় বাচ্চাটা বেরোনোর মুহূর্তে কবি আরও ঝুঁকে পড়ল। তার বুক অবধি এখন ঘরের ভিতরে। তৃতীয় বরাহ নন্দন মুখ বের করেছে দেখে কবি উত্তেজিত হয়ে উঠল। ভাল করে দেখার জন্য হাতের উপর ভর দিয়ে শরীরটা এগোনোর চেষ্টা করতেই নেশার ঘোরে মাথা টলে উঠল।
ধুপ! কবি মুখ থুবড়ে পড়ল ঘরের মধ্যে, শূকমাতার পাশে। প্রসব যন্ত্রণায় কাতর মাতা ভয়ে মুখ ঘুরিয়ে দেখল শুধু। উঁচু থেকে পড়ায় ঘাড়ের হার ভেঙে কবির মৃত্যু হ’ল। মাতৃজঠরের লালারস সারা শরীরে নিয়ে শুয়োরের তৃতীয় বাচ্চাটা যখন জন্ম নিল, কবির আত্মা মুক্তি পেল। মৃতদেহ থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী বেরিয়ে মিশে গেল সদ্যজাত শূকছানার শরীরে।

শুয়োর কবির মৃত্যু আর শূকরছানার জন্মমুহূর্ত এক হয়ে গিয়েছিল। শুয়োর কবি মিশে গেল নবীন প্রজন্মের শুয়োরের সাথে। এই মিলনের ফল কিছুদিন পরেই দেখা গেল। সব বাচ্চাদের থেকে এই তৃতীয় বরাহনন্দন একটু আলাদা! সারাদিন খামারের ছোট্ট ঘরটার এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। খামারের ভাল ভাল খাবার ফেলে সে দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করে। ছেলের হাবভাব মায়ের ভাল লাগে না। বিরক্ত হয়ে বলে, “তোর মতলবটা কি বল তো?”
ছেলে বন্ধ দরজায় মুখ ঘষতে ঘষতে বলে, “এভাবে বন্দি থাকতে তোমাদের ভাল লাগে?”
বন্দি মানে? বেশ তো খাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, মাঝে মাঝে বাইরে ঘুরতে যাচ্ছি। আর কি চাই জীবনে?
শুধু এটাই জীবন? নিজের কোন স্বাধীনতাই নেই। যা খেতে দিচ্ছে খাচ্ছ, যখন বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, তখনই বেরোতে পারছ। নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনও দামই নেই। স্বাধীন চিন্তার তো সুযোগই নেই। আসলে আমরা পরাধীন। আমি, তুমি, সবাই।”
স্বাধীন মানে কি বাইরে ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ানো?
“না। এই পৃথিবীর সব কিছুকে ইচ্ছেমত দেখব, বুঝব। অন্যের দৃষ্টিতে নয়, নিজের স্বাধীন চিন্তায় ভাল-মন্দের বিচার করব। পছন্দমত খাব। নিজেদের অধিকার নিজেরা বুঝে নেব। কোনও ঘৃণার শব্দ নয়, শুয়োর পরিচিত হবে এক স্বাধীন চেতনা হিসেবে।”
ছেলের কথা মা বুঝতে পারে না। বুঝবে কী কিরে? এ তো আর গতানুগতিক জীবন মেনে নেওয়া শুয়োর নয়। শুয়োরের গোঁ আর কবির স্বপ্ন মিশে এক নতুন জীবন। ছেলের জন্য মায়ের ভাবনা হয়। চিন্তিত হয়ে বলে, “বাইরে বেরিয়ে কী আর করবি? জলে-জঙ্গলে, আদাড়ে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াবি আর ঘাস-পাতা, পোকামাকড় খাবি। তেষ্টা পেলে নর্দমার জল জুটবে। তারপর বর্শা নাহয় বল্লমের খোঁচায় মরবি।”
আর তোমরা এক গুলিতে শেষ হবে। নাহয় একটু কম কষ্ট পাবে, কিন্তু মরতে হবেই। আর মরাটাও অন্যের হাতে। যতদিন বাচ্চা দিতে পারবে, ততদিন বাঁচিয়ে রাখবে। সম্পদ উৎপাদনের ক্ষমতা শেষ হয়ে গেলে আর তোমাকে পুষবে না। তোমার মাংস বেচে পয়সা কামাবে।”
তোর যা ইচ্ছে কর।
“করব। লড়াই করেই বাঁচব। অন্যের হাতের পুতুল হয়ে নয়। যদি টিকে যাই, এক সুস্থ পৃথিবী গড়ার চেষ্টা করব। মরে গেলে এক সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন বুকে নিয়ে মরব। কিন্তু তার আগে এই খামার থেকে বেরোনো দরকার।

একদিন সুযোগও এসে গেল। রোজ দু’জন এলেও সেদিন খামারে খাবার দিতে মুশকো একটা লোক ঢুকল। ঘরে ঢুকে খাবারের পাত্র মাটিতে রেখে ঘুরে দরজা বন্ধ করার সময়টুকুর ফাঁকেই বাচ্চা শুয়োর বাইরে বেরিয়ে গেল। লোকটা ছুটল পিছন পিছন। কিন্তু বিদ্রোহী শূকরছানা ততক্ষণে পেরিয়ে গেছে অনেকটা পথ।

মাঠঘাট পেরিয়ে একটা জলার ধারে থামল খামার পালানো বরাহনন্দন। জলার ধারে কতগুলো কালো, কাদামাখা শরীরের শুয়োর ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তাদের দেখে খামারের শুয়োরের ভিতরে লুকিয়ে থাকা কবি জেগে উঠল। আপন মনে বলে উঠল, “সময় এসেছে বন্ধু পথ খুঁজে নেওয়ার।” তার চকচকে সাদা লোমে ঢাকা চেহারা দেখে বুনো শুয়োরগুলো অবাক হ’ল। সন্দেহের চোখে তাকাল খামারের শুয়োরের দিকে। কবি শুয়োর কিন্তু নির্বিকার। তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এসো বন্ধুরা, আমরা এক হই।”

প্রথমে কিছুটা জড়তা থাকলেও কবি শুয়োরের উদাত্ত কন্ঠে আহ্বান, স্বপ্নালু চোখ আর জোট বাঁধার ডাকে তারা তাকে আপন করে নিল। খামার পালানো শুয়োর হয়ে উঠল জল, কাদা, পাঁকে ঘুরে বেড়ানো জংলি শুয়োরদের নেতা। 

কবিরা স্বপ্ন দেখে। রোমান্টিকতার ভেলায় ভেসে তারা সুন্দরের গান গায়। এই সবের সাথে যখন শুয়োরের গোঁ যোগ হয়, তখন সে কোনও বাধাই মানতে চায় না। খামার পালানো শুয়োরও কোনও বাধা মানতে চায়নি। তবুও সে বাঁধা পড়েছিল এক বুনো কৃষ্ণাঙ্গীর মায়ায়। সাদা, কালো, ধূসর … নানা রঙের শুয়োরের পিতা হ’ল সে। তার কবিসত্ত্বা ছড়িয়ে গেল পরবর্তী প্রজন্মে। দিনবদলের স্বপ্ন নিয়ে সে ঘুরে বেড়াতে লাগল নগর, গ্রামের পথে পথে। সঙ্গে একদল বুনো বরাহ।

অবস্থা পাল্টায় না। কিন্তু শুয়োর কবি হতাশ হয় না। সে নানা দেশে ঘুরে বেড়ায়। শুয়োরদের স্বপ্ন দেখায়। খামারের নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে খুব কমই তার সঙ্গী হয়। শুধু নিশ্চিন্ত জীবনই বা বলি কেন! জলকাদায় ঘুরে বেড়ানো অনিশ্চিত জীবন যে শুয়োরদের, তারাও খুব একটা তার সঙ্গী হতে চায় না। তবু নাছোড় শুয়োর পথ ছাড়ে না। 

ধীরে ধীরে দল বাড়ে। সন্তানেরা জোয়ান হয়। শুয়োর কবি ক্লান্তিহীন। তার নেতৃত্বে দলে দলে শুয়োর ঘুরে বেড়ায় গ্রামে, শহরে। কখনও গ্রাম সভায়, কখনও আইনসভার আশেপাশে, কখনও বা সোজা রাজদরবারে। যৌবন পেরিয়ে প্রৌঢ়, তারপরে বৃদ্ধ। ধীরে ধীরে সময় শেষ হয়ে আসে, কিন্তু কবির আত্মা ঘেরা শুয়োরের শরীরে বাসা বাঁধা স্বপ্নের ক্ষয় হয় না। লোলচর্ম বুড়ো শুয়োর তখনও নতুন দিনের স্বপ্ন দেখে। রাতের খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলে, “রাত যত গভীর, প্রত্যয় তত দৃঢ়। চলো, এগিয়ে চলো।”

হোগলা বনে সকাল থেকেই শোরগোল। বুড়ো শুয়োরের খোঁজে তার ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনীরা তোলপাড় করে ফেলল চারধার। নাহ! কোথাও নেই। সন্ধ্যের একটু আগে তাকে পাওয়া গেল খালের ধারে। পা উপরে দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। পেটটা ফোলা, মুখে মাছি ভনভন করছে। দু’টো কাক বসে আছে গায়ের উপর। খোঁয়াড় থেকে পালিয়ে গিয়ে মুক্ত আকাশের নিচে মুক্তির স্বপ্ন দেখা এক গোঁয়ার কবির মৃত্যু হ’ল। ঠিক মৃত্যু নয়। শরীরটা প্রাণহীন হয়ে পড়ে রইল জলের ধারে। কিন্তু সেই কবির আত্মার প্রবাহ ধারণ করা অপত্য শুয়োররা রয়ে গেল মাঠেঘাটে, জলজঙ্গলে, শহরে, নগরে। নানা রূপে, নানাভাবে আজও তারা অদম্য জেদে ঘুরে বেড়ায়, সব বাধা ভেঙে, মুক্তির স্বপ্ন চোখে নিয়ে।


লেখক পরিচিতি : রাজীব চক্রবর্ত্তী
জন্ম ১৯৭০ সালের ৩০শে ডিসেম্বর, কলকাতার সিঁথিতে। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী। দৈনন্দিনতার ক্লান্তি কাটাতেই মূলত: কলম ধরা। বেশ কয়েকটি লিট্ল ম্যাগাজিনে লিখেছেন গল্প, কবিতা। ২০১৭ সালে প্রকাশিত "সংশ্লেষ" নামক গদ্য সংকলনে স্থান পেয়েছে তাঁর মুক্তগদ্য। ঐ একই বছরে সোনারপুর কাব্যমঞ্চ আয়োজিত স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান লাভ করেন তিনি। ২০১৯ সালে প্রকাশিত "অন্য গদ্য" গ্রন্থে স্থান পেয়েছে তাঁর গদ্য। জীবনের বিবিধ অনুভূতি, বাস্তবতাকে ছন্দে বাঁধার প্রয়াসে তাঁর কবিতাচর্চা।

One comment

  1. অনন্যা সাহা

    লেখালিখি তে নির্বাচিত সব লেখাই খুব ভালো লাগে। কিন্তু আমার একটি কবিতা দিয়েছিলাম বিগত প্রায় তিন মাস হয়ে গেলো তারপর গত মাসেও আরেকটি কবিতা দিয়েছি তা নির্বাচিত হোলো কিনা জানতে পারিনি বা na হলেও জানতে পারিনি।
    যদি na হওয়ার কারণ জানানো হয় উপকৃত হই।
    ধন্যবাদ 🙏

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।