লেখক : অভীক সিংহ
কলেজের পরীক্ষা শেষ হওয়ার মুখে, গরমের ছুটি পড়বে আর দু’সপ্তাহ পরেই। আর আপামর মধ্যবিত্তের ছোট্ট জীবনে ছুটি মানেই তো ব্যাগপত্র গুছিয়ে ছোটা। গরমের ছুটিতে পাহাড়ে, শীতের ছুটিতে সমুদ্র কিংবা মরুভূমি। কথায় বলে, বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে। কিন্তু সেই সর্ষে যে চোখে সর্ষেফুল দেখিয়ে দিতে পারে, সেটা ছুটি কাটানোর প্ল্যান করার সময়েই বোঝা যায়। কবে যাব, কোথায় যাব, কীভাবে যাব, কী পরব, কোথায় থাকব, কী খাব, কী কী দেখব, সেখানে কীভাবে যাব, কবে ফিরব, কীভাবে ফিরব, এবং এই সবক’টা প্রশ্নের “কী”, “কখন”, এবং “কোথায়”-গুলোকে বদলে “কেন” করে দেওয়া – এই বিপুল পরিমাণ প্রশ্নের সম্ভার তো এবিটিএ-র টেস্ট পেপারকেও পিটিয়ে তুলোধোনা করে দিত। শেষমেশ নিজের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে ব্যালেন্স বজায় রাখার খাতিরে এই কোশ্চেন ব্যাঙ্কের উত্তর দেওয়া শুরু করতে হয়। আর প্ল্যানে কোনরকম গাফিলতি হলেই মনে হয় ছোটবেলায় কমপ্ল্যানটা হয়ত পেটে একটু কম পড়েছিল, তাই হয়ত ধেড়ে হলেও বেড়ে উঠিনি। একবারের জন্য মনে প্রশ্নও আসল, কলেজ কি আমাদের ছুটিটা দিল ক্লান্তি দূর করার জন্য, নাকি দূরে গিয়ে ক্লান্ত হওয়ার জন্য। যাই হোক, প্ল্যানটা তো ঠিক করে করতেই হবে। সামনে খাতা, পেন, আর ল্যাপটপ নিয়ে কিছুক্ষণ খুচখুচ করার পরেও কিছুই ঠিকমত মনস্থির করে উঠতে পারলাম না। মাথায় একটা খুচরো প্ল্যান অবধি আসছে না। উপায়ান্তর না দেখে টেবিলের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে কল করলাম। কয়েকবার বাজার পরেই অন্যদিক থেকে আওয়াজ ভেসে আসল, “হ্যালো অভীক, কী খবর? এই সক্কাল সক্কাল ফোন করছ, সব ঠিক তো?”
“আরে গুরু, বেজায় ঘেঁটে আছি। তোমার একটু হেল্প লাগত।” আমি নিচুস্বরে বললাম।
“সে তোমার গলার আওয়াজ শুনেই বুঝতে পারছি। কেস গুরুতর নাকি? কী হয়েছে? বাড়িতে সব ঠিক আছে তো?”
“সে সব ঠিক আছে গুরু। তোমাকে ফোনে পুরোটা বলতে পারব না। এখন একটু ফ্রি আছো?”
“দাঁড়াও, এক মিনিট,” বলে সান্যালদা ফোনটা রেখে দিল। তার কয়েক মিনিট পরেই ফোন করল, “ফ্রি আছি। ক্যাণ্টিন যাবে? লাউঞ্জ তো বন্ধ।”
“এক মিনিট ধরো,” বলে আমি চট করে ফোনের স্পিকারে হাত রেখে ভিতরের ঘরে গিয়ে গিন্নিকে বললাম, “এই শোন না, একটা কাজ আছে, একটু ক্যাণ্টিনের দিকে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি চলে আসব।” গিন্নি সম্মতি দেওয়া মাত্র ফোনটা তুলে বললাম, “আসছি গুরু, তুমিও রেডি হয়ে বেরোও।”
জামা-প্যাণ্টটা কোনওমতে গলিয়ে নিয়ে বেরোলাম ক্যাণ্টিনের উদ্দেশ্যে। আমি পৌঁছনোর মিনিট দু’য়েকের মধ্যেই সান্যালদাও এসে হাজির। “কী ব্যাপার? এত জরুরি তলব?” আমি উত্তর দেওয়ার আগেই সান্যালদা বলে উঠল, “চলো ভিতরে গিয়ে বসি আগে। বাইরে বহুত গরম।”
ঘড়িতে বাজে সকাল ন’টা। ক্যাণ্টিনের ব্রেকফাস্ট আরও আধঘণ্টা পাওয়া যাবে। আমরা এগিয়ে গিয়ে দেখি, আজকের মেনু টোস্ট, অমলেট, আর কেক। আমরা ব্রেকফাস্ট আর সাথে গরম চা নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসলাম। আজ ক্যাণ্টিনটা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা, একটু শান্তিতে বসে কথা বলা যাবে। টোস্টে একটা কামড় দিয়ে সান্যালদা শুরু করল, “হ্যাঁ, এবারে বলো কী হয়েছে।”
“আর বলো না গুরু। এই পরীক্ষা শেষ হচ্ছে, ছুটি পড়বে। গিন্নি বলেছে পাহাড়ে বেড়াতে যাবে। আর আমার ভূগোলের দৌড় তো তুমি জানোই। আমায় ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করতে বলা আর বিয়ার গ্রিলসকে নিরামিষ খেতে বলা প্রায় একই জিনিস।”
“হ্যাঁ, তোমার ঘুরতে যাওয়া মানে তো বাড়ির ছাদ অবধি,” বলে সান্যালদা ফিক করে হাসল।
“মাইরি বলছি গুরু, বহুত চাপে আছি। প্লিজ একটা উপায় বাতলে দাও। হাতে সময়ও তো আর বেশি নেই।”
“আরে অত চিন্তা করো না। শান্ত হয়ে অমলেটটা খাও, বেড়ে বানিয়েছে। আর –”
আমি সান্যালদার কথা শেষ করতে না দিয়েই বললাম, “এই গুরু, তুমিই তো গত বছর শিমলা-কুলু-মানালি ঘুরতে গিয়েছিলে। ঠিক বলছি তো?”
সান্যালদা একটা প্রশান্তির সাথে জবাব দিল, “সেই জন্যই তো বলছি, একেবারে চিন্তা করো না। পুরো প্ল্যানটা কীভাবে করতে হবে, বলে দেব। এখন শান্তি করে খাও তো দেখি।”
“যাক, তুমি বাঁচিয়ে দিলে গুরু,” বলে আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চায়ের কাপটা তুলে একটা চুমুক দিলাম।
“যতক্ষণ সান্যালদা আছে, টেনশন নেহি লেনে কা।” বলে সান্যালদাও চায়ের কাপটা তুলে চুমুক দিল।
“সত্যি গুরু, তুমি আছো বলেই বেঁচে গেলাম।” বলে কেকটা তুলে খেতে খেতে বললাম, “কী জানো তো গুরু, বিয়ের আগে বন্ধুরা মিলে অনেক ঘুরতাম। কোন প্ল্যান নেই, কিছু নেই, হঠাৎ রাত্রে ঠিক হল সকালে ঘুরতে যাব, আর আমরাও একটা ব্যাগে জামাপ্যাণ্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। কি সব দিনগুলো ছিল।”
“আরে সে তো কলেজে পড়ার সময়ে আমরাও কত ওইভাবে ঘুরেছি। বাসে বা ট্রেনে চাপার দু’ঘণ্টা আগেও জানতাম না যে কোথায় ঘুরতে যাচ্ছি। বেশ অ্যাডভেঞ্চারাস লাগত। আর এখন তো বয়স হয়েছে, দায়িত্ব বেড়েছে। ওইসব অ্যাডভেঞ্চার করতে গেলে বাড়িতে ঝ্যাঁটাপেটা খেতে হবে।” বলে সান্যালদা হাসতে লাগল।
“সেটা একেবারে ঠিক কথা বলেছ। তবে আমরা যখন কলেজে পড়ি, তখন আমাদের বেশির ভাগ ঘোরার প্ল্যান হত গাঁজার আড্ডায়। কারও মাথাই ঠিকঠাক কাজ করত না, আর সেজন্য সব উদ্ভট রকমের প্ল্যানিং হত। সেগুলোই ছিল আসল মজা।”
“আচ্ছা, তাই নাকি? তা কী রকম প্ল্যানিং হত শুনি একবার।”
আমি একটু চুপ করে চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দিয়ে বললাম, “ধরো, যদি তোমায় আজ নিউ ইয়র্ক যেতে হয়, তাহলে কত লাগতে পারে?”
“ওরে বাবা, সে তো বিশাল ধাক্কা। প্রায় দু’-তিন মাসের মাইনে বেরিয়ে যাবে।”
“হমম, ঠিক বলেছ। কিন্তু যদি ধরো, এই ট্রিপটাই যদি তোমায় সস্তায় ব্যবস্থা করে দিতে পারি?”
“সস্তায়? মানে কত?”
“এই ধরো, দু’শো টাকাতে।”
“কত?” সান্যালদা প্রায় বিষম খেতে খেতে বলল, “দু’শো টাকাতে?”
“হ্যাঁ, দু’শো টাকাতে।” আমি মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে বললাম।
“খুব একটা ভুল বলনি, এই রকম প্ল্যান হস্টেলে বসে গাঁজা খেতে খেতেই হতে পারে।”
“আরে প্ল্যানটাই তো শুনলেই না।”
সান্যালদা একটু মাথা চুলকে বলল, “যদিও একটা উধুম আষাড়ে গল্প দেবে জানি, তবুও ব্যাপারটা কিন্তু ইণ্টারেস্টিং লাগছে। মানে দু’শো টাকায় নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ মাথায় আসে কী করে, সেটাই শুনতে ইচ্ছে করছে।”
“দাঁড়াও, বলছি,” বলে চায়ের কাপটা তুলে একটা লম্বা চুকুক দিয়ে বললাম, “তাহলে শোন।”
ঘটনাটা আমার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের। সালটা ২০০৫, আমাদের ফাইনাল ইয়ার। আর কলেজে তখন ভরা প্লেসমেণ্টের মরশুম। কিন্তু আমাদের, অর্থাৎ আমার আর আমার গ্রূপের জনতাদের ব্যাপারটা একটু অন্য। আগের তিনটে ইয়ারে বেশ ভাল রকম ধ্যাড়ানোর জন্য যথারীতি আমাদের নম্বর কম, আর সেই জন্য অর্ধেকের উপর কোম্পানি আমাদের ইণ্টারভিউতে বসতেই দিচ্ছে না। তাই আমাদের একটু হলেও মন খারাপ। কলেজের অন্যান্য বন্ধুদের চাকরি পাওয়া দেখছি, আর ভাবছি নিজেদের ভবিষ্যতের কথা। দুঃখও হচ্ছে, চিন্তাও হচ্ছে। ঠিক এইরকম সময় আমাদের পরিত্রাতা হয়ে দেখা দিল আমাদের গ্রূপের সর্বেসর্বা – “মামা”। এই মামা এক অদ্ভুত প্রজাতির প্রাণী। সমস্ত জাগতিক মূল্যবোধের ঊর্ধ্বে এনার বিচরণ। জগতে এমন কোন সমস্যা নেই, যার সমাধান মামার কাছে নেই। আবার এর উল্টোটাও সত্যি। মোদ্দা কথা হ’ল মামা মধ্যপন্থায় বিশ্বাস করতেন না। তাই যতক্ষণ মামা আছে, আমাদের হয় কোন চিন্তা নেই, অথবা চিন্তা ছাড়া আর অন্য কিছুই নেই। তো আমরা একদিন সন্ধ্যেবেলায় হস্টেলের ছাদে জটলা পাকিয়ে বসে আছি, এমন সময় মামা অবতীর্ণ হলেন। এসেই মামা ডাক ছাড়লেন, “কী রে, সব মুখ ঝুলিয়ে বসে কেন?”
আমি মাথা তুলে বললাম, “তো কী করব বল মামা। শালা একটা কোম্পানিও ইণ্টারভিউতে ডাকছে না, আর বাকি পাবলিক চাকরি পেয়ে রোজ পার্টি করছে।”
“আচ্ছা, তাহলে পার্টি পাচ্ছিস না বলে দুঃখ করছিস।” মামা শান্তগলায় বলল।
“আবে,” এবারে অন্য একজন বলে উঠল, “পার্টি নয় বে, চাকরি পাচ্ছি না।”
“আচ্ছা, তাহলে চাকরি পাচ্ছিস না বলে দুঃখ করছিস।” মামার গলা আগের মতই শান্ত।
“নয় তো কি, ছাদের উপরে ল্যাংটো হয়ে নাচব?”
“হমম, সেটা করলে অবশ্য দুঃখ কমবে, কিন্তু ব্যাপারটা দেখতে ঠিক জমবে না।”
“দেখ মামা, মাথা গরম করাস না। এখন কেটে পড়।” অন্য একজন বলল।
“দেখ, আমি তো কেটে পড়তেই পারি, কিন্তু তাতে কি তোদের সমস্যা মিটবে?”
আমি এবারে একটু সোজা হয়ে উঠে বসে বললাম, “কী কেস বল তো?”
মামা এবারে এগিয়ে আমাদের মাঝখানে এসে বসল। তারপরে আস্তে আস্তে বলতে শুরু করল, “দেখ, তোরাও চাকরি পাচ্ছিস না, আমিও পাচ্ছি না। কিন্তু এইভাবে মন খারাপ করে বসে থেকে লাভটা কী?” তারপরে একটু ঝুঁকে সবার দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে হাতটা মুঠো করে বলল, “এখন আমাদের জীবনে দরকার পজিটিভিটি। সমস্ত নেগেটিভ চিন্তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। মনকে নিয়ে যেতে হবে আরও উপরের স্তরে, এইসব ছোটখাট চাকরির মারামারি থেকে অনেক, অনেক উপরে।”
মামাকে যতটা চিনি, নিশ্চয়ই কিছু একটা বিটকেল মতলব নিয়ে এসেছে। আমি একটু সন্দেহের সুরে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী বলতে চাইছিস বল তো?”
মামা একটু হেসে বলতে শুরু করল, “তোদের দুঃখের কারণ চাকরি পাচ্ছিস না। চাকরি পাচ্ছিস না, কারণ নম্বর কম। নম্বর কম, কারণ পড়াশুনো করিস নি। পড়াশুনো করিস নি, কারণ তোরা জীবনকে উপভোগ করতে চেয়েছিলি। জীবনে বাঁচতে চাওয়াটাই আনন্দ, কিন্তু বেঁচে থাকার উপায় খোঁজাটাই দুঃখের। আজ সেই দুঃখ থেকে তোদের মুক্তি।” এই বলে মামা পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল এক মোক্ষম জিনিস – গাঁজার ছিলিম! “জগতের সৃষ্টি-বিনাশ যাঁর হাতে, আজ সময় এসেছে সেই মহাদেবের চরণে নিজেদেরকে নিবেদন করার। ব্যোম ভোলে!” আমরা হাঁ করে মামার দিকে তাকিয়ে। মামা অন্য পকেট থেকে গাঁজার পুরিয়া বের করতে করতে বলল, “খোদ মণিপুরী জিনিস বে। এই টানেতেই ত্রিভুবন দেখতে পাবি।”
“এ জিনিস কোত্থেকে জোগাড় করলি রে?” আমি উৎসাহের সাথে জিজ্ঞাসা করলাম।
“তুমি ধোঁয়া টানো, আগুনের খোঁজ করতে যেও না।” বলে মামা গাঁজা তৈরি করতে শুরু করল। আমরাও আর কেউ উচ্চবাচ্য করলাম না। আমরা প্রায় প্রত্যেকেই এর আগে সস্তা লোকাল গাঁজা খেয়েছি, বিশেষ জমেনি। কেউ কেউ তো আবার পুরিয়াতে শুকনো ঘাস ভরে দিয়ে দিত। কিন্তু এই মণিপুরী গাঁজার ব্যাপারে অনেকের কাছেই শুনেছি, কিন্তু কোনদিন চোখে বা চেখে দেখিনি। তাই সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি কখন মামার তৈরি করা শেষ হবে। মিনিট পাঁচের মধ্যেই মামা ছিলিমের মধ্যে বস্তুটিকে টিপেটাপে পুরে আগুন ধরিয়ে এক ব্রহ্ম টান দিয়ে ছিলিমটা আমার হাতে ধরিয়ে চোখ বুজে বসে থাকল। আমিও দিলাম একটা লম্বা টান। ধোঁয়াটা ভিতরে যেতেই বুঝলাম সেটা কি মারাত্মক জিনিস। আমি ছিলিমটা পাশের জনকে দিয়ে চোখ বুজলাম। কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই সবার শিবনেত্র দশা। মামা ধীরকণ্ঠে টেনে টেনে বলল, “কেমন লাগছে?” উত্তরে কেউ হুঁ-হুঁ করল, কেউ দুলতে দুলতে হে-হে করে হাসল, কেউ ঝিম মেরে বসে রইল। মামা এবারে বিরিঞ্চিবাবার ঢংয়ে জিজ্ঞাসা করল, “দুঃখ আছে? কষ্ট আছে? চিন্তা আছে?”
আমরা সবাই চুপ করে চোখ বুজে বসে বসে দুলছি।
এরপর থেকে প্রায়ই হস্টেলের ছাদে আমাদের মণিপুরীর ঠেক বসত। মামা মধ্যমণি, তাকে ঘিরে আমরা সবাই। কয়েকটা দিন যাওয়ার পরে আস্তে আস্তে আমরা সকলে মণিপুরী গাঁজায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। এখন আগের মত ঝিম মারা অবস্থাটা থাকলেও আড্ডাতে ব্যাঘাত ঘটত না। এইরকম একদিন রাতে আমরা ছাদে বসে ঝিম মেরে বসে আছি, হঠাৎ একজন বলে উঠল, “কোথাও ঘুরতে গেলে ভাল হয় রে। হস্টেলে ভাল লাগছে না।”
মামা নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলে উঠল, “কোথায় যাবি?”
“সেসব কিছু ভাবিনি। কোথাও একটা গেলেই হয়।”
“হমম। যদি যেতেই হয়, তাহলে খুব দূরে যেতে হবে। এই সংসার থেকে অনেক, অনেক দূরে।”
আমি চোখটা হালকা খুলে বললাম, “কোথায়? তিব্বত?”
মামা আমার দিকে আধবোজা চোখে তাকিয়ে বলল, “নিউ ইয়র্ক।”
গাঁজার একটা বিশেষত্ব হ’ল, শিবনেত্র দশায় বিবাদ অথবা বিতর্ক করবার প্রবণতা প্রায় অনেকটাই চলে যায়। সমস্ত কথাই বেশ যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। তাই নিউ ইয়র্কের কথাটা শোনার পরেও সবাই বেশ বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে হুঁ-হুঁ করতে লাগল। মামার পাশ থেকে একজন তো চোখ বুজেই বলল, “দারুণ জায়গা। আমি গিয়েছি। এখান থেকে কাছেই, বেশিক্ষণ লাগে না।” যদিও বোলপুর থেকে লোকাল ট্রেনে দুর্গাপুরের বাইরে সে কোনদিন পা রাখেনি, কিন্তু তাতে কী? মামা তার কথা শুনে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “জানি তো, সেই জন্যই তো আমরা সবাই সেখানে যাব।”
এবারে আমি বললাম, “আমিও যাব মামা।”
মামা এবারে সবার দিকে আধবোজা চোখে তাকিয়ে বলতে শুরু করল, “সবাইকে নিয়ে যাব। শুধু আমি যেভাবে বলব, সেভাবে গেলেই কিন্তু পৌঁছতে পারবি।”
“কী করতে হবে মামা?” আরেকজন পাশ থেকে জিজ্ঞাসা করল।
“সবার আগে আমাদের লাগবে একটা নৌকো আর একটা লম্বা দড়ি। কলকাতার ডক থেকে প্রতি সপ্তাহে নিউ ইয়র্কের জন্য জাহাজ ছাড়ে। আমাদের ওই রকম একটা জাহাজের খোঁজ লাগাতে হবে। তারপরেই আসল খেলা শুরু।” বলে মামা চোখ বুজল।
কয়েক সেকেণ্ড পরে মামাকে একটু ধাক্কা দিতে মামা চোখটা একটু খুলে আমার দিকে তাকাতে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “তারপরে?”
মামা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল, “কিসের পরে?”
“নিউ ইয়র্ক, জাহাজ, নৌকো, দড়ি – তারপরে কী?”
“ও হ্যাঁ, নিউ ইয়র্ক। ভুলে গিয়েছিলাম।” বলে মামা ছিলিমে একটা টান দিয়ে আবার শুরু করল, “আমাদের খোঁজ নিতে হবে জাহাজ কোনদিন বেরোয়। আমরা তার আগের থেকে গিয়ে সেই জাহাজের সাথে আমাদের নৌকোটা বেঁধে দেব। তারপরে নৌকোতে বসে অপেক্ষা করব। জাহাজটা ডক থেকে বেরোলে জাহাজের পিছুপিছু আমরাও বেরিয়ে পড়ব। তারপরে, মাঝসমুদ্রে গিয়ে নৌকোটা উল্টে দেব।”
সুস্থ অবস্থায় থাকলে মামার এতক্ষণে বেধড়ক প্যাঁদানি খেয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু শিবনেত্র দশায় আমরা সবাই গভীর মনোযোগ সহকারে মামার প্ল্যানটা বোঝার করছি, আর বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ছি। এরই মধ্যে খুব কাতরস্বরে একজন প্রশ্নটা করল, “মামা, তুমি আমাদের এইভাবে ডুবিয়ে দেবে?”
“না রে পাগলা। তোরা কেউ ডুববি না। তোদের সবার পকেটে থাকবে একটা করে ছোট আয়না। জলে পড়ে যাওয়া মাত্র তোরা সেটা বের করে আলোর রিফ্লেকশন ফেলবি জাহাজের উপর। তখন জাহাজ থেকে লোকজন এসে আমাদের জাহাজে তুলে নেবে।”
আমরা মাথা নেড়ে নেড়ে শুনে চলেছি, আর মামা বলে চলেছে, “জাহাজে উঠেই সবাই আমাদের পাসপোর্ট দেখতে চাইবে। আমরা বলব, সমুদ্রে ভেসে গিয়েছে। ওরা তো তখন আমাদের নামানোর জন্য মাঝসমুদ্র থেকে জাহাজ আর ফিরিয়ে আনতে পারবে না। তাই ওরা তখন আমাদের নিয়ে গিয়ে নিউ ইয়র্কেই নামাবে।”
আমরা সবাই প্রায় সমস্বরে “দারুণ প্ল্যান মামা” বলে ছোটখাট জয়ধ্বনি দিয়ে উঠলাম। কিন্তু এর মধ্যেই আরেকজন প্রশ্ন করল, “মামা, ফিরব কীভাবে?”
মামা তখন আবার বলতে শুরু করল, “সে সব ভেবে রাখা আছে। যে জাহাজ আমাদের নিয়ে যাবে, ওদেরকেই জিজ্ঞেস করে নেব যে ওরা কবে ফিরছে। আমরা জাহাজ থেকে নেমে এদিক ওদিক ঘুরেফিরে কয়েকটা কোম্পানিতে বায়োডেটা দিয়ে আবার ওই জাহাজে করেই ফিরে আসব। আর হ্যাঁ, সবাই মনে করে পকেটে দু’শো টাকা করে রাখিস।”
“কেন মামা?”
“নৌকো আর দড়ি কিনতে চল্লিশ টাকা করে লাগবে। বাকিটা ওখানে খাওয়াদাওয়া আর বায়োডেটা প্রিণ্ট করতে তো লাগবে। ওখানে কোন কালীবাড়ি থাকলে সেখানে খাওয়ার ব্যবস্থাটা সস্তায় হয়ে যাবে, আর কাছেপিঠে কোন সাইবার ক্যাফে থেকে বায়োডেটাগুলো প্রিণ্ট করে নেব। তাছাড়া নিউ ইয়র্ক থেকে ফেরার সময় হাতে করে একটা গিফটও তো আনতে হবে। প্রথমবার যাচ্ছি, স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে নিয়ে আসব।”
“আচ্ছা মামা, টাকা তো জলে ভিজে যাবে। রাখব কোথায়?”
“আহ, এত বোকা বোকা প্রশ্ন করিস কেন? টাকাটা একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে জাঙ্গিয়ার মধ্যে রেখে দিবি। তাহলে আর হারাবেও না, ভিজবেও না। কমন সেন্স।”
আমরা সবাই আধবোজা চোখে বলে উঠলাম, “ঠিক, ঠিক।”
এই পর্যন্ত বলে আমি থামলাম, চায়ের কাপটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। সান্যালদা এতক্ষণ হাঁ করে শুনছিল। প্লেটের অমলেট ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। সেটার দিকে একবার করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “এটা তোমাদের প্ল্যান ছিল?”
আমি টোস্টের শেষ টুকরোটা মুখে পুরতে পুরতে বললাম, “হ্যাঁ গুরু।”
“মাইরি, এই লেভেলের উদ্ভট আইডিয়া আসে কোত্থেকে?”
“এসব আইডিয়া একমাত্র মামার মাথা থেকেই আসত, তাও মণিপুরী পেটে যাওয়ার পরে।”
“তা তোমার এই মামা এখন কী করে?”
“আরে, ভাল কথা মনে করিয়ে দিলে। গেল বার পুজোর সময় বাড়ি গেলাম, হঠাৎ একটা ক্যাফেতে মামার সাথে দেখা। সে এখন এক বেসরকারি ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ অফিসার। কথায় কথায় হস্টেলের সব পুরনো স্মৃতিগুলো উঠে আসল। বলতে বলতে এই দু’শো টাকায় নিউ ইয়র্কের ঘটনাটার কথাও উঠল। আমরা দু’জন তো পুরো গল্পটা করতে করতে হাসাহাসি করছি। এমন সময় মামা একটা কথা বলল, যেটা শুনে আমি একেবারে চুপ হয়ে গেলাম।”
“কী বলল?” সান্যালদা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
“মামা বলল, ও পুজোর সময় বলে ছুটি নিয়ে দেশে এসেছে। কিন্তু সে এখন কোথায় থাকে জানো?”
“কোথায়?”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “নিউ ইয়র্কে।”
সান্যালদার মুখ দিয়ে আর কথা সরল না। চামচ থেকে ঠাণ্ডা অমলেটের টুকরোটা টুক করে আবার প্লেটে পড়ে গেল।
লেখক পরিচিতি : অভীক সিংহ
গল্পটির লেখক ডঃ অভীক সিংহের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষক, যুক্ত আছেন লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে, বর্তমান বাসস্থান চীন। তবে ভালবাসাটা আজও লেখালিখি, পেন্সিল স্কেচ, যন্ত্রসংগীত, এবং নিত্যনতুন রান্নাবান্নার সাথেই রয়ে গিয়েছে। প্রথম বই "R.E.CALL: এক Recollian-এর গল্প" প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখালিখির সূত্রপাত হলেও এখন প্রবন্ধ এবং গল্পতেই মনোনিবেশ করেছেন।