লেখক: মিত্রা হাজরা
রোজের জীবনের খুঁটিনাটি ভুলে যায় ঝিনুক, কোথাও বেড়াতে গেলে। আকাশে বাতাসে যেন আশ্চর্য স্বাধীনতা, মাছরাঙাটা টুপ করে ডুব দিয়ে মাছ ধরে নুয়ে পড়া গাছের ডালটায় বসে, মাঠ ঘাট, পথের দৃশ্য ঝিকঝিক, ঝুকঝুক,ট্রেনের সাথে পালটে পালটে যাচ্ছে। সামনেই যে যাত্রী বসে আছেন, না চাইতেও তাঁর দিকে দৃষ্টি চলে যাচ্ছে, কোথাও কি দেখেছে আগে! জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে থাকে সে।
কতদূর যাবে? —-তাকিয়ে দেখে সেই মানুষটি, গড়পড়তা মধ্যবয়সী, চোখ দুটো উজ্জ্বল, কালো ফ্রেমের চশমা।
আপনি চেনেন আমাকে? তুমি ঝিনুক তো! ঘাড় নাড়ে সে, আমি অনিন্দ্য, অনু -দা —-এতগুলো বছর পর কি করে চিনতে পারল না সে, আসলে তুমি কিন্তু বেশ পাল্টে গেছ —-হ্যাঁ মোটা হয়েছি, আবার টাক ও পড়েছে, হাসলো অনিন্দ্য।
তুমি কিন্তু একটুও পাল্টাও নি ।শুধু বয়সের ছাপ পড়েছে, এই যা।
মনে পড়ে যায় —-মানুষ স্বপ্ন দেখে মুহূর্তের মস্তিস্ক বিকলনে ।এখন মনে হচ্ছে অতীত টা আবরণ সরিয়ে বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছে। সেখানে সংকোচ নেই, জড়তা নেই, সমাজের রক্তচক্ষু নেই। প্রথম প্রেম শুধুই কাঁদায়, শুধুই কষ্ট দেয়। এই ট্রেনের কামরায় এত যাত্রীদের মাঝে ও ঝিনুক একা হয়ে যাচ্ছে। একটা প্লাবন মুক্তি চাইছে রক্ততরঙ্গে। মোহ মদির অচেতনায় যেন আগল দিচ্ছে খুলে।
সেই সন্ধ্যা, হিমাঙ্গ আকাশে অগন্য নক্ষত্র রাজি তার সাক্ষী, বসে আছে দুটি ছেলে মেয়ে,আমি চলে যাচ্ছি, আর হয়তো দেখা হবে না, মেয়েটি আকুল হলো, চিঠি দেবে তো? কোনো উত্তর নেই, সেই ছেলেটাকে আর কখনো দেখেনি সে, অনেক খোঁজ খবর নিয়েছে, কিন্তু না, কখনো যোগাযোগ হয়নি, তারপর অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল ঝিনুক। সব দায়িত্ব, কর্তব্য সামলে এত গুলো বছর বেশ তো ভুলে ছিল সে, মাঝে মাঝে কোন অলস দুপুর, বা সন্ধ্যায় একা থাকা মুহূর্তে উঁকিঝুঁকি দেওয়া কিছু ছবি ভেসে বেড়ায়। আজ ট্রেনের এই কয়েক ঘন্টা যেন সেই স্মৃতিকে উসকে দিচ্ছে।
কোথায় যাচ্ছো? আমি রাউরকেল্লা, তুমি? আমি যাব ঝাড়সুকুদা। তোমার তো দুটো মেয়ে, মাসি বলছিল, খুব গিন্নি হয়েছো এখন! যাক আমার খবর রাখার সময় আছে তোমার! বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল ঝিনুক। অনিন্দ্য দেখে ভাবল, এক ই রকম আছে এখন ও ঝিনুক, সামান্য কারণে ঠোঁট ফোলানো।
কি করে ওকে বলে যে ঝিনুকের মা ই ডেকে অনুনয় করেছিল, বাবা ঝিনুকের বাবা নেই, ওর জ্যাঠা রা ওকে বড় করেছেন, লেখাপড়া শেখাচ্ছেন,ওর ভালো জায়গায় বিয়ে দেবেন বলে পাত্র ঠিক করেছেন। তুমি আর ওর সাথে মেলামেশা কোরো না। তাই ও সবকিছু ছেড়ে, ঝিনুক কে ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
আসলে ওদের গরীবের ঘরে ভালোবাসার কোন দাম নেই, ওই গরীবের ঘোড়ারোগ বলে নাকি একে!
ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে, বোধহয় টাটানগর এলো, প্লাটফর্মে নেমে দুভাঁড় চা নেয় অনিন্দ্য, নাও ধর, ভাঁড়ে চা, মনে আছে তাহলে ভাঁড়ে চা পছন্দ করতো ঝিনুক ।আগ্রহে চা নিয়ে ফুঁ দেয় ঝিনুক, বেশ গরম চা, তারিয়ে তারিয়ে খায়।
যে কথাটা এতক্ষন প্রাণপণ লুকোতে চাইছে দুজনে, যেন সব ই স্বাভাবিক আছে ,সেটা বলার জন্য মনটাকে তৈরি করতেও তো সময় লাগছে, একটা ঝালমুড়ি ওয়ালা এসেছে, অনিন্দ্য বলে বানাও তো ভাই বেশ ঝাল ঝাল করে, ঠোঙা নিয়ে একটা একটা করে মুড়ির দানা মুখে পুরছে ঝিনুক।
এবার কাছাকাছি এসে গেছে গন্তব্য ঝিনুকের, ওর দিকে তাকিয়ে বলল কেন একটাও চিঠি দিলে না, যোগাযোগ রাখলে না, আমি কি এত ই অযোগ্য ছিলাম অনু-দা !
কি করে বলে—-এতগুলো বছর শুধু টাকার পিছনে ছুটেছে, শুধু আর ও আর ও টাকা চাই। কারোর ভালোবাসা পায়নি, কারোর ঘৃনা সয় নি,শুধু মরুভূমির উপর দিয়ে হেঁটেছে। না একটু ভুল হলো, কিছু অবোধ শিশুর সে দায়িত্ব নিয়েছে, যাদের কেউ নেই, তাই সে যাচ্ছে ঝাড়সুকুদা, মাঝে মাঝে মাঝে আসে এখানে, মনটা ভালো হয়ে যায় এদের মাঝে এসে। মুখে বলে আমার দারিদ্রের মধ্যে তোমাকে আনতে চাইনি ঝিনুক, এই ভালো হয়েছে।
ট্রেন রাউরকেল্লা ঢুকছে, ঝিনুক নেমে যাচ্ছে, ওর হাতটা ছুঁতে খুব ইচ্ছে করছে অনিন্দ্যর, কিন্তু নিজেকে বেঁধে রাখলো কঠিন বর্মে, মুখে মৃদু হাসি, যেন কিছু যায় আসে না ঝিনুকের চলে যাওয়া। সবার কি সৌভাগ্য হয়, প্রিয়জনের হাতে হাত রাখার!
লেখকের কথা: মিত্রা হাজরা
আমি মিত্রা, লেখালেখি করতে ভালোবাসি, কবিতা, ছোটগল্প লিখি মাঝে মাঝে। বই পড়তে ও গান শুনতে ভালোবাসি। পড়ি শংকর এর লেখা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প আমার খুব প্রিয়। জীবনানন্দ দাশ, রুদ্রমুহম্মদ শহিদুল্লা, সুনীল, বিষ্ণু দে এর কবিতা পড়তে ভালোবাসি। আমার লেখা পড়ে আপনাদের ভালো লাগলে বা খারাপ লাগলে অবশ্যই জানাবেন।