লেখক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী
দ্বারটি সবসময় বন্ধ থাকত বোস বাড়ির। তিনতলা বাড়ি। লাল রঙের। জানলা দরজা সব সবুজ রঙের। তাতে বাড়িটার আকর্ষণ যেন আরও বেড়েছে। লোহার মোটা মোটা গরাদ। কোনও দুর্গের প্রবেশ পথের মতো দু’পাশে মোটা দেওয়াল, একটু উঁচুতে জানলা। দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে চাপা কপাট। যা নাকি এদের পূর্বপুরুষদের তৈরি করা। কারণ তখন ডাকাতি হত চিঠি দিয়ে জানিয়ে। আর এই চাপা কপাট একবার ফেলে দিলে ডাকাতদের সাধ্য ছিল না ওপরে ওঠার। এখন অবশ্য সেই কপাট শুধু সিঁড়ির দুপাশে শিকলে আটকানো আছে, বন্ধ বা খোলা কোনোটাই করা যায় না।
বিরাট এলাকা জুড়ে বাড়ি ওদের। একপাশে ঠাকুরদালান। তাতে খড়ের মা দুগ্গার কাঠামো সারা বছর বিদ্যমান। বোসরা রোজ ঠাকুরদালানে পিদিম দেখায়। একটি ধূপ নরম মাটির তালের মধ্যে গুঁজে দিয়ে যায় ওদের বাড়ির বড় বউ। ভারি শান্ত চোখ দুখানি বৌটির। সবসময়ই মাথায় ঘোমটা টানা। ঘোমটার মধ্যে দিয়ে যতটুকু দেখা যায় চোখ দুটির বড় বড় টানা পল্লব… যেন থির কাকচক্ষু শানবাঁধানো পুকুরের জল। বুলু প্রায় রোজই দেখে, ওই চোখ, স্বপ্নে। কাকীমা বলে ডাকে।
বোস বাড়ির আগের বোলবোলাও আর নেই। কলসীর জল গড়াতে গড়াতে এখন আর গলা ভেজার মত জলও নেই, তবু ঠোঁট ভেজে এখনও। তাতেই বাইরের ঠাটবাট বহাল থাকে। বাড়ির লাল রঙে দীর্ঘদিন প্রলেপ পড়েনি, তবু আগেকার দিনের বলে এখনও চলকা ওঠেনি। জানলা দরজার সবুজে এখনও রোদ ঝিলিক মারে। তাই অচেনা লোকও বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে দু’বার বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে।
ঠাকুরদালানে পিদিম ধূপ দেওয়া হয় ঠিকই, কিন্তু ওটা ঠাকুরঘরের সমাদর পায় না বছরের অন্যান্য দিন। একমাত্র দুগ্গাপুজোর চারটে দিন ঠাকুরদালান যথার্থ ঠাকুরবাড়ি হয়ে ওঠে। ধূপ, ধুনো, চন্দন, ফুল, শাঁখের আওয়াজ, নতুন শাড়ি, ঢাকের বাদ্যিতে বোসবাড়ি আবার নিজের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দেশের বাইরে থেকে, দেশের মধ্যে অন্যান্য রাজ্য থেকে এ বাড়ির ছেলেমেয়েরা আসে, কুটুম্বরা আসেন। তখন এ বাড়ির ক্ষয়ে যাওয়া স্থায়ী বাসিন্দারা নিজেদের তোরঙ্গ খুলে কয়েকটা সাবেকি গয়না, যেগুলো এখনও বন্ধক দেওয়া হয়নি, বের করে পরে। মুখের দারিদ্র্য হাসি দিয়ে চাপা দেয়।
বুলু পুজোর ক’দিন এ বাড়িতেই পড়ে থাকে। নিজের বাড়ির পথ মাড়ায় না। এ ক’দিন বুলুর চোখে কাকীমার চোখ প্রায়ই পড়ে যায়। বুলু চোখ নামিয়ে ফেলে। কাকীমা বলেন, “বুলু তুই ভোগ খেয়ে যাস। মা ঠাকুমা আসবেন তো?” বুলু মাথা নামিয়েই “হ্যাঁ” বলে। পাছে আবার ওই চোখে চোখ পড়ে যায়। কাকীমা ওর মাথার চুল ঘেঁটে দিয়ে চলে যান। বুলু অসাড় হয়ে অনেকক্ষণ মা দুর্গার দিকে তাকিয়ে থাকে।
বিনু বুলুর থেকে এক দু বছরের ছোটো হবে, কিন্তু মেয়ে তো! বড় পাকা। খুব জ্ঞানের কথা বলে যখন তখন বুলুকে। এটা করিসনি, ওটা ধরিসনি, এটা করলে পাপ হবে, সেটা বললে পাপ হবে, ঠাকুর নাকি সব দেখতে পান, এইসব। বুলু বিনুর কথা বিশ্বাস করে। বিনুর বাবা কোডারমায় কয়লা খনিতে বড় চাকরি করতেন। বোসবাড়ি তখন রমরম করত। বিনুর মা, মানে কাকীমা তখন এক গা গয়না পরে ঘুরতেন দুগ্গাপুজোর সময়। নাকে থাকত ফাঁদি নথ। তাতে কাকীমাকেই লোকে দুর্গা প্রতিমা ভাবত, একথা এ পাড়ায় অনেক লোকের মুখে শুনেছে বুলু। সে নিজে অবশ্য দেখেনি। সে ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার মুখ পর্যন্ত কাকীমার শুধু দীঘল দুটি চোখ দেখতে পায়। শান্ত, সমাহিত, টলটলে, গভীর দুটো চোখের স্বপ্ন ইদানিং সে প্রায়ই দেখে। তার হাফপ্যান্ট প্রায়ই নোংরা হয়ে যাচ্ছে আজকাল। পড়াশোনায় মনও দিতে পারে না পুরোপুরি। এরকম সে ছিল না। কিন্তু ওই মুখপুড়ি বিনু যতো নষ্টের কারণ।
বোস বাড়ির সামনেটা দেখে এর পেছনটা কেউ কল্পনা করতে পারে না। পেছনে বিশাল একটা বাগান আছে, আর তাতে কী নেই! আম, জাম, পেয়ারা, কাঁঠাল, লিচু, পেঁপে, নারকেল, কী নেই? আম গাছই আছে সাতরকমের। এই আমের লোভে বোস বাড়ির পেছনের পাঁচিলের ফোঁকর গলে টিফিন পিরিয়ড বা লম্বা গরমের ছুটিতে পা টিপে টিপে দুপুর বেলা ঢুকে পড়াই যায়। তারপর কাঁচা কষ্টি আম দিয়ে শুরু হত। জামাইষষ্ঠীর সময়েও গাছ পাকা আমের রস বুলুদের হাতের ফাঁক গলে টসটস করে গড়িয়ে নামত। বুলুরা তা দেখে আবার হুড়ুস করে গড়িয়ে যাওয়া রস চেটেপুটে নিত। বিনুও থাকতো কতক সময় এই চুরির ভাগিদার হয়ে। আবার কখনো থাকতোও না।
এইরকমই একটা ঝুম দুপুরে বুলু আচমকা বড় হয়ে গেছিল। সেই যে ছড়া আছে না!
‘ঠিক দুক্কুরবেলা ভুতে মারে ঢেলা!’
ঠিক সেই রকম দুপুরে বুলুর আম খাওয়ার ঝোঁক চাপল। পিন্টু, কাবুল, দেবু কেউ বেরোল না। মানে বেরোতে দেওয়া হল না ওদের, অঙ্কের খাঁড়া ঝুলিয়ে। বুলু বরাবর যদিও ফার্স্ট হয়ে ওঠে প্রতি বছর, তবু ওর এই দুপুর বেলা ‘টো’ ‘টো’ গিরি কারোর বাবা মায়ের পছন্দ নয়। অথচ ফার্স্ট বয়ের সঙ্গে মিশতে সরাসরি বারণও করা যায় না, তাই দুপুরে অঙ্কের পাঠ চাপিয়ে দেওয়া। সবই বোঝে বুলু। কবিতায় বলেছে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’। বুলু এতেই বিশ্বাসী।
বুলু একলাই ঢোকে পাঁচিলের ফোঁকর গলে। কাঁচামিঠে আমগাছটার নিচে তাকাতেই দু তিনটে তাজা আম নজরে পড়ে। তুলে নিয়ে প্যান্টে রগড়ে মুছে এক কামড়। গোটা মুখ নরম টক মিষ্টি স্বাদে বিভোর। ইস! নুন আনা হয়নি। ভাবতেই পাশ থেকে ছোট হাত বাড়িয়ে নুন আসে। গা শিউরে ভাল করে দেখে বুলু। বলা তো যায় না! দুপুর বেলা নিঝুম জায়গায় তেনারা আসেন।
“হি! হি! ভয়ে ম’লি গাধা একটা, আমি রে! আমি!”
ওহ! বিনু! ভাগ্যিস! “ধুস! ভয় কে পেয়েছে?” বুলু সাহসী হয়।
“তাই বুঝি? খুব সাহস তোর?”
“হুঁ তো, ভয় পাই না আমি”
“তবে তোর হাত দে” বিনু ওর হাতটা নেয়। তারপর নিজের মুখ, ঠোঁট, তারপর আরও নিচে, আরও নিচে নরম কবোষ্ণ ছোট ডাঁসা পেয়ারার মত কিন্তু নরম একটা স্পর্শে বুলুর গায়ে ঘাম দেয় বিনবিন করে। বিনু ওর হাতটা আরও নামাতে থাকে। বুলু ভয় পেয়ে বাঁ হাতের আম ছুঁড়ে ফেলে ডান হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে নেয়।
“তুই অসভ্য মেয়ে!”
মুখ রাঙা করে নাক ফুলিয়ে বিনু বলে, “ও তুই বুঝি খুব সভ্য ছেলে? আমি বুঝি না, না !”
“কী? কী বুঝিস তুই?”
“কীসের টানে তুই ছোঁক ছোঁক করে এত আসিস?”
“মানে?”
“বলবো সবাইকে ডেকে?”
বুলু ভয় পেয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে
“কেন? কী করেছি আমি? তুই অসভ্য মেয়ে এটা আমি সবাইকে বলে দেবো।”
“তুই কাকে দেখতে আসিস রোজ আমি বুঝি না?”
“কাকে দেখতে আসি?”
“আমার মাকে দেখতে আসিস তুই।”
বোবা বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে থাকে এক বালক। হঠাৎ করে মনে হয় সে উলঙ্গ হয়ে গেছে তার বন্ধুর কাছে। এটা তো তার মনের গভীরে থাকা একটা ভালবাসা, একটা ভালো লাগা, সেটার খবর ও নিজেও জানতো না ঠিক মতো, বিনু কী করে জানলো!!
হিস হিস করে একরত্তি মেয়ে বলে, “বাবার কোলিয়ারিতে অ্যাকসিডেন্টের পর থেকে বাবা তো আমার হাবাগোবা হয়ে গেল, আমরা গরীব হলুম। বাবার কথা বেরোয় না ভাল করে, নাল পড়ে মুখ দিয়ে। আর আমার দুগ্গাপতিমার মতো মা কী হলো দেখবি? আয় আমার সঙ্গে!” বলে হিড়হিড় করে ওকে টানতে টানতে নিয়ে যায় বিনু। ভয়ে, রাগে, ধরা পড়ে যাওয়া বুলু বিষম বিস্ময়ে ওর পিছু পিছু যেতে বাধ্য হয়।
টানতে টানতে ওকে নিয়ে আসে একেবারে আম গাছের শেষ সারির কাছে যার পাশ দিয়ে ফল্গুনদীর শুরু। এ নদীর নাম ফল্গু হয়েছে কারণ সারা বছর জল থাকে না, বর্ষার ক’টা দিন ছাড়া। বাকি সময় মাঝে মাঝে বালি, আর একটু আধটু জল। বোসবাড়ির পাঁচিলের একপাশ দিয়ে সে বয়ে যায় আপন মনে। এখানটা বেশ নির্জন, ঝুপসি মত। বুলুরাও কেউ আসে না। এখানে কেন নিয়ে আসছে বিনু! আরও কাছে আসতেই একটা অদ্ভুত নিঃশ্বাসের আওয়াজ পায় ওরা। সে আওয়াজে বুলুর মধ্যেও কীরকম উথাল পাতাল হয়ে যেতে শুরু করে যেন। একটু দূরে ঝরা আম জাম পাতার ওপর উদলাগায়ে শুয়ে আছে কাকীমা! গায়ে সুতোটিও নেই! আর তার ওপর বিনুর ছোটকাকা!!
হঠাৎ করে ভীষণ বমি পায় বুলুর। তার সঙ্গে কাঁপুনি। ভীষণ ক্রোধে বিনুর হাত ঝটকা দিয়ে বুলু ছোটে। ছোটে ওই ফোঁকরের দিকে। ছুটতে ছুটতে একবার ঘেন্নায় ফিরে দেখে বিনুর দিকে। বিনু ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে নিঃশব্দে, প্রেতিনীর মতো!
আর কোনদিন বোস বাড়ির দরজা ডিঙোয়নি বুলু। বিনুর সঙ্গে বন্ধুত্ব এখনও আছে। তবে দেখা হয় না কারোর সঙ্গে কারোর। বোসবাড়ির সে আম বাগান শ্মশানে পরিণত হয়েছে। না, আক্ষরিক অর্থে নয়। সেখানে আবাসন গড়ে উঠেছে অনেকদিন। ফল্গু পরিণত হয়েছে নালায়। শুধু এখনও বুলুর স্বপ্নে সেই আমবাগান মাঝেমধ্যে হানা দেয়, আর বুলু জেগে ওঠে।
লেখক পরিচিতি : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী
লেখিকা ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। দুটি একক গল্প সংকলন এবং অনেকগুলি পত্রিকায় ও সংকলনে একাধিক গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। আবৃত্তি ও শ্রুতিনাটকে দক্ষতার পরিচয় রাখেন।