সোয়েটার

লেখক : সুপ্রিয়া মণ্ডল

ছাদে মাদুর পেতে শীতের রোদে পিঠ দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে বিনতাদেবী একমনে উল কাঁটা দিয়ে সোয়েটার বুনে চলেছেন। এটা কিন্তু তাঁর অবসর যাপন নয়, এ তাঁর বহুদিনের অভ্যেস, বা বলা ভাল তাঁর ভালবাসা। কী শীত, কী গ্রীষ্ম, সারা বছরই তাঁর হাতে উল কাঁটা। স্বামী গত হয়েছেন তাও প্রায় বছর পাঁচেক হবে। এখন ছেলে, বৌমা আর একমাত্র নাতিকে নিয়ে তাঁর সংসার। নাতিটির বয়স তিন বছর। তাঁর ভীষণই আক্ষেপ যে, স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় নাতির মুখ দেখে যেতে পারলেন না। বিনতাদেবীরা জাতিতে ব্রাহ্মণ, স্বামী ছিলেন পুরোহিত। কিন্তু ছেলে বাবার পথে না হেঁটে চাকরির চেষ্টা করেছে, বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করে। বৌমাটি তাঁর বেশ আধুনিকা, আর হবে নাই বা কেন? ছেলে প্রেম করে বিয়ে করেছে কোন এক ধনীর ঘরের কন্যাকে, এখানে তার মানিয়ে নিতে এখনও যে অসুবিধা হয়, তা তার শাশুড়িমা ও স্বামীকে মাঝেমধ্যে কথাবার্তা বা ব্যবহারে বুঝিয়ে দেয়। বিনতাদেবী অবশ্য এই নিয়ে বেশি মাথা ঘামান না। তাঁর বক্তব্য, “বাইরে ঝামেলা হলেও পরিবারে যেন শান্তি বজায় থাকে। মাথা ঘামালেই মাথা ঘামবে।” তাঁর শখের মধ্যে ওই একটিই রয়েছে, সোয়েটার বোনা, তাই নিয়েই সময় কেটে যায়। কী শীত, কী গ্রীষ্ম, কী বর্ষা, সব সময় হাতে রং-বেরঙের উলের গোলা। তিনি নিজে দোকানে গিয়ে তাঁর পছন্দমতো রঙের উল কিনে আনেন, বিশেষ করে শীতকালে। তাঁর স্বামী, ছেলে – সবাই তাঁর হাতে তৈরি সোয়েটার, টুপি, মাফলার পরেই জীবনের অর্ধেকের বেশি শীত কাটিয়ে দিয়েছে। এখন অবশ্য ছেলে আর মায়ের তৈরি করা পরে না, হাল ফ্যাশনের বিভিন্ন ডিজাইনের সোয়েটার, জ্যাকেট দোকান বা শপিং মল থেকে কিনে আনে। বিনতাদেবী ছেলেকে মুখে কিছু বলেন না। তিনি এখন নাতির জন্য সোয়েটার, মোজা বানাতে ব্যস্ত। উল দিয়ে অনেককিছু বানালেও তাঁর নিজের খুব প্রিয় হচ্ছে সোয়েটার বোনা। বয়সের কারণে বুনতে বুনতে কোনো কারণে কাঁটা থেকে একটা ঘর পড়ে গেলে সেটাকে ঠিক করার জন্য তিনি নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে ওটা নিয়েই পড়ে থাকেন। 

তবে বিনতাদেবী যতই সোয়েটার বুনে আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে সুখ্যাতি অর্জন করুন না কেন, তাঁর একটা বড় রকমের স্বভাবদোষ রয়েছে। যদিও সেটা ঠিক দোষের নয়, কিন্তু মাঝে মাঝেই পাশের বাড়ির দিকে অহেতুক তীর্যক মন্তব্য ছুঁড়ে দেন তিনি। তাঁরা জাতে ব্রাহ্মণ, মানে এক্কেবারে সমাজের উঁচু তলার মানুষ, সবাই মান্যিগন্যি করে। নিয়ম, আচার এসব পঞ্জিকা দেখে খুব মেনে চলেন। পাশের বাড়ি আবার মুসাহার সম্প্রদায়ের। বিনতাদেবীর স্বামী বছর আটেক আগে মোটামুটি দামের মধ্যে বাড়িটা পেয়ে যান। এখানে তাঁদের কোনো স্থায়ী বাড়ি ছিল না, গ্রামের বাড়িতে ছিল। কিন্তু সেখান থেকে তারা শহরে চলে আসেন, তাই বাড়ির সন্ধান পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে কিনে নেন তিনি। বিনতাদেবী বাড়িতে আসার পরে যখন জানতে পারলেন যে, পাশের বাড়ি তাঁদের থেকে জাতিতে অনেকটাই নিচু, সেই নিয়ে স্বামীকে তিনি অনেক কথা শুনিয়েছিলেন,”বাড়ি কেনার আগে একবার ভাল করে খোঁজ নিলে না কেন, এখন কিভাবে থাকব?” ইত্যাদি। পাশের বাড়িতে স্বামী, স্ত্রী আর তাদের দু’টো ছোট ছোট ছেলে, মেয়ে বাস করে, অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া ঘর। লোকটার নাম ঝন্টু আর ওর বউ রুমকি। ওদের মেয়েটার বয়স দশ আর ছেলেটার তিন। বিনতাদেবীর নাতি বুবুনেরই বয়সী ছোট বাচ্চাটা। একই বছরে দু’জনের জন্ম, তবে মাস আলাদা। ভ্যান চালকের পরিবার। বিনতাদেবী তাঁর সোয়েটার বোনা থেকে ফুরসত পেলেই বাড়ির চারপাশে গঙ্গা জল ছেটান। এই তো সেদিন রুমকি নামের মুসাহার বউটা ওদের কলপাড়ে স্নান করতে গিয়ে তার জল বিনতাদেবীদের বাড়ির দেওয়ালে পড়েছিল, তাই নিয়ে তিনি শুরু করলেন, “দেখো বাপু, আমি কারোর সাতে-পাঁচে থাকি না। শুধু ভগবানের নাম জপ আর আমার সোয়েটার নিয়ে থাকি। আমরা যে তোমাদের পাশে বাস করছি এই তোমাদের পরম ভাগ্যি, একটু দেখে শুনে তো চলতে পারো নাকি।” বউটা শুধু সম্মতিতে মাথা নাড়িয়েছিল। তাঁর ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে যে একটু বাতিক রয়েছে, সেই নিয়ে ছেলে তাঁকে একদিন বলেছিল, “মা, এসব এখন আর চলে না, যে যার নিজের মতো থাক না।” কিন্তু তিনি কারোর কোন কথাই কানে তোলেননি।

বিনতাদেবীর নিজের বৌমা অনেকদিন ধরে বলেছে, “আপনি আর ওই ওল্ড ফ্যাশনের সোয়েটার বানাবেন না। এখন নিউ স্টাইলের জিনিস বাজারে এসেছে, এইসব কেউ আর এখন পরে?” বিনতাদেবী কী আর বলবেন। নিজের বাড়িতে তিনি ছেলে, বৌমাকে কিছু বলতে পারেন না, তাঁর যত হম্বিতম্বি পাশের বাড়ির ওপর। তিনি তাঁর নিজের নাতিকেও পাশের বাড়ির বাচ্চাটার সাথে মিশতে দেন না। হপ্তাখানেক আগে বিনতাদেবী তাঁর বৌমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে কিছুই মুখে তোলেননি, কারণ মর্যাদায় তারা নিচু, আর যে প্লেটে দেওয়া হয়েছিল তাতে তিনি খেতে রাজি নন। বাড়ি ফিরে সেই নিয়ে ছেলে, বৌমার সঙ্গে মন কষাকষি। দিনকতক কেউ কারও সাথে কথা বলেনি, এমনকী নাতিকেও বিনতাদেবীর কাছে যেতে দেওয়া হয়নি। তাঁর ছেলে পড়েছে মহা সমস্যায়, একদিকে মা, আর একদিকে স্ত্রী।

লাল রঙের একটা উলের গোলা নিয়ে চশমা চোখে দিয়ে বিনতাদেবী মাথা নিচু করে কাঁটায় ঘর তুলছেন। নতুন একটা সোয়েটার বুনবেন নাতির জন্য। “যতই বৌমা পুরনো বলুক, এই জিনিস কোত্থাও পাবে না। এতে কী শুধু উল আছে! এতে আমার স্নেহ, মায়া, ভালবাসা সব জড়ানো আছে। এ টাকা দিয়ে কেনা যায় না” নিজের মনেই বললেন বিনতাদেবী।

অফিসে ছুটি পাওয়ায় তাঁর ছেলে কয়েকদিনের জন্য দীঘা বেড়াতে যাবে ঠিক করেছে, সাথে স্ত্রী ও বাচ্চা। এমনিতে কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠে না। বিনতাদেবী বাড়িতেই থাকবেন, তিনি নিজে থেকেই বলেছেন, “আজকাল যা চোরের উপদ্রব বেড়েছে, তাতে যেটুকু আছে, সেটুকুও চুরি গেলে আর কী থাকবে?” ব্যাগপত্র গুছিয়ে সবাই রওনা দিলে বিনতাদেবী দুই হাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে “দুগ্গা, দুগ্গা” বলে দরজা বন্ধ করলেন। ছেলে দু’দিনের সব্জি বাজার করে রেখে গিয়েছে। এখন তিনি কিছুদিনের জন্য মুক্ত, নিজের ইচ্ছে মতো থাকবেন, নিজের জন্য একটু ভাত ফুটিয়ে আলু সেদ্ধ মেখে খেলেই হল। পরদিন সকালে বিনতাদেবী সদর দরজা খুললেন গঙ্গা জল ছেটানোর জন্য, এটা তাঁর প্রাত্যহিক কর্ম। জলের ঘটিটা হাতে নিয়ে যেই ছেটাতে যাবেন, হঠাৎই তাঁর মাথাটা কেমন যেন ঘুরে গেল, হাত থেকে ঘটিটা পড়ে গিয়ে আওয়াজ হল জোরে। পাশের বাড়ির ঝন্টুর বউ রুমকি তখন রাস্তায় বেরিয়ে দাঁতন দিয়ে দাঁত মাজছিল। বিনতাদেবীর পড়ে যাওয়া দেখে ও দাঁতন আর মুখের থুতু ফেলে ছুটে আসে। এসেই বিনতাদেবীর মাথাটা নিজের কোলে তোলে, তারপর চিৎকার করে লোকজন ডাকে। ঝন্টুও বাড়িতেই ছিল। ডাকাডাকি শুনে ও তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে দেখে কী হয়েছে। ততক্ষণে আশেপাশের বাড়ির লোকেরাও চলে এসেছে, কিন্তু কেউই কাছে যেতে চাইছিল না। বিনতাদেবী যদি জানতে পারেন কেউ ছুঁয়েছে, তখন সেই নিয়ে তিনি কুরুক্ষেত্র বাঁধাতে পারেন। রুমকি বিনতাদেবীর চোখে, মুখে জল ছেটাতে লাগল। একটু পরেই জ্ঞান ফিরে এলো তাঁর। বিনতাদেবী চোখ খুলে দেখলেন তাঁর মাথা পাশের বাড়ির বউটার কোলে, তিনি ওর নামটাও সঠিক জানতেন না। ঝন্টু আর ওর বউ দু’জনে মিলে ধরাধরি করে বিনতাদেবীকে নিয়ে গিয়ে ওঁর খাটে শুইয়ে দিল। রুমকি বলল,”আপনি বিশ্রাম নেন মাসিমা। আপনার যখন যা দরকার হবে, আপনি জানালা দিয়ে আমাদের শুধু বলবেন, আর আমি এসে দিনকতক নাহয় রান্না করে দিয়ে যাব। আপনি রাজি না হলে আসব না।” বিনতাদেবীর দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। তিনি শুধু বললেন, “তোমরা যেমনটা ভাল বোঝো করো।” তাঁর ছেলে, বৌমা বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত রুমকি ও ঝন্টু দেখভাল করে গেল, খাওয়ানো থেকে শুরু করে ঘুম পাড়ানো অবধি। মাঝেমধ্যে ওদের ছেলে, মেয়েটাও বিনতাদেবীর কাছে এসে বসত। ছেলে, বৌমা ফিরে এসে সব শুনে ওদের কী বলবে বুঝে পেল না। এক্ষেত্রে ধন্যবাদটাও যেন কম। বিনতাদেবীর কাছে মোবাইল ফোন না থাকায় পাড়ার লোকেরা তাঁর ছেলের ফোনে কল করেও পায়নি। অবশ্য ঝন্টু, রুমকির ওপরেই তারা ভরসা পেয়েছিল। হাসপাতালে ভর্তি করবে ভেবেছিল, কিন্তু বিনতাদেবী যেতে রাজি হননি।

ঘটনার পরে বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে, বিনতাদেবীও মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। রুমকি বাড়ির কাজ সেরে ওর ছোট ছেলেটাকে নিয়ে মাঝেমধ্যেই দেখা করতে আসে। একদিন দুপুরের দিকে বিনতাদেবী নিজেই রুমকির সাথে দেখা করতে চলে গেলেন একটা প্যাকেট নিয়ে। রুমকি তো ওঁকে কোথায় বসতে দেবে ভেবেই পেল না। “তুমি অত ব্যস্ত হয়ো না তো”, বিনতাদেবী বলে উঠলেন। রুমকির কাছে গিয়ে প্যাকেটের মধ্যে থেকে বের করে ওর হাতে তুলে দিলেন সদ্য বুনে শেষ হওয়া লাল সোয়েটার। “তোমার ছেলেকে এটা পরিও, অনেক যত্ন নিয়ে বানিয়েছি। এখন যাই, পরে আসব কেমন” বলে চলে আসলেন বিনতাদেবী। অবাক হয়ে রুমকি তাকিয়ে রইল ওঁর যাওয়ার পথের দিকে।

সমাজের দুই ভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যেকার উঁচু-নিচু বিভেদের প্রাচীর ভেঙে গিয়ে এক হওয়ার সাক্ষী হয়ে থাকল একটা সোয়েটার।


লেখক পরিচিতি : সুপ্রিয়া মণ্ডল
"এখনও পর্যন্ত নিজের কোনও পরিচিতি গড়ে তুলতে পারিনি।"

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।