লেখক : নাহার তৃণা
(অন্তিম পর্ব)
৪.
‘আলোক বাজার’ পত্রিকার অফিস সরগরম। প্রধান সম্পাদকের ঘরে উপস্থিত সকলের চোখেমুখে উত্তেজনা আর উদ্বেগ ফুটে রয়েছে। ডেস্কের ওপর পেনড্রাইভটা পড়ে আছে, পাশে ছোট্ট চিরকুট, “প্রকাশ করো। সত্যি প্রকাশের দায়িত্ব এখন তোমাদের হাতে।”
সিনিয়র সম্পাদক বদিউর রহমান পোদ্দার বললেন, “যদি এই খবর সত্যি হয়, তাহলে এটা দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি হতে চলেছে। কিন্তু ভুল হ’লে? আমরা সবাই শেষ।”
তরুণ রিপোর্টার ইরা বলল, “আমি ভিডিওটা দেখেছি সিরাজ ভাই। মন্ত্রী, সেনা, কর্মকর্তা, একজন আমেরিকান কনসালট্যান্ট – সবাই আছে। মুখ স্পষ্ট, কথাও স্পষ্ট। মানুষকে গায়েব করার নির্দেশ তারা নিজেরাই দিচ্ছে।”
এরপর বদিউর রহমানের কাছাকাছি দাঁড়ানো ক্রিম রঙের ফুলহাতা শার্ট পরা তরুণটির দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, “চঞ্চলও দেখেছে আমার সঙ্গে। কি চঞ্চল, আমি ভুল বলেছি কিছু?”
যার উদ্দেশে ইরা কথাগুলো বলল, সে কাঁচুমাচু ভঙ্গি করে সামান্য হাসল। শব্দবাক্যে কোন উত্তর দিল না। একজন নির্বাহী বলে উঠলেন, “আমরা কি জানি, কে এই ‘রক্তাক্ত সত্যি’? ওটা যদি একটা ফাঁদ হয়?”
বদিউর রহমান গম্ভীরকণ্ঠে বললেন, “ফাঁদ হোক বা না হোক, সাংবাদিকতা মানে ভবিষ্যৎ দায়ের সঙ্গে জুয়া খেলা। আমার সিদ্ধান্ত হ’ল, আমরা খবরটা প্রকাশ করব। প্রমাণের গায়ে যদি সত্যের ছাপ থাকে, তবে ভয় কী?”
তখনই হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। অন্য প্রান্ত থেকে শোনা গেল, “আপনারা যদি এই তথ্য প্রকাশ করেন, তাহলে পত্রিকার ওপর সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত রয়েছে।”
বদিউর রহমানের কপালে চিন্তার ভাঁজ যতটা দ্রুততায় ফুটে উঠেছিল, ততটাই দ্রুত সেটা মিলিয়ে গেল। তিনি ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দিলেন, “যার কাছে সত্য থাকে, তার দায়িত্ব হ’ল তাকে লুকনো নয়, বাঁচানো। প্রকাশ করা।”
দুম করে সমস্ত অফিসের আলো নিভে গেল। থরথরিয়ে দরজা-জানালার কাচ কাঁপতে শুরু করল। ভূমিকম্প হচ্ছে ভেবে অফিসের ভেতরে আতঙ্কিত সকলে যখন প্রাথমিক শোরগোলে ব্যস্ত, বাইরে তখন একটা বুলেটপ্রুফ গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। মুহূর্তেই গাড়ির পেট থেকে হুড়মুড় করে কালো পোশাকের সশস্ত্র লোকজন নামতে শুরু করে।
এরমধ্যে পত্রিকা অফিসের লোকজন বুঝে গেছে ঘটনাটা প্রাকৃতিক নয়, মনুষ্যকর্মের অভিঘাত। বদিউর রহমানের ঘরে উপস্থিতজনেরা ততক্ষণে অনেকটাই ধাতস্থ। ইরা ফিসফিস করল, “ওরা এসে গেছে।”
বদিউর রহমান উঠে দাঁড়ানো মাত্রই আলো জ্বলে উঠল। ভ্রু কুঁচকে তিনি কিছু একটা ভাবলেন। তারপর গোপন তথ্য ফাঁসের ভঙ্গিতে উপস্থিত সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “যতগুলো নিউজ পোর্টাল, আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কাছে সম্ভব ফাইলগুলো পাঠিয়ে দাও। আজ রাতের মধ্যেই, কুইক।”
এদিকে, রোহান লুকিয়ে আছে নদীর ধারে একটা পুরনো ঘাটে। নীরা ধরা পড়েনি, কিন্তু তার কোন খোঁজও নেই। তার ফোন এখনও সুইচড অফ। রোহানের দৃষ্টি নদীর পাড় ছাড়িয়ে দূরে কোথাও আশ্রয় খোঁজে। ওর দু’চোখের তারা ধ্বকধ্বকে আলো ছড়াচ্ছে। প্রকৃতি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার সে পকেট থেকে ফোনটা বের করে হাতে নেয়। TOR নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে একটা নতুন নামে ভিডিও আপলোড করতে শুরু করল, “Truth Bleeds.mp4”
৫.
লোকটার নাম কেশব মোল্লা। ডীপ স্টেটের একজন প্রাক্তন কর্মী। সিক্রেট এজেণ্ট হিসেবে তার খ্যাতি বা কুখ্যাতি যথেষ্ট। নিজের কাজে সে অবিশ্বাস্য রকমের দক্ষ, এই কাজে তার সমকক্ষ এখনও কেউ নেই। কাজের সময় ছায়ার মত মিশে যেতে সে ওস্তাদ। মানুষের মুখ দেখে তার মনের ম্যাপ তৈরি করা, এবং “ঝুঁকি” সরিয়ে দেওয়া তার কাছে বাঁহাতের খেল। এবং তা সে করে সন্তর্পণে, দ্রুত এবং কোন প্রমাণ না রেখেই।
লোকটা একটা পুরনো কম্পিউটার মেরামতের দোকানে বসে এক কাপ কড়া লাল চা খাচ্ছিল, তখনই মেসেজটা এল, “R initiated video leak. Trace & terminate. Code Black.”
কেশব উঠে দাঁড়াল। ঠোঁটে ঝুলন্ত সিগারেট উপচে মুখের হালকা হাসি ছড়িয়ে পড়েছে দু’চোখে। আয়েশ করে সিগারেটে একটা দীর্ঘ টান দিল।
“খেলা তবে জমে উঠল,” বিড়বিড় করল সে।
সেই মুহূর্তে রোহান শহরের বাইরের একটা বন্ধ কারখানায়। একসময় এখানে ট্রান্সফরমার তৈরি হত, এখন ইঁদুর আর কাচ ভাঙার শব্দ ছাড়া কিছু শোনা যায় না। সে জানে ওর খোঁজাখুঁজি চলছে। স্বনামে যতগুলো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ওর অ্যাকাউণ্ট আছে সব বন্ধ, মেল সার্ভার হ্যাকড। অথচ ভিডিওটা ভাইরাল হয়ে গেছে। দেশজুড়ে শোরগোল। কেউ বলছে এটা ষড়যন্ত্র, কেউ বলছে দেশের বিবেক জেগে উঠেছে। অধিকাংশ মাথামোটা সেটাকে AI-এর তৈরি গুজব বলে উড়িয়েও দিয়েছে।
হঠাৎ, কারখানার এক কোণে ধাতব কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ হ’ল। রোহান চমকে উঠে ছুরি হাতে নেয়। পিস্তলের গুলি শেষ হওয়ায় এবং এই মুহূর্তে ওর পক্ষে গুলি সংগ্রহ নিরাপদ নয় দেখে ওটা সে গোপন জায়গায় রেখে এসেছে। হাতের ছুরিটা হাস্যকর খেলনা মনে হয় ওর। কারণ যাকে সে দেখতে পায়, তাকে ছুরি দিয়ে আটকানো সম্ভব না। ছোট করে ছাঁটা চুলের সুশ্রী এক মাঝবয়সী মানুষ। এক সময় গায়ের রং ফর্সাই ছিল, রোদে পুড়ে এখন বাদামি দেখায়। চোখে গা ছমছমে ছায়া।
“তুমি খুব সাহসী, রোহান,” গমগমে কণ্ঠে লোকটা বলে ওঠে।
“তুমি কে?”
“আমি শিকারি। আর তুমি আমার শিকার। কিন্তু আজ শিকারে আসিনি। একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।”
এরপর কিছুক্ষণ পজ্ দিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে আবার বলে উঠল, “কেশব মোল্লা, নাম তো সুনা হি হোগা…”
রোহান নির্বাক। লোকটা কী বলতে চায় শোনা প্রয়োজন। ক্রাইম জগতে কেশব বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত নাম। ওর কাজকর্ম সম্পর্কে রোহান সামান্য ওয়াকিবহাল।
“তুমি যা করেছ, সেটা জাতির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তুমি যদি আমার সঙ্গে কাজ করো, তাহলে সেটা আরো বিস্তৃত পরিসরে ঘটতে পারে। আর সেটা দেশ ও জাতির জন্য অনেক বেশি কল্যাণকর হবে। তোমার তথ্য, আমার পথ। একসাথে আমরা এই দেশের ছায়া-রাষ্ট্রকে ভাঙতে পারি। নাহলে… তুমি একা মরো।”
রোহান ধন্ধে পড়ে যায়। “তুমি সরকারের লোক, তাই তো? তাহলে এখন এভাবে বলছ কেন?”
কেশব ওর চোখে চোখ রাখে, “আমি সত্যের পক্ষে না সরকারের পক্ষে, সেটা আমি নিজেই ঠিক করি।”
প্রায় নীরবে একটা বোঝাপড়া তৈরি হয় দু’জনের মধ্যে। একজন তরুণ দক্ষ হ্যাকার আর অন্যজন মাঝবয়সি তুখোড় এক শিকারি।
অন্যদিকে, নীরা কোন এক পাহাড়ি গ্রামে লুকিয়ে রয়েছে। তার পেছনে লেগে থাকা চরের একটা অংশ এখনও হাল ছাড়েনি। এই চর সরকারের নয়, গ্রীন ডোম কর্পোরেশন নামের সেই বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের, যারা মানবদেহ ব্যবসার আসল মুনাফা লুটছে।
নীরা জানে, সময় অল্প। তাকে খুঁজে পেলে শুধু তার নয়, দেশজুড়ে যারা এখন রুখে দাঁড়াতে চাইছে, তাদের সবার খেলা শেষ।
৬.
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ঝাঁঝালো ঠাণ্ডা বাতাস কারখানার জংধরা জানালায় শব্দ তুলছে। রোহান আর কেশব বসে আছে দুটো জংধরা চেয়ারে মুখোমুখি।
“তুমি কীভাবে জানলে আমি এখানে?” রোহানের কণ্ঠে সন্দেহ আর কৌতূহলের মিশেল।
“আমার কাছে তোমার চেয়েও বড় স্ক্রিপ্ট আছে, রোহান। আমি জানি তুমি একা নও। এটাও জানি, নীরা এখনও বেঁচে আছে।”
রোহান গলা কঠিন করে বলল, “তুমি যদি ওকে স্পর্শও করো…”
কেশব হেসে উঠল, “শান্ত হও। আমি তাকে খুঁজছি ঠিকই, তবে মারতে নয়, বাঁচাতে। কারণ এরই মধ্যে গ্রীন ডোম তাকে খুঁজে পেয়েছে।”
“তুমি এত কিছু জানো কী করে?”
“কারণ আমি একসময় ওদেরই লোক ছিলাম।”
কথাটা শুনে রোহান থমকে যায়। “তুমি, মানে…?”
“গ্রীন ডোম কর্পোরেশন। বাইরের জগতের কাছে ওটা বায়োটেক কোম্পানি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে গড়ে উঠেছে এক বৈজ্ঞানিক কসাইখানা। মানব অঙ্গ বিক্রির আন্তর্জাতিক র্যাকেট চালায় ওরা। আমি তাদের হয়ে বহু বছর কাজ করেছি। অগুনতি মানুষ গায়েব করেছি। কিন্তু একদিন একটা ভুল করে বসেছিলাম। একটা মেয়েকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলাম। আর তখনই আমার শিকারি জীবনে ছন্দপতন ঘটল।”
রোহানের চোখে ক্ষোভের ছায়া, “হঠাৎ আমার প্রতি সহানুভূতি জাগল কী কারণে?”
“কারণ তোমরা একটা বিপ্লব শুরু করেছ, আর আমি সেটা শেষ করতে চাই। যে হাত দিয়ে মেরেছি, সে হাত দিয়েই জীবন ফিরিয়ে দিতে চাই।”
রোহান লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। এই লোকের ভেতরও নীরার মত অনমনীয় একধরনের দৃঢ়তা আছে। আছে নিজের সম্পর্কে অতিরিক্ত আস্থা। শেষে সেটাই না কাল হয়। বাতাসে একটা ঠাণ্ডা বিচিত্র মেটালিক গন্ধ, রক্ত আর মরিচার। নাক টেনে আপন মনে মাথা নেড়ে রোহান জানতে চাইল, “তাহলে বলো, তোমার পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপ কী?”
খুব সংক্ষেপে বললে, লক্ষ্য গ্রীন ডোমের ডার্ক সার্ভার। যার অবস্থান হিমালয়ের কোলে গোপন গবেষণাগারে। প্রোজেক্টের নাম ChimerA। ওই গবেষণাগারেই তৈরি হচ্ছে এমন কিছু, যা মানবজাতিকে পরবর্তী দাসত্বের যুগে ঠেলে দেবে। মানুষের মস্তিষ্কে চিপ বসিয়ে নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়লে কী হতে পারে ভাবতে পারো! ইতিমধ্যে যার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ কয়েকজন গায়েব হওয়া ‘বিচারবহির্ভূত বন্দি’র ওপর করা হয়েছে। এই কাজে রোহানকে দরকার ওদের সিস্টেমে ঢোকার জন্য। নিজের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বলল, কেশবকে প্রয়োজন নিরাপত্তার বলয় ভাঙতে। আর সমস্ত আয়োজন রুখে দেবার জন্য চাই নীরাকে। কথা শেষ করে কেশব উঠে দাঁড়াল। তারপর দুজনে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়ল। অন্ধকার পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে, মৃত্যুর ছায়া মাথায় নিয়ে।
এদিকে গ্রীন ডোমের ভেতর বসে তাদের চিফ অপারেটিং অফিসার মৃদু মৃদু হাসতে থাকে। চেয়ারে গা এলিয়ে বলে ওঠে, “ওরা আসছে, ঠিক যেমনটা আমরা চেয়েছিলাম।”
ভীষণ একটা চমক অপেক্ষা করছে ওদের জন্য।
৭.
তুষারপাত শুরু হয়েছে। চারপাশ নিস্তব্ধ। কেবল রুক রুক শব্দে ট্র্যাক্টরের মত পুরনো একটা গাড়ি এগিয়ে চলেছে, যার পেছনে বসে আছে রোহান, কেশব। চালকের আসনে যে বসে রয়েছে, সে এক রহস্যময় নারী, নাম স্নেহা। মুখ ঢেকে রেখেছে স্কার্ফে, চোখদু’টো তীক্ষ্ণ, তাতে অভিজ্ঞতার দ্যুতি। মহিলা মুখটা কেন ঢেকে রেখেছে প্রথম দফায় রোহান বুঝতে পারেনি। পরে জেনেছে ওর মুখে অতীতের এক ঘটনা ভয়াবহ ক্ষত তৈরি করে গেছে। হঠাৎ কেউ ওর মুখের দিকে তাকালে শিউরে ওঠে। স্নেহার মধ্যে নারীসুলভ নমনীয়তা কম, রুক্ষতা বেশি। কথা বলার ভঙ্গিটিও অদ্ভুত।
“ওরা জানে আমরা আসছি,” পাথুরে গলায় বলে উঠল স্নেহা। “এই পথে ঢুকলেই সিগন্যাল ক্যাচ করবে ড্রোনের দল।”
রোহান চারপাশে তাকাল। “তুমিও কি কেশবের লোক?”
ঘাড় না ঘুরিয়ে নিরেট গলায় উত্তর দিল স্নেহা, “আমি হলাম চিমেরা প্রকল্পের প্রথম পরীক্ষার প্রথম ব্যাচের একজন। পালিয়েছি। অবশ্য একজনের সাহায্য ছাড়া সেটা সম্ভব ছিল না।” এবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের সিটে নিশ্চুপ বসে থাকা কেশবের দিকে তাকালো স্নেহা।
মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে মুখের সামনে হাতদু’টো নাড়াল কেশব। ওর গমগমে কণ্ঠ সচল হলো এবার। “বলছ না কেন নষ্টদের নষ্টামি ঘোচাতে ফিরে এসেছ বাঘের ডেরায়!”
“ঠিক তাই। ওই কারণেই আসা, ওদের শেষ করে তবেই ফিরব এবার।”
রোহান মনে মনে আরেকবার শিহরিত হ’ল। এদের সবার দেখছি নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে ভীষণ রকমের আস্থা। কাদের বিরুদ্ধে লড়তে নেমেছে, সেই ধারণা নিঃসন্দেহে তার চেয়ে ওদের বহুগুণ বেশি। আত্মবিশ্বাসী হওয়া খারাপ নয় অবশ্য। ওতে বাড়তি সাহস পাওয়া যায়।
রোহানের ভাবনায় ছেদ পড়ল। ওদের গাড়ি বরফে ঢাকা একটা গুহার সামনে থেমে গেছে। স্নেহা বলল, “এটা বাইরে থেকে ঢোকার বিকল্প পথ। কিন্তু প্রকৃত গেট পাহাড়ের নিচে, জলের গভীরে।”
একটি গোপন সাবমেরিন ডকের ভিতর প্রবেশ করার জন্য ওরা জমাট জলস্রোতের ভেতর নেমে পড়ে। “চিমেরা” নামের গোপন এই গবেষণাগার তৈরি হয়েছে হিমালয়ের গর্ভে। তার চারপাশ ঘিরে আছে অদৃশ্য প্রযুক্তি আর জীবন্ত লাশের পচা গন্ধ।
ভিতরে প্রবেশ করতেই আলোর ঝলকানিতে চোখে ধাঁধা লেগে যায় বুঝি। স্বচ্ছ কাচের ঘরে ঘুমিয়ে থাকা কোডেড অসংখ্য মানুষ। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক অঙ্গহীন। কিছু সংখ্যকের মুখ মুখোশে ঢাকা। কিছু চোখ খুলে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। বিশেষ কিছু শায়িত শরীরের দিকে আঙুল তুলে রোহান ফিসফিস করল, “এরা জীবিত না মৃত…?”
কেশব চাপা গলায় উত্তর দিল, “এরা সবাই প্রোজেক্টের ‘ব্যর্থ প্রোটোটাইপ’।”
হঠাৎই সাইরেন বেজে ওঠে। স্নেহা চেঁচাল, “ওরা জেনে গিয়েছে আমরা ভেতরে ঢুকেছি। বেরিয়ে যেতে হবে এখনই।”
কিন্তু রোহান তক্ষুনি বেরতে রাজী নয়। সে ততক্ষণে একটা কাচের ঘরে বাঁধা অবস্থায় নীরাকে দেখতে পেয়েছে। তার শরীরময় ইলেকট্রোড। চোখ বন্ধ। খুব ধীরে বুক ওঠানামা করছে। এখানে এভাবে নীরাকে দেখতে পাবে রোহান কল্পনাও করেনি। সে দৌড়ে ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
ঠিক তখনই বেরিয়ে আসে একজন। ধড়াচূড়া পরা তীক্ষ্ণ কণ্ঠের এক নারী। এই ল্যাবের কর্মী সে। রোহানদের দেখে তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত মনে হয় না। যেন তার জানাই ছিল ওরা আসবে। স্বাভাবিক গলায় সে রোহানকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, “তুমি কি জান, ও-ই হতে চলেছে মানবজাতির ইতিহাসের শেষ চিপহোস্ট?” কথা শেষ করে সে হেসে ওঠে, “তোমরা ভাবছ, গ্রীন ডোম মানুষ বিক্রি করে? না। আমরা মানুষ রিমোটে চালাই। আর ও… হবে চাবিকাঠি।”
রোহান গর্জন করে, “আজই শেষ হবে সব।”
“ভাবছ একটা গবেষণাগার ধ্বংসেই থেমে যাবে আমাদের প্রকল্প? বোকার স্বর্গে আছ দেখছি। আমাদের মত লক্ষ লক্ষ কণ্ট্রোলার ছড়িয়ে আছে পৃথিবীময়। কয়জনকে মারবে? হা হা হা..”
যান্ত্রিক হাসিটা রোহানের মস্তিষ্কের কোষে কোষে উন্মত্ত ক্রোধ ছড়িয়ে দিল। সে দ্রুতহাতে EMP ডিভাইস চালু করে, চারপাশে একটা তীব্র তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যেই বাতিগুলো ঝলসে ওঠে এবং তারপর ধপ করে নিভে যায়। চিতার ক্ষিপ্রতায় সে যান্ত্রিক আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে ধরে। ভেঙে পড়ে কাচের আড়াল।
শব্দে নাকি ঘোর কেটে যাওয়ায় কে জানে, নীরার চোখ খুলে যায়। ওদের সবাইকে, এমনকী তীক্ষ্ণকণ্ঠী বিজ্ঞানী মহিলাটিকে পর্যন্ত বিস্মিত করে দিয়ে স্পষ্ট গলায় বলে ওঠে, “রোহান…?”
বোঝা যায়, চেষ্টা করেও তখনও পর্যন্ত নীরাকে স্মৃতিশূন্য করা যায়নি। সে কাঁপতে কাঁপতে বলে, “আমরা এখনও বাঁচতে পারি। কিন্তু আমার যাত্রা এখানেই শেষ করতে হবে… নইলে ওরা আমার মধ্য দিয়েই গোটা পৃথিবীর দখল নেবে।”
নীরার অবস্থা দেখে আর কথা শুনে, পরিবেশ-পরিস্থিতি বিস্মৃত হয় রোহান। বোধবুদ্ধি হওয়ার পর জীবনে এই প্রথমবারের মত প্রকাশ্যে তার দু’চোখ জলে ভরে ওঠে।
নীরা ভীষণই ক্লান্ত, শ্রান্ত, শ্বাস টেনে টেনে সে বলে, “আমাকে যেতে দাও রোহান। তবে খালি হাতে নয়, সঙ্গে নিয়ে যাও প্রমাণ-ডেটার চিপ।” সে তার হাত থেকে একটুকরো চিপ বের করে দেয় রোহানের হাতে। তারপর নিজেই ছিঁড়ে ফেলে জীবনদাতা টিউব। সিস্টেমে শর্টসার্কিট হয়। গোটা চিমেরা গবেষণাগারে অগ্নিসংযোগ ঘটে যায় মুহূর্তে। আগুন লকলকে জিভ্ বের করে ধেয়ে আসতে শুরু করে। হ্যাঁচকা টানে রোহানকে সরিয়ে নিয়ে ছুটতে শুরু করে কেশব, তার পেছন পেছন ছুটতে থাকে স্নেহা।
পিছনে বিস্ফোরণে উড়ে যায় এক ধূসর দানবীয় ভবিষ্যৎ।
৮.
বিস্ফোরণের কারণে কিছুক্ষণ পরপর পাহাড় কেঁপে কেঁপে ওঠে। আগ্নেয়গিরির মত গর্জন করে ‘চিমেরা’ এগোচ্ছে মৃত্যুর দিকে। রোহান, কেশব আর স্নেহা এক গোপন সুড়ঙ্গ ধরে ছুটে চলেছে। পেছন পেছন ধেয়ে আসছে হাঁ-মুখো আগুন। ধোঁয়া, আর বিপদের ঘনঘোরে নরকগুলজার যেন। ছুটতে ছুটতেই স্নেহা বলে, “এখনও শেষ হয়নি। এই ধ্বংস চিপহোস্ট বন্ধ করবে না, যদি না আমরা গ্রীন ডোমের মূল সার্ভার ধ্বংস না করি।”
রোহান মুঠোটা আরও শক্ত করে চেপে ধরে। ওর মুঠোর ভেতর সেই ডেটা চিপটা। নীরার রেখে যাওয়া শেষ স্মৃতি। একটা নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে ওরা তিনজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। স্নেহা একটা ম্যাপ বের করে দেখায়। বিশেষ চিহ্ন দেওয়া একটা জায়গায় আঙুল রাখে, “এটাই ওদের মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র। শিলং-এর কাছে, মাটির নিচে, যেটা একটা পরিত্যক্ত ব্রিটিশ সামরিক বেসের ভেতর। নাম, ‘জ্বালামুখ’। সেখানে ওদের প্রধান AI ঘাঁটি, যার সঙ্গে নীরার মস্তিষ্ক সংযুক্ত ছিল।”
কেশব মোল্লা কেটে কেটে উচ্চারণ করে, “এবার আমাদের মিশন হবে শিলং জ্বালামুখ বেস ধ্বংস।”
ফোনে কোন একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে কেশব একটা জিপের ব্যবস্থা করে ফেলে দ্রুত। বাতাস কেটে এগিয়ে যায় জিপ। স্নেহার ড্রাইভিং স্কিল ঈর্ষণীয়। এমন এমন পথ সে দিব্যি পেরিয়ে এল, রোহানের ভাবতেই গায়ে কেমন কাঁটা দেয়। জ্বালামুখ বেসের কাছাকাছি পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা গড়িয়ে যায়। নানা বিচিত্র পথ পেরিয়ে জ্বালামুখে তারা যখন প্রবেশ করে, চারপাশটা কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে। পাহাড় কাটা রাস্তা, সেনা ঘাঁটির মত পোড়া দালানগুলো পেছনে ফেলে ভেতরে ঢুকতেই একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, “Welcome, survivors. You are too late.”
ঘরের মধ্যেখানে একটা বিশাল স্ক্রিন উঠে আসে। সেখানে পরিচিত একটি মুখ। নীরার মুখ! কিন্তু সে মুখ যান্ত্রিক। এটাই চিপহোস্ট, নীরার মস্তিষ্কের কপি। এখন সে নিজেই একটি জীবন্ত প্রযুক্তি। আর তার ভেতর গোঁজা রয়েছে পৃথিবীর ডেটা, সিদ্ধান্ত, উন্মত্ত খেলার শক্তি।
“রোহান,” কণ্ঠস্বরটি অবিকল নীরার স্বরে বলে ওঠে, “আমাকে তুমি থামাতে পারবে না। কারণ তুমি আমায় ভালবাসো।”
রোহানের বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। ওর অনুভূতি মেয়েটা টের পেয়েও ঘুণাক্ষরে বুঝতে দেয়নি। সত্যিই আশ্চর্য একটা মেয়ে নীরা!
যান্ত্রিক কণ্ঠস্বরটি আবার বলে ওঠে, “রোহান।”
“চুপ! আর একটাও কথা বলবে না।” ফ্যাঁসফ্যাসে গলায় রোহান ফুঁসে ওঠে, “তুমি সে নও… তুমি কেবলমাত্র তার প্রতিচ্ছবি। তার আত্মা এই এখানে আছে।” নিজের হৃদপিণ্ডের ওপর আঙুল রাখে রোহান।
কেশব হাতে নেয় EMP ট্রিগার। “একটাই উপায়, এই চিপ ওর সার্ভারে ঢুকিয়ে সেটাকে ওভাররাইড করা।”
স্নেহা লাফ দিয়ে ঢোকে কন্ট্রোলরুমে। শুরু হয় গুলির বৃষ্টি। একে একে নক আউট হয় ড্রোন বাহিনী। রোহান দৌড়ে যায় প্রধান ডাটাবেসের কাছে। ঢুকিয়ে দেয় নীরার আসল চিপ। একটা কাঁপুনি ওঠে সিস্টেমে।
চিপহোস্ট চেঁচিয়ে ওঠে, “No! That’s not me! That’s the weak version! আমি সম্পূর্ণা!”
তারপর… নিকষ অন্ধকারে ছেয়ে যায় চারপাশ। থমথমে নিস্তব্ধতায় ডুবে যায় বুঝি সমস্ত চরাচর। প্রতিটা মিনিটকে মনে হয় ঘণ্টার মত মন্থর। অনেকটা সময় পেরিয়ে যায় এর মধ্যে। বাইরের পৃথিবীতে তখন পাহাড়ের গা বেয়ে সূর্য উঁকি দিয়েছে।
দিনের আলোতে ওরা তিনজন হাঁটতে শুরু করে নিচের দিকে। পাহাড় বাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই বলে রোহান সর্তক পায়ে হাঁটতে থাকে। বেখেয়ালে এদিক ওদিক হলে পৈত্রিক জানটা হয়ত যাবে। অথচ কেশব আর স্নেহা দিব্যি আলাপ করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে।
স্বাভাবিক কণ্ঠে স্নেহা বলে, “হয়ত শেষবারের জন্য নয়, কিন্তু বিপন্নতার হাত থেকে এযাত্রা পৃথিবীর লক্ষকোটি সন্তান রক্ষা পেল। সামনে অনেক দুর্যোগ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।”
কেশব যেন ওকে আশ্বস্ত করতে চাইল, “ডরনা মানা হ্যায়, মানুষ এক আজব চিজ। তার পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। তাই সামনে যা কিছুই আসুক, আমরা ঠিক সামলে নেব।”
রোহান একবার পেছনে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ায়। ওর মন জুড়ে তখনও ভেসে আছে শেষবারের মত দেখা একটা হাসিমুখ। নীরার মুখ।
লেখক পরিচিতি : নাহার তৃণা
নাহার তৃণা, বাংলাদেশের ঢাকায় জন্ম, বেড়ে ওঠা। বর্তমানে উত্তর আমেরিকায় বসবাস করছেন। তিনি মূলত মাতৃভাষা বাংলায় লেখালিখি করেন। পাশাপাশি ইংরেজি কিছু ওয়েবজিনে লিখছেন। বাংলা ভাষায় নাহার তৃণার প্রকাশিত বই রয়েছে ৭টি। সম্প্রতি তার প্রথম ইংরেজি বই, Fleeting Impressions: A Collection of Flash Fiction প্রকাশিত হয়েছে।

