উকুনে বুড়ি

লেখক : সুচন্দ্রা চ্যাটার্জ্জী

সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক খোঁজাখুঁজির পর মুগ্ধা তার স্কুলের বন্ধু বিয়াস কে পেল। মুগ্ধা স্কুলের কারও সাথেই কানেক্টেড নয়, তাই বিয়াসকে খুঁজে পেতে তার অনেকটা সময় লেগেছে। মেসেঞ্জারে “কিরে আমায় চিনতে পারছিস? আমি মুগ্ধা” বলে একটা মেসেজ করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল। আধঘন্টা পরে “হাই” লিখে উত্তর দিয়ে বিয়াস মেসেঞ্জারে ফোন করল, “বাব্বাঃ, মুগ্ধা, শেষ পর্যন্ত তোকে পেলাম। তোকে কত খুঁজেছি।” বিয়াসের গলার উচ্ছ্বাস, উষ্ণতা মুগ্ধাকে ছুঁয়ে গেল। এ যেন একটা দমকা বাতাস, মিঠেল, সুগন্ধি। মনটাকে একেবারে তরতাজা করে দিল।
মুগ্ধা বলল, “একটু শ্বাস নে, দাড়ি-কমা দে। নইলে যে বিষম খাবি।”
বিয়াস কলকলিয়ে বলল, “এখনই তো বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছি। এতদিন তো রুদ্ধশ্বাসে তোকে খুঁজে বেড়িয়েছি। যাদের যাদের সাথে যোগাযোগ হয়েছে, সবাইকে তোর কথা জিজ্ঞাসা করেছি, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারেনি। দাঁড়া, আমাদের বন্ধুদের একটা গ্রুপ আছে। ওদের জিজ্ঞাসা করে তোকে অ্যাড করব, এটাই আমাদের গ্রুপের নিয়ম।” মুগ্ধা মুখে সম্মতি জানাল, কিন্তু মনে সংশয় ছিল।

বছর পাঁচেক আগে বেশ একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল সে আর তার বর শান্তনু। বাপের বাড়ির অলিগলিগুলো তাকে যেন সবসময় ডাকাডাকি করে। সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে, জায়গাটা একেবারে নিরিবিলি, দু’পাশে বড় বড় মাঠ, পুকুর। তারই বুক চিরে সরু রাস্তা। এই জায়গাটা যেন খেয়ালবশে শহর থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছে। রাস্তার দু’ধারে ছোটবড় গাছগাছালির জন্য স্ট্রিটলাইটের আলোগুলো বাধা পেয়ে একটু স্তিমিত। হঠাৎ সে দেখল, তার থেকে দু’হাত দূরে দুই সহপাঠিনী মৌ আর মীনাক্ষী যাচ্ছে। তারাও তাকে দেখেছে। তাদের কথা শোনা না গেলেও খিলখিল হাসির আওয়াজ আর শরীরী ভাষায় বেশ একটা বিদ্রূপ ফুটে উঠল। শান্তনুর চোখেও বিষয়টা ধরা পড়ল, “তুমি ওনাদের চেনো? মনে হলো ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দেখে নিজেদের মধ্যে কিছু বলাবলি করছে।”
অন্তঃসত্ত্বা মুগ্ধা নিজেকে বলল, “না, আজ আর নয়, মাঝখানে অনেকটা সময় চলে গেছে। সেই আমি আর এই আমির পার্থক্যটা ওদের বুঝতে হবে আজ।”
কিছুটা এগিয়ে জায়গাটা বেশ জমজমাট আলোয় ঝলমলে, মৌ সেখানে একা দাঁড়িয়ে। ওর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মুগ্ধা সামনের দিকে তাকিয়ে চিবুকটা একটু উঁচু করে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “তোমার লোককে খুব ছোটো করা স্বভাব। কখনও নিজের দিকেও তো তাকিয়ে দেখতে পার।”
কথাটা শুনে মৌ কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবে তাকিয়ে রইল। শান্তনু বুঝল “কহিঁ পে নিগাহে কহিঁ পে নিশানা!”
স্কুলজীবন নিয়ে মানুষের কত ফ্যান্টাসি থাকে, কিন্তু মুগ্ধা স্কুলের স্মৃতিগুলোকে মনে করতেই চায় না।

ঠিক এক সপ্তাহ পরে আবার বিয়াস ফোন করল। কথায় কথায় বলল, “জানিস, তোর কথা সবাইকে বললাম। কিন্তু কেউই তোকে চিনতে পারছে না। তোর বর্ণনা দিলাম, তুই কোথায় থাকতিস বললাম, তাও কেউ চিনতে পারল না।”
কথাটা শুনে মুগ্ধার হাসি পেল। বিয়াস ক্লাস সিক্সের পর তার বাবার চাকরিসূত্রে অন্যত্র চলে গেছিল, আর সে প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত ওই স্কুলেই পড়েছিল। তবুও তাকে কেউই চিনতে পারছে না, অথচ বিয়াসকে সবাই এককথায় চিনতে পেরেছে। জীবন তাকে শিখিয়েছে অনেক কিছুই হেসে উড়িয়ে দিতে হয়। আজ থেকে কুড়ি বছর আগেই এই মনোভাব তার এসে গেছিল। মুগ্ধা স্বাভাবিক গলায় হেসে উত্তর দিল, “ও তাই।”
বিয়াস বলে চলল, “দেখ, আমরা তো পাড়ার স্কুলেই পড়তাম। স্কুলের বাইরেও অনেকের সাথে প্রায়ই দেখা হত। আমার মনে হয় ওরা তোকে চিনতে চাইছে না। শুধু মৌমি বলল, কে মুগ্ধা, ওই যার মাথায় উকুন ছিল? জানিস তো মুগ্ধা, জীবনে এত ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে এসেছি, ওঠাপড়া দেখেছি, যে এসব তুচ্ছ বিষয়, কবে কার মাথায় উকুন ছিল, সে নিয়ে আজ আর মাথা ঘামাই না।”
মুগ্ধার মাথার উকুন এখনও তাদের মাথায় রয়ে গেছে। কিন্তু মুগ্ধা সেদিনও মাথা খারাপ করতে পারেনি, কুড়ি বছরে কুড়ি সেকেন্ডের জন্যও তাকে দমাতে পারেনি। কিন্তু আজ সজোরে ধাক্কা খেল। আজ এত বছর পরেও তাকে শনাক্ত করা হচ্ছে ‘ওই যার মাথায় উকুন ছিল’ বলে। ছিটকে চলে গেল ক্লাস সিক্সের সেই দিনগুলোতে।

স্কুলে একদিন এক সহপাঠিনীর চোখে পড়ে, তার মাথায় উকুন বাইছে। সে চেঁচিয়ে ওঠে, “এ মা, মুগ্ধা! তোর মাথায় কত উকুন! এই দেখবি আয় তোরা…”
শঙ্কিত চোখে সবাই তার মাথার দিকে তাকায়।
“এই তুই এতো নোংরা কেন রে? একটু পরিষ্কার হয়ে থাকতে পারিসনা?”
“এবার আমাদের হ’লে লোকের কাছে কত লজ্জা। আর বাড়িতেও বকুনি খেতে হবে।”
কেউ কেউ তাকে উপদেশ দিয়েছিল, “তাড়াতাড়ি উকুন সারিয়ে ফেল, নইলে তোরই চুল নষ্ট হবে।”
কেউ আবার অনুযোগের সুরে, “দেখ তো, এবার তোর থেকে সবার মাথায় উকুন আসবে।”
দু-চারজন নিজেদের মাথায় হাত বুলিয়ে, চুল ঠিক করে বিরক্তিসূচক শব্দ করে মাথা নাড়ছিল। মীনাক্ষী তো কাঁদোকাঁদো সুরে উকুন সারাবার জন্য অনুরোধ জানায়। মুগ্ধাকে চুপ করে থাকতে দেখে করুণ সুরে প্রশ্ন করে, “কিরে, উকুন সারাবি তো?”
মুগ্ধার কাছে এর কোন উত্তর ছিল না। তার চিররুগ্না মা স্কুলে যাওয়ার সময় রোজ ঠিকমত ভাতও রেঁধে দিতে পারতেন না। মৃগীর প্রকোপে যখন তখন যেখানে সেখানে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতেন। কাটা, ফাটা, রক্তারক্তি ছিল প্রায়দিনের ব্যাপার। মা যে তার উকুনের কোন প্রতিকার করতে পারবেন না, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। মায়ের শুশ্রূষাতে সে বাবাকে সহযোগিতা করত। কখনও যদি বাবা বাড়িতে না থাকতেন, স্কুল থেকে ফিরে হয়ত দেখত মা রক্তাক্ত অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছেন। সে এতটুকু ঘাবড়াত না, মায়ের সেবা যত্নে লেগে পড়ত।
পরের দিন স্কুলে গিয়ে নিজের জায়গায় বসতে যাবে, এক সহপাঠিনী বলল, “এই বেঞ্চে না, চারজনে বসতে অসুবিধে হচ্ছে। তুই অন্য কোথাও বস।”
অন্য একটা বেঞ্চে বসতে গেলে তারা ঝাঁঝালো গলায় বলল, “এখানে বসলে কি করে হবে, এখান থেকে যা।” লাস্ট বেঞ্চের পাশে পিঠে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ক্লাস টিচার এসে জিজ্ঞেস করলেন, “কি ব্যাপার, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
“দিদি, আমার বসার জায়গা নেই।”
“আচ্ছা তুমি ওখানে বসো,” বলে একটা বেঞ্চ নির্দেশ করলেন।
বসতে যাবে এমন সময় পাশের জন বলল, “রোজ যেন আবার এখানে এসে বসিসনা।”
সেদিন যে মেয়েই মুগ্ধার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, খানিকটা দূরত্ব বাড়িয়ে নিয়ে তার মাথার দিকে দেখতে দেখতে যাচ্ছিল। আর মুগ্ধার চোখে ভেসে উঠছিল, পাড়ার বন্ধুদের মুখ। ওরাও কি আমাকে আর খেলতে নেবে না? চমক ভাঙলো এক সহপাঠিনীর কথায়।
“কি রে? বাড়িতে গিয়ে বলেছিলি উকুন সারানোর কথা?”
আরেকজন ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছিল। ফিরে এসে বলল, “হ্যাঁ, কি করেছিস, ওষুধ দিয়েছিস? ওষুধ কোথায় পাওয়া যায়?”
কিন্তু কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারল না। উকুন নিয়ে ভাবার অবকাশ পরিস্থিতি তাকে দেয়নি। সুতরাং মুগ্ধার যেমন মাথার উকুনের বাড়বাড়ন্ত হচ্ছিল, আর তেমন ক্লাসরুমে সে ক্রমশই কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল। পরের দিনও তাকে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ক্লাস টিচার ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “আজ কি ব্যাপার?”
“দিদি, বসার জায়গা নেই।”
তিনি চারিদিকে চোখ বুলিয়ে একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে দিলেন। পরের দিন সেখানে বসতে গেলে পাশের মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলল, “দিদি রোজ এখানে বসার কথা বলেননি. কাল প্রতিমা আসেনি তো, তাই ওর জায়গায় তুই বসেছিলি।” যথারীতি সে আবার ব্যাগ ঘাড়ে করে দাঁড়িয়ে রইল।

প্রত্যেকদিন একপ্রকার নিয়ম হয়ে গেলো। ক্লাস টিচারেরও ক্লাসে ঢুকে প্রথম কাজ হল তার বসার জায়গা করে দেওয়া, তারপর ক্লাস শুরু করা। প্রত্যেকের মনে ভয় হত, আজ না দিদি মুগ্ধাকে আমাদের বেঞ্চে বসিয়ে দেন। ক্লাসে চলতে থাকা সমস্যা নিয়ে একে একে সব টিচাররাই অবগত হলেন। এই অবস্থায় তাঁরা কাউকেই দোষ দিতে পারতেন না। নিলীমাদি ছিলেন ছাত্রীদের কাছে খুব প্রিয় শিক্ষিকা। ক্লাস নিতে এলেন, “বসো” বলার পরও সবাই দাঁড়িয়ে রইলো, এক মুগ্ধা ছাড়া।
“কি হয়েছে?”
“দিদি, মুগ্ধার মাথায় উকুন আছে। আমরা ওকে রোজ বলছি, তবু সারিয়ে আসছে না।”
“হ্যাঁ, আমি শুনেছি তোমাদের ক্লাসের এই সমস্যাটার কথা। দেখো, ওর মাথায় উকুন আছে। ক্লাসে আর কারও মাথা খুঁজলে যে উকুন পাওয়া যাবে না, তা তো নয়।” তারপর মুগ্ধাকে বোঝালেন উকুনের অপকারিতা। বোবাদৃষ্টিতে দিদির দিকে তাকিয়ে রইলো। একদিন ক্লাসে ঢোকার সময় তার কানে এলো পার্বনী বলছে, “ঐ দেখ, উকুনে বুড়ি এসে গেছে।” এতদিন কোঁকড়ানো চুলের জন্য তাকে ‘ম্যাগী’, ‘নিগ্রো’ – এসব উপমা শুনতে হয়েছে। যারা শুনতে পেল, তারা ঠিক পনের বছর পরে সেই হাসিটাই হেসেছিল, হুবহু একই অঙ্গভঙ্গি। পার্থক্য ছিল শুধু তাদের নামে। ইতিমধ্যে সে বাবাকে বলে দুদিকে সরু দাঁতওয়ালা বিশেষ ধরনের চিরুনি কিনেছে, তাঁর সাথে সেলুনে গিয়ে ছোটছোট করে চুল কেটেছে। মনে করেছিল, এবার হয়ত পরিস্থিতি কিছুটা সহনশীল হবে। ক্লাসে ঢুকতেই তনিমা চেঁচিয়ে উঠলো, “ওকে দেখ, কি অবস্থা ওর!” সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল, অনেকেই ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল। তবে কেউ কেউ তাকে নিয়ে ভীষণ উদাসীন ছিলো, তারা প্রথম সারির মেধাবী ছাত্রীরা আর তাদের তথাকথিত বন্ধুরা। কয়েকদিন পর সে আশাহত হল। না, এভাবে তার উকুন নির্মূল হবেনা। পিটি ক্লাস থাকত শেষ পিরিয়ডে। সেদিন পিটি টিচার ক্লাসে এসে ভীষণ বিরক্তি দেখিয়ে বলল, “এই, তুমি উকুন সারাও না কেন? কেউ তোমার সাথে দাঁড়াতে চাইছে না।” মাঠে গিয়ে দিদিমণি হাতের ইঙ্গিতে তাকে লাইনে না দাঁড়িয়ে একটু তফাতে দাঁড়াবার নির্দেশ দিলেন। মুগ্ধার বারবার মনে হচ্ছিল কতক্ষণে ছুটি হবে, আর সে পাড়ার মাঠে খেলতে যাবে। আর মাঝে মাঝে অন্যদের সাথে গলা মিলিয়ে বিড়বিড় করে গাইছিল, “চল কোদাল চালাই, ভুলে মানের বালাই।”

ক্লাসে যা চলছিল, তার কোনকিছুই মুগ্ধার বাবা-মা জানতে পারেননি। তাঁদেরকে মুগ্ধা ব্যস্ত করতে চায়নি। তার রুগ্না মা, হতদরিদ্র বাবা নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন, তার ওপর তাঁদের ছিল পুত্রশোক। কোন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে বুঝিয়েছিল, বাবা-মাকে তাকেই আগলে রাখতে হবে। তাছাড়া আত্মীয়-পরিজনদের অযাচিত হেনস্থা, তিরস্কার তাকে বুঝিয়েছিল, তার সঙ্গে যা হচ্ছে এটাই স্বাভাবিক। আজও মুগ্ধা এটা ভেবে আশ্চর্য হয়, ওই বয়সে এতকিছুর পরেও কিভাবে এতটা নিরুত্তাপ ছিল। মা তার মুখ দেখে কিছু একটা আন্দাজ করতেন, কয়েকবার জিজ্ঞেসও করেছেন। সে “কিছু হয়নি” বলে এড়িয়ে যেত। আসলে তার স্কুলের কোন কথা বলতে ইচ্ছে হত না। মুগ্ধা এখন উকুনে বুড়ি নামে ক্লাসে পরিচিত। ক্লাসের সামনের করিডরে বেশ কয়েকটি বেঞ্চ রাখা ছিল। সেখান থেকে একটা টেনে এনে পেছনের দিকে সবার থেকে বেশ খানিকটা তফাতে সেটা পেতে বসল। এক সহপাঠিনী তার সামনে গিয়ে শাসনের গলায় বলল, “কি রে? তুই এভাবে বসেছিস কেন?” মুগ্ধা যথারীতি চুপ করে রইলো। ক্লাস টিচার এসে দেখতে পেয়ে একটু অবাক হলেন, তখন সুচরিতা নামে একটি মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “দেখুন না দিদি, বাইরে থেকে বেঞ্চ নিয়ে এসে বসেছে।” উনি একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, “আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি ওখানে বসো।” টিচার এবং মেয়েদের হাসি দেখে সে বুঝতে পারে, এইভাবে তার বসার ব্যবস্থা হবে না। পরের পিরিয়ডে আবার বেঞ্চটি আগের জায়গায় রেখে আসে। আজকাল মুগ্ধা যাদের পাশে বসে, তাদের থেকে বেশি সে জড়সড় হয়ে থাকে। সে যদি পড়াশোনায় ভালো হত, তাহলে হয়ত পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারত। কিন্তু সে তো পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া ছিল, তাই হয়ত নিলীমাদি ছাড়া আর একজন টিচারের সহানুভূতি সে পেয়েছিল, তিনি হলেন ছন্দাদি। তিনি ভীষণ রাশভারী কড়া স্বভাবের, তারপরও মুগ্ধা যেন কিভাবে তাঁর নজর কেড়েছিল।

এমন‌ই একদিন যখন সে ঘাড়ে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ক্লাসে ফেল করা মেয়ে বলে যাদের দাগিয়ে দেওয়া হয়, তাদেরই একজন মুগ্ধাকে বলে, “ওই এখানে বস না, অনেক জায়গা আছে।”
মুগ্ধা হতভম্ব হয়ে তখনও দাঁড়িয়ে। সে বলল, “তুই এখন থেকে এখানে বসতে পারিস।”
পরের পিরিয়ডে সেই মেয়েটির এক বন্ধু মেয়েটির কাছে এসে বলে, “ওকে বসতে দিলি তো, এবার বুঝবি।”
সে মুখভঙ্গি করে উত্তর দিয়েছিল, “তোর মাথায় উকুন নেই? দাঁড়া, কাল কৌটো করে উকুন এনে তোর মাথায় ছেড়ে দেব।”
তারপর মুগ্ধাকে বলে, “তোদের ক্লাসের আর কারও মাথায় উকুন নেই? আমি নিজে দেখেছি অনেকে দুদিকে বিনুনি করে আসে আর চুলের ফাঁক দিয়ে নিকি ভেসে থাকে।”

একদিন মীনাক্ষী খুব শক্ত করে টেনে বেণী করে এসেছিল, অঞ্জলি নামে এক বন্ধু তাকে বলে, “বাব্বা! তুই একেবারে খিঁচে চুল বেঁধে এসেছিস।”
সে কাঁচুমাচু মুখে বলে, “কি করব? নইলে মাথায় উকুন ঢুকে যাবে যে।”
চলার পথে মুখোমুখি হয়ে গেলে ছিটকে সরে যেত। তবে অন্য কোন সময় যদি রাস্তায় মুগ্ধার সাথে দেখা হত, তখন কেউই ভীষণ ব্যস্ত হয়ে ছুটে পালাবার পথ খুঁজত না। বরং তাকে বিশেষ পাত্তা দিত না, যেন ওকে চেনেই না। হয়ত সবাই নিশ্চিন্তে ছিল, রাস্তাঘাটে মুগ্ধার মাথার উকুন তাদের নাগাল পাবে না। পিটির সময় মুগ্ধাকে নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছিল, তার সমাধান সে নিজেই বের করে নিয়েছিল। পিটির দিনগুলো সে কামাই করত। মাসে চারটে করে কামাই ছিল, তবুও কিভাবে যেন তার অ্যাটেনডেন্স নিয়ে গার্ডিয়ান কল হল না। অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর মামার বাড়ি ঘুরতে গেলে মুগ্ধার দিদিমা সব দেখেশুনে তাকে ন্যাড়া করিয়ে দিলেন। নতুন ক্লাসে মুগ্ধা মাথা ভরা ছোট ছোট চুল নিয়ে যায়, সবার মন থেকে উকুনের আতঙ্ক পালায়। মধুরিমা মুগ্ধার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছিল, “ওই দেখ, কে এসেছে – নানা পাটেকার।” রুপালি নামের এক বন্ধু তার সামনে এসে হাতমুখ নেড়ে নানা পাটেকরের মিমিক্রি করায় আশেপাশের মেয়েরা খিলখিল করে হেসে উঠেছিল । মুগ্ধা নির্বিকার মুখে ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে বসেছিল। না, মুগ্ধার অনুভূতি ভোঁতা ছিল না, বরং অবজ্ঞাটা তীক্ষ্ণ ছিল।

মুগ্ধার হিমশীতল প্রতিক্রিয়া কি তার বান্ধবীদের এতটাই প্রশ্রয় দিয়েছিল, যে তারা আজও একই মনোভাব পোষণ করে। পুরনো দিনকে ফিরিয়ে এনে এখনও তাকে হেনস্থা করতে পারে। নাকি তার আচরণ প্রত্যাঘাত হয়ে ওই বান্ধবীদের মনেই আছড়ে পড়েছিল? এ কি তারই বহিঃপ্রকাশ? মনঃস্তত্ত্ব বড় জটিল বিষয়।


লেখক পরিচিতি : সুচন্দ্রা চ্যাটার্জ্জী
জন্ম ১৯৮৭ সালের ৮ই জানুয়ারী কলকাতায় । একাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময় প্রথম কবিতা লেখা কিন্তু পরবর্তীতে আর লেখার চর্চা হয়নি। শেঠ আনন্দরাম জয়পুরিয়া কলেজ থেকে কলা বিভাগে স্নাতক ও রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। এরপর সংসার, দুই সন্তান, বয়স্ক অবিভাবকদের সেবাযত্ন আর তারই পাশাপাশি গল্পের বই পড়েই সময় কেটেছে। দীর্ঘ বিরতির পর আবার লেখালেখি শুরু হয়েছে । এই লেখা মস্তিষ্কের খোরাক আর প্রাণের আরাম।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।