লেখক : ঊর্মি পান্ডা
এয়ারপোর্টে নামতেই এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া রজতকে ছুঁয়ে যায়। কি সুন্দর জায়গা। রাস্তার দু’ধারে গোলাপ, কাঠবাদাম আর চিনারের গাছ। দূরে বরফঢাকা পাহাড়ে সূর্যের আদর।
খজর রজতের সামনে এসে বলে, “আমি আপনার অফিসের ড্রাইভার। আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।”
কোয়ার্টারে পৌঁছতেই মনটা ভাল হয়ে যায়। সুন্দর করে সাজানো কোয়ার্টার । রান্না ও অন্যান্য কাজকর্মের জন্য আছে ছোটু।
একটু পরেই রজত বেরিয়ে পড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে ।
সন্ধ্যেয় অফিস থেকে বেরিয়ে ডাল লেকের পাশে আসে সে। অনেক হাউসবোট আর শিকারা জলে ভেসে আছে। দূরে পাহাড়ের বুকে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। পাশেই শালীমার বাগ। অসাধারণ লাগছে।
খজর হেসে বলে, “কাশ্মীরকে বুঝতে গেলে পুরো বছরটাই লাগে। সেপ্টেম্বরে আপেল, ডিসেম্বরে বরফ, এপ্রিলে টিউলিপ ফুল, আর জুলাইতে চেরী, স্ট্রবেরীতে ভরে যায় এই উপত্যকা।”
ডাল লেকের পাশে কিছুক্ষণ থেকে রজত ফেরৎ আসে কলোনীতে। কোয়ার্টারে ফিরতেই ছোটু জাফরান দিয়ে কেওয়া বানিয়ে নিয়ে আসে।
পরেরদিন সকালে গাড়ি নিয়ে রজত বেরিয়ে পড়ে পহেলগাঁও এর উদ্দেশ্যে।
সাইটে কাজকর্ম দেখে কলোনীতে ফেরার সময় খজর হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে বলে, “সাহাব, দু’জন লড়কী, আমাদের কলোনীর মধ্যেই থাকে, ওদের গাড়িতে তুলে নিই? বেচারীরা বোধহয় কলেজ থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরছে।”
রজত খানিকটা বিরক্ত হয়। একে সরকারী গাড়ি, তার ওপর জানাশোনা নেই। দু’জন মেয়েকে গাড়িতে তুলতে তার আপত্তি হচ্ছিল।
খজর বুঝতে পেরে বলে, “ওদের বাবা আমাদের অফিসেরই কর্মচারী।”
রজত খানিকটা বিরক্ত হয়েই বলে, “ঠিক আছে, গাড়ির পেছনের দরজাটা খুলে দাও, ওখানে বসুক।”
খজর মেয়েদু’টিকে ডেকে বলে, “এসো, আমরা কলোনীতেই যাচ্ছি, তোমাদেরকেও পৌঁছে দেবো।” মেয়ে দু’টি হাসিমুখে গাড়িতে এসে বসে।
রজতের এত ক্লান্ত লাগছিল, যে কোয়ার্টারে এসে একেবারে ডিনার করে শুয়ে পড়ে।
পরেরদিন দিন সকালে হঠাৎ ডোরবেলের শব্দ শুনে দরজা খুলে দেখে কালকের একটি মেয়ে এসেছে। হাতে এক ঝুড়িভর্তি আপেল। কি অসাধারণ সুন্দরী মেয়েটি।বেশ লম্বা, ফর্সা, গালে হালকা গোলাপি ছোঁওয়া, চোখ দু’টো কি মায়াবী। রজত অবাক হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে আছে দেখে সে লজ্জায় মাটির দিকে তাকিয়ে বলে, “মা এই আপেলগুলো আপনার জন্য পাঠিয়েছে।”
ঝুড়িটি নিতে গিয়ে মেয়েটির হাত রজতের হাতে লেগে পুরো শরীর জুড়ে শিহরণ খেলে যায়। রজত বলে, “তোমার নাম কি?”
“আমার নাম সীমরন।”
সীমরন চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেও রজতের মনে একটা অদ্ভুত ভাললাগা কাজ করতে থাকে। কি অপূর্ব মেয়েটি।
সেই শুরু।
কলোনীর মধ্যে একটু দূরে কয়েকটি পাঞ্জাবী পরিবার থাকে। সীমরন ওখানেই থাকে।
একদিন সীমরনের বাবা এসে বলেন, “সাহাব, আজ রাতের খাওয়াটা আমাদের সাথে করলে খুব খুশি হব।”
রজত বলে, “ঠিক আছে। আমি কিন্তু খেতে খুব ভালবাসি।”
রাতে রজত সীমরনদের বাড়িতে এলে সবাই খুব আপ্যায়ন করে ওকে বসায়। ছোট্ট ছিমছাম করে সাজানো কোয়ার্টার। কার্পেটের ওপর গদী করে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশে একটি কাঙরীও রাখা আছে। কিছু কথাবার্তার পর রজত খেতে বসে। চিকেন কান্দী, গুস্তাবা, পনীর পকোড়া, আর আপেলের তরকারি। অপূর্ব রান্না হয়েছে। সীমরন পরিবেশন করছে। কেমন একটা ভাললাগা কাজ করতে থাকে রজতের মনে। অপূর্ব লাগছে সীমরনকে। দু-একবার চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিলো সীমরন। খাওয়ার শেষে ধন্যবাদ জানিয়ে কোয়ার্টারে ফিরে আসে রজত। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। পুরো মন জুড়ে কেমন একটা ভাললাগার রেশ। সেদিন রাতে অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসে না রজতের। একেই কি প্রেম বলে? চোখ বন্ধ করলেই সীমরনের মুখটা ভেসে উঠছে। সে কি সীমরনকে ভালবেসে ফেলল?
সীমরনদের পরিবারের সঙ্গে রজতের ঘনিষ্ঠতা এতটাই হয়ে গেছিল যে সে প্রায়ই ওদের বাড়িতে রাতের খাবার খেয়ে ফিরত। একদিন সীমরনের মা সীমরনের বাবাকে বলেন, “আমার কিন্তু রজত ছেলেটাকে খুব ভাল লাগে। আমাদের সীমরনের কি আর সেই কপাল হবে?”
“রজত কত বড় অফিসার। তাছাড়া ও আমাদের জাতেরও নয়। এমনিই হয়ত এখানে কেউ নেই বলে আমাদের বাড়িতে আসে।”
“না গো, ওর চোখে আমি সীমরনের জন্য ভালবাসা দেখেছি । ঠিক বোঝা যায়।”
একদিন সীমরনের মা রজতকে বলেন, “বাবা, লোকে তোমাকে আর সীমরনকে নিয়ে অনেক কথা বলছে। আমি তোমাকে নিজের ছেলের মতোই ভালবাসি, কিন্তু মানুষের মুখ তো আমি বন্ধ করতে পারি না। এরপর আমার মেয়ের আর কোথাও ভাল বিয়ে হবে না।”
“আপনার মেয়েকে আমি ভালবাসি। আমি ওকেই বিয়ে করব। আমি কিছুদিন পরেই গুজরাটে আমার বাড়িতে গিয়ে সব কথা বলে খুব তাড়াতাড়িই ওকে বিয়ে করবো।”
“আচ্ছা বাবা, এ তো আমাদের পরম সৌভাগ্য।”
পরের দিন পহেলগাঁও যাওয়ার সময় রজত বলে, “আমি কি সীমরনদের সাথে নিয়ে যেতে পারি?”
সীমরনের মা বলেন, “আচ্ছা, তুমি সীমরন আর তার ভাইকে নিয়ে যাও।”
পরের দিন সকালে ওরা বেরিয়ে পড়ে পহেলগাঁও এর পথে। সীমরনের ভাই সামনের সিটে আর পেছনের সীটে রজত আর সীমরন বসেছে। রজত সীমরনের হাতটা শক্ত করে ধরে বসেছে। সীমরন হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই, আরও শক্ত করে হাতটা চেপে ধরে রজত। সীমরনের মুখটা লাল হয়ে যাচ্ছিল। রজতের বেশ মজা লাগছিল। মাকে সীমরনের ফটো দেখালে মা নিশ্চয়ই খুব খুশী হবেন। এত সুন্দর মেয়ে।
পহেলগাঁওতে পৌঁছে আশেপাশের জায়গা দেখতে বেরোয় ওরা। এত ঠান্ডা পড়েছে যে সীমরনের গাল পুরো লাল হয়ে গেছে। খজরের সাথে সীমরনের ভাই কিছুটা অন্য রাস্তায় গেলে, রজত আর সীমরন পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। রজত সীমরনের হাতটা ধরে বলে, “আমাকে তোমার ভাল লাগে?”
সীমরন মুখ নীচু করে থাকে। লজ্জা পেলে কি অপূর্ব লাগে ওকে। সবুজে মোড়া উপত্যকায় লীডার নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকে ওরা। রজত বলে, “সীমরন,তুমি নিশ্চয়ই জানো যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। এবার তুমি বলো, আমাকে তোমার কেমন লাগে?”
সীমরন চুপ করে থাকে। রজত হাতে একটু চাপ দিয়ে বলে, ” চুপ করে থাকলে হবে না।”
সীমরন বলে, “আমারও আপনাকে খুব ভাল লাগে।”
রজত বলে, “ভাল লাগে বললে হবে না, ভালবাসি বলতে হবে।”
সীমরন বলে, “ভালবাসি আপনাকে।”
সীমরনকে জড়িয়ে ধরে রজত বলে, “আপনি নয়, ভালবাসি তোমাকে বলতে হবে।”
সীমরন বলে, “আমি তোমাকে ভালবাসি।”
সীমরনের ঠোঁট রজতের ঠোঁটের মধ্যে। একেবারে যেন শুষে নিচ্ছে মরুর তৃষ্ণা। সীমরন কাঁপতে থাকে। রজত শক্ত করে সীমরনকে জড়িয়ে থাকে। ধীরে ধীরে সীমরনের কপাল থেকে চুল সরিয়ে কানের উপর রেখে রজত বলে, “তোমাকে আমি অনেক ভালবাসব। একটা সুন্দর ঘর আর দু’টো ছোট্ট বাচ্চা হবে আমাদের।তোমার মতো সুন্দর হবে তারা।”
সীমরন হেসে বলে, “এতদূর পর্যন্ত ভাবা হয়ে গেছে?”
“আমি তো শুধু তোমার কথাই ভাবি। কাজও ঠিক মত করতে পারছি না। একমাসের জন্য বাড়ি যাব, কি করে যে তোমায় ছেড়ে থাকব, তাই ভাবছি।”
কিছুক্ষণ পরে সবাই আবার কলোনীতে ফেরার জন্য বেরিয়ে পড়ে। রজত ওদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসে কোয়ার্টারে ফিরে খেয়ে শুয়ে পড়ে।
পরের দু’দিন শুধু ব্যস্ততার মধ্যেই কেটে যায়। একমাসের জন্য বাড়ি যাবে তাই অফিসের সব কাজ গুছিয়ে রাখতে হচ্ছে। সেদিন সন্ধ্যের সময় সবকিছু গোছাতে বসে রজত। দু’টো পশমীনা শাল আর বাড়ির জন্য বাদাম, আখরোট, খুমানির প্যাকেট কিনেছে সে। হঠাৎ ডোরবেলের শব্দ শুনে দেখে সীমরন এসেছে। সীমরন ভেতরে এলে দরজা বন্ধ করে দেয় রজত। তারপর বলে, “চোখ বন্ধ করো।” সীমরন চোখ বন্ধ করতেই ওর হাতে পরিয়ে দেয় একটা সোনার আংটি। খুব সুন্দর দেখতে আংটিটা, কাল কিনে নিয়ে এসেছে রজত। গোলাপী রঙের পশমীনা শালটাও ওর গায়ে জড়িয়ে দেয়। মনে মনে ভাবে, সত্যি, শালটা কি অসাধারণ মানিয়েছে ওকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে সীমরনকে। আদরে আদরে পাগল করে তুলতে থাকে। বলতে থাকে, “সীমরন, আমি কাল চলে যাবো। আমাকে একটু আদর করতে দাও।”
রজত শক্ত করে সীমরনের ঠোঁটটাকে কামড়ে ধরে। আদরের সোহাগে পাগল করে দিতে থাকে সে সীমরনকে। ভালবাসার স্রোতে ভেসে যেতে থাকে দু’টি হৃদয়। সম্বিৎ ফিরতেই সীমরন তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।
রাতে সীমরনদের বাড়িতে খাওয়ার পর সীমরন রজতকে কোয়ার্টার পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়ার জন্য একসাথে পাশাপাশি চলতে থাকে। রজত বলে, “সীমরন, তুমি ভুল বুঝো না। তখন যে ঠিক কি হয়ে গেছিল, তুমি আমায় ক্ষমা না করলে, আমি বাড়িতে গিয়েও শান্তি পাব না।”
সীমরন শুধু বলে, “তুমি কবে আসবে?”
“ঠিক এক মাস পরে। তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করো।”
রজত চলে যাওয়ার কিছুদিন পরেই সীমরন বুঝতে পারে রজতকে সে কতটা ভালবাসে। কোন কিছুই যেন তার ভাল লাগেনা। শুধুই যেন অনন্তকালের অপেক্ষা।
ধীরে ধীরে এক মাস হয়ে যায়। রজতের কোন খবরই সে পায় না। হাজার চিন্তা সীমরনকে আঁকড়ে ধরে।
সেদিন সকালে কলেজে যাওয়ার সময় রাস্তায় নিশি ভাবীর সঙ্গে দেখা। তিনি সীমরনকে বলেন, “কাল রজতের ফোন এসেছিল। আর কয়েকদিন বাদেই এক ডাক্তার মেয়ের সাথে রজতের বিয়ে হবে। রজতের মা নাকি খুব অসুস্থ, তাই বিয়েটা খুব তাড়াতাড়িই হবে।”
কিছুক্ষণের জন্য সীমরনের পায়ের তলা থেকে যেন মাটিটা সরে যায়। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সে আবার বাড়িতেই ফিরে আসে। তার মা বলেন, “কিরে কলেজ গেলি না?”
“না মা, আজ শরীরটা ভাল লাগছে না।” বলে চুপচাপ দরজা বন্ধ করে দেয়। মানুষকে চিনতে কেন এত ভুল হয়? ওই মানুষটাকে সে বিশ্বাস করেছিল? তাকে তার শরীর, মন সব দিয়েছিল? রজত পারল তাকে ঠকাতে? পারল তার সব বিশ্বাস ভেঙে দিতে? চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু সে শুধু বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল।
সেদিন রজতের বিয়ের দিন। সীমরনের শরীরটা এখন খুব খারাপ লাগে। কেমন যেন মুখে অরুচি, কিছুই খেতে ইচ্ছে করেনা। তবুও কাউকে কিছু বলে না।সীমরনের মা একদিন সীমরনকে বলেন, “কি হয়েছে ঠিক করে বল। মায়ের চোখকে ফাঁকি দিতে পারবি না।”
সীমরন চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে সব কথা বলে। রাতে সীমরনের বাবা এলে সীমরনের মা সব কথা বলেন। সীমরনের মায়ের চোখের জল যেন থামছেই না। তার ফুলের মতো মেয়েটা পুরো শুকিয়ে গেছে। ওর মুখের দিকে তাকানোই যাচ্ছে না।
যেদিন রজতের ফেরার কথা কাশ্মীরে, সেদিন নিশি ভাবী সীমরনকে বলে, “রজত আজ একা এসে কোয়ার্টারটাকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে পরে তার স্ত্রীকে এখানে আনবে।”
সকাল দশটার দিকে রজত এসেই অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়ে। টানা একমাসের কাজ জমে গেছে, দম ফেলারও সময় পাচ্ছে না। তারমধ্যেই কোয়ার্টারটাকেও সাজাতে হবে। ক’টা দিন ব্যস্ততার মধ্যেই কেটে যায়। পরের দিন সকালে ফ্লাইট। সন্ধ্যেতে নিজের জিনিসপত্র গোছাতে বসে রজত।
ধীরে ধীরে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় সীমরন। অনেক সংকোচে ডোরবেলটা বাজায়। রজত এসে সীমরানকে দেখে বলে, “এসো সীমরন।”
রজতের বুকটা মুচড়ে ওঠে। কাশ্মীরে আসার পর আর সীমরনদের বাড়িতে সে যায়নি। কিছুটা লজ্জায়, কিছুটা সংকোচে। অত সুন্দর গোলাপের মতো মেয়েটা যেন শুকিয়ে গেছে। মা যে এত অবুঝ হবে, কি করে জানত সে। তার সব কথা শুনে মা বলেছিল, “তুই যদি ওকে বিয়ে করিস, তবে আমার মরা মুখ দেখবি।” তারপর টানা দু’দিন অনেক চেষ্টা করেও মাকে কিছু খাওয়ানো যায় নি। নিজের জেদে মা অটল ছিল। শেষমেষ মার হাতে ধরে প্রতিজ্ঞা করতে হয়েছিল, সে সবিতাকেই বিয়ে করবে এবং কয়েকদিনের মধ্যেই করবে।
সীমরনকে একটু বুঝিয়ে বলবে বলে রজত তাকে ভেতরে আসতে বলে। কিন্তু সীমরন বাইরে থেকেই বলে, “আপনার কিছু জিনিস আমার কাছে আছে, সেগুলো ফেরৎ দেওয়ার জন্যই আমি এসেছি।”
সীমরন পশমীনা শালটা, আংটিটা, আর একটা মুখবন্ধ খাম ওর হাতে দিয়ে চুপচাপ চলে যায়। রজত ভাবে, সীমরন কি আর জানে, এই একটা মাস ধরে তার ওপর কি ঝড় বয়ে চলেছে। সীমরনকে সে কোনদিনও ভুলতে পারবে না। কিছুক্ষণ চুপ করে সোফার উপর বসে থাকে সে। তারপর চুপচাপ শালটা আর আংটিটা স্যুটকেসে রেখে দিয়ে চিঠিটা দেওয়াল আলমারিতে যত্ন করে রেখে দেয়। একটু সময় নিয়ে পড়বে সে। খুব ক্লান্ত লাগছে।
পরের দিন সকালে রজত গুজরাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। একসপ্তাহ পরে আবার সবিতাকে নিয়ে কাশ্মীরে আসে। সবিতা সাজানো কোয়ার্টার দেখে খুব খুশী হয়। বেশ কয়েক দিন পরে, সবিতা একদিন যখন সবকিছু গোছাচ্ছে, তখন একটা স্যুটকেসের মধ্যে একটা শাল আর একটা আংটি পায়। রজতকে জিজ্ঞেস করতে সে বলে, “তোমার জন্মদিনে ওগুলো দেব বলে কিনে রেখেছিলাম, তুমি দেখে ফেললে?”
সবিতা খুব খুশি হয়। রজতের মতো স্বামী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
আরও জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে গিয়ে সবিতা হঠাৎ দেওয়াল আলমারীতে দেখে একটা গোলাপী রঙের খাম। মেয়েলী কৌতূহলে খামটাকে খুলে দেখে, তার ভেতরে একটা চিঠি আর একটা শুকনো গোলাপ রাখা আছে। ধীরে ধীরে সে চিঠিটা পড়তে শুরু করে।
চিঠিটাতে কোন সম্বোধন নেই, শেষেও কোন নাম লেখা নেই। চিঠিতে লেখা আছে,
“কাশ্মীরের পথের ধারে, ঝোপেঝাড়ে, অনেক গোলাপ ফুল ফুটে থাকে। ওগুলো লতানো গাছের ফুল। ওই ফুলগুলো দেখতে ভাল লাগে। ওই ফুলগুলো তুলে তাদের একটা একটা করে পাঁপড়ি ছিঁড়ে ফেলতেও খুব ভাল লাগে। কিন্তু ওই ফুলগুলো কোনদিন ঘরে নিয়ে এসে ফুলদানিতে রাখা যায় না।
আমরা এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। তোমার সাথে আমার আর কোনদিনও দেখা হবে না।
আমার অনেক আগেই বোঝা উচিত ছিল, আমাদের মতো মেয়েদের নিয়ে কিছুটা আনন্দ করা যায়, কিন্তু কখনও তাদের ঘরের বউ করা যায় না। নিজের সম্মানটা নিজেই রাখতে পারিনি, তাই একটু খারাপ তো লাগছেই। কিন্তু আমি পারব নিজেকে সামলে নিতে।
তোমার আগামী জীবনের জন্য শুভেচ্ছা রইলো।”
সবিতা চিঠিটা নিয়ে রজতের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। রজতের হাতে চিঠিটা দিয়ে বলে, “এই চিঠিটা তোমার দেওয়াল আলমারিতে রাখা ছিল, পড়ো চিঠিটা।”
রজত চিঠিটা নিয়ে পড়তে থাকে। বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। রজত ধীরে ধীরে বলে, “আমার আগেও এই কোয়ার্টারে অনেকেই থেকেছে, হয়তো তাদের কারুর হবে এই চিঠিটা। ভুল করে ফেলে রেখে গেছে।”
সবিতা বলে, “যারই হোক চিঠিটা, কি নিষ্ঠুর ওই মানুষটা, যে একটা মেয়েকে মিছিমিছি প্রেমের অভিনয় করে কষ্ট দিয়েছে। মানুষ যে কিভাবে এত নিষ্ঠুর হয়।”
রজত চুপ করে থাকে।
তারপর ধীরে ধীরে ছাদে এসে দাঁড়ায়। রাত্রি হয়ে গেছে। দূরে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। রজত ট্রান্সফারের জন্য আবেদন করে দিয়েছে। কাশ্মীরে সে থাকতে পারবে না। কাশ্মীরের প্রতিটি জায়গায় সীমরনের স্মৃতিচিহ্ন। রজতের চোখটা জ্বালা জ্বালা করতে থাকে। সীমরনের বাবা কলোনীর থেকে অনেকটা দূরে কোথাও বাড়ি ভাড়া করে চলে গেছে।
ভীষণ শীত করছে রজতের। সে চলে যাবে। তার আর সীমরনের প্রেম চাপা পড়ে থাকবে, অজস্র চিনারের ঝরাপাতায়। বরফ পড়বে সেই পাতায়। হালকা হালকা করে ভিজবে সে আর সীমরন সারাটা জীবন।
লেখক পরিচিতি : ঊর্মি পান্ডা
আমি ঊর্মি পান্ডা। আমি একজন গৃহবধূ। আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে স্নাতক হয়েছি। বাংলা সাহিত্যে লেখালেখি এবং পড়ার বিষয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ আছে।