লেখক: সম্বিত শুক্লা
গত পর্বের লিঙ্ক এখানে
দ্বিতীয় ভাগ
স্থানীয় প্রতিক্রিয়া
সমস্যাটা বিশ্বব্যাপী হলে তার সমাধানও বিশ্বব্যাপী হওয়া উচিত। স্থানীয় স্তরে আমরা কতটুকুই বা করতে পারি? উত্তরে বলা যায়, ধনী ও ক্ষমতাবান লোকেরা এই অবস্থার জন্য বেশি দায়ী হলেও সমস্যাটা সর্বস্তরের। যদি জাতিসঙ্ঘ বিশ্বব্যাপী জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে ও সরকার পদক্ষেপ নেয় এবং শিল্প সভ্যতার পতন ঘটে তাহলে পুনরুদ্ধার এর জন্য বাস্তুতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন ও তাকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব স্থানীয় স্তরের মানুষকেই নিতে হবে। এখনও অবধি বাস্তবে কোন সরকারই দৃঢ় কোন পদক্ষেপ নেয়নি আর আমাদেরকে এই মুহূর্তেই রূপান্তরের কাজে হাত দিতে হবে কারণ আমরা আগেই জেনেছি যে ‘কাজ করার এটাই সময়’ এবং ‘কাজ করার সুযোগ প্রায় শেষ’।
যথাযথ প্রতিক্রিয়া দিতে গেলে, প্রথমেই আমাদেরকে সমস্যাটি ভালো করে বুঝতে হবে এবং তারপর এমনভাবে লক্ষ্য (ভিশন) স্থির করতে হবে যাতে করে শিল্প-সভ্যতা পরবর্তী সমাজে এরকম সমস্যা আর না ফিরে আসে। এবং তারপরেই আমরা আমাদের কর্মপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করতে পারি যাতে করে ধাপে ধাপে আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি।
তবে তার আগে বর্তমান সমস্যাগুলো আগে দেখে নেওয়া যাক – ১। কোন বিকল্প শক্তি নেই যা দিয়ে ট্রাক, গাড়ি ইত্যাদি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় পেট্রোলিয়াম ও গ্যাসকে প্রতিস্থাপন করা যায়। বর্তমানে, পরিবহন ব্যবস্থা বিশ্ব পুঁজিবাদে এতটাই ন্যুনতম চাহিদা যে শুধু পরিবহন ব্যবস্থার পতনই গোটা সভ্যতার পতনের কারণ হয়ে উঠতে পারে। ২। কোন বিকল্প শক্তি নেই যা আমাদের বর্তমান ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় শক্তির চাহিদা পূরণ করতে পারে। ৩। উপরের দুটি সমস্যার সরল অর্থ ‘বিশ্বায়ন’ আর সম্ভব নয়। ৪। সম্পদের বর্তমান হারে খরচের ফলে বিশ্ব উষ্ণায়নের হার অগ্রহণযোগ্য সীমায় পৌঁছাবে এবং বাস্ততন্ত্রের অবক্ষয় ঘটবে।
উপরের সমস্যাগুলির ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে শিল্প সভ্যতা পরবর্তী সমাজে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি থাকতে হবে – ১। সমতা ২। সম্পদ বিশেষ করে শক্তি ব্যবহারের পরিমাণ কমানো ৩। স্থানীয় স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি ৪। বর্তমানের অবক্ষয়িত বাস্তুতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন ৫। এমন এক মূল্যবোধ বা নীতিনির্ভর ব্যবস্থা গড়ে তোলা যা সহযোগিতাপূর্ণ এবং বর্তমান সমাজের থেকে কম প্রতিযোগিতা পূর্ণ হবে।
ফলত, আমাদেরকে এখন থেকেই ভাবতে হবে, পরিকল্পনা করতে হবে এবং কাজ করতে হবে। কথায় বলে, ‘ভাবনাটা কাজ করা নয়, পরিকল্পনা করাটা কাজ করা নয়, কাজ করাটাই কাজ করা’।
স্থানীয় কাকে বলব?
‘স্থানীয়’-কে অনেকভাবেই সংজ্ঞায়িত করা যায়। মানবসমাজের ক্ষেত্রে স্থানীয় বলতে মানুষের সংখ্যা এবং যতটুকু এলাকা আমরা চিনি, হেঁটে বা সাইকেলে ঘুরতে পারি সেই দিয়ে বোঝাতে পারি। সোজা হিসেবে পিন কোডকে নিতে পারি। প্রত্যেক দেশের পিন কোড সেখানের একটা স্থানীয় এলাকাকে বোঝায়। ভারতে ৩৯৭২২ টি পিন কোড আছে যার গড় লোক সংখ্যা ৮২২১ এবং এলাকার পরিমাণ ২১.২২ বর্গ কিলোমিটার। ভারতের ক্ষেত্রে মোটামুটি ১০০০০ লোক এবং ২৫ বর্গকিমি এলাকাকে ‘স্থানীয়’ বলা যায়।গ্রামীণ এলাকায় এটা ক্ষুদ্র জলবিভাজিকা বা পঞ্চায়েত এবং শহরের ক্ষেত্রে একটি পৌরসভা ওয়ার্ড হতে পারে। একবার ভাবতে শুরু করলে নিজেই নিজের স্থানীয় এলাকা বুঝে নেওয়া যাবে। আর পরিশেষে, স্থানীয় এলাকার মূল বিষয় অবশ্যই আমরা নিজে বা আমাদের পরিবার।
আমি কি করতে পারি ?
শহরে বা গ্রামের স্থানীয় এলাকায় কি করা যাবে সে নিয়ে আলোচনার আগে আমরা নিজেদের দিয়ে শুরু করি। তাহলে আমরা কি করতে পারি? সাধারণভাবে এর মূল নীতিটাই হল স্বেচ্ছায় ব্যক্তিগত স্তরে সরল সাদাসিধে জীবনযাপন। এটা অবশ্যই ঠিক যে একটি লোক তার ব্যক্তিগতস্তরে শক্তির ব্যবহার কমিয়ে অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারবে না। সমালোচকরা বলতে পারে, ‘যদি তুমি ব্যবহার না করো তাহলে অন্য কেউ করবে’। কিন্তু নিজে এটুকু শুরু করলে পরে বড় আঙ্গিকে বিভিন্ন বড় কোন সমস্যায় যুক্ত হওয়ার মানসিক শক্তি পাওয়া যাবে। কেননা, সকলকে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই হয় – ‘তুমি নিজে কি করছো এই ব্যাপারে? তোমার নিজের ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট কি?’ দ্বিতীয়ত, এটাও বলা যায়, সাদাসিধে জীবনযাপন বা ভোগবাদি দুনিয়া থেকে দূরে থাকার ফলে একজন অন্যান্য কাজ করার জন্য সময়ও বেশি পাবে।
ব্যক্তিগত স্তরে মূল লক্ষ্য শুধুই কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানো নয় বরং জীবনধারণের জন্য রোজগারও সবুজ জীবিকা থেকে করতে হবে। আমরা ‘সবুজ জীবিকা’ সেই জীবিকাগুলিকেই বলি যেগুলি ‘সমতা ও স্থায়ীত্ব’-এর উপর নির্ভর করে সমবায় গড়ে তুলে বাস্তুতন্ত্রের পুনুরুজ্জীবন করতে পারে।
শহুরে এলাকায় স্থানীয় প্রতিক্রিয়াঃ রূপান্তর নগর
বিশ্ব উষ্ণায়ণের জন্য দায়ী কার্বন নিঃসরণের প্রায় ৭০% শহরগুলি থেকে হয়। ইদানীং গ্রামের লোকেরা শহরগুলিকে তাদের আদর্শ ভাবে। তাই বিশ্বব্যাপী জরুরী অবস্থাকে মোকাবিলা করার জন্য শহরের মানুষদেরকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।
রূপান্তর নগর (Transition Town) আর্থ-সামাজিক স্থানীয়করণের জন্য একটি ধারণা। ট্রানজিশন টাউনের মূল ধারণাটি হল যে তেল ছাড়া জীবন প্রকৃতপক্ষে এখনকার চেয়ে অনেক বেশি উপভোগ্য এবং পরিপূর্ণ হতে পারে : আমাদের মানসিকতাকে পরিবর্তন করে আমরা আগামী ‘সস্তা-তেল’ পরবর্তী যুগকে হুমকির পরিবর্তে সুযোগ হিসাবে নিতে পারি এবং ভবিষ্যতের নিম্ন কার্বন যুগকে উন্নত, প্রাণোচ্ছল এবং প্রাচুর্যে ভরা হিসাবে বানাতে পারি – যা আমাদের বর্তমানের লোভ, যুদ্ধ ও চির-বৃদ্ধির অলীক কল্পনা ভরা বিচ্ছিন্ন ভোগবাদী সংস্কৃতির থেকে অনেক ভাল। আগামী দশ বছরের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানী মুক্ত শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা ট্রানজিশন টাউনগুলির লক্ষ্য হওয়া উচিত। আগেই আমরা স্থানীয় হিসেবে একটা শহর বা তাঁর অংশকে ধরেছি, যা মোটামুটি ভাবে ১০০০০ মানুষ ও ২৫ বর্গকিমি এলাকা নিয়ে হবে।
পরিকল্পনা
পরিকল্পনায় এই বিষয়গুলি থাকতে হবে – ১। বাতাস ২। জল ৩। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ৪। খাদ্য উৎপাদন ৫। শক্তি ৬। স্বাস্থ্য ৭। শিক্ষা ৮। বাসস্থান ৯। কমন্স ও হেরিটেজ ১০। কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং উদ্যোগ
এই ১০ টি বিষয়ে আমাদের ভবিষ্যতের সমাজ কেমন হবে তার একটা সাধারণ ধারণা তৈরি করে নিতে হবে এবং সেই নিয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলার জন্য প্রায় এক বছর ধরে বিভিন্ন আলোচনা সভা, বক্তৃতা সভা, চলচ্চিত্র ইত্যাদির আয়োজন করতে হবে। আমাদেরকে স্থানীয় নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে যারা এই বিষয়গুলি বোঝে এবং তা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। এই দলে ৭-১০ জন থাকতে পারে। এই দলটি রূপান্তর নগরের জন্য দশ বছরের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করবে।
মূল লক্ষ্য হবে, ঐ এলাকাকে ১০ বছরের মধ্যে ধীরে ধীরে জীবাশ্ম জ্বালানি মুক্ত করতে হবে এবং প্রত্যেকে সবুজ জীবিকার দ্বারা জীবন নির্বাহ করবে।
সাধারণভাবে লক্ষ্যগুলি এরকম হতে পারে –
১। বাতাস
আমরা বাতাস ছাড়া ৩ মিনিটও বাঁচতে পারি না! শহরে বায়ুদূষণ সব চেয়ে বেশি ঘটায় জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত যানবাহন যেমন স্কুটার,ছোট গাড়ি, বাস, ট্রাক ইত্যাদি। এর মধ্যে গাড়ি (car) থেকে জনপ্রতি নিঃসরণ সব থেকে বেশি হয়। তাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ছোট গাড়ির ব্যবহার কমানো এবং গণপরিবহন বাড়ানো। গাড়ি বিহীন এলাকা তৈরি করতে হবে, এবং ঘনবসতি এলাকায় গাড়ি-বিহীন দিন চালু করতে হবে। উল্টোদিকে সাইকেল, রিক্সা, বা অন্যান্য মানব বাহিত যান যেমন ভ্যান রিক্সা, ঠেলা গাড়ি ইত্যাদি ব্যবহার বাড়াতে হবে।
২। জল
বাতাসের পরই জলের গুরুত্ব সর্বাধিক। সমস্ত মনুষ্য বসতি জলের উৎসের অর্থাৎ নদী, সরোবর ইত্যাদির কাছাকাছি অবস্থিত। সাম্প্রতিক অতীতেও মনুষ্য বসতির আয়তন জলের সহজলভ্যতার উপর নির্ভর করেই হত। শক্তি সস্তা হওয়ার পর থেকেই দূরের নদী থেকে জল পাম্প করে শহরে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। বর্তমানে প্রত্যেক ফোঁটা জলের জন্য কিছু কয়লা (পাম্পিং এর জন্য বিদ্যুৎ) এবং/অথবা পেট্রোল (ট্যাঙ্কারে পরিবহনের জন্য) খরচ হয়। আমাদের পরিকল্পনায় এটা নিশ্চিত করতে হবে যে প্রত্যেক সরোবর পরিষ্কার বা বৃষ্টির জলে পূর্ণ হয় যাতে সরোবরের জল পানযোগ্য থাকে, মাছ চাষ করা যায় এবং স্নানযোগ্য থাকে। সরোবরের জলে ফেনা বা গ্যাজলা হওয়া বন্ধ করতে হবে। কোন বাড়ি বা রাস্তা যেন বৃষ্টির জলে প্লাবিত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে, প্রত্যেক সরকারি ও ব্যক্তিগত বাড়িতে রেন ওয়াটার হারভেস্টিং এর ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে একটুও জল নষ্ট না হয়। আর সর্বোপরি, প্রতি বছর মাটির তলার জলস্তর যাতে বৃদ্ধি পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
৩। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
বর্তমানে কঠিন বর্জ্যের প্রধান উৎস প্লাস্টিক তাই শুরুতেই একক ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক (single use plastic) নিষিদ্ধ করতে হবে। পরবর্তী পদক্ষেপ হবে বর্জ্য পদার্থকে উৎসেই সবুজ (বায়োডিগ্রেডেবল) এবং লাল (নন-বায়োডিগ্রেডেবল) বর্জ্য হিসেবে পৃথক করা এবং তার পরের পদক্ষেপে লাল বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহার ও সবুজ বর্জ্যকে সারে পরিণত করতে হবে। পরবর্তীকালে বর্জ্যশূন্য ব্যবস্থার করতে হবে এবং কারখানা বা নর্দমার বর্জ্য যাতে নদী বা জলাশয়ে না মেশে তা সুনিশ্চিত করতে হবে। মলমূত্রকে সারে পরিণত করার পদ্ধতিও ধীরে ধীরে চালু করা যেতে পারে যাতে জলাশয় পরিস্কার থাকে। কারখানার দূষিত জল শোধন করে ছাড়তে হবে এবং ক্ষতিকারক কারখানাগুলি বন্ধ করে দিতে হবে। বাইরে থেকে বা উচ্চপ্রবাহ থেকে কোন মতেই সেই এলাকায় যেন দূষিত পদার্থ প্রবেশ না করে তা নিশ্চিত করতে হবে।
৪। খাদ্য
খাদ্য দূরত্ব (Food mile) কমানোর জন্য সমস্ত রকম খাদ্য স্থানীয় এলাক্য উৎপাদন করতে হবে। তবে লবণসহ কিছু অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য হয়ত বাইরে থেকে আমদানী করতে হবে যা স্থানীয়ভাবে উৎপাদন অসম্ভব। ফল, শাকসব্জির মত সহজে নষ্ট হয়ে যাওয়ার মত খাদ্যদ্রব্য একদম স্থানীয় এলাকায় উৎপাদন করতে হবে, দানাশস্য জেলাস্তরে উৎপাদন করতে হবে। ঘরে বা ছাদে সব্জি বাগান, ফলের বাগান যেখানে যেখানে সম্ভব করতে হবে। কেউ যেন অভুক্ত না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে এবং দরকারে বিনামূল্যে ভোজনশালার ব্যবস্থা করতে হবে।
৫। শক্তি
প্রত্যেক লোকের শক্তি ব্যবহারের হিসেব করতে হবে এবং প্রতি বছর ১০% হারে শক্তি (তাপ বিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ, পারমাণবিক শক্তি, গ্যাস) ব্যবহার কমাতে হবে। অর্থাৎ, দশ বছর পরে অফ-গ্রিড হতে হবে, তবে এমনিও ততদিনে গ্রিড ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। কোন কোন জায়গায়, সৌর-তাপ, বায়ু বা মাইক্রো-হাইডাল শক্তি ব্যবহার হতে পারে। ছাদের উপর সোলার প্যানেল বসিয়ে প্রয়োজনীয় শক্তির জোগানের ব্যবস্থার উপর জোর দিতে হবে।
৬। স্বাস্থ্য
শহরবাসীর স্বাস্থ্য অভূতপূর্বভাবে ভেঙে পড়েছে। আমরা প্রশ্বাসে বিষ নিচ্ছি, বিষ পান করছি, বিষ খাচ্ছি। শেষেরটা প্রধানত প্যাকেটজাত জাঙ্ক ফুড ও রেস্তোরাঁয় খাওয়ার জন্য হচ্ছে – এ সমস্তই HFSS (high fat, salt and sugar) বিভাগভুক্ত। এগুলির বিরুদ্ধে প্রচার দিয়ে শুরু করতে হবে ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচাতে হবে। বিশুদ্ধ বাতাস, জল এবং স্বাস্থ্যকর খাবার হল ভাল স্বাস্থ্যের প্রাথমিক চাহিদা। এরপর স্থানীয় সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে যাতে পর্যাপ্ত পরিকাঠামো ও কর্মী থাকে এবং সেগুলি বাসিন্দাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে প্রতিরোধক ব্যবস্থা করতে পারে। বয়স্ক ও অসুস্থ রোগীদের উপশমের ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রত্যেক ওয়ার্ডে স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং প্রধান স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির ব্যবস্থাও রাখতে হবে। মশাবাহিত সমস্ত রোগকে দূরীভুত করতে হবে।
৭। শিক্ষা
শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত ‘সম্প্রদায়ের পুনর্গঠন এবং সাম্য ও স্থায়ীত্বের মাধ্যমে বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার করা’র মত দক্ষতা এবং মূল্যবোধ তৈরি করা। স্থানীয় ভাষা, হিন্দি / উর্দু, ইংরেজি এবং আঞ্চলিক ভাষাগুলি প্রচার করতে হবে। শারীরিক দক্ষতার সাথে মানসিক সক্ষমতার শিক্ষাও দেওয়া দরকার। সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে সাইকেল দিতে হবে। প্রত্যেক বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার থাকা বাধ্যতামূলক। পাড়ায় পাড়ায় পঠন কক্ষে স্থানীয়, হিন্দি/উর্দু, ইংরাজি ইত্যাদি ভাষার সংবাদপত্র রাখতে হবে। বিদ্যালয় শিক্ষা স্থানীয়স্তরে বাধ্যতামূলক করতে হবে যাতে দূরের বিদ্যালয়ে যাওয়ার থেকে সময়, অর্থ ও শক্তির অপচয় কম হবে।
৮। বাসস্থান
ভবিষ্যতের বাসস্থানগুলি দ্বিতলের থেকে বেশি হওয়া অনিশ্চিত কারণ লিফট ও জল উপরে তোলার মত শক্তি থাকবে না। সস্তায় পরিবেশবান্ধব এবং মর্যাদাপূর্ণ আবাসনের মাধ্যমে প্রতিটি বাসিন্দার ন্যুনতম বাসস্থান নিশ্চিত করতে হবে। নতুন ঘরগুলি এমনভাবে বানাতে হবে যাতে এয়ার কন্ডিশনার বা ফ্যানের প্রয়োজন না হয় এবং দিনের বেলা কৃত্রিম আলো প্রয়োজন না হয়।
৯। সম্প্রদায় ও ঐতিহ্য
পার্ক ও খেলার মাঠের সুব্যবস্থা এবং প্রত্যেক নাগরিক ও শিশুর তাতে বিনামূল্যে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ঐতিহ্যবাহী সৌধগুলি স্থানীয় স্তরে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং স্থানীয় অনুষ্ঠান ও বিনোদনের জন্য ব্যবহার করতে হবে।
১০। কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং উদ্যোগ
বিভিন্ন সবুজ-উদ্যোগ যেমন রেন ওয়াটার হার্ভেস্টিং, বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সার তৈরি, উদ্যান সামগ্রী, সাইকেল স্ট্যান্ড এবং সাইকেল মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের দোকান, জৈব এবং সবুজ পণ্য বাজার, সোলার কুকার, ওয়াটার হিটার এবং সোলার প্যানেল ইত্যাদির বিক্রয়, রক্ষণাবেক্ষণ এবং মেরামত ইত্যাদিকে উৎসাহ দিতে হবে। আগেই বলেছি, মূল লক্ষ্য হ’ল দশ বছরের শেষে প্রত্যেকে সবুজ কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করবে।
শুরুর পথে
শুরুতেই ঘরে, অফিসে বা নিজেদের দলে কিছু দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে যেমন, একক ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করা, একটা সাইকেল কেনা এবং যত বেশি সম্ভব তা ব্যবহার করা, ঘরে সার তৈরি করা এবং বাগান করা ইত্যাদি। ঘরে এবং অফিসে শক্তি ব্যবহারের পরিমাণ হিসেব করা ও শক্তি ব্যবহার ক্রমশ কম করা। স্কুল, হাসপাতাল ইত্যাদির নজরদারি কমিটিগুলির সাথে আলোচনা শুরু করা যেতে পারে। এগুলি সব নিজেই করা যায় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে যখন কেউ কোনও আগ্রহ দেখাবে না তখন হতাশ হওয়া থেকে বাঁচাবে।
গ্রামীণ অঞ্চলে স্থানীয় প্রতিক্রিয়াঃ বাস্তুতান্ত্রিক গ্রাম
এক্ষেত্রেও প্রথমে সমস্যাগুলি খুঁজে বের করে তার সমাধান এবং সেই সমাধানের পরিকল্পনা করতে হবে।
গ্রামীণ ভারতের সঙ্কট
মুম্বই ও দিল্লিগামী কৃষকদের সাম্প্রতিক মিছিল তাদের সমস্যাগুলি তুলে ধরেছে। এগুলি সংক্ষেপে বললে: প্রায় ৮০% গ্রামীণ কৃষক এবং অ কৃষক পরিবার ঋণগ্রস্থ। কৃষিকাজ থেকে ঋণ পরিশোধের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ ঋণ স্থানীয় মহাজনদের থেকে নেওয়া এবং ব্যাংকগুলি থেকে নয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কৃষক চাষের সার, পরিবারে বিবাহ, মৃত্যু এবং জন্মের জন্য এই ঋণ নেন।
কৃষকরা ঋণগ্রস্ত কেন? এর মূল কারণ হ’ল সবুজ বিপ্লব এবং দুগ্ধ প্রকল্প। এগুলি নানা নামে পরিচিত: কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ, উন্নয়ন বা কৃষিতে পুঁজিবাদী অনুপ্রবেশ ইত্যাদি। নাম যাই হোক না কেন, এর তিনটি সুপরিচিত ফলাফল রয়েছে: (১) উৎপাদন ও সম্পদ বৃদ্ধি, (২) বৈষম্য বৃদ্ধি। ধনী ব্যক্তিরা আরও বেশি ধনী হয় আর গরিবরা আগের চেয়ে বেশি অর্থ উপার্জন করলেও তারা আরও বেশি ঋণে ডুবে থাকে, (৩) বাস্তুতন্ত্রের অবক্ষয়।
যেহেতু সবুজ এবং সাদা (দুধ) বিপ্লব এর জন্য প্রচুর নগদ জোগান প্রয়োজন, তাই তাদের পণ্যগুলি বিক্রি করতে হয়। ফলে বর্তমান কৃষিতে প্রচুর অ-খাদ্যশস্য অন্তর্ভুক্ত। তুলা, আখ, তামাক এবং পাট চিরাচরিত অর্থকরী ফসল। নতুন অর্থকরী ফসল হিসেবে যোগ হয়েছে সয়া (গবাদি পশুর জন্য তেলের কেক, মূলত ইরানে রফতানি করা হয়), ভুট্টা (মূলত পোল্ট্রির জন্য), ফুল (মূলত শহরে রফতানির জন্য) এবং দুধের জন্য গবাদি পশুদের খাওয়ানোর জন্য বিশেষ ঘাস। চাষযোগ্য জমি, সেচের আওতাধীন এলাকা এবং মোট উৎপাদন বিপুলভাবে বেড়েছে।
এসবই গ্রামীণ অঞ্চলে প্রচুর সম্পদ এবং অর্থ বৃদ্ধি করেছে। এর ফলে ভোগবাদ বেড়েছে যা গ্রামীণ মানুষের ব্যয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছে।গ্রামীণ মানুষ নগরবাসীর জীবন আদর্শ মনে করে তাদেরকে অনুসরণ করার চেষ্টা করছে – ইংলিশ মিডিয়ামে শিক্ষা, মোটর সাইকেল, স্মার্ট ফোন, বিদেশি মাদক। আর এসবের ফলে শারীরিক এবং মানসিক উভয় স্বাস্থ্যর ক্ষেত্রে নতুন সমস্যা তৈরি করেছে।
সবুজ বিপ্লব বায়ু, জল এবং খাদ্যকে বিষাক্ত করছে। কৃষিক্ষেত্রে বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার (কীটনাশক স্প্রে) এর ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস, পানীয় এবং খাদ্যের মাধ্যমে তা শরীরে প্রবেশ করে স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করছে। কৃষিক্ষেত্র ও পরিবহণের ক্ষেত্রে বর্ধিত যান্ত্রিকীকরণও পরিবেশকে অস্বাস্থ্যকর করে তুলেছে ফলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যয় বিপুল পরিমাণে বাড়ছে। ঋণের কারণে মানসিক চাপ বাড়ছে যা মদ্যপান, ঝগড়া, হতাশা এবং অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার দিকে নিয়ে যায়। ঋণ এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে আত্মহত্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সবুজ বিপ্লব মাটির স্বাস্থ্যকে আরও খারাপ করছে এবং গ্রামীণ অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। কৃষির জন্য জমি বাড়ার সাথে সাথে বনভূমি, খালি ও ঘাসের জমিও কমছে। ফসলের জন্য অতিরিক্ত জলের ব্যবহার হ্রদ এবং ভূগর্ভস্থ জলস্তর বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। দরিদ্র ভূমিহীন শ্রমিকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় কারণ তারা আংশিকভাবে খালি এবং বনভূমির উপর নির্ভরশীল।
একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গেছে এবং একক পরিবার বেড়েছে। গ্রামবাসীদের মধ্যে সহযোগিতা হ্রাস পেয়েছে। যেহেতু নিজের জমির নিচের জল ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে বিবেচিত হয়, তাই কোনও গভীর কূপ খননকারী ব্যক্তি প্রতিবেশীদেরকে তাদের প্রাপ্য জল থেকে বঞ্চিত করছে। ফলত উত্তেজনা, ঝগড়া এবং মারামারি বাড়ছে।
গ্রামীণ ভারতের সমস্যার সমাধান
উত্তরটা পাওয়া যাবে এখানেই- ‘সম্প্রদায়ের পুনর্গঠন এবং সাম্য ও স্থায়ীত্বের মাধ্যমে বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার করা’।
সম্প্রদায় বলতে একটি মাইক্রো জলবিভাজিকা অঞ্চল যা সাধারণত একটি পঞ্চায়েত বা মোটামুটি ১০০০০ জনবসতি নিয়ে গঠিত। সমগ্র জলবিভাজিকা এবং এর সমস্ত সম্পদকে গোষ্ঠী মালিকানাধীন হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। জল সকলের সম্পত্তি এবং তা কোন ব্যক্তি বা খামারের সম্পত্তি হতে পারে না।
পরিকল্পনায় নিচের বিষয়গুলি থাকতে পারে –
১। উপরে বর্ণিত বিষয়গুলির উপর সামগ্রিক সচেতনতা বৃদ্ধি।
২। এই বিষয়ে সচেতন শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের একত্রিত করে গ্রামের জন্য পরিকল্পনা করতে হবে। ‘হিবরে বাজার’ সিনেমাটি এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই সিনেমায় মহারাষ্ট্রের আহমেদনগর জেলার একটি গ্রামের কথা আছে যেখানে স্থানীয় যুবকরা গ্রাম পঞ্চায়েত নিজেদের দায়িত্বে নেয় এবং তারা গ্রামটিকে সবুজ ও সমৃদ্ধ করে তোলে। এই অঞ্চল আগে শুষ্ক ছিল, তারা সেখানে আখ চাষ ও বাইরের লোকদের জমি বিক্রয় নিষিদ্ধ করে।
৩। স্কুল, স্বাস্থ্য, পরিবহন, যোগাযোগ, তামাক এবং মদ ইত্যাদি খাতে ব্যয় হ্রাস করা। এছাড়াও পারিবারিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় কার্য এবং তীর্থস্থানগুলিতে ব্যয় কমাতে হবে। স্থানীয় সরকারী স্কুল এবং সরকারী হাসপাতাল ব্যবহারকে উৎসাহিত করা।
৪। সবুজ বিপ্লব, সার ও কীটনাশক ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করতে হবে এবং ধীরে ধীরে জৈব চাষ বাড়াতে হবে। পুরো গ্রামের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য, ডাল, শাকসবজি, ফল, ডিম এবং হাঁস-মুরগির পরিকল্পনা অরতে হবে। অঞ্চল বিশেষে মাছ এবং মাংসও এরমধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। তারপর মাটি এবং জলের সহজলভ্যতা অনুসারে সমস্ত খামারের জন্য ফসল ফলানোর পরিকল্পনা করতে হবে। প্রয়োজনের তুলনায় খাদ্যশস্য খুব বেশি হলে ২৫% বেশি উৎপাদন করা যেতে পারে। অর্থকরী ফসলের উৎপাদন কম করতে হবে, খুব বেশি হলে মোট ফসলের ২৫%।
৫। বাকী সমস্ত জমি গাছ লাগানোর জন্য ব্যবহার করা উচিত। সাধারণ জমি সংরক্ষণ করা উচিত এবং সম্ভব হলে প্রসারিত করা উচিত। স্থানীয় বন সংরক্ষণ করা উচিত। হ্রদ এবং জলাশয় সংরক্ষণ এবং পরিষ্কার করা উচিত। ভূগর্ভস্থ জলতল ঠিক রাখতে বোর ওয়েলের ব্যবহার কম এবং রেনওয়াটার হার্ভেস্টিং বৃদ্ধি করতে হবে।
৬। স্থানীয় মানুষকে স্থানীয় স্কুল, হাসপাতাল, গ্রন্থাগার, খেলার মাঠগুলিতে আরও বেশি অবদান রাখতে হবে কারণ এগুলি তাদের সকলের সম্পত্তি।
৭। বিদ্যালয়ে বৃক্ষরোপনের জন্য গ্রামেই নার্সারি পরিকল্পনাকরা যেতে পারে। এই ভাবে শিশুরা পরিবেশ সম্বন্ধে হাতেকলমে শিখবে। পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করতে বিদ্যালয়গুলি জলদূষণ, বৃষ্টিপাত ইত্যাদির পরিমাপ করার ব্যবস্থাও রাখতে পারে। বিদ্যালয়কে পরিবেশ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে সন্ধ্যায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
৮। প্রত্যেক বাড়িতে অন্তত একটি করে সাইকেল, টর্চ ও রেডিয়ো রাখতে হবে।
কিভাবে করতে হবে
১। এই ৯ টি ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের চেহারা কেমন হবে সে সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক ধারণা হলে সেই নিয়ে প্রায় এক বছর ধরে বক্তৃতা, চলচ্চিত্র, আলোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে সেসব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচি নিতে হবে। যুবসমাজের উপর গুরুত্ব দিতে হবে বিশেষ করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর শিক্ষিত যুব অংশের দিকে। যারা এই ধারণাগুলি বোঝে এবং কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তাদের নিয়ে স্থানীয় নেতৃত্ব গঠন করতে হবে। এই দলটি ৭-১০ জন নিয়ে হতে পারে। এই দলটি রূপান্তর নগরের জন্য দশ বছরের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করবে।
২। বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে দ্য ভিলেজ (গ্রামের নাম) ইকোলজিকাল সোসাইটি বা এই ধরণের কোনও সংগঠন তৈরি করা উচিত। এর আগে গ্রামের বাস্তুতন্ত্রের উপাদানগুলি গণনা করা উচিত। সেগুলি হ’ল: ১. সমগ্র এলাকার মাপ ২. চাষযোগ্য অঞ্চল ৩. জল উৎপাদন ৪. জনসংখ্যা ৫. পশুর জনসংখ্যা ৬. খাদ্য উৎপাদন ৭. দুধ উৎপাদন ৮. সার উৎপাদন ৯. পশুর জন্য প্রয়োজনীয় শুকনো পাতা ১০. পশুর খাদ্য ১১. জ্বালানী কাঠের ব্যবহার ১২. জলের ব্যবহার (গার্হস্থ্য এবং প্রাণী)।
৩। এই তথ্যগুলি দিয়ে এমন পরিকল্পনা করতে হবে যার লক্ষ্য হবে (ক) স্থানীয় খাদ্য সুরক্ষা (খ) স্থানীয় শক্তি সুরক্ষা
খাদ্য সুরক্ষা: গ্রামের বাসিন্দাদের প্রয়োজনীয় স্থানীয় শস্য, ডাল, তৈলবীজ, শাকসবজি এবং ফল উৎপাদন করতে হবে। ফলের গুরুত্ব কেবল পুষ্টিকর খাদ্য হিসাবেই নয় কারণ বাস্তুতন্ত্রগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বস্তু যেমন মাটি, জল সংরক্ষণ, পাখি, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি বৃক্ষের উপর নির্ভর করে। প্রাণীজ প্রোটিনগুলি মূলত মাছ, হাঁস-মুরগি থেকে আসা উচিত। মাছ এবং হাঁস গুরুত্বপূর্ণ কারণ গাছের মতো এরা জলাশয়ের সুস্বাস্থ্য ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় সাহায্য করে।
শক্তি সুরক্ষা: যদিও গ্যাস এবং বায়োগ্যাস ব্যবহার সুবিধাজনক তবে এগুলির উৎস নির্ভরযোগ্য নয় তাই জ্বালানী কাঠের উপর নির্ভর করতে হবে।
৪। সুতরাং বৃক্ষের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং জলের উৎস উন্নত করা এই পরিকল্পনার মূল উপাদান। তবে গ্রামবাসীদের মধ্যে সহযোগিতা এবং সম্মিলিতভাবে কাজ করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ বিশেষ কাজের জন্য যেমন জলাশয়ের উন্নতি, অনুর্বর অঞ্চলে গাছ লাগানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্থানীয় লোকদের সংগঠিত করাও গুরুত্বপূর্ণ।
৫। গ্রাম সমাজ শুধু ধনী ও দরিদ্রের মধ্যেই বিভক্ত নয় জাতিগত ভাবেও বিভক্ত। বিভিন্ন জাতির জন্য নির্ধারিত জায়গাও থাকে। তাই গ্রামের ক্ষেত্রে এই কাজটি একটু বেশি কঠিন। এই কারণেই শিক্ষিত যুবক, স্কুল শিক্ষক, স্বাস্থ্য কর্মী এবং যাদের কেউ শহরে চাকরি করে সেই সব লোকদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত। ‘হিবরে বাজার’ সিনেমাটিতে এই বিষয়টি সুন্দর ভাবে দেখানো হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন ইউনিয়ন যেমন MNREGA ইউনিয়ন, জেলেদের ইউনিয়ন ইত্যাদি সংস্থার সাথে কাজ করা যেতে পারে যাতে করে সমস্ত অংশের মানুষকে একত্রিত করা যায়।
৬। এর মধ্যে দলের সদস্যরা তাদের ব্যক্তিগত জীবনে এবং খামারে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে পারেন। তারা ব্যক্তিগত খরচ কমাতে পারে, নিজেদের বাচ্চাকে স্থানীয় সরকারী বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারে, সাইকেল ব্যবহার করতে পারে, পরিবারিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যয় সংকোচ করতে পারে। তাদের খামারে তারা জৈব চাষ শুরু করতে পারে, বৃষ্টির জল সংগ্রহের ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে, ছোট মাছের পুকুর তৈরি করতে পারে এবং সেগুলিতে হাঁস এবং মাছ চাষ করতে পারে। এর সাহায্যে তারা অন্যদের সাথে আলোচনা করা এবং গ্রামের জন্য কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করার প্রেরণা এবং শক্তি পাবে।
উপসংহার
মানব সমাজ ইতিহাসের এক সঙ্কটজনক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবীতে বেশিরভাগ জীবনের (মানুষ সহ) বেঁচে থাকা আমরা, মানবজাতি, পরবর্তী ১২ বছর বা তার মধ্যে কি করছি তার উপর নির্ভর করছে। সুতরাং আমাদের নিজস্ব স্বার্থে আমাদেরকে জরুরি ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ তার উপর নির্ভর করছে। যুবসমাজের এইসব কাজে অংশ নেওয়া আরও গুরুত্বপূর্ণ।
গ্রামে বা শহরে যেখানেই থাকি না কেন, অদূর ভবিষ্যতে, জীবন ধারণের জন্য আমাদেরকে সবুজ জীবিকা বেছে নিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, বর্তমানের জীবাশ্ম জ্বালানী ভিত্তিক অর্থনীতির তুলনায় সবুজ জীবিকায় কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বেশি। আমাদেরকে এখনই আমাদের চাহিদা হ্রাস করতে হবে যাতে আয়ের পরিমাণ কম করা যায় এবং আমরা এই কাজগুলি করার জন্য আরও বেশি সময় পাই। আমাদের মধ্যে যাদের সময় ও সংস্থান আছে এবং ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা কম রয়েছে তারা অবিলম্বে এই সব কাজে পুরো সময়ের জন্য নিযুক্ত হতে পারে। এখনই কাজ করার সময়!
লেখক পরিচিতি: সম্বিত শুক্লা
সববাংলায় এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সম্বিত শুক্লা গল্প, কবিতা ইত্যাদি লেখেন ‘ইচ্ছেমৃত্যু’ ছদ্মনামে। প্রবন্ধ, নিবন্ধ ইত্যাদি লেখা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে যেখানে গল্প, কবিতার রূপকের বাইরে বেরিয়ে যুক্তি ও তথ্যের দায় বেশি। জীবিকার পাশাপাশি সববাংলায় এর কাজেই দিনের বেশিটা সময় অতিবাহিত হয় বাকিটা কাটে বইপত্র ও লেখালিখি নিয়ে।