লেখক : নাহার তৃণা
মূল গল্প: হারুকি মুরাকামি
জাপানি ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন: ফিলিপ গ্যাব্রিয়েল
“জীবনে অনেক ধরণের নারীর সাথে আমি সাক্ষাৎ করেছি,” লোকটি বলল, “কিন্তু আপনার মত এমন কদাকার কাউকে কখনও দেখিনি।”
কথাটি তখন বলা হয়, যখন তারা ডেজার্ট খাওয়ার পর কফি আসার অপেক্ষায় বসেছিল। কী বলা হ’ল, সেটা পুরোপুরি বুঝে উঠতে কিছুটা সময় লেগেছিল কাহোর। তিন বা চার সেকেণ্ডের মত। কথাগুলো বলা হয়েছিল একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে, এবং কাহো বুঝতে পারছিল না, এমন আচরণের পেছনে লোকটির উদ্দেশ্য কী। যখন সে সপাটে, হতভম্ব করার মত কথাগুলো বলছিল, তখন তার মুখে লেপ্টে ছিল মৃদু, এবং বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি। রসিকতার কোন ছিটেফোঁটা সেখানে ছিল না। সে মোটেও ঠাট্টা করেনি; বরং, তাকে বেশ ভাবগম্ভীর দেখাচ্ছিল। ওরকম কথার অভিঘাতে কাহোর প্রতিক্রিয়া দেখানোর একমাত্র উপায় হতে পারত তার কোলের ওপর থাকা রুমালটি টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে, পাশের চেয়ারে রাখা তার ব্যাগটি তুলে নেওয়া, উঠে দাঁড়ানো, এবং একটিও বাক্যব্যয় না করে রেস্তোরাঁ ছেড়ে চলে যাওয়া। সম্ভবত, ওটাই হত ওরকম পরিস্থিতি সামলানোর সেরা উপায়। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে কাহো তা করে উঠতে পারল না। এর একটা কারণ যা পরে তার মনে উদয় হয়, তা হ’ল, সে সত্যিই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। দ্বিতীয় কারণটা ছিল কৌতূহল। কোন সন্দেহ নেই সে রেগে গিয়েছিল, না রেগে উপায় ছিল না। কীভাবে নির্লিপ্ত থাকা সম্ভব? কিন্তু তা সত্ত্বেও সে জানতে চেয়েছিল, লোকটি তাকে এমন কিছু বলার চেষ্টা করল কেন। সে কি সত্যিই অতটা কদাকার? না কি এর পেছনে অন্য কোন কারণ আছে?
“আপনাকে খুব কদাকার বলা কিছুটা অতিরঞ্জিত হয়ে গেল,” কিছু সময় থেমে থাকার পর লোকটি বলে উঠল, “তবে আমার সাক্ষাৎ হওয়াদের ভিতর আপনি সবচেয়ে জমকহীন চেহারার নারী, এতে কোন সন্দেহ নেই।”
কাহো ঠোঁট চেপে নীরবে লোকটির দিকে তাকিয়ে রইল, তার দৃষ্টি লোকটির মুখের ওপর স্থির। কেন এই লোকটি এমন কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করল? একটা ব্লাইণ্ড ডেটে (এই সাক্ষাৎ এমনই কিছু ছিল) যদি কেউ অন্যজনকে পছন্দ না করে, তাহলে পরে আর যোগাযোগ না করলেই তো হয়। এতে তো সহজেই সমাধান হয়ে যায়। সামনাসামনি অপমান করার কী প্রয়োজন?
বয়সে লোকটি কাহোর চেয়ে কমপক্ষে দশ বছরের বড় হবে, দেখতে সুশ্রী, পরনের পোশাকও পরিচ্ছন্ন এবং রুচিশীল। সে ঠিক কাহোর ধাঁচের নয়, তবে দেখেশুনে ভাল পরিবারের বলে মনে হয়। তার চেহারায় চটক আছে, ফটোজেনিক – এভাবে বললেই সঠিক বলা হবে। উচ্চতায় আর কয়েক ইঞ্চি যোগ হলে সে দিব্বি অভিনেতা হতে পারত। এই রেস্তোরাঁটি সে নিজেই বেছে নিয়েছে, যেটি আরামদায়ক এবং আড়ম্বরপূর্ণ, এখানকার পরিবেশিত খাবার টাটকা এবং সুস্বাদু। লোকটি খুব বেশি কথা বলে না, তবে কথাবার্তা চালিয়ে নেওয়ার মত যথেষ্ট মেধাবী, ফলে তাদের মধ্যে কোন অস্বস্তিকর নীরবতা তৈরি হয়নি। অদ্ভূত ব্যাপার হ’ল, পরবর্তীতে সে যখন ভাবতে চাইল যে তাদের কী নিয়ে কথা হয়েছিল, তা সে কিছুতেই মনে করতে পারছিল না। রাতের খাবারের সময়, সে বুঝতে পারল, লোকটার প্রতি তার মন গলছে। এটা তাকে স্বীকার করতেই হবে। আর তারপর, একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে—এই ঘটনা। এখানে আদতে কী ঘটেছিল?
“আপনার কাছে এটা অদ্ভুত লাগতে পারে,” তাদের টেবিলে দু’কাপ এসপ্রেসো কফি রেখে যাওয়ার পর লোকটি শান্ত গলায় বলল, যেন সে কাহোর মন পড়তে পারছিল। সে তার এসপ্রেসোতে একটা ছোট্ট চিনির কিউব দিয়ে চুপচাপ নাড়তে লাগল। “আপনি হয়তো ভাবছেন, কেন এমন একটা কথার জন্য আমি ডিনার পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। আপনার চেহারা যদি এত অপছন্দই হয়, এক গ্লাস ওয়াইন খাওয়ার পরই তো আমি এই আলাপের ইতি টেনে উঠে যেতে পারতাম। এক ঘণ্টা ত্রিশ মিনিট সময় আর তিন পদের খাবারে ডিনার শেষ করা—এটা তো সম্পূর্ণ সময়ের অপচয়, তাই না? আর কেন, সন্ধ্যার একেবারে শেষে, আমাকে এমন কিছু বলতে হ’ল?”
কাহো টেবিলের ওপারে বসা লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল। তার হাত কোলে রাখা ন্যাপকিন শক্ত করে চেপে ধরেছিল।
“আমার মনে হয়, আমি আমার কৌতূহল দমন করতে পারিনি,” লোকটা বলল। “সম্ভবত আমি জানতে চেয়েছিলাম, একজন সত্যিকারের আটপৌড়ে নারী হিসেবে আপনার চিন্তাধারা কেমন, আর এই চেহারা আপনার জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলছে।”
“তোমার কৌতূহল কি মিটেছে?” কাহো মনে মনে ভাবল। অবশ্য, সে সেটা মুখে বলল না।
“আমার কৌতূহল কি মিটেছে?” কফিতে এক চুমুক দেওয়ার পর, লোকটা জিজ্ঞেস করল। কোন সংশয় নেই সে কাহোর চিন্তা পড়তে পারছিল। যেভাবে একটা পিঁপড়েভূক প্রাণী তার লম্বা, সরু জিভ দিয়ে চেটে পিঁপড়েঢিবি পরিষ্কার করে ফেলে, সেভাবেই বুঝি সে কাহোর ভেতরটা দেখতে পাচ্ছিল। লোকটা সামান্য মাথা নাড়ল, কাপটা পিরিচে নামিয়ে রাখল। তারপর নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিল, “না, মেটেনি।”
সে তার হাত তুলে ওয়েটারকে ডাকল এবং বিল মিটিয়ে দিল। তারপর কাহোর দিকে তাকিয়ে সামান্য মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানিয়ে রেস্তোরাঁ ছেড়ে বেরিয়ে গেল। একবারও পেছন ফিরে তাকাল না।
সত্যি বলতে, ছোটবেলা থেকেই কাহো তার চেহারা নিয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। আয়নায় দেখা নিজের মুখটা তার কখনই খুব সুন্দর বা খুব কুৎসিত মনে হয়নি। সে মুখ তাকে হতাশ করত না, আবার আনন্দও দিত না। তার চেহারা নিয়ে এই অনাগ্রহের কারণ ছিল, সে কখনই মনে করত না, তার চেহারা তার জীবনে কোন প্রভাব ফেলছে। অথবা বলা ভাল, সে কখনই জানার সুযোগ পায়নি যে আদৌ কোন প্রভাব ফেলছে কি না। সে ছিল একমাত্র সন্তান, আর তার বাবা-মা সবসময় তাকে এমন ভালবাসায় ভরিয়ে রেখেছিলেন, যা সম্ভবত তার সৌন্দর্যের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখত না। কৈশোরকাল জুড়ে কাহো নিজের চেহারা নিয়ে একেবারেই উদাসীন ছিল। তার বেশিরভাগ বান্ধবী নিজেদের চেহারা নিয়ে চিন্তিত থাকত, আর সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য মেকআপের সব কৌশলই প্রয়োগ করত। কিন্তু কাহোর সেসবের প্রতি কোন আকর্ষণ ছিল না। আয়নার সামনে সে খুব কম সময় কাটাত। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল শরীর ও মুখ পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি রাখা। আর সেটা কখনই খুব কঠিন কাজ ছিল না।
সে একটি কো-এডুকেশন হাইস্কুলে পড়ত এবং সেখানে কিছু ছেলেকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছিল। যদি তার ক্লাসের ছেলেরা তাদের প্রিয় মেয়ের জন্য ভোট দিত, তাহলে কাহো কখনই জিতত না, সে মোটেও সেই ধরণের ছিল না। তবুও, অদ্ভুতভাবে, প্রতিটি ক্লাসেই এক-দুজন ছেলে থাকত, যারা তার প্রতি আগ্রহ দেখাত। কাহো কখনই বুঝতে পারত না, ঠিক কী ছিল তার মধ্যে যা তাদের আকৃষ্ট করত।
হাইস্কুল শেষ করে টোকিওর একটি আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরেও, সে কখনও ছেলেবন্ধুর অভাব বোধ করেনি। সুতরাং সে কখনই নিজের আকর্ষণীয়তা নিয়ে চিন্তিত হয়নি। সেই দিক থেকে বলতে গেলে, কাহোকে সৌভাগ্যবতী বলা যায়। তার কাছে বরাবরই অদ্ভুত লাগত, যে তার অনেক বান্ধবীই ছিল, যারা দেখতে তার চেয়ে অনেক ভাল, অথচ তারা নিজেদের চেহারা নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন থাকত। অনেকে তো ব্যয়বহুল প্লাস্টিক সার্জারিও পর্যন্ত করিয়ে ফেলত। ওদের কর্মকাণ্ড তার মাথায় ঢুকত না। কাহোর কাছে সেসব ছিল একেবারেই অজানা জগৎ। তাই যখন তার ছাব্বিশতম জন্মদিন পেরনোর দিনকয়েক পরে এক অচেনা পুরুষ সরাসরি তাকে “কুৎসিত” বলল, কাহো গভীরভাবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। ওই লোকটির কথায় কাহো বিস্মিত হয়নি, বরং একধরণের অস্থিরতা আর হতবুদ্ধিভাব তাকে গ্রাস করেছিল।
লোকটির সঙ্গে কাহোর পরিচয় ঘটিয়েছিলেন তার সম্পাদক, মাচিদা। তিনি কান্দার একটি ছোটখাটো প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করতেন, যেখানে মূলত শিশুদের বই প্রকাশিত হত। মহিলা কাহোর চেয়ে চার বছরের বড়, নিজের দুইটি সন্তান রয়েছে। কাহো শিশুদের যে বইগুলি লিখত, সেগুলোর সম্পাদনা করতেন তিনিই। কাহোর চিত্রকর্মের বইগুলো তেমন বেশি বিক্রি হত না, তবে সেই বইগুলো আর ম্যাগাজিনের জন্য করা ফ্রিল্যান্স ইলাস্ট্রেশনের কাজ মিলিয়ে তার চলার মত আয় হয়ে যেত। সেই সময়, কাহো সদ্যই তার সমবয়সী এক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে ফেলেছিল, যার সঙ্গে সে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ছিল। স্বভাবতই তার মন ছিল নিদারুণ খারাপ। বিচ্ছেদটা তার ভেতর একটা তিক্ততা রেখে গিয়েছিল। আর আংশিকভাবে সেই কারণে তার কাজও ভাল যাচ্ছিল না। মাচিদা পরিস্থিতি বুঝতে পেরে লোকটির সঙ্গে তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছিলেন। “তোমার হয়তো একটু পরিবর্তনের দরকার,” এই বলে তিনি কাহোকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলেন।
ওই লোকের সঙ্গে দেখা করার তিন দিন পর, মাচিদা তাকে ফোন করেন। “তোমাদের প্রথম সাক্ষাৎ কেমন হ’ল?” আলাপের শুরুতেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন তিনি।
কাহো একটু অস্পষ্টভাবে “হুম্” বলে সরাসরি উত্তর এড়িয়ে যায়, তারপর নিজেই একটি প্রশ্ন করে, “তিনি মানুষটা আসলে কেমন?”
মাচিদা বলেন, “সত্যি বলতে কি, আমি তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানি না। তাকে ‘বন্ধুর-বন্ধু’ বলা যায়। সম্ভবত সে চল্লিশের কাছাকাছি, অবিবাহিত, আর কোন বিনিয়োগ সংক্রান্ত কাজে যুক্ত। তার পারিবারিক অবস্থা ভাল, কাজেও সে দক্ষ। যতদূর জানি, তার কোন অপরাধের রেকর্ড নেই। আমি একবার তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম, কয়েক মিনিট কথা বলেছিলাম, তখন মনে হয়েছিল দেখতে ভাল আর স্বভাবও মোটামুটি ভাল। স্বীকার করছি লম্বায় একটু খাটো। তবে টম ক্রুজও তো খুব লম্বা নয়, যদিও আমি কখনো টম ক্রুজকে সামনে থেকে দেখিনি।”
“কিন্তু এমন একজন মানুষ, যিনি সুদর্শন, স্বভাব ভাল, আর কাজেও দক্ষ, তাকে কেন চেনাপরিচয় নেই এমন একজনের সঙ্গে ব্লাইণ্ড ডেটের ঝামেলায় যেতে হবে?” কাহো প্রশ্ন করে, “তার তো অনেক নারীর সঙ্গে পরিচয় থাকার কথা, যাদের সঙ্গে তিনি বাইরে যেতে পারেন, তাই না?”
মাচিদা বলেন, “হ্যাঁ, হয়ত তাই। সে খুব বুদ্ধিমান, কাজেও দক্ষ। তবে আমি শুনেছি তার ব্যক্তিত্ব একটু অদ্ভুত ধরনের। আমি সেটা তোমাকে আগেভাগে বলিনি, কারণ তোমার মনে কোন পূর্বধারণা তৈরি হোক, সেটা চাইনি।”
“একটু অদ্ভুত,” কাহো কথাটার পুনরাবৃত্তি করে। মাথা নাড়ে। সত্যিই কি এটাকে ‘একটু’ বলা যায়?
“তোমরা কি ফোন নম্বর বিনিময় করেছ?” মাচিদা জানতে চান।
কাহো কিছু সময়ের জন্য থমকে যায়। ফোন নম্বর বিনিময়? “না, করিনি,” শেষমেশ উত্তর দেয় সে।
তিন দিন পর, মাচিদা আবার ফোন করলেন কাহোকে। “আমি সেই সুদর্শন মিস্টার সাহারার ব্যাপারে ফোন করেছি। কথা বলতে সমস্যা নেই তো?” তিনি জানতে চাইলেন। সাহারা সেই লোকটি, যার সঙ্গে কাহোর ব্লাইন্ড ডেট হয়েছিল। তার নামটা সাহারা মরুভূমির মত একইভাবে উচ্চারণ করতে হয়। কাহো তার আঁকার কলমটা নামিয়ে রাখল এবং রিসিভারটা বাঁ হাত থেকে ডান হাতে নিল।
“হ্যাঁ, বলো।”
“গত রাতে সে আমাকে ফোন করেছিল,” মাচিদা বললেন। “সে বলেছে, তোমার সঙ্গে আবার দেখা করতে চায়, এবং জানতে চাইল তোমাদের আরেকবার কথা বলা সম্ভব কি না। তার গলা শুনে বেশ সিরিয়াস মনে হচ্ছিল।”
কাহো অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল, এবং কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। সে আবার আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়, শুধু কথা বলার জন্য? কাহো বিশ্বাসই করতে পারছিল না সে যা শুনছে।
“কাহো-চান,” স্নেহভরে ডাকলেন মাচিদা। “তুমি কি শুনছ?” উদ্বিগ্ন শোনাল তাঁর কণ্ঠ।
“হ্যাঁ, শুনছি,” শান্তগলায় জানাল কাহো।
“সে মনে হয় তোমাকে পছন্দ করেছে। আমি তাকে কী বলব?”
সাধারণ যুক্তি বলছে, কাহোর ‘না’ বলা উচিত। কারণ, সে তো কাহোর মুখের ওপর অভব্যের মত কথা বলেছিল। এমন একজনের সঙ্গে আবার দেখা করার দরকারই বা কী? কিন্তু কাহো তখনই কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারল না। তার মাথায় নানা সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছিল, সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়।
“আমি কি একটু ভাবতে পারি?” মাচিদাকে বলল কাহো। “আমি তোমাকে পরে ফোন করব।”
শেষ পর্যন্ত কাহো সাহারার সঙ্গে আরেকবার দেখা করল, সেই শনিবার বিকেলে। তারা দিনের বেলায়, অল্প সময়ের জন্য, কোনরকম খাবার বা পানীয়ের আড়ম্বরে না গিয়ে, এমন একটা জায়গায় দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয়, যেখানে তারা নির্বিঘ্নে কথা বলতে পারবে, আশেপাশে অন্য মানুষ থাকলে সমস্যা নেই। এই শর্তগুলো ছিল কাহোর, যা মাচিদা সাহারাকে জানিয়েছিলেন।
“দ্বিতীয় সাক্ষাতের জন্য বেশ অদ্ভুত শর্ত,” কাহোর কথা শুনে মন্তব্য করেছিলেন মাচিদা। “তুমি তো খুবই সাবধানী হয়ে পড়েছ।”
“হয়ত,” ছোট্ট উত্তর দিয়েছিল কাহো।
“তুমি হাতব্যাগে কোন রেঞ্চ বা ওইরকম কিছু লুকিয়ে নিচ্ছো না, তাই তো?” মাচিদা সকৌতুকে বলেছিলেন।
আইডিয়াটা একেবারে মন্দ নয়, মনে মনে ভেবেছিল কাহো।
প্রথম যখন তারা দেখা করেছিল, সাহারাকে দেখে মনে হয়েছিল সে অফিস থেকে ফিরছে। পরনে ছিল চমৎকার গাঢ় রঙের স্যুট আর টাই। কিন্তু এবার সে ধরাচুড়ার পরিবর্তে ছুটির দিনের আরামদায়ক ক্যাজুয়াল পোশাক পরে এসেছে। গায়ে পুরু বাদামি চামড়ার জ্যাকেট, চিপা জিন্স, আর পায়ে প্রতিদিনের ব্যবহৃত বুট জুতো। বুকপকেটে সানগ্লাস গোঁজা। দেখতে বেশ স্টাইলিশ লাগছিল।
কাহো নির্ধারিত সময়ের একটু পরে পৌঁছল, আর হোটেলের লবিতে পৌঁছেই দেখল সাহারা আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত, কাউকে টেক্সট করছে। কাহোকে দেখে তার ঠোঁটে হালকা একটা হাসিরেখা ফুটে উঠল, তাকে দেখে সে মোবাইলের চামড়ার কভারটা বন্ধ করল। পাশে একটা মোটরসাইকেলের হেলমেট রাখা।
“আমি ১৮০০ সিসি বিএমডব্লিউ চালাই,” বলল সাহারা। “সব বিএমডব্লিউ-র মধ্যে এইটার ডিসপ্লেসমেন্ট সবচেয়ে বেশি, আর ইঞ্জিনের আওয়াজ সবচেয়ে সুন্দর, জোরালো।”
কাহো মুখে কিছু বলল না। “তুমি বিএমডব্লিউ চালাও, ট্রাইসাইকেল চালাও, কিংবা গরুর গাড়ি, আমার কিছু যায় আসে না,” মনে মনে বলল সে।
“আমি বিলক্ষণ জানি আপনি মোটরসাইকেল নিয়ে একদমই আগ্রহী নন, তবুও বললাম, শুধু আপনাকে জানানোর জন্য,” সাহারা যোগ করল।
এই লোকটা আমার মনের কথা ঠিকই বুঝে ফেলে, আবার ভাবল কাহো।
একজন ওয়েট্রেস এসে উপস্থিত হল, কাহো কফি অর্ডার করল। সাহারা অর্ডার করল ক্যামোমাইল টি।
“আচ্ছা, আপনি কখনও অস্ট্রেলিয়া গিয়েছেন?” সাহারা জিজ্ঞেস করল।
কাহো মাথা নাড়ল। সে কখনও অস্ট্রেলিয়া যায়নি।
“আপনি কি মাকড়সা পছন্দ করেন?” সাহারা জিজ্ঞেস করল, দুই হাতে বাতাসে একটা পাখার মত আকৃতি তৈরি করে। “আরাকনিডস? যাদের আটটা পা থাকে?”
কাহো কোন উত্তর দিল না। সে মাকড়সা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে, কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে চাইল না।
সাহারা বলল, “আমি যখন অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলাম, একটা মাকড়সা দেখেছিলাম, যেটা ছিল বেসবল গ্লাভসের মত বড়। দেখে ঘেন্নায় আমি শিউরে উঠেছিলাম। গায়ে রীতিমত কাঁপুনি দিয়েছিল। কিন্তু ওখানকার লোকেরা ওদের ঘরে স্বাগত জানায়। কেন জানেন?”
কাহো চুপ করে রইল।
“কারণ তারা নিশাচর এবং তেলাপোকা খায়। এদের উপকারী বলা যায়, দরকারি পোকা। তবুও ভাবুন একবার, ঘরের ভেতর মাকড়সা রয়েছে, যারা তেলাপোকা খায়! আমি এই ভেবে অবাক হই, ওদের খাদ্য শৃঙ্খলের গঠন কতটা বুদ্ধিদীপ্ত আর অসাধারণ।”
এরই মধ্যে কফি আর হারবাল টি চলে এলো, চা-কফি সামনে নিয়ে তারা দুজনই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল।
“আপনি হয়ত ভাবছেন ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত,” কয়েক মিনিট পর সাহারা বলে উঠল, তার কণ্ঠে খানিকটা আনুষ্ঠানিকতা। “আমি আবার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম, এভাবে।”
কাহো এবারও কোন উত্তর দিল না। কোনরকম ঝুঁকিতে গেল না।
“তবে আমি সত্যিই অবাক হয়েছি আপনি রাজী হয়েছেন দেখা করতে,” সাহারা বলল। “আমি কৃতজ্ঞ, কিন্তু একই সঙ্গে বিস্মিতও কম নই, ওই রূঢ় কথার পরেও আপনি দেখা করতে রাজী হয়েছেন। না—আমি যা বলেছিলাম, সেটা শুধু রূঢ় নয়। সেটা ছিল একেবারে ক্ষমার অযোগ্য অপমানসূচক, যা একজন নারীর মর্যাদাকে পিষে ফেলে। আমি যখন নারীদের এ কথা বলি, বেশিরভাগই আর কখনও আমার মুখোমুখি হতে চায় না। আর সেটাই স্বাভাবিকই।”
“বেশিরভাগই,” কাহো মনে মনে তার কথাটা পুনরাবৃত্তি করল। বিষয়টা তাকে চমকে দিল।
“বেশিরভাগ?” প্রথমবার মুখ খুলে সে বলে উঠল। “আপনি বলতে চান, যেসব নারীর সঙ্গে দেখা করেন, তাদের সবাইকে আপনি একই কথা বলেন? আপনি বলতে চান…”
“ঠিক তাই,” সাহারা নির্দ্বিধায় স্বীকার করল। “আমি যেসব নারীর সঙ্গে দেখা করি, সবাইকে ঠিক এই কথাটাই বলি: ‘আপনার মত বিশ্রী কাউকে আমি আগে কখনও দেখিনি।’ সাধারণত তখনই বলি, যখন আমরা ডিনার উপভোগ করছি এবং টেবিলে ডেজার্টও পরিবেশন করা হয়েছে। এই ধরনের ব্যাপারে টাইমিংটাই আসল।”
“কিন্তু কেন?” কাহো প্রশ্ন করল, তার কণ্ঠ শুষ্ক শোনাল। “আপনি এমন কাজ কেন করেন? আমি বুঝতে পারছি না। আপনি মানুষকে কষ্ট দেন কোন কারণ ছাড়াই? এভাবে সময় আর টাকা খরচ করেন শুধু অপমান করার জন্য?”
সাহারা মাথাটা সামান্য কাত করল, এরপর বলল, “কেন, এটাই তো আসল প্রশ্ন। এটা এতটাই জটিল যে ব্যাখ্যা করা কঠিন। আমরা বরং এই কথার প্রভাব নিয়ে কিছু বলি। আমাকে যেটা সবসময় অবাক করে, সেটা হ’ল নারীদের প্রতিক্রিয়া। আপনি ভাবতে পারেন, এমন ভয়ানক কথা মুখের ওপর সরাসরি শোনার পর বেশিরভাগ মানুষ হয়ত রেগে যাবে, অথবা হেসে উড়িয়ে দেবে। এমন মানুষও আছে। তবে সংখ্যায় তারা খুব বেশি নয়। বেশিরভাগ নারী… কেবল কষ্ট পায়। তীব্রভাবে, এবং সেটা দীর্ঘসময় স্থায়ী হয়। কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হয়ে তারা এমন কিছু বলে ফেলে, যা অদ্ভুত, যা বোঝা কঠিন।”
একটু সময় চুপচাপ কেটে গেল। তারপর কাহো নীরবতা ভাঙল।
“তাহলে আপনি বলতে চান, এই প্রতিক্রিয়াগুলো আপনি উপভোগ করেন?”
“না, আমি উপভোগ করি না। ব্যাপারটাকে আমি অদ্ভুত মনে করি। যখন এমন নারীরা, যারা স্পষ্টতই সুন্দরী, বা অন্তত গড়ের চেয়ে দেখতে অনেকটাই ভাল, তাদের মুখের ওপর বলা হয় তারা কুৎসিত, তখন তারা কতটা হতভম্ব হয় বা কষ্ট পায়, সেটা আমাকে অবাক করে।”
কাহোর সামনে রাখা ধোঁয়া ওঠা কফির ভাপ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। কাপটা সে ছুঁয়েও দেখেনি।
সে বেশ রূঢ়স্বরে বলল, “আমার মনে হচ্ছে আপনি অসুস্থ।”
সাহারা মাথা নেড়ে বলল, “সম্ভবত তাই। আপনি ঠিকই বলছেন। আমি হয়ত অসুস্থ। নিজেকে ছাড় দেওয়ার জন্য বলছি না, কিন্তু একজন অসুস্থ মানুষের চোখে দুনিয়াটা আরও বেশি অসুস্থ। তাই না? শুনুন, আজকাল মানুষ ‘লুকিজম’-এর বিরুদ্ধে খুব জোরালোভাবে কথা বলে। সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে সবাই গলা চড়িয়ে প্রতিবাদ করে। প্রকাশ্যে কাউকে ‘কুৎসিত নারী’ বললে মার খাওয়ার জোগাড় হয়। কিন্তু টিভিশোগুলো দেখুন, ম্যাগাজিন দেখুন। সব জায়গায় কসমেটিকস, প্লাস্টিক সার্জারি, স্পা ট্রিটমেন্টের বিজ্ঞাপনের সয়লাব। যেভাবেই দেখুন না কেন, এটা একটা হাস্যকর, অর্থহীন দ্বিচারিতা। আসলে পুরোটাই এক প্রহসন।”
“কিন্তু সেটা কি মানুষকে বিনা কারণে কষ্ট দেওয়ার যুক্তি হতে পারে?” কাহো পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিল।
“হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলছেন,” সাহারা বলল। “আমি অসুস্থ। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু, যেভাবেই দেখুন না কেন, অসুস্থ হওয়াটাও উপভোগ্য হতে পারে। অসুস্থদের জন্য একটা আলাদা জায়গা থাকে, যা শুধু তারাই উপভোগ করতে পারে। যেমন মানসিকভাবে অসুস্থ বা তিতিবিরক্ত মানুষদের জন্য ডিজনিল্যান্ড। ভাগ্যক্রমে সেই জায়গা উপভোগ করার মত সময় এবং টাকা, দু’টোই আমার আছে।”
কোন কথা না বলে কাহো উঠে দাঁড়াল। এবার এর ইতি টানা দরকার। এই লোকের সঙ্গে আর কথা বলা সম্ভব নয়।
“একটু দাঁড়ান,” কাহো দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সাহারা বলে উঠল। “আপনি কি আমাকে আর একটু সময় দিতে পারেন? বেশি সময় লাগবে না। পাঁচ মিনিটই যথেষ্ট। আমি চাই আপনি আমার কথাগুলো শোনেন।”
কাহো কয়েক সেকেণ্ড দ্বিধা করে তারপর আবার বসে পড়ল। ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু লোকটার গলায় এমন কিছু ছিল যা উপেক্ষা করা কঠিন।
“আমি যা বলতে চাইছিলাম, সেটা হ’ল, আপনার প্রতিক্রিয়া ছিল অন্য সবার থেকে আলাদা,” সাহারা বলল। “আপনি যখন আমার সেই ভয়ানক কথাগুলোর মুখোমুখি হলেন, আপনি আতঙ্কিত হননি, রেগে যাননি, হেসে উড়িয়েও দেননি, এমনকি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন বলেও মনে হয়নি। কোনরকম ভাবাবেগে ভেসে না গিয়ে আপনি বরং সপাটে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে, যেন কোন ব্যাকটেরিয়া দেখছেন মাইক্রোস্কোপে। আপনিই একমাত্র, যে এমনভাবে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আর ভেবেছিলাম, এই নারী কষ্ট পেল না কেন? যদি এমন কিছু থাকে, যা তাকে গভীরভাবে আঘাত করতে পারে, তবে সেটা কী?”
“তাহলে আপনি এসবই করেন,” কাহো বলল, “বারবার এমন সাজানো সাক্ষাতের আয়োজন করেন শুধু মেয়েদের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য? শুধু এটুকুই?”
লোকটা মাথা কাত করল। “অনেকবার নয়, শুধু সুযোগ এলে। আমি কখনও ডেটিং অ্যাপ ব্যবহার করি না। যেটা খুব সহজ, সেটা বিরক্তিকর। পরিচিতরা পরিচয় করিয়ে দেয়, আর আমি শুধু তাদের সঙ্গে দেখা করি, যাদের অতীতের গল্প আমি জানি। পুরনো ধাঁচের, ওমিয়াই টাইপ অ্যারেঞ্জড মিটিং, এইটাই সেরা। পুরনো স্টাইল। আমি সেটা উপভোগ করি।”
“আর তারপর আপনি সেই নারীকে অপমান করেন?” কাহো বলল।
সাহারা কোন উত্তর দিলো না। শুধু মৃদু হাসল, যা আবার দ্রুত মিলিয়ে গেল। সে তার হাত দুটো বুকের সামনে তুলে ধরল, কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইল। যেন হাতের রেখায় কোনো পরিবর্তন খুঁজছে।
“আমি ভাবছিলাম, আপনি চাইলে আমার সঙ্গে বাইকে ঘুরতে যেতে পারেন,” হাত থেকে চোখ তুলে সে বলল। “আপনার জন্য একটা বাড়তি হেলমেটও এনেছি। আজকের আবহাওয়া বেশ ভাল, আমরা একটু এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতে পারি। আমার বাইকের ওডোমিটার বলছে, এখন পর্যন্ত আমি পাঁচ হাজার কিলোমিটার পার করেছি। আর বিএমডব্লিউ তাদের যে ‘হরাইজন্টালি অপোজড ইঞ্জিন’ নিয়ে এত গর্ব করে, সেটাও একেবারে নিখুঁতভাবে টিউন করা আছে।”
কাহোর ভিতরে এক অপ্রতিরোধ্য ক্রোধ ফুঁসে উঠল। অনেকদিন পর সে এতটা রেগে গেল। হয়ত জীবনে এই প্রথমবার। “আমরা একটু এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতে পারি?” এসব কী ভাবছে লোকটা? কীভাবে সম্ভব!
“আমি যাচ্ছি না,” আবেগ নিয়ন্ত্রণে রেখে, যতটা সম্ভব শান্ত গলায় কাহো জবাব দিল। “আপনি জানেন, এই মুহূর্তে আমি সবচেয়ে বেশি কি করতে চাই?”
সাহারা মাথা নাড়লো। “কী সেটা?”
“আপনার কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরে যেতে চাই। আর এই আলাপের কারণে যে নোংরা আমার সত্তা জুড়ে ছাপ ফেলেছে, সেটা ঘষে তুলে ফেলতে চাই।”
“বুঝেছি,” সাহারা বলল। “ঠিক আছে, বেশ। দুর্ভাগ্যবশত তাহলে এবারের মত ঘোরাঘুরির পরিকল্পনা বাদ দিতে হচ্ছে। কিন্তু আপনি কী ভাবছেন? আপনার কী মনে হয় আমার কাছ থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা সফল হবে?”
“তার মানে কী?”
সেই মুহূর্তে কোথাও একটা শিশু কেঁদে উঠল। সাহারা উৎসের খোঁজে সেই দিকে তাকাল, তারপর কাহোর দিকে চোখ ফেরাল।
“খুব বেশি সময় লাগবে না, আপনি বুঝে যাবেন,” সে বলল। “যখন আমি কারও প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়ি, তখন সহজে তাকে চলে যেতে দিই না। হয়ত বিষয়টা আপনাকে অবাক করবে, দূরত্বের দিক থেকে আমরা কিন্তু খুব বেশি দূরে নই, আপনি আর আমি। দেখুন, মানুষ কখনও অদৃশ্য শিকলের হাত থেকে পালাতে পারে না, যতই তারা সেটা দেখতে না চাক, যতই তারা তার সঙ্গে কোন সম্পর্ক না রাখুক। গিলে ফেলা আর গেলার বস্তু হওয়া— দু’টোই একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, সামনে-পেছনে, দেনা-পাওনা। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। আমার মনে হয়, আবার কোথাও না কোথাও আমাদের দেখা হয়ে যাবে।
“এই লোকের সঙ্গে আবার দেখা করা একদমই উচিত হয়নি,” কাহো ভাবল। দ্রুত পায়ে রেস্তোরাঁর দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে নিজের ভুলটা সে নিশ্চিতভাবে টের পেল। মাচিদা যখন ফোন করেছিল, তখনই আমার স্পষ্ট করে বলা উচিত ছিল “না, ধন্যবাদ। আমি আর কখনও ওই লোকটার সঙ্গে দেখা করতে চাই না।” কৌতূহল। কৌতূহলই তাকে এখানে টেনে এনেছে। সে জানতে চেয়েছিল, এই মানুষটা আসলে কী চায়, কী উদ্দেশ্য তার। কিন্তু ভাবনাটাই ছিল মস্ত ভুল। সাহারা তার সেই কৌতূহলকেই ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করেছে, নিপুণভাবে, ঠিক যেমন একটা মাকড়সা করে। তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা শিহরণ বয়ে গেল। “আমি এখনই কোন আরামদায়ক উষ্ণ জায়গায় যেতে চাই,” সে ভাবল। জেগে ওঠা আকাঙ্ক্ষাটা তাকে প্রবলভাবে টানছিল। দক্ষিণের একটা সাদা বালিময় দ্বীপ বুঝি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সে মনে মনে ভাবল, “সেখানে গিয়ে শুয়ে পড়বো, চোখ বুজে, মনের কপাট পুরোপুরি বন্ধ করে, সূর্যের আলোয় নিজেকে ভাসিয়ে দেবো।”
কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। কাহো চেয়েছিল সাহারার স্মৃতি যত দ্রুত সম্ভব মন থেকে মুছে ফেলতে। সেই অপ্রাসঙ্গিক, অদ্ভুত অভিজ্ঞতাকে এমন এক কোণে ঠেলে দিতে, যেখানে আর কোনদিন তার চোখ পড়বে না। তবু, রাতে ডেস্কে কাজ করার সময়, হঠাৎ করেই মনের ভেতর ভেসে উঠত সাহারার মুখ। অকারণে মনে পড়ত একজনের হালকা হাসি, অন্যমনস্ক দৃষ্টি, আর তার লম্বা, সূক্ষ্ম আঙুলের দিকে তাকিয়ে থাকা। সে আয়নার সামনে আগের চেয়ে অনেক বেশি সময় কাটাতে শুরু করলো। বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত, যেন নিজেকে যাচাই করছে। আর তখনই মনে হত, “আমি এসব নিয়ে খুব একটা আগ্রহী নই। এটা নিশ্চয়ই আমার মুখ, কিন্তু এমন কিছু নেই যা বলে দেয়, এটাই আমার মুখ হওয়া উচিত।” সে এমন কী হিংসা করতে শুরু করল তার সেই বন্ধুদের, যারা প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছে। তারা জানে, অথবা অন্তত বিশ্বাস করে, মুখের কোন অংশ বদলালে তারা আরও সুন্দর হবে, হবে আরও আত্মতুষ্ট। “আমার নিজের জীবন হয়ত আমার ওপর এক রকমের চতুর প্রতিশোধ নিচ্ছে,” কাহো ভাবল। “যখন সময় আসবে, জীবন হয়ত আমার পাওনা কেটে নেবে। ক্রেডিট আর ডেবিট।” সে বুঝল, সাহারার সঙ্গে দেখা না হলে এই ভাবনাগুলো কখনই তার মাথায় আসত না। সে আরো ভাবল, হয়তো সেই লোকটা অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছে, আমি কখন তার সামনে গিয়ে দাঁড়াব। ঠিক যেন একটা বিশাল মাকড়সা, অন্ধকারে তার শিকারের জন্য অপেক্ষা করছে।
মাঝে মাঝে, গভীর রাতে, যখন চারপাশ নিস্তব্ধ, তার অ্যাপার্টমেন্টের বাইরের রাস্তায় একটা বড় মোটরসাইকেল ছুটে যেত। সেই কম্পিত, নিরেট শব্দ, ইঞ্জিনের ড্রামবিট শুনে কাহোর শরীর মৃদু কেঁপে উঠত। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে যেত, আর বগল বেয়ে ঠান্ডা ঘাম ঝরত।
“আপনার জন্য একটা বাড়তি হেলমেট এনেছি,” সাহারা বলেছিল।
নিজেকে সে কল্পনা করল বিএমডব্লিউ বাইকের পিছনে বসে। ভাবল, এই শক্তিশালী যন্ত্রটা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে?
“দূরত্বের দিক থেকে, আপনি আর আমি খুব বেশি দূরে নই,” সাহারা বলেছিল।
সেই অদ্ভুত ব্লাইন্ড ডেটের ছয় মাস কেটে যাবার পর, কাহো ছোটদের জন্য একটা নতুন বই লিখল। এক রাতে স্বপ্ন দেখল, সে গভীর সমুদ্রের তলদেশে আছে। ঘুম ভাঙতেই মনে হ’ল, যেন হঠাৎ করে সে ভেসে উঠছে, সমুদ্রের তল থেকে ওপরে। সে সরাসরি ডেস্কে গিয়ে গল্পটা লিখে ফেলল। লেখা শেষ করতে বেশি সময় লাগেনি।
গল্পটা ছিল একটা মেয়েকে নিয়ে, যে নিজের হারানো মুখ খুঁজতে বের হয়। একসময়, ঘুমের মধ্যে, তার মুখ কেউ চুরি করে নেয়। তাই সেটা ফেরত পেতে অনেক কাঠখড় পোড়ানোর কাজে তাকে নামতে হয়। কিন্তু সে একদমই মনে করতে পারে না, তার মুখটা কেমন ছিল। সুন্দর না কুৎসিত, গোল না লম্বা, সেসব তার কিছুই মনে নেই। সে মা-বাবা, ভাই-বোনদের জিজ্ঞেস করে, কিন্তু কেউই মুখটা কেমন ছিল বলতে পারে না। অথবা বলতে চায় না। তাই মেয়েটি একা বেরিয়ে পড়ে মুখ খুঁজতে। আপাতত একটা মুখ খুঁজে নেয়, যেটা তার মুখে মানানসই, সেটাই সে নিজের মুখ হিসেবে লাগিয়ে নেয়। কারণ, কোন মুখ না থাকলে, পথে যাদের সাক্ষাৎ পায়, তারা তাকে অদ্ভুতুড়ে ঠাওরাতে পারে।
মেয়েটি সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়। উঁচু পাহাড়ে ওঠে, গভীর নদী পেরোয়, বিশাল মরুভূমি পাড়ি দেয়, ভয়ঙ্কর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পথ খুঁজে নেয়। সে নিশ্চিত ছিল, নিজের মুখ দেখলেই চিনে ফেলবে। “এটা আমার অস্তিত্বের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ,” এই বলে সে নিজেকে আশ্বস্ত করত। পথে অনেক মানুষকে পায়, নানা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। একবার হাতির পালের নিচে পিষে যাওয়ার উপক্রম হয়, এক বিশাল কালো মাকড়সা তাকে আক্রমণ করে, বুনো ঘোড়ার লাথি খাওয়ার কাছাকাছি চলে যায়।
এভাবে অনেক সময় কেটে যায়, সে ঘুরে বেড়ায়, অসংখ্য মুখ দেখে, কিন্তু কিছুতেই নিজের মুখটা সে খুঁজে পায় না। অন্যদের মুখই সবসময় দেখতে পায়। সে বুঝতে পারে না কী করবে। আর মধ্যে কখন যে সে ছোট্ট মেয়ে থেকে তরুণীতে পরিণত হয়েছে, বুঝতেও পারে না। তাহলে কি সে আর কখনও নিজের মুখ খুঁজে পাবে না? সে হতাশায় ভেঙে পড়ে।
একদিন, উত্তরের এক প্রান্তে, এক খাড়া চূড়ায় বসে কাঁদছিল সে। তখনই এক লম্বা যুবক, পশমের কোট গায়ে, এসে তার পাশে বসে। তার লম্বা চুল বাতাসে দুলছিল। যুবকটি তার মুখের দিকে তাকিয়ে, হাসিমুখে বলল, “তোমার মত সুন্দর মুখ আমি আগে কখনও দেখিনি।” তখন, যে মুখটা সে লাগিয়ে নিয়েছিল, সেটাই হয়ে উঠেছিল তার সত্যিকারের মুখ। সব অভিজ্ঞতা, সব অনুভূতি, সব চিন্তা মিলেমিশে তৈরি হয়েছিল সেই মুখ। তার মনে বিশ্বাস জাগে, এটাই তার মুখ, শুধু তারই মুখ। মেয়েটি আর যুবকটি বিয়ে করে, আর সেই উত্তরের দেশে সুখে বসবাস করতে থাকে।
কাহো নিজেও নিশ্চিত করে জানে না কেন বইটা শিশুদের, বিশেষ করে কিশোরী মেয়েদের মনে এতটা অদ্ভুত আলোড়ন তুলেছিল। তারা উত্তেজিত হয়ে মেয়েটির অভিযান আর সংগ্রাম অনুসরণ করত। মেয়েটি যখন নিজের মুখ খুঁজে পায়, তার মনে মানসিক শান্তি আসে। তাতে পাঠকেরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। লেখাটা ছিল সহজ, আর কাহোর আঁকা ছবিগুলো ছিল প্রতীকী, সাদাকালো রেখাচিত্র। এই গল্প লেখা আর আঁকার কাজটা কাহোর নিজের মনেও এক ধরণের আরাম এনে দেয়। “আমি এই পৃথিবীতে নিজের মত করে বাঁচতে পারি,” সে বুঝতে পারে। ভয়ের কিছু নেই। সেই সমুদ্রতলের স্বপ্ন তাকে এই শিক্ষা দিয়েছিল। মাঝরাতে যে উদ্বেগ তাকে গ্রাস করতো, তা ধীরে ধীরে কমে আসে। যদিও পুরোপুরি চলে যায়নি।
বইটা ধীরে ধীরে বিক্রি হতে থাকে, খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে পাঠকের মুখে মুখে, বইটা নিয়ে পত্রিকায় ভাল রিভিউ প্রকাশ পায়। মাচিদা রীতিমত উত্তেজিত, বেজায় খুশি।
“আমার ধারণা, শিশুদের এই বইটা দীর্ঘদিন বেস্টসেলারের তালিকায় থাকবে,” আনন্দিত মাচিদা বলেন, “আমার এমনটাই মনে হচ্ছে। এটা তোমার আগের বইগুলো থেকে একেবারে আলাদা ভঙ্গিতে লেখা, প্রথমে পড়ে আমি অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু বলো তো, এই গল্পের ভাবনা তোমার মাথায় কোত্থেকে এল?”
একটু ভেবে কাহো উত্তর দিল, “একটা খুব অন্ধকার, গহিন জায়গা থেকে।”
পাদটিকা: জাপানি ভাষায় “chan” এবং “san” দুটোই সম্মানসূচক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বয়স্ক, শ্রদ্ধা/সম্মানের যোগ্য এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সাধারণত “san” ব্যবহার হয়ে থাকে। ঘনিষ্ঠতা বা স্নেহের সম্পর্ক বোঝাতে সাধারণত “chan” ব্যবহৃত হয়।
লেখক পরিচিতি: হারুকি মুরাকামি (জন্ম: ১২ জানুয়ারি ১৯৪৯, কিয়োটো, জাপান) একজন বিশ্বখ্যাত জাপানি ঔপন্যাসিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক। তাঁর সাহিত্যজগতে প্রবেশ ঘটে ১৯৭৯ সালে Hear the Wind Sing উপন্যাসের মাধ্যমে। এরপর তিনি লিখেছেন একাধিক পাঠকপ্রিয় উপন্যাস, যার মধ্যে রয়েছে Norwegian Wood, Kafka on the Shore, The Wind-Up Bird Chronicle, এবং 1Q84।
মুরাকামির লেখায় জাদুবাস্তবতা, নিঃসঙ্গতা, সংগীত, এবং অস্তিত্বের রহস্যময়তা বারবার ফিরে আসে। তাঁর গল্পগুলো জাপানি সংস্কৃতির গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে পাঠকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। তাঁর কাজ ৫০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং কয়েক কোটি কপি বিক্রি হয়েছে।
২০২৫ সালে তিনি Center for Fiction কর্তৃক Lifetime of Excellence in Fiction Award লাভ করেন, যা তাঁর সাহিত্যিক অবদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এই পুরস্কারটি তাঁকে প্রদান করেন তাঁর বন্ধু, শিল্পী ও লেখক প্যাটি স্মিথ।
তাঁর সর্বশেষ ইংরেজি অনূদিত উপন্যাস The City and Its Uncertain Walls প্রকাশিত হয় ২০২৪ সালের নভেম্বরে, অনুবাদ করেছেন ফিলিপ গ্যাব্রিয়েল।
লেখক পরিচিতি : নাহার তৃণা
নাহার তৃণা, বাংলাদেশের ঢাকায় জন্ম, বেড়ে ওঠা। বর্তমানে আমেরিকায় বসবাস করছেন। তিনি মূলত মাতৃভাষা বাংলায় লেখালিখি করেন। পাশাপাশি ইংরেজি কিছু ওয়েবজিনে লিখছেন। বাংলা ভাষায় নাহার তৃণার প্রকাশিত বই রয়েছে ৭টি। সম্প্রতি তার প্রথম ইংরেজি ফ্ল্যাশ ফিকশন প্রকাশিত হয়েছে।