লেখক : জয়শ্রী পাল
সীমান্তে পৌঁছল ওরা। রাত্রি সমাগমের প্রান্তরেখায়।
নেনা দাকোন্তে বুঝতে পারল, বিয়ের আংটি-পরা আঙুল থেকে তখনও রক্ত পড়ছে তার। ঠিক সেই সময়ে নগররক্ষী ছাড়পত্র পরীক্ষা করছিল তাদের, কারবাইড লন্ঠনের আলোয়। চকচকে চামড়ার তেকোনা টুপি, মোটা পশম-কম্বলে ঢাকা। পাইরেনিস থেকে ছুটে আসা দাপুটে হাওয়ার থেকে, অতি কষ্টে ধরে রাখতে হচ্ছিল নিজের ভারসাম্য।
বিদেশি ছাড়পত্র দুটোই নির্ভুল, সম্পূর্ণ। রক্ষী তার আলো তুলে ধরে ছবির সঙ্গে মুখ মিলিয়ে নেয়। বাচ্চা-বাচ্চা মুখ নেনা দাকোন্তের। সোহাগী পাখির সুখি চোখ। ক্যারিবিনীয় উজ্জ্বল সূর্যতাপে মধুরঙা ত্বক ঝকঝক করছে। দুঃখী জানুয়ারির নিরাশাও বিবর্ণ করতে পারেনি সে’ ঔজ্জ্বল্য। চিবুক পর্যন্ত ঢাকা দেওয়া মিঙ্ককোটে। সীমান্ত বাহিনীর সারা বছরের রোজগার ঢেলেও এমন কোট কেনা সম্ভব নয়।
বিলি সাঙ্কেজ ডি আভিলা তার স্বামী। গাড়িটা সে-ই চালাচ্ছিল। বয়সে বছরখানেকের ছোটই হবে। নেনার মতই সুন্দর দেখতে। পড়ে আছে পশম-জ্যাকেট – বেসবল টুপি। গড়নপিটনে সম্পূর্ণ আলাদা কিন্তু স্ত্রীর থেকে। লম্বা খেলোয়ারি চেহারা, ভীরু দুর্বৃত্তের কঠিন চিবুক। সামাজিক অবস্থানটাকে তাদের চিনতে পারা যায়, রুপোলি বাহনের পরিচয়ে। গাড়ির ভেতরটা যেন জীবন্ত প্রানীর মত শ্বাস নিচ্ছে ছাড়ছে। দৈন্যদশার সীমান্ত প্রদেশে এমন অপূর্ব কোন কিছুই দেখা দেয়নি কখনও।
পেছনের আসন সুটকেসের ভীড়ে ঠাসাঠাসি। প্রত্যেকটা নতুন। প্রচুর উপহারের বাক্স না খোলা অবস্থায় জড়ো করা। উচ্চগ্রামে বাঁধা একটা স্যাক্সোফোনও রয়েছে। ওটা নেনার বাতিল করা শখ। দুরন্ত প্রেমিকের অশান্ত ভালোবাসায়, বাজনা বাজানোর শৌখিনতা ছাড়তে হয়েছে তাকে।
সিলমোহর হয়ে, ছাড়পত্র ফেরত আসে তাদের কাছে। বিলি স্যাঙ্কেজ কোন একটা ওষুধের দোকানের হদিশ জানতে চায় তার কাছে। নেনার আঙুলের রক্তক্ষরণটাকে বন্ধ করতে হবে। হাওয়ার গাঁ-গাঁ শব্দ টপকিয়ে চিৎকার করে রক্ষী। খোঁজটা তারা যেন ফ্রান্সের দিকে হেনদায়েতে গিয়ে করে। সেটাই ঠিক জায়গা।
হেনদায়ের প্রহরীরা বসেছিল একটা গরম কাচের ঘরে, আরাম করে। গায়ে শুধুমাত্র শার্ট। টেবিলে বসে তাস খেলছিল, বড় গ্লাসে করে ওয়াইন খেতে খেতে। গাড়ির চেহারা দেখতে পেয়েছিল প্রত্যেকেই। হাত নেড়ে ফ্রান্সের দিকে যেতে ইশারা করল। বিলি স্যাঙ্কেজ তবুও হর্ণ বাজাল বেশ কয়েকবার। ওরা বুঝল না ঘটনা কি হচ্ছে? একজন জানলা খুলে বাতাসের চেয়েও রাগী আওয়াজে চেঁচাল,
‘নিকুচি করেছে! তোমাদের যেতে বলেছি না?’
নেনা দাকোন্তে তখন কান পর্যন্ত কোট দিয়ে ঢেকে, গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। নিখুঁত ফরাসীতে জানতে চায় কোথায় একটা ওষুধের দোকান পেতে পারে তারা? মুখ ভর্তি রুটি নিয়ে রক্ষী জবাব দিল, স্বভাবসিদ্ধ রুক্ষতায়। সেটা তাদের জানার কথা নয়। তাও আবার এরকম একটা সাংঘাতিক ঝড়ের রাতে। বলেই জানলা বন্ধ করে দিচ্ছিল। সম্ভবতঃ তখনি তার মনোযোগ জোরাল হয়ে উঠল, মিঙ্ককোটের উজলতায় মোড়া মেয়েটার প্রতি। নিজের আহত আঙুলটাকে মুখে পুরে চুষছে সে। অমন ভয়ঙ্কর দুর্যোগের রাতেও কোন এক মায়াময় দৃশ্য দেখল যেন প্রহরী। সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ পালটিয়ে, ব্যাখ্যা শুরু করে। সবচেয়ে কাছের শহর হল বায়ারিজ। কিন্তু এই মাঝশীতের রাতে, হাওয়া যখন নেকড়ের মত গজরাচ্ছে, বেয়নে পর্যন্ত বা তার থেকে আরেকটু বেশি না গেলে কোন ওষুধের দোকান খোলা পাওয়া যাবে না।
‘খুব মারাত্মক চোট?’ জানতে চায় সে।
‘একেবারেই না।’
নেনা দাকোন্তে হেসে তার হীরের আংটি পরা আঙুল দেখায়। আঙুলের ডগায় প্রায় দেখা যায় না এমনি একটা গোলাপে কাটা দাগ।
‘একটা মাত্র কাঁটা ফুটেছিল।’
বেয়নে পৌঁছনর আগেই তুষারপাত শুরু হল। সাতটার বেশি বাজেনি যদিও, পথঘাট তবু শুনশান। ঝড়ের তাড়া খেয়ে, জানলাকপাট বন্ধ ঘরদুয়ারের। কোনাচ- কানাচ তন্ন তন্ন খুঁজেও, কোন ওষুধের দোকান খোলা পাওয়া গেল না। এগিয়েই যাবে ঠিক করল তখন। বিলি স্যাঙ্কেজ খুব খুশি এই সিদ্ধান্তে। দুর্লভ মোটরগাড়িতে ওর এক অতৃপ্ত আগ্রহ। আর রয়েছেন এক বাবা, যাঁর মনে অপরাধবোধ প্রচুর। ছেলের খেয়াল মেটাতে, সঙ্গতি তাঁর যথেষ্টরও অনেক বেশি। বিয়েতে তাই বাবার উপহার হিসেবে পেয়েছে, বেন্টলের কনভার্টিবল। আগে কখন এ’ গাড়ি চালায়নি। চলন্ত চাকার সঙ্গে তার আনন্দোচ্ছ্বাস, উপচে পড়ছে তাই। গাড়ি যত চলে, ক্লান্তি ততই কমে আসে। সেই রাতেই বোরড্যাক্স পৌঁছতে চাইছিল সে। হোটেল স্পেলেনডিড-এ সদ্য বিবাহিতের বিলাসী কামরা তাদের প্রতীক্ষায় রয়েছে। সুতরাং দোর্দন্ডপ্রতাপ হাওয়া কিংবা আকাশভেদী তুষারপাত কোন কিছুই আটকাতে পারছিল না তার গতিবেগ। সেদিক দিয়ে নেনা কিন্তু ক্লান্ত হয়েছে একটু বেশি। বিশেষ করে মাদ্রিদ থেকে ধারাবাহিক যাত্রার শেষ পর্বে। পাহাড়ী ছাগলচরা পাহাড়চূড়ার কিনারা এবং বিধ্বস্তকরা ঝড় বড় বেশি শ্রান্ত করেছে তাকে। বেয়নের পর অনামিকায় একটা রুমাল জড়ায় নেনা। শক্ত করে চেপে ধরে, যাতে রক্ত পড়া বন্ধ হয়। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয় তারপর। মাঝরাত পর্যন্ত কিছুই খেয়াল করল না বিলি। যতক্ষণ না বন্ধ হল বরফ পড়া। পাইনবনে হাওয়া থামল হঠাৎ করে। চারনভূমির ওপর আকাশ অগুন্তি তারায় উঠল ঝিলমিলিয়ে। বোরড্যাক্স-এর ঘুমন্ত আলোদের পেরিয়ে এসেছে। একবার মাত্র থেমেছিল শুধু, গাড়ির ট্যাঙ্ক ভর্তি করতে। এখনও যথেষ্ট উৎসাহ আছে, কোন বিশ্রাম-টিশ্রাম ছাড়াই, প্যারিস পর্যন্ত গাড়ি চালানোর। এমনই সম্মোহিত-মুগ্ধ হয়ে রয়েছে, পঁচিশ হাজার পাউন্ডের বড়সড় খেলনায়, যে অন্য কথা মনেও আসেনি। পাশে ঘুমিয়ে রয়েছে দীপ্তিময়ী রূপসী। অনামিকায় জড়ানো রক্তেভেজা রুমাল। এই প্রথম কৈশোরস্বপ্ন যার দুভাগ হয়ে যাচ্ছে অনিশ্চয়ের বিদ্যুচ্চমকে। – সেও কি তারই মত রোমাঞ্চ অনুভব করছে আজকের রাতে? একথা ভাবেনি মোটে।
মাত্র তিনদিনের বিবাহিত তারা। দশ হাজার কিলোমিটার দূরের কার্টাগেল ডি ইন্ডিয়াস-এ অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেই বিবাহোৎসব। বিলির বাবা-মা বিস্ময়ে অভিভূত। নেনার বাবা-মায়ের সব সংশয় মুছেছিল। সঙ্গে ছিল আর্চবিশপের একান্ত আশীর্বাদ। তারা দুজন ছাড়া, আর কেউই বোঝেনি বিয়ের সত্যিকারের কারনটাকে। জানতে পারেনি অনিশ্চিত ভালোবাসার মূলসূত্র কোনখানে।
বিয়ের ঠিক তিনমাস আগের ঘটনা সেট্ সমুদ্র সংক্রান্ত রোববারের। সে’ সময়ে বিলি স্যাঙ্কেজের দলবল মার্বেলা বিচে মেয়েদের বেশ পরিবর্তন কামরায়, ঝড় বওয়াচ্ছিল। নেনার বয়স সবেমাত্র আঠেরো। সেন্ট ব্লেজ, সুইজারল্যান্ড-এর চ্যাটলিনে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছে। নির্দিষ্ট বাচনভঙ্গি ছাড়াই, চারটে ভাষায় অবাধ। আর উচ্চগ্রামের স্যাক্সোফোনে ওস্তাদের দক্ষতা। বাড়ি আসার পর, সমুদ্রতটে প্রথম রোববার সেদিন তার। সাঁতারের বেশ পরবে বলে সবেমাত্র পোষাক খুলেছে, আতঙ্ক ভেঙে পড়ল। জলদস্যুরা হই হই করে উঠেছে কাছাকাছির কেবিনে। কিছুই বোঝেনি সে, কি ঘটতে যাচ্ছে আসলে। যখন তার কামরার হাতল খুঁচিয়ে ভাঙা হল। আর সামনে পেল, অনুমান করা সবচেয়ে সুন্দর ডাকাতকে। পরনে আর কিছু না, নকল চিতার চামড়ার অধোবাস। শান্ত-কমনীয়, মহাসমুদ্রে রাতদিন ঘুরে বেড়ানো সোনালী শরীর নিয়ে, দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। ডানহাতের কব্জিতে ধাতব বালা, রোমান গ্ল্যাডিয়েটারদের ঢং-এ। হাতের মুঠিতে পাকানো লোহার চেন। ওটাই তার মারনাস্ত্র।
দুজনে কিন্তু একই প্রাথমিক স্কুলে পড়েছে। বহু জন্মদিন উপলক্ষে খেলনা-লজেন্সের বাক্স ফাটিয়েছে একসঙ্গে। কারন তারা একই প্রাদেশিক পরিবারের ছেলেমেয়ে। যে পরিবার নগরী পরিচালনা করে আসছে, কলোনী বসতির সময় থেকে। যেহেতু বহু বছর দেখাসাক্ষাত নেই, প্রথম দেখায় তাই চিনতে পারেনি পরস্পরকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নেনা, তার চরম নগ্নতাকে ঢাকার চেষ্টা না করেই। বিলি তার ছেলেমানুষী কাজকর্ম আরেক ধাপ বাড়ায়। ধীরে নামিয়ে আনে চিতা-ফুটকি অধোবাস। দেখাতে চায় কতটা পুরুষ সে। সরাসরি তাকায় নেনা, অবাক না হয়ে,
‘এমন ঢের দেখা আছে আমার।’ আতঙ্ক চেপে রেখে জানায় নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায়।
‘এখন ভেবে দেখো কি করবে? একজন কালো মানুষের থেকে অনেক ভালো কিছু করে দেখাতে হবে তোমায় কিন্তু।’
বাস্তবে, নেনা শুধুমাত্র অক্ষত কুমারীই নয়, কোন বিবসন পুরুষকেও সে দেখেনি এই মুহূর্তের আগে। প্ররোচনায় তবু কাজ হয়। কথা কটা শুনে বিলি মোটমাট যা করল, চেনসমেত মুঠিতে সজোরে দেওয়ালে ঘুষি মেরে হাত ভাঙল। নেনা তাকে গাড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করে। ঘটনাচক্র একটু একটু করে শেখায় তাদের, কি করে ভালবাসতে হয় একাত্মবোধে।
জুনের কষ্টকর বিকেলগুলো তাদের কাটতে লাগল সেই বাড়ির ছাদের তলায়, যেখানে নেনা দাকোন্তের মহিমান্বিত ছয়পুরুষ বাস করে গেছেন। স্যাক্সোফোনে নেনা বাজাত জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সব গান। আর বিলি? হাত-ভাঙা-ব্যান্ডেজে বন্দী থাকা হাত নিয়ে, দোলনা বিছানার থেকে গভীর ভাবে চেয়ে থাকত নেনার দিকে। হতচেতনা থেকে যেন মুক্তি পায়নি সে।
বাড়িটাতে অসংখ্য জানলা মেঝে থেকে ছাদ অবধি। বেলাভূমির আঁশটে জল জমে থাকত যাদের গায়ে। লা মাঙ্গা জেলার সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপত্য এই বাড়িটা। এবং সবচেয়ে কুৎসিত নিঃসন্দেহে। তবু ডোরাকাটা টালির চত্বরে, যেখানে নেনা স্যাক্সোফোন বাজাত, বিকেল চারটের গরম রোদ্দুর সত্বেও জায়গাটা মরূদ্যান হয়ে উঠত। চত্বরটা মিলেছিল একটা আঙিনায়। ছায়াঢাকা আড়াল সেখানে। আমের গাছ আর কলাবাগান। যার তলায় রয়েছে এক কবর। নামছাড়া সমাধিপাথর এক, অনেক পুরোন এই বাড়ির থেকে, পরিবারের গালগল্পের থেকে।
গানবাজনার কিছুই যারা বোঝে না, এমনকি তারাও ভাবে, স্যাক্সোফোন বাজনাটা বড় বেমানান, এই মান্ধাতা আমলের বাড়িটার সঙ্গে।
‘জাহাজের গর্জনের মত আওয়াজ বেরোয় এর ভেতর থেকে।’
নেনার ঠাকুমা প্রথম বাজনা শুনে মন্তব্য করেছিলেন। নেনার মায়ের আপত্তি ছিল সম্পূর্ণ অন্য কারনে। বাজাতে বাজাতে স্কার্ট উঠে আসত ঊরুর ওপরে, দুটো হাঁটু ছড়ানো থাকত দুধারে। একটা ব্যাপার স্পষ্ট, বাজনার সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই।
‘কি বাজাচ্ছো তুমি, তা নিয়ে আমার একটুও মাথাব্যথা নেই।’ নেনার মা বলতেন, ‘কিন্তু যতক্ষণ বাজাবে পা দুটো যেন একসঙ্গে থাকে।’
অতএব জাহাজী বিদায়সঙ্গীত আর ঝুঁকেপড়া ভালোবাসার ইন্দ্রিয়তৃপ্তি, নেনাকে সাহায্য করল বিলি স্যাঙ্কেজের ভেতরের তেঁতো খোলসটাকে ভাঙতে। অজ্ঞ বর্বর হিসেবে অগৌরবের পরিচয়ের তলা থেকে, নিজেকে বিলি উঠিয়ে আনতে পারল বড় মাপের সফলতায়। দুই সম্মানিত পরিবারের নামের প্রভাব থেকে নেনা খুঁজে পেল, এক ভীরু কমনীয় অনাথকে। হাতের হাড় জোড়া লাগার সঙ্গে সঙ্গে, সে আর বিলি একে অন্যকে চিনে নিচ্ছিল প্রগাঢ় অনুভবে। কোন এক বৃষ্টিশেষের বিকেলে, ভালোবাসার গহীনতাকে অবাক হয়ে চিনল বিলি, যখন নেনা তাকে ডাক দিল তার কুমারীশয্যায়। বাড়িঘর তখন নিরালা নির্জন। সপ্তাহদুয়েক ধরে প্রায় প্রতিদিন হুল্লোড় করল তারা, একই সময়ে। আবেগতাড়িত-নগ্ন। অবাক হওয়া সামরিক যোদ্ধাদের, কিংবা অতৃপ্ত-বাসনা ঠাকুমা-দিদিমার ছবির নিচে চলল এই উৎসব। ওঁরা তাদের পৌঁছে দিল ঐতিহাসিক পালঙ্কের স্বর্গ-মুহূর্তে। মিলন বিরতির মাঝের সময়টুকুও অমনি বসনহীন রইল ওরা। দুয়ার-জানলা হাট করে খোলা। নিঃশ্বাস ফেলল তটে জড়ো করা জাহাজী জঞ্জালের দুর্গন্ধে। এবং স্যাক্সোফোনের নীরবতার মধ্যে দিয়ে শুনতে পায়, আঙিনার নিত্যনৈমিত্তিক শব্দ। ছোট্ট একটু ব্যাঙের ডাক কলাবাগানের নিচে। অজানা কবরে টুপ করে ঝরা একবিন্দু শিশির। জীবনের চলাফেরায় স্বতঃ স্বাভাবিক শব্দ, যা তারা আগে কখন শোনেনি।
নেনার বাবা-মা বাড়ি ফিরলেন। নেনা দাকোন্তে আর বিলি স্যাঙ্কেজ তখন এতদূর পেরিয়েছে ভালোবাসার পথ, যে জগৎ তাদের পক্ষে আর তত বড় নয়। যেখানে খুশি, যখন খুশি মিলন ঘটছিল তাদের। আর প্রতিবার নিত্য নতুনত্বে। তাদের প্রথম প্রচেষ্টা স্পোর্টসকার। নিজের অপরাধবোধ কমিয়ে আনতে, বিলি স্যাঙ্কেজের বাবা তাকে দিয়েছিলেন যেটা। এরপর গাড়িটা যখন খুব সহজ উপায় হয়ে দাঁড়াল, রাত্তিরে মার্বেলা বিচের ধূ-ধূ করা কেবিনগুলোকে উপলক্ষ্য করা গেল। সেখানকার প্রথম সাক্ষাতকার নির্দিষ্ট লক্ষ্যপথে ঠেলছিল ওদের। নভেম্বর উৎসব চলাকালীন, যাযাবরী পোষাকের সাজ চাপাত, যাতে পুরোন ক্রীতদাস জেলা গেটসামানিতে ঘরভাড়া করতে পারে। বিলি স্যাঙ্কেজ আর তার চেনওলা দলবলের অনুগত মেয়েরক্ষীরা সুরক্ষিত রাখত ওদের দুজনের অবস্থান। নিজেকে নেনা বিকিয়েছিল গোপন প্রেমে। সেই ধারারই উন্মত্ত নিবেদনে। একদিন, এই সময়টা কাটত তার স্যাক্সোফোন বাজিয়ে। বাধ্য ডাকাত বুঝে উঠছিল একটু একটু করে যে, প্রথম শাসানিতে কি বলতে চেয়েছিল নেনা, কালোমানুষদের থেকেও ভালো কিছু করতে হবে বলে। বিলি সর্বদাই নেনার ভালোবাসাকে একই রকম উদ্দীপনায় ভরিয়ে রাখত। বিয়ের পরও প্রেমের একাগ্রতাকে পরিপূর্ন করল ওরা, আটলান্টিকের ওপর। বিমানসেবিকারা যখন ঘুমের দেশে। বাথরুমের নিরালায় ঝাঁপ দিল। যত না আনন্দ পেল, খুশি হল অনেক বেশি। বিয়ের চব্বিশ ঘন্টা পরে, ঠিক তখনি জানা গেছে, নেনা দু’ মাসের অন্তঃসত্তা।
সুতরাং মাদ্রিদ পৌঁছোনো, কেবলমাত্র সফল প্রেমিক-প্রেমিকা হিসেবে নয়। সদ্য বিবাহিত ভূমিকা পালনের যথেষ্ট সদিচ্ছা মনে নিয়েই। বাবা-মায়েরা সব ব্যবস্থাই করে রেখেছিলেন সাজিয়ে গুছিয়ে। প্লেন থেকে নামার আগে, দূতাবাসের একজন অফিসার এলেন কেবিনে। নেনার জন্য এনেছেন তিনি সাদা মিঙ্ক কোট, উজ্জ্বল কালোর বর্ডার দেওয়া। বিলিকে দিলেন ভেড়ার লোম ছাঁটা জ্যাকেট, শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য। আর দিলেন দাগবিহীন গাড়ির চাবি – এক বিস্ময়কর মোটরগাড়ির। যা তার জন্য অপেক্ষা করে আছে বিমান বন্দরে।
তাদের দেশের দূতাবাস বিভাগের মানুষজন, দপ্তরের অভ্যর্থনা কক্ষে সানন্দে বরন করে নিল বিলি আর নেনাকে। রাষ্ট্রদূত আর তাঁর স্ত্রী শুধুমাত্র দুই পরিবারের বন্ধু নন। দূতমশাই একজন ডাক্তারও। নেনাকে পৃথিবীর প্রথম আলো দেখিয়েছেন। একগুচ্ছ তাজা গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি অপেক্ষায়। গোলাপগুলো এত টাটকা যে, পাপড়িতে জমা হওয়া, ঝিলমিল শিশিরকনাদের নকল মনে হচ্ছিল। দুজনের গালেই আলতো করে চুমু খায় নেনা। সাত তাড়াতাড়ি বিয়ের কনে সেজে ওঠার দরুন একটু অস্বস্তিতেই ছিল। রাষ্ট্রদূতের থেকে গোলাপগুচ্ছ নিতে যাওয়ার সময়ই একটা কাঁটা বিঁধল আঙুলে। দুর্ঘটনাটাকে সে সুন্দর কৌশলে সামলেছে, ‘ইচ্ছে করেই করেছি। যাতে আমার আংটিটা তোমাদের চোখে পড়ে।’
আর সত্যি সত্যিই পুরো দূতাবাসের দলটা অবাক হয়েছে আংটির দীপ্তিতে। নিশ্চয়ই এটা সৌভাগ্যের প্রতীক? না, তা হয়তো নয়। হীরের গুনাগুন নির্ভর করে সযত্নে রক্ষিত প্রাচীনতার ওপর। কারুরই কিন্তু খেয়াল হয়নি যে, নেনার আঙুল থেকে রক্তঝরা শুরু হয়েছে। সকলের নজর তখন নতুন গাড়িটার দিকে। রাষ্ট্রদূতের উদ্ভাবনী পরিকল্পনায় গাড়িটাকে বিমানবন্দরে আনা হয়েছে, সেলোফেন কাগজে মুড়ে, লম্বা সোনালী রিবন বাঁধা অবস্থায়। বিলি তাঁর এই উদ্দীপনা বুঝল না। এতই অধীর ছিল গাড়িটা দেখার জন্য যে একটানে ছিঁড়ে ফেলল সমস্ত মোড়ক এবং রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে পড়ল সেখানে। সে বছরই বেন্টলে কনভার্টিবলকে খাঁটি চামড়ার সাজসজ্জায় সাজান হয়েছে। আকাশ তখন ছাইরঙা মেঘকম্বলে মোড়া। কেটে বসে যাওয়া বরফ-ঠান্ডা হাওয়া বইছিল গুয়াডারামা থেকে। বাইরে থাকার উপযুক্ত সময় নয় মোটে। বিলি স্যাঙ্কেজের তবু কোন হুঁশ নেই শীত সম্পর্কে। পুরো দূতাবাসকে সে, বাইরে গাড়ি রাখার জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখল। ধারনায় এল না যে ভদ্রতার খাতিরে ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে সকলে। যতক্ষন না আপাদমস্তক ভালো করে দেখে নিল গাড়িটাকে, থামল না। এরপর রাষ্ট্রদূত পাশে বসে দেখালেন দপ্তরের আবাসন কোথায়, যেখানে প্রস্তুত রয়েছে দুপুরের ভোজ। পথে যেতে যেতে তিনি নগরের সুবিখ্যাত দ্রষ্টব্যদের চিনিয়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু বিলির মন ভুলেছিল গাড়ির জাদুকরী মায়ায় শুধুমাত্র।
এই প্রথম দেশের বাইরে এসেছে বিলি। সব ধরনের সরকারী-বেসরকারী স্কুলে পড়াশোনা করেছে সে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বার বার। এক সময় বুঝেছে বিশেষ কিছু লাভ হয়নি তাতে। নগরের দিকে প্রথমবার তাকিয়েই বুঝল, তার শহর থেকে সম্পূর্ণ অন্য রকম এর দৃশ্যাবলী। দিনের মাঝামাঝি সময়ে আলোজ্বলা ধূসর বাড়ির সারি। বিরল গাছপালা, দূরদিগন্তের মহাসমুদ্র – তার মনে এক নিরানন্দের অনুভব এনে দিল। যেটাকে অতিকষ্টে মনের এক কোনায় ঢেকে-চেপে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছিল। কিন্তু খুব শিগগীরই, নিজের অজান্তে সবটুকু গেল ধুয়েমুছে। একটা আচমকা নিঃশব্দ ঝড়, ঋতুর শুরুতেই ভেঙে পড়ল মাথার ওপর। তখন তারা ভোজ সেরে, রাষ্ট্রদূতের আবাসন থেকে বেরিয়েছে, ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার জন্য। বিলি স্যাঙ্কেজ বেমালুম ভুলে গেল তার গাড়ির কথা। প্রত্যেকে দেখল আনন্দে চিৎকার করে, মুঠো মুঠো বরফ ছুঁড়ছে সে মাথার ওপর দিয়ে। নতুন কোটপরা অবস্থাতেও মাঝরাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।
নেনা তার রক্তেভাসা আঙুলটাকে খেয়াল করেনি। মাদ্রিদ পেরিয়েছে যখন, ঝড় ছাপিয়ে ওঠা এক স্বচ্ছ বিকেলে, তখনই নজরে এল ব্যাপারটা। অবাক লাগল এই ভেবে, রাষ্ট্রদূতের স্ত্রীর সঙ্গী ছিল যখন ভোজসভার পর, ভীষন উৎসাহে উনি ইতালীয় গান গাইতে চাইছিলেন স্যাক্সোফোনে। তখনও তো কোন কষ্ট বোঝেনি আঙুলে। স্বামীকে যখন সীমান্ত থেকে সংক্ষিপ্ত পথ বলে দিচ্ছিল, আনমনা ভাবে আঙুল চুষেছে নিজের। পাইরেনিসে পৌঁছেই ওষুধের দোকান খোঁজার কথা মনে এসেছে। বিগত কয়েকদিনের জমে ওঠা স্বপ্নই বুঝি দেখছিল নেনা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। রাতস্বপ্নের অনুভব নিয়ে জেগে উঠে, সে দেখে গাড়ি চলছে জলের ভেতর দিয়ে। অনেক পরে তার মনে পড়ল আঙুলে রুমাল জড়ানো আছে। গাড়ির ড্যাশবোর্ডে রাখা জ্বল জ্বলে ঘড়িতে, তিনটে বেজে গেছে। মনে মনে হিসেব করে বোঝে, বোরডিয়াক্স পেরিয়ে গেছে। অ্যাঙ্গুলিস আর পৈতিয়ার্সও ছাড়িয়ে এসেছে। এখন চলেছে লইয়ারের জলে ভাসা খাত পেরিয়ে। চাঁদের আলো চুঁইয়ে নামছে, কুয়াশা ভেদ করে। পাইন বনের আড়ালে, প্রাসাদের অন্ধকার যেন পরীর দেশের রূপকথা। এই অঞ্চলটা আপাদমস্তক চেনে নেনা। ঠিক বুঝতে পারল তাই, প্যারিস থেকে আর ঘন্টা তিনেকের দূরত্বে রয়েছে মাত্র। বিলি তখনও অদম্য উৎসাহে গাড়ি চালাচ্ছে।
‘আচ্ছা পাগল লোক তুমি!’ নেনা বলে ওঠে, ‘এগারো ঘন্টা ধরে, না খেয়েদেয়ে গাড়ি চালাচ্ছো?’
নতুন গাড়ির অমৃতময় আনন্দ বিলিকে চলার নির্দেশ দিয়েছে শুধু। প্লেনে সে বেশি ঘুমোয়নি। তবু জেগে থাকার আগ্রহ এবং উদ্দীপনা প্রচুর। যাতে ভোর নাগাদ প্যারিস পৌঁছে যেতে পারে।
‘দূতাবাসের ভোজ এখনও পেটে গজ গজ করছে আমার।’ জানাল সে। তারপর কোন নির্দিষ্ট যুক্তি ছাড়াই বলল, ‘আরে বাবা, কার্টাগেনাতে তো সবেমাত্র সিনেমা থেকে বেরিয়েছে মানুষজন। এখন নিশ্চয়ই দশটার মত বেজেছে।’
এসব বলা কওয়া সত্বেও,নেনা ভয় পাচ্ছিল হয়তো সে স্টিয়ারিঙের ওপরই ঘুমিয়ে পড়বে। মাদ্রিদে পাওয়া অসংখ্য উপহারের বাক্সের একটা খুলে, এক টুকরো কমলালেবু লজেন্স তার মুখে পুরে দেওয়ার চেষ্টা করে। মুখ ফিরিয়ে নেয় বিলি।
‘ছেলেরা কখনও মিষ্টি খায় না।’
অরলিনসের কিছু আগে কুয়াশা কেটে গেল। একটা মস্ত চাঁদ, তুষারে মোড়া প্রান্তরটাকে ভরিয়ে দিল আলোয়। গাড়ি চালানো তবু মুস্কিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বড় বড় মাল সরবরাহের লরী আর মদের ট্যাঙ্কার, এসে ভীড় বাড়াচ্ছিল জাতীয় সড়কের। সব চলেছে প্যারিসের দিকে। নেনা গাড়ি চালানোয় সাহায্য করতে চাইছিল স্বামীকে। কিন্তু সাহস পাচ্ছিল না, সে কথা বলার। বিলি আগেই জানিয়ে রেখেছে, স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে প্রথম গাড়িতে বেরোনর সময়, স্ত্রী যদি গাড়ি চালায়, স্বামীর কাছে তার চেয়ে বেশি যন্ত্রনাদায়ক আর কিছু হতে পারে না। পাঁচ ঘন্টা টানা ঘুমোনর পর, নেনার বেশ ঝরঝরে লাগছিল এমনিতে। সে খুব খুশি যে তাদের কোন গ্রামীন ফরাসি হোটেলে রাত কাটাতে হয়নি। ওসব হোটেল ভালো মত চেনা ওর। যখন ছোট ছিল, অসংখ্য বার যাতায়াতের পথে বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকেছে।
‘এত সুন্দর গ্রামের পরিবেশ আর কোথাও পাবে না তুমি।’ সে বলে, ‘কিন্তু যদি তেষ্টাতেও মরে যাও কেউ এসে এক গ্লাস জল ধরবে না মুখের সামনে।’
এ ব্যাপারটা এতো ভালো রকম জানে, যে রাত্রিবাসের ব্যাগে একটা সাবান আর এক রোল কাগজ রেখে দিয়েছে। হোটেলগুলোতে কোন সাবান থাকে না। শুধু তাই নয়, টয়লেট পেপারের বদলে, খবরের কাগজের চৌকো টুকরো একটা পেরেকে ঝোলানো থাকে। মাত্র একটা ব্যাপার তার পছন্দ হয়নি মোটে। রাতটা তারা পুরোপুরি নষ্ট করেছে। মিলনবিহীন রাত এটা। স্বামীকে জানাতেই সঙ্গে সঙ্গে জবাব আসে,
‘মনে হচ্ছে বরফের মধ্যে দারুন জমবে ব্যাপারটা। তুমি রাজি থাকলে নাহয় -’
গভীর ভাবে চিন্তা করে নেনা বিষয়টা। চাঁদের আলোয় পথের দুপাশের বরফকে মনে হচ্ছে তুলতুলা নরম আর উষ্ণ। কিন্তু তারা প্যারিসের শহরতলীতে ঢুকে পড়েছে। যানবাহন ঘন হয়ে উঠছে ক্রমাগত। গুচ্ছ গুচ্ছ আলোজ্বলা কারখানা রয়েছে। অসংখ্য কারখানার শ্রমিকের সাইকেলে যাতায়াত। নেহাত শীতকাল, নয়তো এ রাস্তা এতক্ষনে দিনের আলোয় ভরে থাকত।
‘নাহ! প্যারিসের জন্য অপেক্ষা করাই তো ভাল।’ নেনা মতামত জানায় নিজের, ‘পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাদরে ঢাকা, একটা বিছানাই বেশ সুন্দর আরামের হবে। বিবাহিতেরা স্বাভাবিক ভাবে তাই করে।’
‘এই প্রথম তুমি আমায় ফেরালে।’ অভিমানী হয় স্বামী তার।
‘নিশ্চয়ই!’ হেসে বলে সে, ‘এই প্রথমই তো আমরা বিবাহিত হয়ে উঠতে পেরেছি। তাই না?’
ভোর হবার একটু আগে, পথের ধারের রেস্টুর্যান্টে মুখ-চোখ ধুলো ওরা। পরিচ্ছন্ন করে নেয় নিজেদের। কফির সঙ্গে গরম ক্রোসিয়েন্ট রুটি খেল। লরিচালকেরা এখানে রেড ওয়াইন দিয়ে প্রাতরাশ সারছে। বাথরুমে ঢুকে নেনা ব্লাউজে আর স্কার্টে রক্তের দাগ খুঁজে পেল। ধোওয়ার চেষ্টায় যায় না। বরং রক্তমাখা রুমালটাকে ফেলে দেয় ডাস্টবিনে। বিয়ের আংটিটা বাঁ হাতের আঙুলে গলাল। সাবান আর জল দিয়ে ধুলো আহত আঙুলটাকে। কাটার দাগ দেখাই যাচ্ছে না প্রায়। কিন্তু গাড়িতে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই আবার শুরু হয় রক্ত পড়া। গাড়ির বাইরে হাতটাকে ঝুলিয়ে দিল নেনা, যাতে মাঠের বরফ ঠান্ডা হাওয়ায় বন্ধ হয় রক্ত। প্রক্রিয়াটা কাজে লাগল না। তখনও সে তেমন হুঁশিয়ার হয়নি।
‘যদি আমাদের কেউ খুঁজতে চায়, কাজটা খুব সোজা হবে।’ স্বাভাবিকতায় বলে, ‘একটাই কাজ করতে হবে। বরফে আমার রক্তনিশানা দেখে দেখে চললেই হবে।’
নিজের বলা কথাটাকে খুব মন দিয়ে ভাবল। আর ভোরের আলোয়, ফুলের মত সুন্দর হয়ে ফুটে উঠল তার মুখখানি।
‘ভাবো একবার।’ তার কল্পনা বলে চলেছে, ‘মাদ্রিদ থেকে প্যারিস, পুরো পথ জুড়ে রক্তনিশানা। একটা দারুন গান হতে পারে না, এর থেকে?’
বেশিক্ষন চিন্তার সময় সে পেল না। প্যারিসের উপান্তেই অশ্রান্ত ধারায় রক্ত বইতে থাকল আঙুল থেকে। তার মনে হল আত্মাটাই যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে আঙুলের ক্ষত গলে। ব্যাগের রোল কাগজ দিয়ে থামাতে চাইল রক্তস্রোত। কিন্তু সেগুলো জড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এমন ভিজে উঠল, যে তৎক্ষণাৎ ছুঁড়ে ফেলে দিতে হল জানলার বাইরে। যে জামাকাপড় সে পরে ছিল সেগুলো, তার কোট, গাড়ির আসন সবই ভিজছে, এক এক করে নিরুপায় ভাবে। বিলি সত্যিই উতলা হয়ে, ওষুধের দোকান খুঁজতে লাগল। নেনা কিন্তু ততক্ষনে বুঝে ফেলেছে ওষুধ বিক্রেতার কর্ম নয় এটা।
‘আমরা পোর্ট দি অরলিনে পৌঁছেই গেছি প্রায়। সোজা চলো জেনারেল লেকল্যারফ অ্যাভিনিউ ধরে। সবচেয়ে বড়, গাছে ছাওয়া রাস্তাটা। তারপর বলে দেব কি করতে হবে?’
যাত্রাপথের সবচেয়ে কষ্টকর পরিস্থিতিতে রয়েছে তারা। জেনারেল লেকল্যারফ অ্যাভিনিউ দুদিক থেকেই যানজটে আটকানো। নরকযন্ত্রনার গিঁট যেন পাকিয়ে গেছে। ছোট গাড়ি, মোটর সাইকেল আর বড় বড় লরির ভীড়। প্রত্যেকে চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় বাজারে পৌঁছতে। অহেতুক হর্নের সোরগোল- চেঁচামেচি বিলিকে এমন খেপাল যে, অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দিল সে কিছু কিছু ড্রাইভারদের। এমন কি একজন তার গাড়িতে ধাক্কা লাগানোয় তেড়ে মারতেও নামছিল। নেনা তাকে আটকালো এই বলে যে ফ্রান্সের লোক অত্যন্ত অভদ্র হতে পারে, কিন্তু তারা হাতাহাতি করে না। যথেষ্ট সুস্থির ছিল নেনা সেই মুহূর্তেও। তখনও আপ্রান চেষ্টা ছিল, অজ্ঞান না হওয়ার।
আরো এক ঘন্টা লাগল লিওন ডি বেলফোর্ট-এর চক্রাকার পথে পৌঁছতে। কফি আর অন্যান্য দোকানগুলোয় আলো জ্বলছিল মাঝরাতের মত। একটা গতানুগতিক মেঘাচ্ছন্ন মঙ্গলবার, কাদামাখা প্যারিসীয় জানুয়ারির। ঘ্যানঘেনে বৃষ্টি ঝরছে অবিরত। যার ফলে তুষারকনারা জমাট বাঁধেনি। ডেনফোর্ট রোকেরিউ অ্যাভিনিউতে গাড়ি অনেক কম। কয়েকটা বাড়ি পেরোনর পর, নেনা তার স্বামীকে বলল ডান দিকে ঘুরতে। একটা বিরাট থমথমে হাসপাতালের দোরগোড়ায় গাড়ি দাঁড় করাল বিলি। হাসপাতালের জরুরী অবস্থাকালীন চিকিৎসার দরজায় একেবারে।
গাড়ি থেকে বেরোতে সাহায্য লাগল নেনার। তখনও মনের শক্তি হারায়নি ও কিংবা সহজবোধ। হাসপাতালের চাকা লাগানো বিছানায় শুয়ে, ডাক্তারের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে, নার্সের স্বাভাবিক প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল। পরিচয় আর চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য নথিবদ্ধ হল। বিলি একহাতে তার ব্যাগ বইছিল। অন্যহাত দিয়ে শক্ত করে ধরেছিল নেনার বাঁ হাত। সেই হাতেই পরাছিল বিয়ের আংটি। হাতটা অবসন্ন আর ঠান্ডা। ঠোঁটের থেকে স্বাভাবিক রঙ মুছে যাচ্ছে। যতক্ষন না ডাক্তার এসে আহত আঙুলটাকে ভালো ভাবে পরীক্ষা করলেন, বিলি হাত ধরে পাশে দাঁড়িয়ে রইল। ডাক্তার খুবই অল্পবয়স্ক। মাথা কামানো। পুরোন তামার মত গায়ের রঙ। নেনা দাকোন্তে তাঁর দিকে তাকায়ই না। বরং হাসি-হাসি মুখে স্বামীর দিকে ফেরে, ‘ভয় পেও না।’ মজা করার ভঙ্গীতে সে জানায়,
‘একটা জিনিসই হতে পারে। এই নরখাদক হয়তো আমার হাতটা কেটে খেয়ে ফেলল।’
ডাক্তার পরীক্ষা শেষ করেছেন। এবার তাঁর এশীয় উচ্চারনে পরিষ্কার স্প্যানিশে বলে ওঠেন,
‘নাগো! এই নরখাদক বরং খেতে না পেয়ে মরে যাবে, তবু এত সুন্দর হাত কাটতে পারবে না।’
অস্বস্তি বোধ করল ওরা। খুব ভালো ব্যবহার দিয়ে ঠান্ডা করলেন ডাক্তার ওদের। তারপর চাকা দেওয়া খাটটাকে ভেতরে নিয়ে যেতে বলেন। বিলি সঙ্গ নেওয়ার চেষ্টা করছিল, স্ত্রীর হাত ধরে থেকে। ডাক্তার ওকে থামান।
‘তুমি নয়।’ তিনি বাধা দেন, ‘ওকে এখন অতিরিক্ত যত্নে রাখা হবে। আলাদা করে বিশেষ ব্যবস্থার মধ্যে।’
নেনা দাকোন্তে স্বামীর দিকে তাকিয়ে হাসল। সরু গলির শেষপ্রান্ত অবধি, যতক্ষন তাকে দেখা গেল হাত নাড়ল। ডাক্তার পেছনে ছিলেন। ক্লিপ-আঁটা বোর্ডে নার্সের লেখা তথ্য পড়ছিলেন। বিলি স্যাঙ্কেজ তাঁকে জানাতে চায়, ‘ডাক্তারবাবু ও মা হতে চলেছে।’
‘কতদিন হল?’
‘দু’মাস।’
ডাক্তার তথ্যটাকে গুরুত্ব দেন না তত, যতটা বিলির ভেবেছিল।
‘বলে ভালো করেছো তুমি।’
খাটটাকে যেদিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেদিকেই চলে গেলেন তিনি। বিলি একা পড়ে রইল রুগী-রুগী গন্ধে ভরা দুঃখী ঘরটায়। বুঝে উঠল না, কি তার করনীয়। বার বার তাকায় গলিপথের শেষপ্রান্তে, যেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নেনাকে। একটা কাঠের বেঞ্চে বসে পড়ে শেষে। অন্যরাও সেখানেই বসে অপেক্ষা করছে। কতক্ষন তাকে এখানে বসতে হবে ধারনায় এল না কিছু। রাত্তির ঘুরে এসেছে আবার যখন, হাসপাতাল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিল ও। বৃষ্টি ঝরছে অবিরাম ধারায়। পৃথিবীর ভার যেন ঘাড়ে চেপে বসেছে। তবুও জানা নেই এখনকার করনীয়?
বছর কয়েক পরে, হাসপাতালের নথিপত্র থেকে জানা গিয়েছিল, নেনা দাকোন্তে জানুয়ারির সাত তারিখ, মঙ্গলবার, সকাল সাড়ে নটায় ভর্তি হয়েছিল। প্রথম রাতটা বিলি গাড়িতে ঘুমোল। গাড়িটা রাখাছিল জরুরী ব্যবস্থাপনায় ঢোকার মুখে। পরদিন খুব সকালে ছ’টা ডিমসেদ্ধ আর দু’কাপ কফি খায় ও সামনের কফিদোকানে। মাদ্রিদের ভোজের পর বিশেষ কিছু আর পেটে পড়েনি। তারপর গেল জরুরী রুগীদের ঘরে নেনাকে দেখতে। অতিকষ্টে হাসপাতালের লোকজন তাকে বোঝাতে পারল যে, সামনের বড় দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে। ভাগ্য ভালো একজন অস্তুরিয়া প্রদেশের মানুষ ছিলেন ওখানে। যোগাযোগের সুবিধে হল কিছু। হাসপাতালের থেকে এইটুকু জানা গেল যে, নেনা ভর্তি হয়েছে বটে, কিন্তু মঙ্গলবার ন’টা থেকে চারটের মধ্যে দেখতে আসতে হবে তাকে। আগামী ছ’দিনে মোটেই আর দেখাশোনার সম্ভবনা নেই। তখন বিলি স্প্যানিশ বলিয়ে সেই ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করবে ভাবল। একজন কালো মত, ন্যাড়ামাথা মানুষের বর্ণনা দিল ও। কিন্তু মাত্র এই দুটো তথ্য থেকে কেউ তাঁর সন্ধান দিতে পারে না।
নেনা দাকোন্তের নাম হাসপাতাল তালিকায় উঠেছে জেনে, নিশ্চিন্তে গাড়িতে ফেরে বিলি। একজন যানপরিচালক অফিসার দুটো বাড়ির পরে, গাড়ি রাখার নির্দেশ দিলেন তাকে। খুব সরু একটা রাস্তায়, জোড় সংখ্যার বাড়িগুলো যেদিকে, সেদিকে গাড়ি দাঁড় করাল ও। রাস্তা পেরিয়ে একটা সদ্য সারানো বাড়ি। সামনে লেখা রয়েছে ‘হোটেল নিকোলে’। এক তারার হোটেল। অভ্যর্থনা করার জায়গাটা বড়ই ছোট। একটা মাত্র সোফা আর পুরোন একটা পিয়ানো দিয়ে সাজানো। মালিকের কন্ঠস্বর বাঁশির মত সুরেলা, কিন্তু চড়া ভীষন। সব ভাষাভাষীর লোকের কথা বোঝে, যতক্ষন পকেটে পয়সা থাকে সে’ লোকের। বিলি স্যাঙ্কেজ এগারোটা সুটকেস আর ন’টা উপহারের বাক্স সমেত ন’ নম্বর তলের একমাত্র তিনকোনা ছাদেরঘরে ঠাঁই নেয়। সেখানে রুদ্ধ নিঃশ্বাসে উঠে আসতে হয়েছে তাকে, ফুলকপি সেদ্ধর গন্ধে ভরপুর একটা গোল সিঁড়ি বেয়ে। ঘরের দেওয়ালগুলো বিষন্ন দেওয়াল-কাগজে মোড়া। একটা জানলা, একেবারেই ব্যবহারের অযোগ্য। ভেতরের উঠোন থেকে মৃদু একটা আলো আসে ঘরের মধ্যে। আসবাব হিসেবে রয়েছে দুজনের খাট, বড় একটা আলমারি। একটা পিঠ সোজা চেয়ার, বয়ে নিয়ে যাওয়া যায় এমন কমোড, হাত ধোওয়ার বেসিন মগসহ। এই ঘরে থাকার মানে হচ্ছে, শুধুই শুয়ে থাকা। পুরোনর চেয়েও বাজে জিনিসপত্র সব, একদম হেলাফেলার। খুব পরিষ্কার যদিও আর ওষুধের গন্ধে ভরপুর।
বাকি জীবনটা এই ঘরে কাটাতে হয় যদি, বিলি সেই জগতের ধাঁধাটাকেই খুঁজে পাবে না, কৃপনেরা সহজে গড়ে তোলে যাকে। যেমন সিঁড়ির আলোর রহস্যটা কোনভাবেই ধরা যায় না। ওপরের তলায় পৌঁছোনর আগেই কি করে যে ওটা নিভে যেত। আর কখনই জ্বলত না। অর্ধেক সকাল খরচ করে বুঝতে হল বিলিকে যে, প্রতি তলের ওঠা-নামার সিঁড়ির মাঝখানে একটা ঘর রয়েছে স্নানঘর সহ। একবার চেন ধরে টানলেই জলে ধোওয়া হয়ে যায় ঘরটা। সে ঠিক করে ছিল অন্ধকারের মধ্যেই ব্যবহার করবে ওটাকে। তারপর হঠাৎ দেখল, দরজা ভেতর দিকে বন্ধ করলেই আলো জ্বলে ওঠে। তাই আবার করে সেটা নেভানোর কথা কেউ ভাবেনা। ঘরের শেষপ্রান্তের শাওয়ারটাকে দু’বারই ব্যবহার করা যাবে। নিজের দেশে তাইতো করে। এক একবারের জন্য যদিও নগদ পয়সা দিতে হবে।ক গরমজল আসে কলে, অফিস নিয়ন্ত্রিত উপায়ে। তিন মিনিটের মধ্যে চলেও আসে গরমজল। যথেষ্ট যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে বিলিকে বুঝতে হয়েছে ব্যাপারগুলো। তার দুনিয়ার থেকে এত আলাদা এ’সব। যাহোক, তবুও জানুয়ারি মাসের শীতে বাইরে ঘোরার থেকে তো ভালো। এতই বিভ্রান্ত ও এখন আর তেমনি একা। নেনার সাহায্য-সুরক্ষা ছাড়া কি ভাবে যে থাকবে ভেবে পায় না।
বুধবার সকালে হোটেলের ঘরে পৌঁছে, কোটপরা অবস্থাতেই ছুঁড়ে দিল নিজেকে বিছানাতে। সেই অনির্বচনীয় মানুষটার কথা ভাবছিল, দুটো বাড়ি পরেই রক্তে ভাসছে যে। ভাবতে ভাবতেই স্বতঃস্ফূর্ত ঘুমে ঢলে পড়ল। যখন জাগল ঘড়ি বলছে পাঁচটা। কিন্তু ও বুঝল না তখন সকাল নাকি বিকেল? কিংবা সপ্তাহের কোনদিন সেটা? অথবা কোন শহরে রয়েছে? জানলায় ওদিকে হাওয়া আর বৃষ্টির চাবুক আছড়াচ্ছে। কিছুই মাথায় এলনা। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে নেনার কথা ভাবতে থাকল। এক সময় বুঝতে পারে সকালই এটা। তখন প্রাতরাশ খেতে গেল আগের সেই কফিদোকানে। এবং জানতে পারল সেদিন বৃহস্পতিবার। হাসপাতালের আলোগুলো জ্বলছে। বৃষ্টি ওদিকে বন্ধ হয়েছে। ও করল কি, বড় দরজার কাছে চেষ্টনাট গাছের গুঁড়িতে ভর দিয়ে লক্ষ্য করতে থাকল, সাদা পোষাকের ডাক্তার নার্স যারা যাতায়াত করছে তাদের। যিনি নেনাকে ভর্তি করেছিলেন, সেই এশিয়ার ডাক্তারের দেখা পাওয়াই একমাত্র উদ্দেশ্য।
তাঁর দেখা কিন্তু মিলল না। দুপুরে খাওয়া শেষ হওয়ার পর, বিকেল পর্যন্ত সতর্ক নজরদারি চালিয়েও কিছুই হল না। এক সময়ে বাধ্য হল থামতে। প্রবল শীত জমিয়ে দিচ্ছে। ঘুমোনর জন্য হোটেলে ফিরে দেখে, রাস্তার একপাশে তার গাড়ি একা দাঁড়িয়ে। সামনের কাঁচে গাড়ি দাঁড় করানোর টিকিট মারা। বাকি সব গাড়ি রাস্তার অন্য দিকে। হোটেল নিকোলের একজন পাহারাদার অতি কষ্টে তাকে বোঝাল, বিজোড় সংখ্যার দিনে গাড়ি দাঁড় করানোর নিয়ম রাস্তার বিজোড় সংখ্যার বাড়ির দিকে। আর জোড় সংখ্যার দিনে ঠিক তার উলটো। এমন যুক্তিবাদী কৌশল, একজন খাঁটি রক্তের স্যাঙ্কেজ ডি আভিলার বোধবুদ্ধির বাইরে। বছর দুই আগে খোদ মেয়রের দপ্তরের গাড়ি নিয়ে, সিনেমায় গিয়েছিল বিলি। উৎকট এক শখ মেটাতে বেপরোয়া ভাবে চালাচ্ছিল সেটাকে। অথচ দুঁদে সব পুলিসেরা আশপাশেই ছিল সে’সময়ে। তার মাথায় বিষয়টা আরো ঢুকল না, যখন মাল বওয়ার লোকটা বলল, গাড়ি না সরিয়ে জরিমানা করা পয়সাটা দিয়ে দিতে। মাঝরাত পেরোলে গাড়িটা তো আবার এ পাশেই আনতে হবে। বিছানায় নিজেকে আছড়ে ফেলেও ঘুমোতে পারে না বিলি। এই প্রথম শুধুমাত্র নেনার ভাবনাই নয়, নিজের দুঃখের রাতগুলোও ভাবনায় আসে। ক্যারিবিয়ানে কার্টাগোনা বাজারের উজ্জ্বল মদের দোকান। বন্দরের রেস্টুর্যান্টে ভাজা মাছের আর নারকেল ভাতের স্বাদ, যেখানে আরুবার জলযান টহল দিত। বাড়ির কথাও মনে এল ওর। দেওয়ালগুলো প্যানসিফুলে ঢাকা। এখনও রাত শুরু হয়নি সেখানে, সাতটা বাজে সবে। মনের চোখে দেখতে পেল বাবাকে। সিল্কের পাজামা পরনে, খবরের কাগজ পড়ছেন ঠান্ডা চাতালে বসে।
মার কথাও মনে পড়ল। কোথায় যে থাকতেন তিনি কেউ কখনও বুঝে ওঠেনি। সময়কে গ্রাহ্যেই আনতেন না মোটে। সুন্দর, অবিরাম কথা বলা মানুষটা রোববারের বেশবাস পরে, কানের পাশে গোলাপ গুঁজতেন সন্ধেবেলায়। অপূর্ব বুননের পোষাকের মধ্যে যদিও হাঁসফাঁস দশা হত ওঁর। তার বয়স যখন সবেমাত্র সাত, মায়ের ঘরে দরজায় আওয়াজ না করেই ঢুকে পড়েছিল। বিছানায় বিবস্ত্রা মাকে খুঁজে পেল, তাঁর সে’সময়ের এক প্রেমিকের সঙ্গে। এই দুর্ঘটনার উল্লেখ কেউই করে না। কিন্তু সম্পর্কের ভেতরে জন্ম নিল এক জটিলতা। যার থেকে বেশ বোঝা যায়, ভালোবাসার থেকেও সম্পর্কবোধ জরুরী অনেক। বিলির সে’ব্যাপারে কোন সচেতনতা ছিল না তখন। প্যারিসের মন খারাপ করা এক চিলেকোঠা ঘরের রাতবিছানায় শুয়ে শুয়েই, খুঁজে পেল সে একলা শৈশবের দৈন্যকে। কেউ বলে দেয়নি তাকে দুঃখ কাকে বলে। নিজের ওপর জ্বলছিল সে প্রচন্ড ক্ষোভে, কারন ইচ্ছে করলেও এক বিন্দু কান্না আসছে না তার।
এই না-ঘুমের অসুখটা বেশ উপকারী। রাতের অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে, শুক্রবার বেরিয়ে এল সে বিছানা ছেড়ে। ঠিক করল নিজের অবস্থাটাকে একটু গুছিয়ে তুলবে। জামাকাপড় বদলাবার জন্য নাহয়, তালাই ভাঙবে সুটকেসের। সব কটা চাবি রয়ে গেছে নেনার ব্যাগে ওদিকে, আর তাদের বেশির ভাগ টাকাপয়সাও। ঠিকানা লেখা নোটবই, যার মধ্যে প্যারিসে থাকা পরিচিতের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। রোজকার কফিদোকানে ঢুকে বিলি বোঝে, ফরাসিতে সম্বোধন শিখে গেছে। হ্যাম স্যান্ডউইচ আর কফির কথা অনায়াসে বলতে পারে এখন। তবে মাখনের উচ্চারন জানে না। মাখন অবশ্য রুটির সঙ্গেই দেয়। আর শক্ত ডিমসেদ্ধ সামনে সাজানো থাকে। ওদের কথা না উচ্চারন করলেও চলবে। তাছাড়া তিনদিনে পরিচারকেরাও চিনে ফেলেছে তাকে। কথাবার্তা বুঝে নিয়ে সাহায্য করছিল, ফরমায়েস অনুযায়ী খাবার পরিবেশন করতে। শুক্রবার দুপুরে তাই বানমাছের টুকরো নিল আলুভাজা দিয়ে। সঙ্গে এক বোতল ওয়াইনও। এত ভালো লাগল নিজের আত্মবিশ্বাস দেখে, যে আরো একটা বোতল নিয়ে অর্ধেক খালি করে ফেলে। রাস্তা পেরিয়ে চলল তারপর হাসপাতালের দিকে। মনে দৃঢ় সংকল্প ওখানে ঢুকবেই। নেনাকে কোথায় পাওয়া যাবে জানে না। কিন্তু এশিয়ার ডাক্তারের চেহারা বৈশিষ্ঠ্য স্পষ্ট মনে আছে। তাঁকে খুঁজে বের করতে পারবে নিঃসন্দেহে। তবে সামনের দরজা দিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। জরুরী চিকিৎসার রুগীদের দিকে তুলনামূলক ভাবে পাহারা কম। সেই পথই ধরল বিলি। কিন্তু সরু গলিটার যেখানে গিয়ে হাত নেড়েছিল নেনা, সেই জায়গাটা পেরোন গেল না। একজন সাফাইওলা রক্তমাখা ন্যাতা হাতে, কিছু জিগ্যেস করল। তার দিকে ফিরেও তাকাল না বিলি। পেছনে হাঁটতে হাঁটতে লোকটা বার বার একই প্রশ্ন করছে ফরাসীতে। জবাব না পেয়ে শেষে সজোরে হাত চেপে ধরে থামায়। বিলি স্যাঙ্কেজ লোকটাকে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করল, চেনযোদ্ধার কেরামতিতে। সাফাইওলা নোংরা গালিগালাজ দেয় তার মার নামে। পেছন দিক থেকে মুচড়ে ধরে হাত। হাজার অশ্লীল গালাগালিতে বেশ্যার ছেলে বলে তাকে। টানতে টানতে দরজার কাছে নিয়ে যায়। যন্ত্রনায়-রাগে উন্মত্ত অবস্থায় ছুঁড়ে ফেলে দেয় রাস্তার মাঝখানে, এক বস্তা আলুর মত।
সেই বিকেলে বড় হয়ে উঠল, বিলি স্যাঙ্কেজ। শাস্তির যন্ত্রনা বিধ্বস্ত করেছে তাকে। এবং পরিনত। নেনার মতই বিচক্ষন সিদ্ধান্ত নেয় এবার। রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করবে। হোটেলের পরিচারক খুব অন্তরঙ্গ না হলেও, প্রচুর সাহায্য করল। তার ভাষার গন্ডগোলে অধৈর্য্য না হয়ে, টেলিফোন বই থেকে দূতাবাসের ফোন নম্বর-ঠিকানা খুঁজে বার করে, একটা কার্ডের পেছনে লিখে দিল। একজন ভীষন অমায়িক ভদ্রমহিলা ফোন ধরলেন। তাঁর কথা বলার বেরঙা ধীর-স্থির ধরনে বিলি বুঝে ফে্লে, তিনি আন্দিজের বাসিন্দা। নিজের পুরো পরিচয় দিল ও। দুই নামী পরিবারের উল্লেখ করল, যাতে চটজলদি কাজ হয়। টেলিফোনের কন্ঠস্বর তবু বদলায় না। তোতাপাখির ভঙ্গীতে ভদ্রমহিলা বলে যান। মহামান্য রাষ্ট্রদূত এই মুহূর্তে দপ্তরে নেই এবং কাল অবধি পাওয়া যাবে না তাঁকে। আগে থেকে যোগাযোগ করলে অবশ্য ঠিক সময়েই দেখা করবেন উনি, কিন্তু শুধুমাত্র বিশেষ প্রয়োজনে। বিলি বুঝে ফেলে এভাবে কাজের কাজ হবে না কিছু। ভদ্রমহিলাকে তাঁরি কায়দায় ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রেখে দেয়। তারপর একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে দূতাবাসে যাওয়ার জন্য।
২২ নং রুডেস চ্যাম্পস এলিসীস, প্যারিসের অন্যতম শান্তিপূর্ণ এলাকা। দূতাবাসের বাড়িটা ওখানেই। কিন্তু বিলিকে অভিভূত করল সেদিনের রোদ্দুর। ক্যারিবিয়ানীয় দিনের মতই উজ্জ্বল সেদিনটা। আইফেল টাওয়ারটা জ্বল জ্বল করছিল নীলিম আকাশের প্রেক্ষাপটে। রাষ্ট্রদূতের বকলমে যে সচিব দেখা করলেন, এমন ভাবে তাকালেন তিনি, যেন কোন মারাত্মক অসুখ থেকে সদ্য সেরে উঠেছে বিলি। কেবল মাত্র কালো স্যুট, বিধ্বস্ত কলার, করুন টাইয়ের জন্য নয়। আদালতে বিচারাধীন আসামীর মত চেহারা আর ভাঙা গলার আওয়াজের কারনেও। বিলি স্যাঙ্কেজের দুর্দশা দেখেও, বিচক্ষনতায় মনে করিয়ে দিলেন, যে এক অতি সভ্যদেশে রয়েছেন তাঁরা। বহু বছর ধরে, এ’ দেশে এক সুদৃঢ় নিয়ম শৃঙ্খলা গড়ে উঠেছে। এখানে বর্বর আমেরিকার মত ঘুষ দিয়ে, যেমন ইচ্ছে তেমন হাসপাতালে ঢোকা যায় না।
‘না ভাই, মোটেও এমনটা কোরো না।’
এতটা বলে আরো যোগ করেন, ‘সেই ফাঁকে তুমি বরং ল্যুভর মিউজিয়াম দেখে আসো। দেখবার মত জিনিস সেটা।’
সাক্ষাত শেষ হওয়ার পর, বিলি স্যাঙ্কেজ নিজেকে খুঁজে পেল প্লেস ডি লা কনকর্ড-এ। কি করবে বুঝে উঠল না। আইফেল টাওয়ার দেখে, সেটাকে এত কাছে মনে হল, যে নদীর পাড় ধরে হাঁটা শুরু করে দেয়। পরে বুঝল দূরত্ব আসলে অনেকটাই। তখন স্যেন নদীর পাড়ে বসে নেনাকে ভাবতে ভাবতে দেখছিল, একের পর এক বাষ্পে চলা নৌকো পুলের তলা দিয়ে চলে যাচ্ছে। ওগুলোকে দেখে মোটেই নৌকো মনে হয় না। চলমান বাড়ি যেন। লাল ছাদ, জানলায় ফুলের টব সাজানো, পাটাতনে সার দিয়ে জামাকাপড় মেলা। অনেকক্ষন ধরে একজন মাছ-ধরিয়ের দিকে চেয়ে থাকল ও, একটা নট-নড়ন-চড়ন ছিপসহ। আর স্থির হয়ে থাকা একটা বৈদ্যুতিক তার। কোন কিছু চলতে শুরু করবে এই অপেক্ষায় থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়ে বিলি। তখন ভাবে ট্যাক্সি ধরে হোটেলে ফিরবে। তৎক্ষনাৎ মনে পড়ে হোটেলের নাম-ঠিকানা কিছুই মনে নেই। প্যারিসের কোন জায়গায় সেটা, তাও জানে না। আতঙ্কে পাথর হয়ে গেল সে। প্রথম যে কফিদোকান পেল তাতে ঢুকে পড়ে, কনাগ চাইল একটা। ভাবনাটাকে গুছিয়ে নেওয়া দরকার। বার বার ভাবতে থাকল অবস্থাটাকে। আর দেওয়ালে ঝোলানো অসংখ্য আয়নার ভিন্ন ভিন্ন কোনে নিজেকে খুঁজে পেল, একা সন্ত্রস্ত। জন্মের পর এই প্রথম মৃত্যুর বাস্তবতাকে ছুঁয়ে দেখছে সে। কিন্তু দ্বিতীয় গ্লাস কনাগ খাওয়ার পর অনেকটাই ধাতস্থ লাগল। আর দূতাবাসে ফিরে যাওয়ার কথাটাও মাথায় এল। ঠিকানা লেখা কার্ডটা পকেট থেকে বার করেই চমকাল। উল্টো পিঠে হোটেলের নাম ঠিকানা ছাপানো রয়েছে। ঘটনা তাকে এতই নাড়া দিল যে, সারা সপ্তাহ ধরে ঘরের বাইরেই বেরোল না আর, একমাত্র খাওয়ার সময় ছাড়া। আরেক বার বেরোত গাড়িটাকে রাস্তার অন্যদিকে রাখার জন্য। তিনদিন ধরে একই ধরনের ঘিন ঘিনে বৃষ্টি সকাল থেকে। সারাদিন ধরে পড়তেই থাকে। বিলি যে কোনদিন একটা পুরো বই পড়েনি, ঠিক করল একঘেয়েমি কাটানোর জন্য এবার একটা পড়বে অন্ততঃ, বিছানায় শুয়ে শুয়ে। কিন্তু স্ত্রীর সুটকেস থেকে যেসব বই পেল, কোনটাই স্প্যানিশ ভাষার নয়। অতএব মঙ্গলবারের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে, সে দেওয়ালকাগজের ময়ূরগুলো দেখেই চলল মনোযোগ দিয়ে। আর সব সময় ভাবত নেনাকে। সোমবার ঘরটাকে ঠিকঠাক করে গুছিয়ে তোলে। এমন ছন্নছাড়া দশা দেখলে নেনা কি ভাববে? এসব ভাবতে গিয়ে চোখে পড়ে, সাদা মিঙ্ক কোটে রক্তের দাগ লেগে রয়েছে তখন। সারা বিকেল ধরে নেনার রাতব্যাগে পাওয়া সুগুন্ধি সাবান দিয়ে কোটটাকে ধুলো সে। যতক্ষন পর্যন্ত না সেটা আগের অবস্থায় ফেরে ততক্ষন।
মঙ্গলবার সকাল এল আকাশে মেঘের ভার আর বরফশৈত্য নিয়ে। বৃষ্টি ছিল না। বিলি সকাল ছ’টার থেকে হাসপাতালের দরজায় দাঁড়িয়ে। একগুচ্ছ রুগীর আত্মীয়দের ভীড়ে দাঁড়িয়ে রইল। কেউ কেউ তারা উপহার এনেছে। কেউ এনেছে ফুলের তোড়া।
ভীড়ের সঙ্গে সঙ্গেই চলল বিলি, হাতে সাদা মিঙ্ক কোট। কারুকে সে প্রশ্ন করছে না, অথচ তার কোন ধারনাই নেই নেনা কোথায় থাকতে পারে। মনের ভেতরটা বলছে এশিয়ার ডাক্তারের সঙ্গে আজ দেখা হবে। অন্দরমহলের একটা বিরাট চত্বর দিয়ে হাঁটছিল। ফুল আর বন্য পাখিতে সাজানো সে’ চত্বর। দু’ধার ধরে রুগীদের আবাসন, ডানদিকে মেয়েদের, বাঁদিকে ছেলেদের। অন্যদের দেখাদেখি সেও ঢুকে পড়ল মেয়েদের দিকে। লম্বা এক সারি ধরে, বিছানায় বসে আছে মেয়েরা। পরনে হাসপাতালের গাউন। জানলা দিয়ে আসা আলোয় তাদের উপস্থিতি জ্বল জ্বল করছে। তার মনে হল বাইরে থেকে উঁকি দেওয়ার চেয়ে, ভেতরে গিয়ে দেখা অনেক বেশি আনন্দের। হাঁটতে হাঁটতে শেষপ্রান্ত অবধি এসে, আবার ফিরে চলল। সে বুঝেছে নেনা এদের মধ্যে নেই। বাইরে বেরিয়ে এল তখন। ছেলেদের আবাসনের দিকে উঁকি দিয়ে খুঁজতে লাগল ডাক্তারকে।
দেখাও মিলল এক সময়ে। ডাক্তার একজন রুগীকে পরীক্ষা করছিলেন। আরো কিছু ডাক্তার-নার্স পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। বিলি ঢুকে পড়ে ভেতরে। একজন নার্সকে সরিয়ে সরাসরি সামনে দাঁড়ায়। ঝুঁকে পড়ে রুগী দেখছিলেন তিনি। প্রশ্ন করে বিলি তাঁকে। বিষন্ন চোখ তুলে তাকালেন ডাক্তার, এক মুহূর্ত ভাবলেন। চিনলেন তারপর, ‘হায় পোড়াকপাল! কোন জাঁহান্নামে ছিলে তুমি অ্যাদ্দিন?’
আতঙ্কে জমে গেল বিলি স্যাঙ্কেজ, ‘হোটেলে ছিলাম। এই তো এখানেই। ওইপাশে, কোনের দিকে।’
আর তখনি সে জানতে পেল, বৃহস্পতিবার, ৯ই জানুয়ারির সন্ধে সাতটা বেজে দশ মিনিটে, নেনা দাকোন্তে মারা গেছে অতিরিক্ত রক্তপাতে। ফ্রান্সের নামী-দামী ডাক্তারের ষাট ঘন্টা ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর, অবসন্ন হয়ে পড়ছিল নেনা। শেষ মুহূর্তে শান্ত আর নির্মল দেখাচ্ছিল ওকে। সকলকে বলছিল প্লাজা আথেনে-তে তার স্বামীকে খবর দিতে। ওখানেই ঘরভাড়া করা ছিল তাদের। বাবা-মাকে খবর পাঠানোর হদিশও দিয়েছিল। বিদেশমন্ত্রক থেকে জরুরী তার গেছে শুক্রবার দূতাবাসে। নেনার বাবা-মা তখন প্যারিস আসছেন প্লেনে। রাষ্ট্রদূত নিজেই গেলেন সান্ত্বনা দিতে। আর অন্তেষ্টি ক্রিয়াকর্মেও রইলেন। পুলিসের সঙ্গে যোগাযোগও রাখছিলেন, যাতে প্যারিসে বিলি স্যাঙ্কেজের খোঁজ পাওয়া যায়। শুক্রবার রাত থেকে রোববার বিকেল পর্যন্ত বিশেষ ঘোষনা প্রচার হচ্ছিল রেডিও এবং টেলিভিশানে। এই চল্লিশ ঘন্টা, ফ্রান্সে যাকে সবচেয়ে বেশি খোঁজা হয়েছে, সে হল বিলি স্যাঙ্কেজ। তিনটে বেন্টলে কনভার্টিবল-এর খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু কোনটাই বিলির নয়।
নেনা দাকোন্তের বাবা-মা শনিবার দুপুরে এসে পৌঁছোলেন। হাসপাতালের গির্জায় মৃতদেহ নিয়ে বসে ছিলেন, এই ভেবে যে শেষ মুহূর্তে হয়তো বিলিকে খুঁজে পাওয়া যাবে। বিলির বাবা-মাও খবর পেয়ে প্যারিসের দিকে রওনা হচ্ছিলেন। কিন্তু টেলিগ্রামের খবরটাই পুরোপুরি স্পষ্ট হয়নি ওনাদের কাছে। রোববার দুপুরে যখন অন্তিম ক্রিয়া চলছে, মাত্র দু’শো মিটার দূরত্বে বিলি তখন নেনার ভালোবাসা না ছুঁতে পারার একাকীত্বে বিদীর্ণ হয়ে শুয়ে আছে। বিলি স্যাঙ্কেজের সঙ্গে দূতাবাসের সচিব যিনি কথা বলেছিলেন, পরবর্তীতে জানিয়েছেন, বিলি তাঁর অফিস থেকে বেরোবার একঘন্টা পরেই বিদেশমন্ত্রকের তারটা এসেছে। আর সেটা পাওয়া মাত্র তিনি তৎক্ষনাৎ রু-ডু-ফবোর্গ-সেন্ট-অনার-এর সভ্যভব্য সমস্ত মদের দোকান খুঁজে বেরিয়েছেন। পরে একথাও কবুল করেছেন অবশ্য, বিলিকে বেশি পাত্তা দেননি উনি। সমুদ্র উপকূলের দেশ থেকে আসা, ভেড়ার লোমের কোটপরা ছেলেটা যে, প্যারিসের অভিনবত্বে ধাঁধিয়ে গেছে সেটা তিনি বুঝেছিলেন। তবে তার এমন সুবিখ্যাত পরিচয় রয়েছে, ধারনায় আনতে পারেননি।
ঠিক সেই রাতে সে যখন কান্না না আসার নিরুপায় কষ্ট সইছে, নেনার বাবা-মা ঠিক তখুনি তাকে খোঁজা বন্ধ করে, ওষুধ দিয়ে রাখা মৃতদেহ কফিনে ভরবার ব্যবস্থা করছেন। যারা দেখছিল ঘটনাটা, তাকাচ্ছিল বার বার। বহু বছরের ভেতর এত সুন্দর মেয়ে দেখেনি তারা জীবিত কিংবা মৃত। সুতরাং বিলি যখন মঙ্গলবারে হাসপাতালে ঢুকেছে, নেনার দেহ তার ঢের আগেই লা মাঙ্গার বিষন্ন সমাধিস্থলে জায়গা করে নিয়েছে। তাদের সুখের চাবিকাঠি যে বাড়িতে খুলেছিল, তার থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে এই সমাধিক্ষেত্র। এশিয়ার ডাক্তার পুরো দুঃসংবাদটাই জানালেন বিলিকে। ঘুমের কিছু ওষুধও দিতে চাইলেন। কথা কানে নিল না ও।
বিদায় না জানিয়ে, ধন্যবাদ না দিয়ে, বেরিয়ে পড়ল চুপচাপ। মনের ভেতর একটাই ইচ্ছে প্রবল, কারুকে একটা খুঁজে বার করে চেন দিয়ে থেঁতলে দেবে তার মগজ। এই মর্মান্তিক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার সেটাই হবে প্রতিশোধ।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে হাঁটছে বিলি, শুরু হল তুষারপাত। এমন আশ্চর্য ঘটনা অনুভবে এল না ওর আদৌ। তুষারে কোন রক্তনিশানা পড়ছে না এবার আর। নিচে নেমে আসা তুষারকনারা যেন ঘুঘুর পালক। অথবা প্যারিসের রাস্তায় বইছে এক উৎসবের হাওয়া। সবচেয়ে বড় তুষারপাত ঘটতে চলেছে, দশ বছরে প্রথম।
লেখক পরিচিতি : জয়শ্রী পাল
সরকারি চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত