তুঙ্গনাথের পথে ।। প্রথম পর্ব ।। দেওড়িয়া তাল ও চন্দ্রশীলা পর্বতশৃঙ্গ

লেখক: কৃষ্ণাশীষ রায়

যাত্রা হল শুরু …

দিন ১ :

হাওড়া থেকে ট্রেন, উপাসনা এক্সপ্রেস দুপুর ২টো।

দিন ২ :

ট্রেন লেট। হরিদ্বারে বিকেল ৪টার বদলে পৌঁছলাম রাত ৯টায়। হোটেলে যাওয়ার পথে অটো বিষ্ণু ঘাটের কাছে নামিয়ে দিল। তারপর পায়ে হেঁটে মা গঙ্গার উপর দিয়ে ব্রিজ পেরোলাম। রাতের গঙ্গার নৈসর্গিক দৃশ্য আর হিমেল হাওয়া ২ দিনের ট্রেন যাত্রার সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে দিল।|

দিন ৩ :

আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। হরিদ্বার থেকে সকাল ৮:৩০ টা নাগাদ আমাদের গাড়ি ছাড়ল। আমাদের গন্তব্যস্থল হরিদ্বার থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরে সারি গ্রাম। রাস্তায় আমরা একে একে পেরোলাম দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, অগস্ত্যমুনির আশ্রম। সারি পৌঁছতে আমাদের লাগল ৮ ঘন্টা। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট এই গ্রাম থেকেই রাস্তা চলে গেছে দেওড়িয়া তালের দিকে, মাত্র ৩ কিলোমিটার, দেবদারু, সিলভার ফার, ম্যাপেল, পেন্সিল সিডার আর কুয়াশায় মোড়া সেই রাস্তা। দেওড়িয়া তাল পৌঁছলাম তখন বিকেল ৫:৩০ বেজে গেছে। আমাদের তাঁবু খাটানোই ছিল। সঙ্গে যা মালপত্র ছিল তা রেখে, গেলাম টিফিন করতে রাম সিং-এর রান্নাঘরে। এখানে বলে রাখি সারিতে আমাদের আগে থেকেই যোগাযোগ করা ছিল রাম সিং-এর সঙ্গে।

তার থেকে আমরা ২ জন পোর্টার সঙ্গে নিয়েছিলাম। খেয়ে তাঁবুর কাছে ফিরে আকাশের দিকে চাইতেই শিহরণ খেলে গেল। শত সহস্র তারামণ্ডল এক ফালি চাঁদ আর তার মাঝে দাঁড়িয়ে চৌখাম্বা, ত্রিশূল, সুমেরু ইত্যাদি সুউচ্চ শৃঙ্গগুলি। সামনে দেওড়িয়া তালের জল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। আর তারই মাঝে আমাদের সবুজ তাঁবুর ভেতরের আলোগুলো জোনাকির মতো মিটমিট করছে। এই অপার্থিব দৃশ্য ভাষায় বর্ণনা করার মতো লেখনী আমার নেই। রাতে  রাম সিং-এর রান্নাঘরে খিচুড়ি খেয়ে তাঁবুতে শুয়ে পড়লাম। চারপাশের জঙ্গল যে পুরোপুরি নিরাপদ তাও বলা যাবে না। কেননা মাঝেমধ্যেই তাঁবুর ভেতর থেকে সিকিউরিটি গার্ডের টর্চের তীব্র আলো আর সঙ্গে ভাঙা গলায় “ডাইনেকে জঙ্গল মে কি মত্ জানা” সতর্কবাণী ভেসে আসতে লাগল। বাইরে তাপমাত্রা ২ – ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাঁবুর বাইরে শেয়ালের ডাক, সিকিউরিটি গার্ডের বাঁশি, টর্চের আলোর চলচ্চিত্র দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম |

দিন ৪:

দিনের শুরুটা ভালোই হয়েছিল, প্রকৃতির কোলে প্রাতঃকৃত্য সেরে, ওয়াচ টাওয়ারে উঠে নানান পাখি দেখে অজস্র ছবি তুলে ও ছায়া সহযোগে আলুর পরোটা গলাধঃকরণ করে। দেবাদিদেব হয়তো উপরে বসে হাসছিলেন আর বলেছিলেন, আমাকে অত সহজে পাওয়া যায় না। দেওড়িয়া তাল থেকে সেদিনের যাত্রা আমাদের চোপ্তা ভ্যালি পর্যন্ত, মাঝপর্বে রোহিনী বুগিয়াল, মোট দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। এটুকু ছিল কাগজে কলমের হিসেবে। সকাল ৮:৩০ টায় দেওড়িয়া তাল থেকে রওনা হলাম আমরা ৯ জন সঙ্গে ১ জন পোর্টার। বাকি মালপত্র আমরা গাড়িতে করে চোপ্তায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে ওপর পোর্টারকে বিদায় দিয়েছিলাম। ঘণ্টা দুই হাঁটার পরই এলো প্রথম ধাক্কা, বৃষ্টি। কোনোরকমে গায়ে বর্ষাতি চড়িয়ে আবার হাত লাগলাম।

চলতে চলতে শুনলাম পোর্টার এর থেকে যে রাস্তা মোটেই ১৪ কিলোমিটার নয়। ওটি ২২ কিলোমিটার, দ্বিতীয় ধাক্কা। রাস্তার বর্ণনা পাঠকগণ ছবির মাধ্যমেই দেখে নেবেন। ঘন জঙ্গল, ভালুক, চিতা সবেরই পায়ের চিহ্ন ফেলে আমরা এগিয়ে চললাম। ইতিমধ্যে বৃষ্টি খানিকটা ধরেছে। রোহিনী বুগিয়ালে এসে একটাই জলের উৎস, পাহাড়ি ভাষায় যাকে বলে ‘ঝোড়া’ নেমে এসেছে। বোতলে জল ভোরে আমরা সঙ্গের আলুর পরোটাগুলো শেষ করতে সবে শুরু করেছি সঙ্গে সঙ্গে আবার তেড়ে বৃষ্টি। পরোটা, আচার, বৃষ্টির জল মাখামাখি হয়ে যে মুখরোচক পদার্থচটি তৈরি হল তাড়াতাড়ি তা শেষ করে আমরা পা চালালাম। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম চোপ্তা ভ্যালি। পা অসাড়, হাতে কোনো সাড় নেই, কোনোএক্রমে মঙ্গল সিং-এর হোটেলে ঢুকে ২টো কম্বল ও ২টো লেপের ভেতর শরীরটাকে সেঁধিয়ে দিলাম। বাইরের তাপমাত্রা -১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

ক্রমশ …


লেখক পরিচিতি: কৃষ্ণাশীষ রায়

কৃষ্ণাশীষ রায় একজন ভ্রমণ পিপাষু মানুষ। তিনি দেশে-বিদেশে ঘুরতে এবং সেই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখালিখি করতে ভালোবাসেন।

আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< তুঙ্গনাথের পথে ।। শেষ পর্ব ।। আজ কনকচৌরির কার্তিকস্বামী মন্দিরতুঙ্গনাথের পথে ।। দ্বিতীয় পর্ব ।। আজ সারাদিন তুঙ্গনাথে >>
শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।