তুঙ্গনাথের পথে ।। তৃতীয় পর্ব ।। চন্দ্রশীলা – উচ্চতা ৪১০০ মিটার

লেখক: কৃষ্ণাশীষ রায়

পূর্ব কথা : কলকাতা -> হরিদ্বার (রাত্রি যাপন) -> সারি গ্রাম… দেওরিয়া তাল (রাত্রি যাপন) -> চোপ্তা (রাত্রি যাপন) -> তুঙ্গনাথ (রাত্রি যাপন)।
পূর্বকথা নিয়ে বেশি কথা না বাড়িয়ে আপনাদের অবগতির জন্য উপরের এই ছোট নোটটি দিয়ে রাখলাম — আমাদের এখন পর্যন্ত যাত্রাপথ…

দিন ৬ : সত্যি বলছি, আপনারা যেমন গত এক সপ্তাহ অপেক্ষা করেছেন কখন আমরা ষষ্ঠ দিনে চন্দ্রশীলার উদ্দেশ্যে রওনা হবো অথবা গত রাতের ভয়াবহ দুর্যোগের পরে আমরা আদৌ রওনা হতে পারব কিনা, এই একই কারণে ৬ ঘন্টার রাত্রি আমাদের কাছে ৬ দিনের সমান মনে হচ্ছিলো | সময় যেন কাটতেই চাইছিলো না উৎকণ্ঠায়।

আমাদের তুঙ্গনাথে থাকার জায়গা। চিত্রগ্রহণ : লেখক।

ঘুম ভাঙলো দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে। পাশের ঘরের লোকেরা আমাদের আগে উঠে পড়েছিল। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম আশংকা অমূলক নয়, আকাশের মুখ ভার, সঙ্গে ইলশেগুঁড়ি। আমাদের সামনে তখন দুইটি রাস্তা, এক — ট্রেক র পরিকল্পনা বাতিল করে পরের 8-৫ ঘন্টা আরামে কাটিয়ে চোপ্তার দিকে রওনা দেওয়া। তাতে আরও ২ ঘন্টা ঘুম দিয়ে শরীর চাঙ্গা করে, পর্যাপ্ত সময় নিয়ে প্রাতরাশ সেরে চোপ্তা র দিকে রওনা দেওয়া যাবে। দুই — আকাশের দুর্যোগ অঘ্রাজ্য করে নিজেদের মনোবলকে সঙ্গী করে পরের ৪ ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসতেই হবে, এই ডেডলাইন মাথায় রেখে চন্দ্রাশিলার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া। আশ্চর্যভাবে আমাদের দলের কেউই বসে থাকতে রাজি হল না, এই সুযোগ তো আর বারবার আসে না, দেখাই যাক-না কতদূর যেতে পারি। এটাই বোধ হয় পাহাড়ের টান, যেটা আমাদের সবার উপরে প্রভাব বিস্তার করেছিল।

চিত্রগ্রহণ : লেখক।

আমরা হাঁটা শুরু করলাম, তখন ঘড়িতে সোয়া পাঁচটা। ঝিরঝিরে বৃষ্টি, আমাদের পরনে রেইনকোট হাতে লাঠি। আমার হাতে অবশ্য কোনো লাঠি ছিল না, কারণ ছবি তুলতে হবে, আর লাঠি, ক্যামেরা একসঙ্গে বহন করা কঠিন। আমার কোনো অসুবিধা হয় না কেননা আমি প্রায় সব ট্রেকেই লাঠি ছাড়াই হাঁটি। শুরুর দিকটা খানিকটা বেশ উঁচুনিচু পাথুরে জমির উপর দিয়ে কখনও হামাগুড়ি কখনও বসে স্লাইড করে চলতে হল আমাদের। বৃষ্টিটা আবার একটু বাড়ায় ক্যামেরা ঢুকিয়ে রাখতে হল। এইভাবে মিনিট চল্লিশ যাওয়ার পর অনুভব করলাম বাতাস হালকা হতে শুরু করেছে। সবাই হাঁটার গতি কমালাম। এইবারে সামনের দৃশ্যপট সিনেমার মতো বদলাদে শুরু করল। বৃষ্টি উধাও, দূরে সূর্যের রক্তিমাভা দেখা যাচ্ছে, আর সেই আলোয় পাহাড়ের চুড়োগুলি তাদের রং পরিবর্তনের খেলা শুরু করে দিয়েছে। এতক্ষণ মাথা উঁচু করে সেই নৈসর্গিক সভা দেখছিলাম, এবারে চোখ পড়ল সামনের দিকে, পাথুরে রাস্তা শেষ, সামনে গালিচার মতো বিস্তৃত তৃণভূমি বা “Meadows”, আর সেই তৃণভূমিতে ফুটে কত নাম না-জানা ফুল। সত্যি, ভাগ্য সাহসীদেরই সঙ্গে দেয়, এই আপ্তবাক্যটা মনে পড়ে গেল। অবশ্য এর মধ্যে একটা মুশকিল হল, আমাদের দলের একজনের উচ্চতাজনিত কারণে শরীর খারাপ দেখা দিল। আমাদেরই দলের কিছু লোক, তারা আমাদের আগে বেরিয়েছিল, চন্দ্রশীলা ছুঁয়ে নিচে ফিরছিল, তাদের সঙ্গে সেও নেমে গেল।

চিত্রগ্রহণ : লেখক।

আমরা বাকিরা এগোতে থাকলাম। সকাল পৌনে সাতটা নাগাদ পৌঁছলাম চন্দ্রশীলা চূড়োয়। সত্যি, নিজেদের ক্ষুদ্রতা নিজেদের কাছেই ধরা দেয় যেন এইসব জায়গায় এলে। কোটি কোটি বছর ধরে পাহাড়গুলি একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে সদম্ভে মাথা উঁচু করে। মান, অভিমান, অহং কোথায় যেন ফুৎকারে মিলিয়ে যায় এদের দর্শনে। মিনিট কুড়ি এভাবেই কেটে গেল। কোথায় বৃষ্টি, কোথায় মেঘ, আকাশ তখন ঝলমল করছে সূর্যের কিরণে। প্রকৃতি যেন তার সবচেয়ে মূল্যবান উপহারগুলি সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিল মেঘ বৃষ্টির আড়ালে, শুধুমাত্র আমাদেরই জন্য। না-এলে যে কী অপসোসটাই-না থাকত।

চিত্রগ্রহণ : লেখক।

চন্দ্রাশিলায়ও একটা মন্দির আছে শিব-বিষ্ণুর। তাছাড়া একটু দূরে একটা পাথরের উপর একটা চার-মুখওয়ালা শিবের মূর্তি আছে। উপকরণ দেখেই বোঝা যায় যে এখানে নিয়মিত পুজো হয়। পৌনে আটটা নাগাদ আমরা আবার নিচে নামবার জন্য প্রস্তুত হলাম। একই রাস্তা, সুতরাং আর নতুন করে বর্ণনা দিলাম না, বরং নামার সময় আর বৃষ্টি পাইনি আমরা, তাই নামাটা উপরে ওঠার তুলনায় আরামদায়ক লাগল।

তুঙ্গনাথে ফিরে চা জলখাবার খেয়ে চোপ্তার উদ্দেশ্যে নামার পালা। আমরা ক’জন পায়ে হেঁটেই যাওয়া স্থির করলাম, বাকিরা খচ্চরের পিঠে। তুঙ্গনাথে উঠবার সময় যেমন রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া পেয়েছিলাম, নামার সময় তেমনটা পেলাম না। কিছুদূর যেতেই সেই একঘেয়ে ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হল। তা যাইহোক, একই রাস্তায় দুই সময়ে দু-রকম দৃশ্য দেখাটাও মন্দ লাগল না।

ফোকলা বুড়ো গাছ। চিত্রগ্রহণ : লেখক।
উচ্ছলতা যেন ছলকে পড়ছে। চিত্রগ্রহণ : লেখক।
কুয়াশায় বৃষ্টিতে মোরা তুঙ্গনাথের রাস্তা। চিত্রগ্রহণ : লেখক।

নেমে এলাম চোপ্তায়, মঙ্গোল সিং-এর ডেরায়, যেখান থেকে আমাদের যাত্রা শুরু করেছিলাম | এবার গাড়িতে ওঠার পালা। পরের গন্ত্যব্য কনকচৌরি। সেখানকার দ্রষ্টব্য কার্তিকস্বামীর মন্দির। সেটা শোনাব পরের শনিবার, লেখাটা একটু গুছিয়েনি, কী বলেন!

ক্ৰমশ…


লেখক পরিচিতি: কৃষ্ণাশীষ রায়

কৃষ্ণাশীষ রায় একজন ভ্রমণ পিপাষু মানুষ। তিনি দেশে-বিদেশে ঘুরতে এবং সেই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখালিখি করতে ভালোবাসেন।

আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< তুঙ্গনাথের পথে ।। দ্বিতীয় পর্ব ।। আজ সারাদিন তুঙ্গনাথে

2 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

রুচিশীল ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনার জন্য ক্লিক করুন এখানে

sobbanglay forum