একটু শুনবেন!

লেখক: অয়ন মৈত্র

ঠাকুমা যেদিন মারা গেলেন সেই দিন বিকেল থেকে মা কেমন যেন হয়ে গেল। সারাদিন থম মেরে বসে থাকে আর মাঝে মাঝে আমায় ডেকে বলে -“দেখ দেখ মা কেমন হাসছে।” আমি, বাবা কেউই মা’কে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না যে আম্মা আর নেই। ঠাকুমাকে আমি আম্মা বলতাম। অনেক অনেক সাইকিয়াট্রিস্ট দেখালাম। সবাই বললেন- “মেজর প্যানিক আ্যটাক। এর চিকিৎসা তো সেইভাবে নেই। কেবল ওনাকে ভাবতে দিলে চলবে না। যতটা সম্ভব ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হবে।” হাই ডোজের সিডেটিভ নিয়ে মা আমার সারাদিন ঘুমিয়েই থাকত।

এক পরিচিত খবর দিলেন অন্য এক সাইকিয়াট্রিস্টের যিনি নাকি এই প্যানিক আ্যটাকের চিকিৎসায় অব্যর্থ। নিয়ে গেলাম মা’কে। উনি কেবল আধ ঘন্টা ধরে মা’কে প্রশ্নই করে গেলেন। ঠাকুমার সাথে মায়ের সম্পর্ক নিয়েই বেশি। আমি শুনছিলাম চুপ করে। সব শুনে দুটো মাত্র ওষুধ লিখে দিয়ে বললেন – “বই পড়বেন না। খালি গান শুনুন। আবার দেখা করবেন ছ মাস বাদে।” একেবারে রেডিও কিনে বাড়ি ঢুকলাম সেদিন।

ছ’মাস বাদে মাকে নিয়ে গেলাম যখন মা নিজেই হেসে কথা বলতে শুরু করল ডাক্তারবাবুর সাথে। উনি মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রথম প্রশ্নই করলেন – “কেমন আছেন মিসেস মৈত্র?” “অনেকটা ভাল। ছেলে একটা রেডিও কিনে দিয়েছে। ওতেই সারাদিন গান শুনি। সবই অবশ্য এখনকার গান শোনায়। ছেলেকে বলেছি নিজের পছন্দ মত গান শোনা যায় এমন কিছু পাওয়া যায় কিনা। ছেলে বলেছে এনে দেবে।” মা টানা বলে গেল। আরও দু একটা কথা বলে উনি বললেন – “ওষুধ যা ছিল তাই থাকবে। দেখবেন বাড়িতে আপনার ঠাকুমা নিয়ে যেন কোন কথা এখন ওনার সামনে না ওঠে। উনি অনেকটা ইম্প্রুভ করেছেন। বাকিটাও হয়ে যাবে আস্তে আস্তে। পারলে কোথাও থেকে ঘুরে আসুন আপনারা।” “তাহলে আবার কবে আসব?” আমি জিগেস করলাম। “আসুন না মাস ছয়েক পর।” হাসতে হাসতে বললেন উনি।

ছয়মাস বাদে যেদিন ওনার আ্যপয়েন্টমেন্ট পেলাম তার তিনদিন আগে আনন্দবাজরে এক কোনায়
একটা খবরে পড়লাম কোলকাতার এক মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ মালদায় ট্রান্সফার হয়ে যাওয়ার কারণে মানসিক অবসাদে হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করেছেন। নামটা – আমার মা যাঁকে দেখান তিনি। সেদিনের কাগজটাই আমি গায়েব করে দিলাম। বাড়িতে বাবাকে নিউজ চ্যানেলও চালাতে দিইনি। রাতে শুতে যাওয়ার আগে মা আমায় বলল – “জানিস, যে ডাক্তারবাবুকে দেখাতাম ওনার মতোই ওই একই নামের এক ডাক্তারবাবু আত্মহত্যা করেছেন। রেডিওয় শুনলাম। তুই একটু দেখতো আমার ডাক্তারবাবু নয়তো?” আমি বললাম “আরে দূর! একই নামের একই পেশার কত লোক আছে তুমি জানো? যাও এখন। ঘুমোতে যাও”। পরদিন সকালে আবার যখন ডাক্তারবাবুর সেক্রেটারিকে ফোন করলাম। উনি প্রথম কথাটাই বললেন – “ডাক্তারবাবু নেই। উনি সুইসাইড করেছেন।” আমি ফোনটা রেখে মাকে বললাম – “ডাক্তারবাবু আর এখন এখানে বসবেন না। ওনার সেক্রেটারি আ্যপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করে দিয়েছেন।” মা শুনে খালি বলল – “ও”। তারপর নিজের ঘরে চলে গেল।

শরীরটা বিশেষ ভাল ছিল না বলে স্কুলে যাইনি। আগের দিন স্কুল করে পড়িয়ে বাড়ি ফিরতে রাত এগারোটা বেজে গেছিল। আজ তাই ছুটি নিলাম একটু বেলা করে উঠব বলে। ঘুম থেকে উঠেছি সবে দেখি ফোন বাজছে। এক ছাত্রী ফোন করছে। ফোন ধরতেই ওপার থেকে কান্না কান্না গলায় ও বলল – “স্যার! হাবিব সুইসাইড করেছে কাল রাতে। আপনাকে ফোনে পাচ্ছিলাম না। এখন পেলাম তাই জানালাম। পারলে স্কুলে চলে আসুন স্যার।”

কাল রাত যখন ১০টায় পড়িয়ে উঠলাম ওই আমাকে বাসে তুলে দেয়। স্কুলে গিয়ে শুনলাম সকল টিচিং স্টাফ ওর বাড়ি গেছে। কেবল আমি যাইনি। বাকি স্টুডেন্টদের সাথে কথা বলে জানলাম বাবার সাথে রাতে বাইক কিনে দেওয়া নিয়ে প্রবল কথা কাটাকাটি হয়। বাবার বক্তব্য ছিল টেস্ট পরীক্ষা শেষ হলে তারপর কিনে দেবে। ওর বক্তব্য ছিল সাতদিন ও অপেক্ষা করতে পারবে না। ওর কালকের মধ্যেই চাই। বাবা রাজি হয়নি। স্কুল সেদিন হয়নি। ছুটি হয়ে গেছিল।

আজ মনে পড়ছে এ কথাগুলো। কি কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে তা নিয়ে দিস্তা দিস্তা গবেষণা আছে। আমার কেবল মনে হয় – একটাই কারণে মানুষ নিজের ইতি টেনে দেয় নিজেই – সেটা এক আকাশ অভিমান। ডিপ্রেশন, মানসিক অবসাদ সব গিয়ে ওই একটা বিন্দুতেই মেশে – অভিমান। হঠাৎ বাবার একটা কথা, প্রেমিকার একটা মেসেজ, স্যারের একটা ঠাট্টা ভেতরটা একবারে চুর চুর করে ভেঙে দেয়। এর সাথে যোগ হয় – এই এক অলকানন্দা অভিমানটাকে ভাগ করে নেওয়ার মত কেউ পাশে না থাকা। ভরসাযোগ্য কেউ না থাকা।

মনোবিদরা সকলেই বলেন ভরসাযোগ্য কারও পাশে থাকাটা জরুরি যাকে মন খুলে সবটা বলা যায়। আমার মনে হয় এই ধারণাটায় একটা বেসিক ভুল আছে। পাশে থাকা আসলে কোন পাশে থাকা বোঝায়? ডানদিকে দাঁড়ালে বাঁদিক, বাঁদিকে দাঁড়ালে ডানদিক। যেদিকেই দাঁড়াই একটা পাশ সর্বদা খালিই তো থেকে যায়। দাঁড়াতে হলে বরং পেছনে দাঁড়াও। হেরে যাওয়ার আগে মানুষ ঐ দিকটাইতেই তাকায় সবচেয়ে বেশি। ভেঙে পড়বার আগে আমরা সকলেই ওই একটা দিকেই তাকিয়ে খুঁজি কেউ দাঁড়িয়ে আছে কিনা… যে বলবে কম। কেবল শুনবে…শুনবে…শুনবে। আমি হৃদয় নিংড়ে দিয়ে তাকে বলে যাব আর সে খালি আগলে রেখে, আকুলভাবে আমার বলা প্রতিটা শব্দ, অক্ষর মন দিয়ে শুনবে। শুধু শুনবে না, যত্ন নিয়ে শুনবে। আমরা মোটিভেশন এর কথা বলি। কিন্তু মোটিভেশন এর দৌড় কতটা? একটা সাডেন ইমপাল্স আমার তিল তিল করে অর্জন করা সমস্ত মোটিভেশন এক মুহূর্তে দুমড়ে মুচড়ে রাস্তায় ফেলে দিতে পারে। তাই আমার ছাত্র একটা রাতও বাবাকে সময় দিল না। আমার মায়ের ওই চিকিৎসক সবাইকে সুস্থ করলেন। কেবল নিজেকে কারো হাতে সঁপে দেওয়ার মত খুঁজে পেলেন না।

এরকম কত মানুষ রোজ তিলে তিলে শান্ত করে নিজেকে নিজের আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে তার নথি আমরা খবরে দেখি। দেখে আবার ছেলেকে বলি – “তোর মত মাথা মোটা আমি জন্মে দেখিনি! হ্যাঁরে! এতটা ছাগল হতে তোর একটুও লজ্জা করে না!” খবরে শুনি আমরা কেউ একজন সুশান্ত হয়ে গেল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে না পেরে। তারপর রাতে ঝগড়া হলে মেসেজ পাঠিয়ে শুতে যাই- “তোমার সাথে থাকতে আমার ঘেন্না করে। জাস্ট ঘেন্না করে।” কথায় আর কাজে আজ অবধি কোন মানুষ সর্বদা সবক্ষেত্রে মিল রাখতে পারেনি, কারন মানুষ কথা বলে। আমরা বলতে ভালবাসি। বলতে বলতে আশা করতে শুরু করে দিই। বলতে বলতে প্রমিস করি ফেলি আগল না রেখেই। তাই ভালবেসে বিয়ের প্রমিস করি। আশা ক্রমশ প্রত্যাশা হয়ে যায়। অথচ প্রমিস হয়ে যায় ঠাট্টা। এ সমস্ত কমা বাড়া চলে অবশ্য আমার দিক থেকে। উল্টোদিকটা আমরা কোনদিনই খেয়াল করিনা। করিনা বললে ভুল বলা হয়। খেয়াল করা হয়ে ওঠে না।

প্রতিটা স্কুলের ক্লাসে ক্লাসে, প্রতিটা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ঘরে আমরা কেউ কোনদিন কোন ছাত্র কোন ছাত্রীর পাশে দাঁড়াই কিন্তু পেছনে দাঁড়াতে পারি না। সময় লাগে… অনেকটা সময় লাগে তার জন্য। ভরসা একটা বড় ইমারত যেটা তৈরি হয় সবথেকে সস্তা মেটেরিয়ালে – বিশ্বাস। বহুদিনের বিশ্বাস জমে তবে এক আকাশচুম্বী ভরসা তৈরি হয়। কিন্তু সস্তা উপাদানে তৈরি যেকোনো জিনিষেই যা হয়, এখানেও তাই হয়। অল্প আঘাতেই হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ে। আমরা সকলেই trustworthy হতে চাই, faithful হতে নয়। তাই স্কুলের ম্যাডাম, অফিসের কলিগ, কোচিং এর বন্ধু, ফেসবুক ফ্রেন্ড এবং বাবাকে সবটা উজাড় করে বলতে পারি না। ওটা বলা যায় ডায়রিকে, ওটা বলা যায় শেষ লেখা চিঠিতে যে কেবল অবিশ্রান্তভাবে আমার কথা শুনবে সেটাও অতল মনোযোগে। যে কোন নির্বাক বস্তুই সবথেকে বিশ্বস্ত হয়। ঈশ্বর নির্বাক বলেই বোধহয় আমরা জীবনের সবথেকে বেশি বিশ্বাসটা ওখানেই রেখেছি। উথাল পাতাল হওয়া মনটাকে বিন্দু বিন্দু করে ওনার পায়ে ঢেলে দিতে পারি।


3 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন