লেখক: কৃষ্ণাশীষ রায়
আচ্ছা স্বপ্নের কি কোনো ছবি তুলে রাখা যায়? নাকি স্বপ্নের ছবি শুধুই স্বপ্নে মিলিয়ে যায়! স্বপ্নের ছবি তুলে না রাখা গেলেও কিছু কিছু খণ্ডচিত্র ধরা থাকে আমাদের মস্তিষ্কের জটিল রসায়নে। কিন্তু এই ভারতেই এমন জায়গা আছে, যেখানে গেলে মনে হতেই পারে জায়গাটি কোনও স্বপ্নের থেকেই তুলে আনা। তখন কিন্তু নিঃসন্দেহেই ক্যামেরায় সেই স্বপ্নের ছবি তোলা যায়। সিকিম তথা ভারতের একমাত্র সংরক্ষিত লেপচা অঞ্চল জংগু-এর ৪৫টা গ্রামের একটা হল স্বপ্নের উপত্যকা তিংভং। যেমন রোমাঞ্চকর যাত্রাপথ, তেমন রোমান্টিক পরিবেশ, ঠিক যেন স্বপ্নের মতো।
অসংখ্য ঝরনা, জলপ্রপাত, লেক, গা ছমছম করা জঙ্গল, পাখি, প্রজাপতি, অর্কিড আর কিছু অসাধারণ ছবির মতো সরল সুন্দর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেপচা গ্রাম নিয়ে উত্তর সিকিমের জঙ্গু উপত্যকা। কাঞ্চনজঙ্ঘা বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ সম্প্রতি ইউনেস্কোর ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তিংভং গ্রামটার একের তিন ভাগ ঘিরে রেখেছে কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ। মাঝে ঘাড় উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মাউন্ট পান্ডিম। চারিদিকে অর্কিড, পাহাড়ি ফুল, প্রজাপতি ও অসংখ্য পাখি, গ্রামটাকে প্রকৃতি দিয়েছে ঢেলে। প্রধান আয় চাষবাস। সকাল থেকে রাত্তির অবধি যা খাবেন…ভাত, ডাল, আলু, পেয়াঁজ, লংকা, কপি, বেগুন, মুলো, পালং, লেবু, পেয়ারা, মাংস (শুয়োর, মুরগি), দুধ — সবই এই গ্রামেই চাষ ও ফার্মিং। আর রকমারি অর্গানিক ফুড। এমনকি দেশি পানীয় অবধি ভেষজ পদ্ধতিতে। প্রধান রোজগার এলাচ আর দারচিনি। অর্কিড ও প্রজাপতি বিশেষজ্ঞ যদি হন, তা হলে তো কথাই নেই। দু’দিন এমনি এমনি কেটে যাবে।
তিংভং পৌঁছতে হলে শিলিগুড়ি থেকে শেয়ার জীপে সিংতাম যেতে হবে। সিংতাম-এ কিছু খাওয়াদাওয়া করে আবার একটা শেয়ার গাড়ি ধরে মঙ্গন। ছবির মতো সাজানো পাহাড়ি ছোট্ট শহর। উত্তর সিকিম এর ডিস্ট্রিক্ট হেডকোয়ার্টার হল এই মঙ্গন, রাজধানী গ্যাংটক থেকে মাত্র ৬৫ কি.মি দূরে। উত্তর সিকিম এর লাচেন, লাচুং, ইয়ুমথাং, গুরুদংমার-এর মতো প্রখ্যাত জায়গাগুলি যাওয়ার প্রবেশ পথ হল এই মঙ্গন শহর। পর্যটককে জঙ্গুতে ঘুরতে যেতে হলে মঙ্গন থেকে Inner Line Permit নিতে হবে। Inner Line Permit পেতে গেলে মূল পরিচয়পত্র এবং চার কপি ফটো লাগবে, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে স্কুলের ID কার্ড নিয়ে যেতে হবে।
মঙ্গনে পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে। তিংভং পৌঁছনোর আগে মঙ্গনে সেদিন থেকে পরদিন সকালে মঙ্গন-এর আশেপাশে ঘুরে বেড়াতে পারেন। তিংভং যাবার জন্য জঙ্গুর শেয়ারের গাড়ি দুপুর ৩টের থেকে চালু হয় মঙ্গন থেকে। কাছের লাবরাং গুম্ফা আর রং লুঙতেন মিউজিয়ামটা ঘুরে আসুন। ফিরে এসে স্নান খাওয়া সেরে জঙ্গুর শেয়ার গাড়িতে উঠে পড়ুন।
গাড়িতে ওঠার পর মিনিট চল্লিশের পথ। গাড়ি এসে থামবে এক বিশাল জলাশয়ের পাশে। এটি আসলে নদী। ওই পাড়ে পাহাড়ে পৌঁছতে হবে মোটরচালিত র্যাফটিং বোটে। আগে কিন্তু এই ব্যবস্থা ছিল না। সহজেই পৌঁছে যাওয়া যেত। উত্তাল কানাখা নদী বয়ে যেত আপার আর লোয়ার জংগুর মাঝ দিয়ে। ওপরে সাসপেনসন ব্রিজ। এই ছিল জংগুর আগের ভূগোল। তারপর ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে একদিন সিকিম অঞ্চলের একটা ধস বা ল্যান্ডস্লাইডের খবর এল। পাথর নয়, একটা গোটা পাহাড় নেমে এল নদীতে। ব্রিজ ধুলো হয়ে মিশে গেল। বিশদভাবে আরও জানতে গুগুল করতে পারেন : “Dzongu Landslide”। তবে নিহতের সংখ্যা শূন্য! গ্রামের লোকের কথা অনুযায়ী সকাল থেকেই তারা বুঝতে পারছিল, কিছু একটা ঘটবে। আর তাদের বিশ্বাসের কারণ, তাদের পাহাড় দেবতা !
এভাবেই দুই জংগু বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ওপারের গাড়ি রয়ে গেল ওপারেই। নদী হয়ে গেল লেক। কিন্তু মানুষ থেমে থাকে না। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট টিম নামিয়ে দিল র্যাফটিং বোট। প্রশিক্ষিত চালক। আমার আপনার জন্য লাইফ জ্যাকেট। বোটে করে চলে আসবেন এপাড়ে। আবার গাড়ি সফর। মিনিট কুড়ির পথ।
তিংভং হোমস্টেতে থাকার মজা সত্যিই আলাদা। সকালে উঠে জানলার পর্দা সরিয়েই যদি দেখতে পান পান্ডিম, কাব্রু আর কাঞ্চনজঙ্ঘার কিছুটা অংশের অপরুপ সৌন্দর্য, তাহলে বলুন তো মনে হবে না স্বপ্নের মতো? মনে হবে দেখতেই থাকবেন সেই দৃশ্য। তবে বসে না থেকে তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে গ্রাম গুলোতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য বেরিয়ে পড়ুন । এখানেএদের রান্না ঘরে প্রায় সবরকম ফলের ওয়াইন দেখতে পাবেন। লেপচারা নাকি যেকোনও ফলের ওয়াইন বানাতে ওস্তাদ। সেখানকার স্থানীয় পানীয়ের নাম ‘চি’।
অন্যান্য টুরিস্ট স্পট এর মতো তিংভং-এ কিন্তু কোনও ‘অমুক পয়েন্ট তমুক পয়েন্ট ‘নেই। নেই কোনও গাড়িওয়ালা বা ট্যুর অপারেটরদের তাড়া। দু-তিন দিন নিজের মতো ঘুরে বেড়ান। হাইকিং, ট্রেকিং…যা মন চায় করুন। গ্রামের বাচ্চারা পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। হাঁটতে হাঁটতে দেখে আসুন, পাশের গ্রাম কুসং। গাড়ি করে, কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে, লিংথেম, হেয়গ্যাথাং, পেনতং, থোলাং মনেস্ট্রি, লেপচা মিউজিয়াম, লিংজ্যা জলপ্রপাত। হাতে-পায়ে ব্যথা। স্পা! চান করে নেবেন? আছে হটস্প্রিং। না কোনও স্পা সেন্টার নয়, একেবারে প্রাকৃতিক, বিনে পয়সায়।
আর একটা জিনিস এখানে দেখতে পাবেন। অজস্র বৌদ্ধ ধর্মের পতাকা। সাদা ফ্ল্যাগগুলো কিন্তু প্রেয়ার ফ্ল্যাগ নয়। যেমনটা আমরা জেনে এসেছি। বাঁশের খুঁটিতে সাদা ফ্ল্যাগগুলি মৃত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে লাগানো হয়েছে।পতাকার গায়ে লেখা স্ক্রিপ্ট যেন হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়, ফিসফিস করে কথা বলে মৃত ব্যক্তিদের সাথে। এখানে থাকার অনুভূতিটাই আলাদা। একটা স্বপ্নের মধ্যে যেন হারিয়ে ফেলা নিজেকে। আপনারাও ঘুরে আসুন। একটা লেপচা পরিবারের সঙ্গে দু-তিন দিন কাটালেন। ওদের রান্না শিখলেন, আপনিও হয়তো কিছু শেখালেন। ওদের স্কুল, উপাসনা দেখলেন, চি (দেশি পানীয়) খেলেন, ওদের সংগীত শুনলেন। মুরগির ডাকে ঘুম থেকে উঠলেন। ক্যামেরার শাটার টিপতে-টিপতে আঙুলে ব্যথা করলেন! কম কী!
বহু শতাব্দী ধরেই এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা লেপচারা। লেপচা উপজাতিদের জীবনযাত্রা, ইতিহাস, রীতি রেওয়াজ, সংস্কৃতি, ভাষা ছড়িয়ে আছে জঙ্গু উপত্যকা জুড়ে। সাথেই রয়েছে এই সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার ভয়ও। আগ্রহীরা পড়ে ফেলতে পারেন A.R. Foning-এর লেখা বই ‘Lepcha: My Vanishing Tribe’। সিকিমের আদি বাসিন্দা লেপচা প্রজাতি আধুনিকীকরণের স্রোতে তাদের রীতি রেওয়াজকে হারাতে বসেছিল। সেই ১৯৬০ সাল থেকেই সিকিম সরকার লেপচা প্রজাতি ও তাদের সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে জঙ্গুকে ‘বিশেষ লেপচা সংরক্ষিত এলাকা’ বলে ঘোষণা করেছে।
লেখক পরিচিতি: কৃষ্ণাশীষ রায়
কৃষ্ণাশীষ রায় একজন ভ্রমণ পিপাষু মানুষ। তিনি দেশে-বিদেশে ঘুরতে এবং সেই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখালিখি করতে ভালোবাসেন।