লেখক: অয়ন মৈত্র
চাঁদে নেমেই উইলিয়াম আগে আমাকে খুঁজতে লাগলো। আমি তখন আ্যপোলো-৮ এর কেবিনে শুয়ে। হুড়মুড় করে দৌড়তে দৌড়তে কেবিনে ঢুকে উইলিয়াম আমাকে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে যেতে যেতে নিজের মনেই কেমন একটা ঘোরের মধ্যে বলতে লাগলো –“পৃথিবী! পৃথিবী উঠেছে আকাশে!. . .এটা চাঁদ নয়। এটা পৃথিবী! পৃথিবী উঠেছে আকাশে!” কেবিনের বাইরে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমিও হতবাক! গভীরতার থেকেও কালো মহাকাশে আধোঘুমে পৃথিবী উঠেছে। আমারও ভাবতে অবাক লাগছিল – পৃথিবী উঠেছে। পৃথিবী শব্দটার পর এই ক্রিয়াপদটা প্রথমবার শুনলাম। “উঠেছে”।
জীবনে এই প্রথমবার আমি পৃথিবীকে উঠতে দেখলাম। পৃথিবীও তাহলে ওঠে। পৃথিবীও তাহলে ডুবে যায় রোজ একটু একটু করে যেমন চাঁদ ডুবে যায় পৃথিবীতে। সূর্য ডুবে যায় পশ্চিমে। উইলিয়ামও দেখি তাকিয়ে দেখছে- পেটের কাছটা গাঢ় নীল আর মাথার কাছটা টুকরো টুকরো জমাট সাদা নিয়ে পৃথিবী উঠেছে মহাকাশের গভীরে। আমি উইলিয়াম-এর গলাটা জড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম-“অনেক তো নিজের চোখে দেখলে। আ্যই! এবার আমার চোখ দিয়ে দেখবে পৃথিবীকে?” উইলিয়াম আমার দিকে তাকাল-তারপর আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল-“একদম!” আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।
মোহগ্রস্ত আমরা দেখতে লাগলাম,আর আমাদের সাথে সাথে নাসা দেখতে থাকল, প্রেসিডেন্ট কেনেডি দেখতে থাকল, দেখতে থাকল আমেরিকা, দেখতে থাকল রাশিয়া, দেখতে থাকল ভারত, খবরের কাগজে ;ভূগোল বইয়ের পাতায়, দেখতে থাকল মানুষের লক্ষ বছরের ইতিহাস- মহাকাশে পৃথিবী কেমন করে আড় ভাঙে, হাই তোলে। কেমন করে পৃথিবীতে পড়ে যাওয়া মানুষ… চাঁদের মাটিতে আবার উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে, একটু একটু করে।
(চাঁদের আকাশে প্রথমবারের মতো মানুষসম্বলিত অভিযানের সময় উইলিয়াম অ্যান্ডারস “আর্থরাইজ” [Earthrise] আলোকচিত্রটি গ্রহণ করেন। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে যে ক্যামেরায় ছবিটি তোলা হয় তার ভেতরের অনুভূতিটা তার নিজের জবানবন্দীতে আন্দাজ করলাম.)