সিনেমা রিভিউ: শিবায়

লেখক: অয়ন মৈত্র

  • সিনেমার নাম: শিবায়
  • পরিচালনা: অজয় দেবগণ
  • প্রযোজনা: অজয় দেবগন এফ ফিল্মস, পেন ইন্ডিয়া লিমিটেড এবং এনএইচ স্টুডিওজ।
  • অভিনয়: অজয় দেবগণ, সায়েশা এবং অন্যান্য সাবলীল শিল্পীরা।
  • সময়: ২ ঘণ্টা ৪২ মিনিট

“A film is never really good unless the camera is an eye in the head of a poet”- Tim Burton সিনেমার উৎকর্ষতার গাইড লাইন হিসেবে টিম বার্টন–এর বক্তব্যের পর আর কিছু বলার থাকে না। সব পরিচালককেই কবি হয়ে উঠতে হয়, তা সে সিনেমার স্বার্থেই হোক আর স্বভাব বশে।কিছু কবিতা থাকে যেন পাহাড়ি ছোট নদী;বিশাল ব্যপ্তি নয়, গগনবিদারী শব্দ নয়, কুল কুল শব্দে নুড়ি পাথর বুকে বয়ে যায় নিজের মর্জি মত;কিন্তু বয়ে যায়, বয়ে যেতেই থাকে।আবার কিছু কবিতা যেন নদীর জলপ্রপাত হয়ে নিচে পড়ার শেষ ল্যাপ।এরপরই নদী – মহানদী,মহানদী থেকে মহাকাব্য, মহাকাব্য থেকে মহাকাল-সেখান থেকে ক্রমশ চিরকালীন হয়ে যায়।সিনেমাও তাই। অজয় দেবগণের পরিচালক হিসেবে রাজু চাচা(২০০০)য় হাতে খড়ির পর ‘শিবায়’ আবার তিনি পরিচালক।

‘শিবায়’-র মোশন পোস্টার-এ কিছুটা বোঝা গেছিল এ সিনেমা উত্তেজনা ঠাসা,আর ট্রেলার বেরনোর পর বোঝা গেল ধুন্ধুমার অ্যাকশনে ঠাসা সাথে অনবদ্য প্রাকৃতিক শোভা,আর পিছনে অজয় দেবগণের ব্যারিটোনে শিবের স্তুতি নিয়ে ‘শিবায়’ মহাকাব্যিক হতে চলেছে।কিন্তু হল্ থেকে বেরনোর পর মনে হল – কই অনেক সিটি দিলাম, অনেক চিৎকার করলাম উত্তেজনায়, কিন্তু কই আমার তো আলাদা করে মনে হচ্ছে না যে আমার রোজকার থ্রি- ডাইমেনশনাল জগতে আমি- মাল্টি ডাইমেনশনাল ‘শিবায়’ হতে পারি! কেন বাড়ি ফেরার বাসের কথা ভাবছি, হিমালয়ের বরফ চুড়ায় কেন বাস না আসা অবধি অপেক্ষা করার কথা মাথায় আসছে না একবারও।সিনেমা পরবর্তিকালীন মুগ্ধতাটা কে যদি কোন সিনেমার মাপকাঠি ধরি-তাহলে বলতে হয়- ‘শিবায়’কে দীপাবলির রাতে পরমাণু বোমা হতে চেয়েও শেষ অবধি গ্রেনেডেই থেমে থাকতে হল। আপনি যদি ভোলেবাবা’র পরম ভক্ত হন, এবং ‘শিবায়’- তে শিবের স্তুতি পাঠ, ট্যাটু ও গাঁজা সম্বলিত কৈলাস পর্বতের প্রেক্ষাপটে অজয় দেবগণ কে দেখে আপনি যদি ভেবে থাকেন – শিবের ২০১৬-ভার্সান দেখতে চলেছেন, তাহলে প্রথমেই বলি আপনি শিব নয়, ‘সিংঘম্’- এর অজয় দেবগণকে দেখতে চলেছেন,।তবে এটা ঠিক যে, অজয় দেবগণ কে ছাড়া এই চরিত্রটি আর কাউকেই মানাত না। অজয় দেবগণ-এর বিখ্যাত ট্রেডমার্ক রাগী পুরুষালি আবেদন এবারও আপনাকে কানায় কানায় ভরিয়ে দেবে।ডায়লগে বাজিমাত না হলেও, সে অভাব পরিচালক অজয় সুদে আসলে পুষিয়ে দিয়েছেন দুর্ধষ অ্যাকশন স্টান্টে, বিশেষ করে গাড়ি চেজিং,এবং হাতে লাগানো হ্যান্ডকাফ কে যেভাবে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলেন, তা অ্যাকশন সিনেমার ভক্তদের সিটি দিতে বাধ্য করাবেই। সিনেমাটির প্রথম ত্রুটি বোধহয় এর প্রায় ৩ ঘণ্টা ব্যাপী দৈর্ঘ্য।এই অতি বহর বৃদ্ধিতে বুল্গেরিয়ান বৃদ্ধ মাফিয়া লর্ড চরিত্রটি,গিরিশ কারনাডের চরিত্রটি, নবাগতা সুন্দরী দিলীপ কুমারের নাতনী সায়েশা সায়গলের বাথটাবে শুয়ে বাবার স্নেহ, মমতা তার প্রতি, ভেবে চোখের জল ফেলা, ভারতীয় দূতালয়ের কূটনীতিক চরিত্রে সৌরভ শুক্লার বিহারী হিসেবে মূল্যবোধের ফিরিস্তি প্রদান এবং ‘এথিক্যাল হ্যাকার’ হিসেবে ভীর দাস ‘কমিক রিলিফ’ হলেও, সিনেমার টানটান মেদহীন শরীরে অনাকাঙ্ক্ষিত ফ্যাটের মত এনারা।সিনেমাটির দ্বিতীয় ত্রুটি হল যেখানে আপনার মনে হবে এইবার বোধ হয় শেষ হল, সেখান থেকে আবার দেখবেন পুনরায় চালু হয়ে গেল নতুন দৃশ্য।পরিমিতি বোধের অভাব এ সিনেমার অন্যতম ত্রুটি।আর তৃতীয় হল,যুক্তি। পাহাড় কে মোটামুটি বাড়ির উঠোন বানিয়ে ছেড়েছেন। তেঞ্জিং নোরগে বেঁচে থাকলে ‘শিবায়’-এর জুতোয় লেগে থাকা একটু বরফ কুঁচি কৌটো করে রেখে দিতেন।রাখবেন নাই বা কেন- জীবনেও কল্পনা করতে পারবেন, বরফ মোড়া ক্রিভাসের ফাঁক গলে তাঁবু সুদ্ধু অতল গভীরে পড়তে পড়তে, তাঁবুর মধ্যে প্রেম করা যায়!এরকম আরও অনেক যুক্তিহীন,ভরহীন, মাধ্যাকর্ষণহীন দৃশ্যের সাক্ষী থাকতে আপনাকে দেখতেই হবে ‘শিবায়’। তবে এত সমালোচনার পরও বলতে হবে ওই গাড়ি চেজিং, বরফ ধস নামা দৃশ্যে, ওই বিশাল পর্বত চূড়া আপনা হতেই যে নৈসর্গিক প্রেক্ষাপট বানিয়ে দিয়েছে, তাতে ভি.এফ.এক্স আর্ট
িস্ট দের আর আলাদা করে কোন সিচুয়েশান তৈরী করতে হ্য়নি অ্যাকশন দৃশ্যের তীব্রতা বাড়াতে। ‘অলগা’র চরিত্রে এরিকা কার- ভালোই।‘গউরা’র চরিত্রে ‘আবিগালি এয়ামেস’ মানানসই।‘শিবায়’ দেখতে দেখতে আপনি যদি স্কাইফল, জী.আঈ.জো, জ্যাস্ন বোর্ণ, টেকেন, সিনেমা গুলির কিছু সাদৃশ্য খুঁজে পান, তাহলে ‘টুকেছে’ বলে চিৎকার করার আগে অজয় দেবগণের সাক্ষাতকারের বলা কথাটা একবার শুনে নিন- আমি হলিউডের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যেতে চাইনি। আমি যেটা চেষ্টা করেছি এমন একটা সিনেমা বানাতে যা আন্তর্জাতিক মানের সমান হয়। সেই চেষ্টায় ‘শিবা’ ব্যাপক সফল।আর আরও একটা বিষয় বলতেই হবে।গান এই সিনেমার অন্যতম সম্পদ।অন্তত ‘বোলো হর হর’ গানটির জনপ্রিয়তা ভারতীয় যুব সমাজে ‘শিবের’ জনপ্রিয়তা কিছুটা হলেও বাড়াবেই। না পাহাড়ী নদীর তন্ময়তা, না জলপ্রপাতের মহাকাব্যিকতা, শিবায় কবিতা হল না, কিছু তাতেও আপনার দীপাবলির আনন্দে আলাদা মাত্রা দেবেই।


শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।