লেখক : দামিনী সেন
১ম পরিচ্ছদ
লোকাল ট্রেনের জানলা দিয়ে লোকটিকে দেখে মনটা কেমন যেন হয়ে গেল অম্বিকার। অথচ তেমন কিছুই ঘটেনি কোত্থাও। দিব্যি সে ফিরছে সারাদিন কাজ সেরে। সেই সক্কালবেলায় ছেলে সামলে, তাকে খাইয়ে, মার হাতে তুলে দিয়ে – তারপর স্নান-টান সেরে, রেডি হয়ে (এই বিষয়টা নিয়ে অবশ্য অমল প্রায়ই খেপায় তাকে; বলে সে নাকি দরকারে একটা ট্রেন মিস করতেও রাজি, দরকারে না খেয়েও দৌড়তে রাজি, তবু নাকি এই রেডি হবার সময়টা নিয়ে নো কম্প্রোমাইজ। – কোনও মানে হয়? করে তো নিজে একটা হাইস্কুলে চাকরি। বেসরকারি ফার্মের চাপ আর’ও বুঝবে কী করে! একটা ট্রেন মিস হলে সেদিন যে কী পরিস্থিতির সামনে পড়তে হয়, সে আর’ও কী বুঝবে। আর মেয়েরা একটু টিপটপ থাকতেই পছন্দ করে। না হলে ঐ অমলের মতো হাফশার্টটা কোনওরকমে গুঁজতে গুঁজতে পায়ে জুতোটা যেমনতেমন করে গলিয়ে নিয়ে – ঐভাবে দৌড়বে নাকি ও ! অর্ধেক দিন তো শোনে বেরোনোর আগে চুলে আরেকবার চিরুণিটাও ছোঁয়াতে ভুলে যায়। তার আবার বড় বড় কথা! ), কোনও রকমে নাকে-মুখে গুঁজে আধপেটা খেয়ে সেই যে রোজ অফিসে ছোটে – অফিসে ঢুকতে ঢুকতেই সমস্ত ফ্রেশনেস কোথায় যেন উধাও হয়ে যায় রোজ। কিন্তু তা বললে তো আর অফিস শুনবে না। অতএব প্রসাধন কক্ষে ঢুকে ভিতরের ক্লান্তিটা উপরের প্রসাধনীর তলায় কিছুটা চাপা দিয়ে এসে দাঁড়ানো ডেস্কে। তারপর সারাদিন ধরে ক’ মিনিট একটু বসার সুযোগ মেলে, বোধহয় হাতের কর গুনেই বলে দেওয়া যাবে।
লোকটার একমাথা অবিন্যস্ত চুল, ক্লান্তিতে এলোমেলো। চোখে চশমা। ঢিলেঢালা প্যান্টটা কোমরে শক্ত করে বেল্ট দিয়ে বাঁধা। সকালে বেরোবার সময় ওটা নিশ্চয়ই ইস্ত্রি করাই ছিল, কিন্তু এখন সেটায় বিচিত্র সব ভাঁজ। কপাল দিয়ে ঝরে নামা ঘামের রেখাটা ভদ্রলোক একটা রুমাল দিয়ে ঘসে ঘসে তুলছেন। প্ল্যাটফর্ম ধরে বাড়ানো তাঁর পায়ে স্পষ্ট সারাদিনের ক্লান্তির ছাপ।
হঠাৎ ভারি হিংসে হল অম্বিকার। একটা অদ্ভুত মন খারাপ লোকটার প্রথম দর্শনেই যে অধিকার করে বসেছিল ওর সারা মনটা, এই হিংসের ভাবটা এসে যেন খানিকটা ধাক্কা দিয়েই সরিয়ে দিতে চাইল তাকে। ভীষণ হিংসে হল তার লোকটাকে, আশেপাশের সারাদিনের কাজফেরত আরও বহু লোকের ভিড়টাকে, এমনকি অমলকেও সারাদিন পরে বাড়ি ফেরে অমল, বাড়ি ফেরে অম্বিকাও। একজনের চুল উস্কোখুস্কো, দোমড়ানো মোচড়ানো জামাপ্যান্ট। এসেই কাঁধ থেকে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ধপাস করে বসে পড়ে সোফায়। তারপর হাতের কাছে জোগানো ঠাণ্ডা জল বা শরবৎ খেয়ে বাথরুমে ঢুকে গা ফা ধুয়ে টিভির সামনে বসা। বড় জোর কোনও দিন ছেলেকে ডেকে নিয়ে একটু পড়া দেখা কি কিছু একটা আনতে বললে গায়ে পাঞ্জাবিটা গলিয়ে পাড়ার দোকানে অভিযান। অবশ্য সে অভিযানে বেরোলে ফিরতে তার একটু সময়ই লাগে। পাড়ার গুচ্ছের বন্ধুবান্ধবদের সাথে চায়ের দোকানের ঠেকে কি মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে বিস্তর রাজাউজির উড়িয়ে তবে তো ফেরবার প্রশ্ন।
আর অন্যজন? সারাদিনের পরও যখন বাড়িতে ঢোকে সে, যেন সেই সক্কালবেলার মতোই ফ্রেশ। পায়ের জুতোটা খুলে সুন্দর করে র্যাকে গুছিয়ে রেখে তবে বাড়িতে প্রবেশ; ব্যাগটা খুলে যা যা বের করার আগে বের করে ঠিক মতো জায়গায় আগে ওটা প্লেস করা। তারপর এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল বা শরবৎ নিয়ে ফ্যানটা পুরো স্পিডে চালিয়ে দিয়ে খাবার টেবিলে একটু বসা। ব্যাস, রিল্যাক্স বলতে ঐটুকুই। তার মধ্যেই ছেলে এসে প্রথমে ঝাঁপিয়ে পড়বে কোলে। ফিটফাট পোশাকের কোলের কাছটায় মুখ ঘষে একটু এলোমেলো ভাঁজ ফেলে দেবে জায়গাটায়। সারাদিনের একমাত্র স্বাভাবিকতা। কিন্তু কপট রাগে ধমক দিয়ে সাথে সাথেই আবার উঠে পড়বে সে। বাথরুমে ঢুকে একটু ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে নিয়ে ছেলেকে নিয়ে একটু সোহাগ করতে করতেই মার কাছ থেকে সারাদিনের খবরাখবর নেওয়া: কাজের লোক, ছেলের আয়া, কাকে নিয়ে কী সমস্যা – সংসারের হাজারো খুঁটিনাটি, ঝক্কিঝামেলা, সব কিছু।
এরপর আছে রান্নাঘর। অমলটা মাংস খেতে ভারি ভালোবাসে। মাঝে মাঝেই ফ্রিজ খুলে ও একটা জিনিসই খেয়াল করে, রকমারি মাছ আর মুরগির যোগান সেখানে ঠিক আছে কিনা। কিন্তু সেগুলো প্লেটে সাজিয়ে দেওয়ার আর যাবতীয় দায়িত্ব তো অম্বিকারই। কাজের লোকের রান্না ঐ সকালবেলা নাকেমুখে গুঁজে ছোটার জন্য ঠিক আছে। কিন্তু রাতের স্পেশাল পদটি অন্তত একটু যত্ন করে না রাঁধলে কি আর মুখে রোচে? তারওপর আছে বিছানায় ছেলেকে গান শোনানো, পরদিনের অফিসের প্রস্তুতি সারা, মিষ্টি বউটি হয়ে অমলের ডাকে সাড়া দেওয়া …
শুধু ক্লান্তির তার কোনও এক্সপ্রেশন নেই। ও যে আছে – তা স্বীকার করতেও ভয়। শুধু অন্যদের কাছে নয়, নিজের কাছেও।
ভীষণ ভীষণ রাগ হয় হঠাৎ অম্বিকার। ঐ যে লোকটা – ওও তো কোনও না কোনও অফিস থেকেই ফিরছে। সারাদিন তো ওকেও খাটতে হয়েছে। হয়তো বা তা অম্বিকার থেকেও বেশি। কিন্তু এই যে বিধ্বস্ত চেহারায়, ইস্ত্রি নষ্ট হওয়া জামা কাপড়ে, ধুলোর পরত পড়া জুতোয়, হাতের জবজবে হয়ে যাওয়া রুমালটা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে সে পা বাড়ালো বাড়ির দিকে – কই নিজের চেহারা নিয়ে কি খুব লজ্জিত মনে হল তাকে? তাহলে সে নিজে অফিস থেকে বেরনোর আগে রোজ প্রসাধন কক্ষে একবার হাজিরা দেয় কেন? কেন সে ভাবতে বসে, সারাদিনের ক্লান্তি মুখে দেহে ফুটে উঠলে সবাই তার দিকে কেমন অদ্ভুতভাবে তাকাবে? কেন সে কথা ভাবতে হয় তাকে? তাদের?
লেডিজ কামরায় ওদের কুপে বসে থাকা একটার পর একটা মুখে একে একে চোখ বোলায় সে। মৌসুমী, টিয়া, অনন্যা, রুকসানাদি। সকলেই ফিরছে সারাদিনের কাজ সেরে। কেউ কোনও অফিস থেকে, কেউ বা দোকান থেকে, আবার কেউ কোনও স্কুল থেকে। অথচ দেখো – সক্কলেই ফিটফাট। মুখে হাসি, ম্যানিকিওর করা আঙুল। মাথার চুল থেকে হাতের নখের নেলপালিশ, সবকিছু এক্কেবারে ঠিকঠাক। মাপা হাসি, হাল্কা মস্করা। চোখের তলার ক্লান্তির ছাপটুকুকে চাপা দিতে কত না আয়োজন। হঠাৎ খুব আশ্চর্য লাগে অম্বিকার।
এই এক রোগ ওর। ও নিজেও জানে। থেকে থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত সব আবেগ চাগাড় দিয়ে ওঠে ওর মাথায়। ভীষণ তীব্র। তীব্র আর অস্বাভাবিক। চারিদিকের স্বাভাবিক পৃথিবীটা – যেখানে সব কিছুই কেমন মানানসই, সুন্দর, যেমনটা হওয়ার তেমনটা, তার থেকে একেবারেই খাপছাড়া। বেখাপ্পা। ও চিনতে পারে তার লাগামছাড়া ঝোঁকটাকে, খ্যাপামিটাকে – চিনতে পারে, আর আতঙ্কিত হয়।
আতঙ্কিত হওয়ার কারণও কি নেই! তিল তিল করে গড়ে ওঠা ওর চারপাশের এই পৃথিবীটা, যেটাকে ও এখন দুহাতে কেবলই আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়, ওর সমস্ত সুখ, ওর ভালো লাগা, ভালো থাকা, ওর আজকের পুরো অস্তিত্বটাই একরকম নির্ভরশীল যার উপর – হঠাৎ পাকিয়ে ওঠা কোনও ঘুর্ণিঝড় এসে যদি তছনছ করে দিতে চায় তাকে, ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলতে চায় তার সমস্ত মসৃণ পেলব আবরণ, ভয় না পেয়ে তবে উপায় কী।
জানালার বাইরের কু-ঝিকঝিক অন্ধকারে ফুটে ওঠা প্রতিটি অভ্যস্ত অবয়ব – গাছপালা, দেওয়াল, বাড়ি, মাঠ, কারখানা, প্রতিদিনের দেখায় মুখস্ত যাদের প্রতিটি রেখা – ট্রেনের গতির তালে তালে তারা হঠাৎ যেন নাচতে শুরু করে। কোনও এক দমকা হাওয়া এসে যেন ছুঁয়ে যায় তাদের মাথা, সমস্ত শরীর। অম্বিকার
বুকের ভিতরটা হঠাৎ কেমন ফাঁকা মনে হয়, বড্ড হাল্কা লাগে মাথাটা। চোখদুটো হারিয়ে যায় যেন কোন সুদূরে।
২য় পরিচ্ছদ
ছোট্ট নৌকাটার গলুই’এর কাছে ক্রমাগত নদীর ঢেউগুলি এসে পড়ছিল ছলাৎ ছলাৎ করে। হয়তো তারই অভিঘাতে নৌকাটা অল্প অল্প দুলছিল। একটা খুব মৃদু হাওয়া এসে ছুঁয়ে যাচ্ছিল ওর মুখ, কপাল, চুল। সেগুলো উড়ছিলও একটু একটু। এতক্ষণে এই প্রথম।
– নাঃ, সত্যি বলছি। এতটা খোলা আকাশ, এত সবুজ ! জায়গাটা দারুণ রে শুভ্র।
যাকে লক্ষ করে ও ছুঁড়ে দিয়েছিল কথাগুলো, হাঁটু পর্যন্ত প্যান্টটা গুটিয়ে সে ততক্ষণে নেমে পড়েছে জলে। পাড়ের একটু উঁচু চরাটা থেকে নৌকা বেঁধে রাখার গোঁজটা খুলে ছুঁড়ে দিয়েছে খোলে, সঙ্গে নিজের চটি জোড়াও। এবার শুধু জলে নেমে পড়ে নৌকাটাকে ঠেলে জলে নামানোর অপেক্ষা। সেটা করতেই সে এখন গোড়ালি পর্যন্ত কাদায় গেঁথে জলে নেমে প্রাণপণে টানছিল নৌকাটাকে। ফলে তৎক্ষণাৎ কোনও জবাব জোটেনি কথাগুলোর।
অবশ্য তা নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি অম্বিকাও। একটা অদ্ভুত ভালোলাগা এসে যে কেমন জড়িয়ে ধরেছিল তাকে। ওপারের সবুজে সবুজ খেতগুলোর দিকে চেয়ে কেমন যেন হারিয়ে যেতে বসেছিল সে।
ওর স্বপ্নাতুর ভাবটা কেটে গিয়েছিল হঠাৎই। নৌকাটা আচমকাই কেমন একটু হালকা হয়ে তরতর করে এগিয়ে গিয়েছিল খানিকটা। ভারসাম্য হারিয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল ও। কোনওরকমে নৌকোর ধারের কাঠটা ধরে সামলে নিয়েছিল। আতঙ্কের একটা উচ্চারণ ছিটকে বেরিয়েছিল ওর মুখ থেকে।
– “আরে, সামলে !” উলটো প্রান্তে লাফিয়ে উঠতে উঠতেই চেঁচিয়ে উঠেছিল শুভ্র। তারপর ওকে সামলে নিতে দেখে একটু নিশ্চিন্ত হয়েই যেন ধমক লাগিয়েছিল – “নৌকোয় অমন আলগা হয়ে কেউ বসে ! তাও আবার অমন একটি ধারে। পাটাতনটার ঠিক মাঝখানে এসে বোস। গলুই’এর কাঠটার দিকে পিঠ দিয়ে। আর দুই হাত দিয়ে চেপে ধর ধারের কাঠগুলোকে।”
ধমকানিটা মোটেই তেমন গায়ে মাখেনি অম্বিকা। ওর মধ্যের স্নেহের পরশটুকু ছুঁয়ে গিয়েছিল ওর মন। হাতের তালু দুটোকে একটু ঝেড়ে নিয়ে বাঁ হাতের তর্জনী ও মধ্যমা দুটো দিয়েই কপাল থেকে নেমে আসা ঘামটা মুছে নিয়েছিল। তারপর ঘাম চকচকে মুখটা তুলে একটু হেসেছিল শুধু।
– ওপারটা কিন্তু ভারি সুন্দর। কী নাম রে জায়গাটার?
– বেদনির চর। আসলে সাপখোপের জায়গা তো। একসময় এখানে অনেক বেদে বাস করত। আমরাও ছোটবেলায় দেখেছি। এখন অবশ্য সংখ্যায় অনেক কমে গেছে। ঐ বেদেনী থেকেই বেদনি।
কথাগুলো বলতেই বলতেই কাদামাখা পা’দুটো নৌকার বাইরে একটু ঝুলিয়ে নদীর ঘোলাটে বর্ণের জলেই ধুয়ে নিয়েছিল শুভ্র। তারপর পা’দুটো গুটিয়ে নিয়ে দাঁড়টা হাতে তুলে নিয়ে বলেছিল – “ঐ যে দূরে একটা ঊঁচু আলের মতো দেখছিস। ঐখানেই ছিল আমাদের জমি। বেশি না, বিঘে তিনেক। বাবা ওখনেই চাষ দিতেন। এখন অবশ্য আর নেই। গত বছর দাদা বিক্রি করে দিয়েছে।”
– সে কী ! কেন?
– খরচায় পোষাচ্ছিল না, তাই। চাষে আজকাল খরচ কম? সার জল মুনিষ – ফসল ভালো হলেও বিক্রি করে শেষে হাতে তেমন কিছু থাকে না। তার চেয়ে ঐ টাকাটাই দাদা দোকানে ইনভেস্ট করায় দোকানটা আগের চেয়ে একটু বড় হয়েছে। ওতেই এখন আমাদের মোটামুটি চলে যাচ্ছে। তাছাড়া বাগানটা তো আছেই।
– “তোদের বাড়ির পিছনদিকের ঐ বাগানটা। কী দারুণ জায়গাটা ! কত গাছ।” রীতিমতো উচ্ছাস ফুটে উঠেছিল অম্বিকার গলায় – “আচ্ছা, পেয়ারা ছাড়া আর কী কী গাছ আছে ওখানে?”
– “তা আছে কয়েকটা জামরুল, কালোজাম গাছ। একটা বেল গাছও আছে। তবে পেয়ারা গাছই বেশি। তা তোর হাতটা এখন ঠিক আছে তো ?” হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়া উদ্বেগের সুরেই শেষ প্রশ্নটা ভাসিয়ে দিয়েছিল শুভ্র।
হেসে উঠেছিল অম্বিকা। রীতিমতো হি হি করেই। ওর অভ্যস্ত ঠোঁটচাপা মাপা হাসির সমস্ত ডেকোরাম ভুলেই। আসলে সত্যিই দিনটা কেমন যেন উলটে পালটে দিয়েছিল ওর সব কিছুই। একটু আগেরই তো ঘটনাটা। অন্য সময় হলে নিজের কাণ্ডে তো মরমে মরে থাকার কথা ওর। অথচ তখন ওর মনে হয়নি তেমন কিছুই।
ওকে বারণই করেছিল সবাই। শুভ্রর বৌদিও। কিন্তু ওর মাথায় তখন রোখ চেপে বসেছিল যে। আসলে শুভ্রর ঠাট্টার ছলে বলা কথাটাই ওর জেদ বাড়িয়ে দিয়েছিল। হ্যাঁ, ও শহরে মানুষ, কিন্তু বোটানির ছাত্রী তো। গাছপালাই তো ওর বিষয়। নাহয়, তাদের সঙ্গে ওর সরাসরি পরিচয় কিছুটা দূর থেকেই। তাই বলে পেয়ারা গাছে চড়া এতই শক্ত নাকি !
দেখিয়েও দিয়েছিল তো। উঠে পড়েও তো ছিল একটা গাছে। তারপর শক্ত দেখে একটা ডালে বসে পা দোলাতেও শুরু করেছিল শুভ্রকে দেখিয়ে দেখিয়েই। শুভ্রও অবশ্য তাড়াতাড়ি হাত জোড় করে এসে দাঁড়িয়েছিল নিচে।
– হয়েছে, হয়েছে। এবারে বাবা নেমে আয়। পেয়ারা গাছের ডাল মোটেই খুব একটা শক্ত নয়। তারউপর যদিও ফুট পাঁচেকের উপরে উঠিসনি, তবু –
উফ্ এত নাটক করতে পারে ছেলেটা !
– মানে ! কী বলতে চাস?
– না, খুব একটা হাল্কা তো আর নস। যদি কোনওভাবে –
– “এই দেখ। একদম আমার ওজন তুলে কথা বলবি না। মোটেই মুটকি নই আমি।” রীতিমতো আঙুল তুলে গর্জে উঠেছিল অম্বিকা। আর বলতে বলতেই –
কাঠ পিঁপড়েটা কখন যে ওর পিঠের খোলা অংশটুকুতে উঠে এসেছিল টেরও পায়নি ও। কিন্তু হঠাৎ কামড়টার তীব্রতা ছিল এতটাই যে প্রায় লাফিয়ে উঠেছিল। মুখ থুবড়েই পড়ত ও সোজা মাটিতে, কিন্তু শুভ্র ধরে ফেলেছিল। ফলে খুব একটা লাগেনি ওর তেমন। তবে গাছের ডালে লেগে বাঁ হাতের কনুইটার তলাটা বেশ খানিকটা কেটে গিয়েছিল। রক্তও বেরিয়েছিল যথেষ্ট। শুশ্রুষার অবশ্য কোনও অভাবই ঘটেনি। বরং সবাই এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ওকে নিয়ে যে ও খানিকটা বিব্রতই বোধ করছিল। এখনকার এই নৌকাভ্রমণটাও খানিকটা হয়তো তারই ক্ষতিপূরণ।
৩য় পরিচ্ছদ
হ্যাঁ, দিনটা ছিল একেবারেই অন্যরকম।
ট্রেন থেকে এসেও নেমেছিল যখন ছোট্ট স্টেশনটায়, তখনও পর্যন্ত তেমন কিছু মনে হয়নি। তবে হ্যাঁ, আর পাঁচটা দিনের থেকে আলাদা তো বটেই। অন্যদিনগুলো সেই সকাল থেকে কলেজ, ক্লাস, প্র্যাকটিকাল, বন্ধুবান্ধব, শপিং মল, পার্ক, সিনেমা, আড্ডায় এতটাই ভরপুর থাকত যে কখন যে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত ঘনিয়ে আসত ভালো করে বুঝতেই পারত না। কিন্তু তাই বলে পড়াশুনোটা তো আর অবহেলা করা যায় না। বিশেষত প্র্যাকটিকাল প্রোজেক্টের ব্যাপারটা। আর বোটানির ক্ষেত্রে এমন এমন কিছু স্যাম্পলের ব্যাপার থাকে, যার সংগ্রহ আর ফার্স্ট হ্যান্ড ফটো – দুটোর কোনওটাই ঠিক শহরের পথেঘাটে পাওয়া যায় না, বাজারেও পয়সা ফেললেই মেলে না। অতএব কোথায় যাওয়া যায়, তাই নিয়ে বেশ কিছু দিন খানিকটা উদ্বেগেই কাটাতে হয়েছিল ওকে।
শেষপর্যন্ত মুশকিল আসান হিসেবে হঠাৎই মনে পড়েছিল শুভ্রর নাম। হ্যাঁ, ওরই তো বাড়ি একেবারেই গ্রামে। ওখানে গেলে নিশ্চয়ই ওর দরকারি স্যাম্পলগুলো পেতে খুব একটা অসুবিধে হবে না। আশ্চর্য, হাতের এত কাছেই সমাধান থাকতেও এতদিন ওর কথা তার মনে আসেনি !
শুভ্রর কাছে কথাটা পাড়তেই ও সঙ্গে সঙ্গেই রাজি – “হ্যাঁ, চলে আয় না। কোনও অসুবিধেই হবে না। একটা রবিবার বা ছুটির দিন দেখে চলে আয়। আমি নিজে তোর সাথে ঘুরে যতটা পারি তোর স্যাম্পল জোগাড় করে দেব।”
– “সত্যি বলছিস ! এ’ এই দেখ – আমার কিন্তু মোট ১০টা জিনিস জোগাড় করতে হবে, ঢ্যাঁড়শ ফুল থেকে শুরু করে –“ বলতে বলতে তালিকাটা মেলে ধরেছিল অম্বিকা। একটা কিছুটা অসহায়ত্বর হাসিই খেলে গিয়েছিল ওর মুখে।
আসলে আগের দুটো সেম’এ তত ঝামেলা ছিল না। ‘প্ল্যান্ট অ্যানাটমি’ ছাড়া বাকি পেপারগুলো তো মূলত থিওরিটিকালই। ওটার জন্যও তেমন দৌড়ে বেড়ানোর দরকার পড়েনি। কিন্তু এবারের এই এনজিওস্পার্ম সংক্রান্ত পেপারটা সত্যিই জ্বালিয়ে খাচ্ছিল। বিশেষত এই স্যাম্পলগুলো। কোথায় ম্যাগনোলিয়া, লিলি, গোলাপ – এইসব সহজে পাওয়া যায় এমন স্যাম্পল দিয়ে ম্যানেজ করা যাবে, তা নয় চাই ওকরা, ঘাসফুল, আরও যত্তসব।
– “ডোন্ট ওয়রি। চলে আয়। মোটামুটি বেশিরভাগটাই ম্যানেজ হয়ে যাবে।” উদাত্ত কন্ঠে আশ্বাস দিয়েছিল শুভ্র।
সেই ভরসাতেই সেদিন এসে ও নেমেছিল অতটা দূরের ঐ ছোট্ট স্টেশনটিতে। বাড়ি থেকে অতটা দূরে একা একা, ফলে একটা অস্বস্তি একটু ছিলই। তারউপর রিকশায় উঠতে সেটা যখন একের পর এক সরু সরু অলিগলি বেয়ে চলতে শুরু করলো, ও আরও একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল। কোথা দিয়ে কোথায় যাচ্ছে রে বাবা ! এইখানেই যদি ওকে হঠাৎ ছেড়ে দেয়, ও তো পথ চিনে স্টেশনেও ফিরতে পারবে না। তারউপর রাস্তার দু’দিকের পুরনো পুরনো, রঙ চটা, প্লাস্টার খসে পড়া বা নতুন কিন্তু ইঁট বের করা বাড়িগুলো ওকে যেন দু’ পাশ থেকে গিলতে আসছিল। রিকশার সিটের এককোণায় ও খানিকটা কাঁটা হয়েই বসেছিল।
দূর থেকে শেষপর্যন্ত নদীটাকে দেখতে পেয়ে ও খানিকটা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। কিন্তু ক্ষণিক স্বস্তির সেই ভাবটাও উবে গিয়েছিল রিকশা থেকে নেমে ভাড়াটা মিটিয়ে ঘাটের দিকে আসতেই। কী চওড়া আর বিশাল রে বাবা ! এত্ত বড় নদীটা ঐ ভুটভুটি নৌকোয় চেপে পার হতে হবে ! যদি মাঝনদীতে কিছু একটা ঘটে যায়? ওরে বাবা।
পেটের মধ্যের গুরগুরানির ভাবটা চেপেই শেষপর্যন্ত ও আরও অনেকের সাথেই চেপে বসেছিল নৌকাটায়। দেখতে দেখতেই গোটা নৌকাটাই বোঝাই হয়ে উঠেছিল – না শুধু মানুষে নয়, সাইকেল থেকে ছাগল, ত্রিপল থেকে বস্তা, হাঁড়িকুড়ি, আরও কত কীতে। আরও খানিক্ষণ বাদে ছেড়েছিল খেয়াটা।
চুপ করে ও বসেছিল একটা ধারের দিকের বেঞ্চিতে, জলের দিকে পিঠ করে। ভুটভুট করতে করতে নৌকোটা ঘাট ছেড়ে এগোতে শুরু করতে, ক্রমশ পিছোতে থাকা ঘাটটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎই ওর মনে পড়ে গিয়েছিল – ও সাঁতার জানে না। অবশ্য জানলেও তা এই এত চওড়া নদীতে কোন কাজে আসত, সাথে সাথেই সে’ সন্দেহটাও মনে হানা দিতে ছাড়েনি। ফলে একরকম কাঠ হয়েই ও বসেছিল নিজের জায়গাতেই। অতবড় খোলা আকাশ, নদীর দুই পাড়ের অনাবিল সবুজ, পিঠের ঠিক কাছ দিয়েই হাত বাড়ানোর দূরত্বে প্রবাহিত জলের সান্নিধ্য – কিছুই তখন চোখেই পড়েনি ওর। শুধু মনে মনে ভাবছিল, কতক্ষণে পৌঁছবে নৌকোটা ওপারে।
ঘড়ির হিসেবে যদিও বড়ো জোর মিনিট পাঁচেক, ওর ধারণায় অনন্তকাল পরে খেয়া এসে পৌঁছেছিল ওপাশের জেটিতে। ঢেউ’এর ধাক্কায় টলমল করতে থাকা নৌকাটা থেকে কে যে ওকে হাত বাড়িয়ে নেমে আসতে সাহায্য করেছিল, ও তা ভালো করে খেয়ালও করেনি। শুধু মনে আছে, পায়ের তলায় শক্ত পাটাতনের নিশ্চয়তা ফিরে পেতেই ও উর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিয়েছিল ঘাটের ভাঙাচোরা সিঁড়িটা বেয়ে উপরের দিকে। উপরে উঠে টিকিট কাউন্টারের সামনের সরু গার্ডরেল দেওয়া চ্যানেলটা পেরিয়ে বেরিয়ে এসে সামনেই বট গাছটার বেদীটার তলে দাঁড়িয়েছিল ও। তারপর একটু এদিক ওদিক চাইতেই দেখতে পেয়েছিল শুভ্রকে – ওপাশের একটা চায়ের দোকানের সামনে সাইকেলটাকে দাঁড় করিয়ে ওর দিকেই চেয়ে হাত নাড়ছে। যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল ও।
আগামী পর্বের লিঙ্ক এখানে
লেখক পরিচিতি: দামিনী সেন
গত শতাব্দীর শেষ পাদে জন্ম। ছেলেবেলা কেটেছে মফস্সলে। সেখানেই পড়াশুনো — স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। ঘুরতে ভালোবাসেন, আর ভালোবাসেন পড়তে। জানেন একাধিক বিদেশি ভাষা। আগ্রহ বহুমুখী, কলমের অভিমুখও। কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস — সাবলীল তাঁর কলমের গতি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ইতিমধ্যেই প্রকাশিত বেশ কিছু কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প। কাব্যগ্রন্থ “ভাঙা সে সাম্পান” প্রকাশের পথে। ধারাবাহিক প্রকাশিতব্য উপন্যাস “ভাঙা মঞ্চের মঞ্চিনী”-র মধ্য দিয়েই ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ।
খুব জীবন্ত উপন্যাস। এরকম ভালো উপন্যাস আপনাদের সাইটে আরও পড়তে চাই।
অভিনব সূচনা। কটা পর্বে শেষ হবে। পরের পর্ব পড়ার জন্য তর সইছে না
লেখাটি তিনটি পর্বে শেষ হবে। আগামী দুটি পর্ব যথাক্রমে ২০ এবং ২৭ ডিসেম্বরে প্রকাশিত হবে।
আচ্ছা ওনার য়ার একটা উপন্যাস এখানেই প্রকাশিত হয়েছিল না ? কয়েকটা পর্ব পড়ার পর লিংক হারিয়ে ফেলেছিলাম। লিংক গুলো কোথায় পাব ?
হ্যাঁ লেখিকার প্রথম উপন্যাস “ভাঙা মঞ্চের মঞ্চিনী” লেখালিখি সাইটেই প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম পর্বের লিঙ্ক দিলাম।
https://lekhalikhi.sobbanglay.com/novels/vanga-moncher-monchini-1-illustration-sharmistha-debjani-writer-damini-sen-part-1/
প্রতিটা পর্বেই তার পূর্ববর্তী এবং আগামী দুই পর্বেরই লিঙ্ক দেওয়া আছে।
ভালো লাগল। উপস্থাপনা গুণ সুন্দর
Khub valo trend e egocche. Ager uponyas ta link theke porlam . Plot er dik theke etar plot nirman valo laglo. Ager uponyas tar suru tay prokriti bornona boddo besi.
Khub valo trend e egocche. Ager uponyas ta link theke porlam . Plot er dik theke etar plot nirman valo laglo. Ager uponyas tar suru tay prokriti bornona boddo besi.