লেখক: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
- সিনেমার নাম: টেনেট
- পরিচালনা: ক্রিস্টোফার নোলান
- প্রযোজনা: ওয়ার্নার ব্রাদার্স পিকচারস এবং সিনকপি ইনক ।
- অভিনয়: জন ডেভিড ওয়াশিংটন, রবার্ট প্যাটিনসন, কেনেথ ব্র্যানা, এলিজাবেথ ডেবিকি, ডিম্পল কাপাডিয়া এবং অন্যান্য সাবলীল শিল্পীরা।
- সময়: ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট
২০২০ সালে মুক্তি পেল ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত বহু প্রতীক্ষিত সিনেমা টেনেট।এই সিনেমার ট্রেলার দেখে গল্প সম্বন্ধে কিছুই আন্দাজ করা যায়নি, অন্তত আমি পারিনি। করার কথাও না। এটাই নোলানের সিনেমার বৈশিষ্ট্য। কোন রহস্য সিনেমায় যেমন ধীরে ধীরে রহস্যের জট ছাড়ানো হয়, নোলানের সিনেমার গল্পও দর্শককে সেইভাবেই ধীরে ধীরে ছাড়াতে হবে। চট করে আপনি বুঝতে পারবেন না, আর এই জট ছাড়ানোতেই আপনার আনন্দ। সেই জট ছাড়ানোর শেষে যে কাহিনীটি খুঁজে পাবেন, তা আপনাকে ভাবাবে। আর যত দিন যাচ্ছে তত যেন বেশি করেই যেন নোলান তাঁর সিনেমা দিয়ে ভাবাচ্ছেন আমাদের। এই সিনেমার গল্প তাঁর জটিলতম বললেও মনে হয় ভুল হবে না। এবং এই জটিল গল্পকে তিনি তাঁর চিত্রনাট্যে নিখুঁতভাবে সাজিয়েছেন। শোনা যায় এই চিত্রনাট্য লিখতে নাকি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় লেগেছে, আর ভাবনাটা এক দশকেরও বেশি।
তবে এই গল্প আগেও বলা হয়েছে। পার্থক্য একটাই, সেটা নোলানের বলার ধরন, তাঁর দেখানোর ধরন। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আটকানো প্রাক্তন সি আই এ এজেন্ট এই সিনেমার নায়ক। সিনেমার খলনায়ককে সাহায্য করছে ভবিষ্যতের কিছু মানুষ, তারাই আসল খলনায়ক, তারাই অতীতের মানুষজনকে মুছে দিতে চাইছে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ, অতীত-ভবিষ্যতে যাত্রা, সি আই এ বা এম আই সিক্স, এ তো হলিউডের অতিপরিচিত এবং পছন্দের বিষয়। কিন্তু চিত্রনাট্য একেবারেই মৌলিক। এখানে টারমিনেটারের মত ভবিষ্যৎ থেকে মানুষ বা মেশিন মারতে আসছে না, বা ব্যাক টু দ্য ফিউচারের মত অতীত বর্তমান পরিবর্তনের কথাও বলছেনা। এখানে ভবিষ্যতের ভিলেনরা বর্তমানের একজন মানুষকেই তাদের উদ্দেশ্য সফলের জন্য নিয়োগ করছে। তারা এমন কিছু বস্তু পাঠাচ্ছে যা কিনা সময়ের বিপরীতে চলে। সেগুলো বুলেটের মত ছোট ছোট জিনিস থেকে শুরু করে আরও জটিল কিছু বস্তু। যা টেনেট বলে একটা সংস্থা উদ্ধার করে এবং বোঝার চেষ্টা করে সেই বস্তু গুলো কোথা থেকে আসছে এবং কেন আসছে। সেটা জানতে জানতেই জট খুলবে সিনেমার গল্পের, গুলিয়ে যাবে মাথা। সেটা জানতেই সিনেমার নায়ককে নিয়োগ করা হয় টেনেট নামক সংস্থায়। সে একজন প্রাক্তন সি আই এ এজেন্ট। সে জানতে পারবে ভবিষ্যতের মানুষেরা বর্তমানের মানুষদের মারতে চায়। কারণ বর্তমান তাদের থেকে কেড়ে নিয়েছে প্রাকৃতিক সব সম্পদ, তাদের বাঁচার উপাদান। বর্তমান পৃথিবীর এই সমস্যার কথা নোলান এর আগে বলেছেন ইন্টাস্টেলার সিনেমায়। সমাধান হিসাবে সেবারে মানুষ অন্য গ্রহে পাড়ি জমিয়েছিল। এবারে ভবিষ্যতের মানুষেরা সমাধান হিসাবে বেছে নিয়েছে অতীতের পরিবেশটাই ধ্বংস করে দেওয়া, তবেই তারা বাঁচবে। কিন্তু অতীত শেষ করে দিলে তো ভবিষ্যৎও বিপন্ন। এটাই তো গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স। সেটাও একজন ভবিষ্যতের বিজ্ঞানী বুঝতে পেরে অতীত ধ্বংস করার যে যন্ত্র, সিনেমায় যাকে বলছে অ্যালগোরিদম, তা নয়টি ভাগে ভাগ করে অতীতেই লুকিয়ে রাখে। ভবিষ্যতের ভিলেনরা বর্তমানের ভিলেনের সাথে যোগাযোগ করে যাতে অ্যালগোরিদমের সবকটা অংশ জোগাড় করা যায়, তা করতে নির্দেশ দেয়। তাহলেই তো ধ্বংস করা যাবে বর্তমানের পৃথিবীকে।এটাই সম্ভাব্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আর সেটাই আটকাতে হবে সিনেমার নায়ককে। কিভাবে? সেটা নিয়েই তো গল্প এগোবে।
এই সিনেমার অ্যাকশন দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে যাবে। ভবিষ্যতের মানুষদের পাঠানো জিনিসগুলো সময়ের উল্টোদিকে চলে, তাই কিছু কিছু ভিলেনও সেই ভাবেই তৈরি হয়ে আসে। অর্থাৎ তারাও সময়ের উলটো দিকে চলে। তবে এরা ভবিষ্যৎ থেকে আসেনি। ভবিষ্যতের পাঠানো মেশিন থেকে নিজেদের এইভাবে সময়ের উল্টোদিকে যাওয়ার উপযোগী করে নিয়েছে। যেহেতু তারা উল্টোদিকে চলে, সেইহেতু তাদের মারামারিওটাও উলটোদিকে, এবং এই দৃশ্যগুলোই আপনি রুদ্ধশ্বাসে দেখবেন। এইভাবে নাকি অভিনেতাদের রীতিমত অনুশীলন করতে হয়েছিল। তাহলেই ভাবুন!
সিনেমাটা দেখতে দেখতে কোথাও আমার জেমস বন্ডের কথা মনে হয়েছে। অবশ্যই জেমস বন্ডের থেকে অনুপ্রাণিত একদমই বলছি না। কিন্তু এ যেন নোলানের নিজস্ব বন্ড। টেনেট যেন এম আই সিক্স। সিনেমার নায়ক প্রথমবার ভিলেনের লোকজনকে পিটিয়ে যখন কোটের বোতাম ঠিক করতে করতে বেরোয়, তখনই প্রথম জেমস বন্ডের কথা মনে করিয়ে দেয় আমায়। তারপরে ভিলেনের সাথে নায়কের কথোপকথনের সময় তার যে উত্তরগুলো, তাতেও আমার মনে হয়েছে এ যেন নোলানের নিজস্ব বন্ড।
সিনেমাটোগ্রাফার হয়েতে ভান হয়েতেমা খুব সুন্দর কাজ করেছেন। বিমানবন্দরের বিল্ডিং ভেঙে প্লেনের ঢুকে পড়ার দৃশ্যটা নাকি সত্যিকারের শুট করা হয়েছে। সিনেমার শেষের দৃশ্যগুলোও খুবই সুন্দর। এক কথায় সিনেমাটোগ্রাফি অসাধারণ করেছেন হয়েতে ভান হয়েতেমা। তিনি নোলানের সাথে ইন্টাস্টেলার সিনেমা থেকেই কাজ করছেন। তার আগের নোলানের সমস্ত সিনেমাতেই (ফলোয়িং বাদে) সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন ওয়ালি ফিসার। আবহসঙ্গীত ও খুবই সুন্দর। বিশেষ করে অ্যাকশন বা সাসপেন্সের দৃশ্যগুলোতে। এর কৃতিত্ব লুডভিগ গোরানসনের। নোলানের সাথে এটাই তার প্রথম কাজ। এর আগে ডেভিড জুলিয়ান বা হ্যান্স জিমারই আবহসঙ্গিতের কাজ করে এসেছেন। এডিটিং-এ জেনিফার লেইমও খুব সুন্দর কাজ করেছেন। নোলানের সাথে তারও এটা প্রথম কাজ। এর আগে লি স্মিথই প্রধানত এডিটিং এর কাজ করতেন। অভিনয়ে প্রত্যেকে নিখুঁত। বর্তমানের ভিলেন স্যাটরের চরিত্রে কেনেথ ব্র্যানা অসাধারণ। তাঁর চরিত্রে ভিলেনের সাথে একটা ট্র্যাজিক ছায়াও আছে, যেটা সুন্দরভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।
সব মিলিয়ে একটা সুন্দর সিনেমা আবারও নোলান উপহার দিল আমাদের। তবে ব্যাটম্যানের বা প্রেস্টিজের চরিত্রগুলোর যে ব্যাপ্তি, তা এখানে নেই। এখানে নেই ইন্টারস্টেলারের বাবা মেয়ের ভালবাসার সেই আবেগ। এখানে ক্যাথেরিন আর তার ছেলের মধ্যেও সেইরকম কিছুটা আবেগ বোনার চেষ্টা করেছেন নোলান, কিন্তু সফল হননি। যতই হোক সবশেষে মনে রাখতে হবে এটা একটা রুদ্ধশ্বাস অ্যাকশন সিনেমা। সেই দিক থেকে পুরোপুরি সফল নোলান।
লেখকের কথা: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
লেখকের জন্ম পশ্চিমবাংলায়। পেশায় একটি বহুজাতিক সংস্থার তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। নেশায় লেখক এবং পরিচালক। বাঙালির জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সববাংলায় এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কবিতা থেকে শুরু করে গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, চিত্রনাট্য সবকিছুই লিখতে ভালবাসেন। লিটিল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক বিভিন্ন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখেছেন। স্রোত থেকে প্রকাশিত তাঁর কবিতার সংকলন দৃষ্টি এবং বালিঘড়ি। এছাড়া তথ্যচিত্র, শর্ট ফিল্ম বা অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ভিডিও পরিচালনা করেন। ধর্ম এবং বিজ্ঞান তাঁর প্রিয় বিষয়। ভ্রমণ তাঁর অন্যতম শখ। অন্যান্য শখের মধ্যে রয়েছে স্কেচ, ফটোগ্রাফি, ছবি ডিজাইন করা।
সিনেমা দেখে সময় নষ্ট করছো, তোমার হচ্ছে!!
বলছি, সিনেমাটা অনলাইনে কোথায় পাবো?