লেখক : শুভ আইচ সরকার
পাড়ার সবাই ওকে ডাকত অফিসার বলে। শুনেছি ছোটবেলা থেকেই পুলিশ অফিসার হওয়ার সখ ছিল, বিদ্যায় কুলায়নি বলে আর অফিসার হয়ে ওঠা হয়নি। কিন্তু নামটা দিব্যি থেকে গেছে। ভাল নাম সত্য সাহা। পাড়ার সবাই অফিসার নামেই চেনে। আমি যে ফ্ল্যাটের চার তলায় থাকি, তার পেছনে একটা পুকুর, পুকুরের পারে অফিসারের বাড়ি। তার এক তলাটা দালান। উপরে টালি, নিচটা কাঁচা মাটির কিন্তু লেপানো থাকে। দেওয়ালের গায়েও প্লাস্টার নেই, মেরে কেটে দুটোর বেশী ঘর হবে না। শহরের বুকে এমন ঘর অক্সিমোরন। আমার ফ্ল্যাটের দক্ষিণ দিকের ঘর থেকে ওর ঘরটা দেখা যায়। সকাল সন্ধ্যে ওর বৌকে রান্না করতে দেখি আর দুপুরে মাঝে মাঝে অফিসারকে দেখি বছর দুইয়ের মেয়েকে নিয়ে খেলা করে। আপাতভাবে সুখী সংসারই মনে হয়। অফিসার সকালে বাড়ি বাড়ি খবরের কাগজ বিলি করে আর বিকেলে টোটো চালায়। আমার অবসর যাপন, সারাদিন বারান্দায় বসে থাকি, লোক দেখি, দেখি অফিসার সকালে সাইকেলের হ্যান্ডেলে ডাঁই করে খবরের কাগজ নিয়ে বেরোয়, বেলা বাড়তে থাকলে কাগজ কমে আসে কিন্তু পেছনের কেরিয়ারে রাখা ম্যগাজিনগুলি তখন বিলি করে। খেয়াল করি সারাদিন এ গলি ও গলি করে বেড়াচ্ছে। বিকেলে টোটো নিয়ে বেরোলেও এ পাড়া ও পাড়ার মধ্যেই ঘোরে, এলাকা ছেড়ে খুব একটা বেরোয় না। ওর টোটোর রঙটা বড় অদ্ভুত, হলুদের উপরে কালো ডোরাকাটা দাগ, বাঘের ছালের মত, একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম এই রঙ কেন? “স্যার হলুদ কালো রঙ সহজে চোখে পরে, অ্যাক্সিডেন্ট কম হয়”, বলেছিলাম “তাই বলে এই রকমের?” কোন উত্তর দেয়নি।
অফিসারর সাথে আমার প্রথম কথা হয়েছিল ফোনে। আমি আসলে নদীয়ার মাঝদিয়ার লোক, অবসর নিয়েছি বছর পাঁচ ছয় আগে। মেয়ে যাদবপুর থেকে পি এইচ ডি করছে। যাতায়াতের সুবিধার জন্যই এখানে ফ্লাট কিনে নিয়েছি। যেদিন এই বাড়ির গৃহপ্রবেশ হল, সেদিন ওর ফোন এসেছিল, জানি না কে নম্বর দিয়েছিল- “স্যার আমি অফিসার বলছি, এই এলাকার সব ফ্ল্যাটে আমিই পেপার দি, আপনি নুতন এসেছেন তাই ফোন করলাম”। বললাম “আচ্ছা। ঠিকাছে তুমি দিয়ে দিও”। উত্তর করেছিল “আচ্ছা স্যার ফ্ল্যাটের ‘কোপ্সেল’ গেটে রোজ সকাল ছটা পয়তাল্লেস থেকে ৭ টার মধ্যে পেপার পেয়ে যাবেন, পেপার দিয়ে একবার বেল বাজিয়ে দেব, আর টাকাটা প্রতি মাসে এক থেকে পাঁচ তারিখের মধ্যে দিতে হবে, নালে পব্লেম হয়”। বললাম “পেয়ে যাবে”। “আর একটা কথা স্যার – হোলি, মে দিবস, স্বাধীনতা দিবস, গান্ধী জয়ন্তী আর পুজোতে তিন দিন ছুটি থাকে, তার পরের দিনগুলি পেপার পাবেন না।” এবার বিরক্ত হলাম “হ্যাঁ আমি জানি, তুমি কাল থেকে শুরু কর” বলে ফোন কেটে দিলাম। কোথা থেকে শুনেছে মাঝদিয়া থেকে এসেছি আর শহুরেগিরি শুরু করেছে। হ্যাঁ, এই একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি আমার যেসব শহুরে বন্ধু বা আত্মীয়রা আছে তারা অনেক সময়েই গ্রামের বা মফস্বলের লোকজনকে একটু হ্যাটা করে। আমি ১৯৮১ সাল থেকে সারা ভারত ঘুরে ঘুরে রেলের চাকরি করেছি, তবুও কিছু লোক মাঝদিয়া নাম শুনলেই নাক সিটকায়।
যাকগে কথায় ফিরি, অফিসারর সঙ্গে প্রথম কথা বলার পর সেভাবে আর দেখা হয়নি। সকালে যথা সময়ে আসে, কাগজ দেয়, বেল বাজায় আর চলে যায়। দেখা হয় না। ওই মেয়ে মাঝে মাঝে সকাল করে বেরোয়, ওর সাথে দেখা হয়। আসলে আমাকে মেয়েই চিনিয়েছিল যে ওই পুকুর পারের বাড়িটা অফিসারের, আর মাঝে মাঝে যাকে দুপুরে বাচ্চার সাথে খেলতে যাকে দেখা যায় সেই অফিসার। বয়েস হয়েছে তাই পুরোপুরি ঠাহর করতে অসুবিধাই হয়। সেই বার দাঁত তুলতে গেছি মেয়েকে সাথে নিয়ে। ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছিলেন সাথে কাউকে আনতে, আর আমার এখন মেয়ে ছাড়া কেই বা আছে। সন্ধ্যে থেকেই বসে আছি। আমি শেষ রোগী। ডাক্তারবাবুর সহকারী চেয়ারে বসে ঝিমচ্ছে। আমি হাই তুলছি আর অপেক্ষা করছি কখন আগের রোগী বেরবে। হঠাৎ এর মধ্যে বাইরে খুব হৈচৈ শুনতে পাই। দেখি একটা ছেলেকে তিন চার জন মিলে ধরাধরি করে নিয়ে আসছে, হাতের কুনুই ছরে গেছে, কাদা মাখা পায়ে চটি নেই, পরনে টি শার্ট আর বারমুডা প্যান্ট। মুখটা একটা গামছা দিয়ে পেঁচানো। গামছাটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সাথে আসা লোকেরা চিৎকার করতে থাকে- “ডাক্তারবাবু কই?” আমি অবাক হই, আগে কখনো কোন দাঁতের ডাক্তারবাবুকে ‘এমারজেন্সি পেসেন্ট’ দেখতে দেখিনি, তাও আবার অ্যাক্সিডেন্ট। হই হট্টগোলে ডাক্তারবাবু বেরিয়ে আসেন, তারপরে যেটা জানলাম তা হল টোটো চালিয়ে যাওয়ার পথে ট্যাক্সির ধাক্কায় এই ছেলেটি পরে যায় তাতে ওর একটা দাঁত ভেঙ্গে গিয়ে মাড়িতে ঢুকে গেছে এবং রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। আমার মেয়ে কানে কানে জানায় এই বেচারা টোটো চালকই হল অফিসার। সেটাই আমার অফিসারকে প্রথম দেখা। যাইহোক এবার ডাক্তারবাবু একটু করুন চোখে আমাকে বলেন “আপনি একটু বসবেন? এই অফিসারকে একটু ছেড়ে দিতাম?”। এই অবস্থায় না বলার কোন মানে হয় না। সাদরে সম্মতি দিলাম। আর এটাও বুঝলাম অফিসার এই ডাক্তারবাবুরও পরিচিত লোক। আর পাড়ার ছেলেরা নিয়ে এসেছে তাই ব্যাপারটা একটু গুরুত্ব বেশী দিচ্ছেন। কিন্তু সমস্যাটা এবারই বাঁধল। হঠাৎ অফিসার জড়ানো ঠোঁটে বলে উঠল “ওনারা আগে আছে যখন ওনারাই যাক, আমি পরে যাব”। যথারীতি সবাই অবাক। আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে জবাব দি “না না আপনি যান, আমার কোন সমস্যা নেই, আমি বসছি”। কিন্তু তাতে কাজ হয় না। একটা চেয়ারের উপর বসে পরে বলে “আপনারা দেখিয়ে নিন তারপরেই আমি যাব”। খিস্তির সাথে ধমক উড়ে আসে যারা নিয়ে এসেছিল তাদের কাছ থেকে। কিন্তু এক গোঁ ধরে বসে অফিসার। আমি, আমার মেয়ে আরো একবার অনুরোধ করি, কানে নেয় না অফিসার। অগত্যা ডাক্তারবাবুর সহকারীকে বলে বেরিয়ে আসি আমরা, বলি পরে ফোন করে একটা ডেট নিয়ে নেব। এত বড় জীবনে এরকম ঘটনা দেখিনি, প্রথমে ভেবেছিলাম ওর কাছ থেকে কাগজ নিয়ে থাকি বলে বিনয় দেখাচ্ছে কিন্তু পরে বুঝতে পারি ওটা ওর ধরণ। অফিসারের এই এক বাতিক- সৎ পথে থাকা, সত্য কথা বলা, সৎ জীবন যাপন করা- যেন ছোটদের ইশপের গল্প থেকে উঠে আসা চরিত্র।
দাঁতের ডাক্তারের কাছে ওই ঘটনার পরে স্বাভাবিকভাবেই কাগজ পরের দিন আসবে না ধরেই নিয়েছিলাম, অবাক করে সময়মত ঠিক বেল বাজে। একবার না, দুবার বাজে। আমিই গিয়ে দরজা খুলি। ফোলা মুখে দাঁড়িয়ে আছে অফিসার। ব্যন্ডেজ নেই কোন। চোখের নীচে ছরে যাওয়ার দাগটাও আছে। “সরি স্যার কাল আমার জন্য আপনার চলে আসতে হল”। আমি একটু ধমকের সুরেই বললাম “তুমি কি পাগোল? কাল ওই অবস্থায়…এরকম করতে আছে?” বোকা হাসি হাসে। আমি আরও বলি “আর আজকেই বা পেপার দেওয়ার কি ছিল? দু দিন তো রেস্ট নিতে পারতে”। “না না স্যার, সবার একটা অভ্যাস সকালে পেপার পড়ার, আমি তাই কামাই করি না”। বললাম “তবুও”। “আচ্ছা স্যার আসি, আপনাকে সরি বলতেই এসেছিলাম” বলে তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের ফ্লাটে উঠে যায় অফিসার। এটা বেশ বুঝতে পারি ওকে নিয়ে সবার এই সততার কৌতূহল ও বেশ উপভোগ করে।
এর মাঝে আর খুব একটা দেখা হয়নি অফিসারের সাথে। একদিন গভীর রাতে খবর এল আমার এক বৃদ্ধ মেসোমশাই মারা গেছেন। কাছেই ছিল ওনার বাড়ী। ওরা জানাল ভোর পর্যন্ত দেহ রাখবে না বাড়ীতে। আমি গাড়ি চালাতে জানি না, অ্যাপ ক্যাব গুলোতে দুবার চেষ্টা করেও পেলাম না। অগত্যা মাথায় এল অফিসারের নাম। ফোন করলাম। পাঁচ মিনিটের মাথায় এসে হাজির। বেরোলাম ওকে নিয়ে। রাস্তায় গোটা পাঁচেক সিগনাল পরে। অত রাতে রাস্তায় না ছিল কোন গাড়ী, না ছিল কোন পুলিশ, আমার ছিল তাড়াতাড়ি পৌঁছনোর তারা, সহজেই চলে যাওয়া যেত সিগনাল ভেঙ্গে, কিন্তু না, বেশ কয়েক বার তাড়া দিয়েও কাজ হল না, সুতরাং জনহীন রাস্তায় সিগনালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুনতে হল সিগনালের সাথে লাগানো টাইমার গুলোকে। “স্যার ষাট – সত্তর বছর বাঁচি, আর মাত্র কয়েক মিনিট দাঁড়াতে পারব না।” তাড়া থাকায় খুব মাথা গরম হল। ভাবলাম একটা মানুষের নিয়ম মানার বাতিক কোন পর্যায়ে পৌঁছলে সে এরকম করতে পারে। মানুষ বিভিন্ন রকম নেশায় গভীরভাবে আসক্ত থাকে, অফিসারকে দেখে আমার এই উপলব্ধি হয়েছে সৎ পথে থাকার অদ্ভুত এক আসক্তিতে আচ্ছন্ন সে, সে চায় সবাই তার এই ব্যবহারে তার প্রশংসা করুক, কোন কাজ করে সে তাকিয়ে থাকে সামনে থাকা মানুষের মুখের দিকে, চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবে “কেমন চমকে দিলাম”। আমি বিচ্ছিন্নভাবে অনেককে দেখেছি – কারোর সময় জ্ঞান অসাধারণ, কেউ চাকরির জায়গায় অসম্ভব সৎ, কেউ পরীক্ষার সময় না পারলেও কাউকে জিজ্ঞেস করেনি, এমনও দেখেছি খুব অভাবের সংসারেও টাকা পেয়ে থানায় দিয়ে এসেছে। সেসব মনে হয়েছে বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু কয়েনের অপর পাশ টা, যারা এই মানুষটির ঘরের লোক- এমন মানুষের পাল্লায় পরলে তার আশেপাশের লোকের কি অবস্থা হতে পারে। কিছুক্ষণের জন্য ভাবছিলাম অফিসারের পরিবারের কথা, বৌ, মেয়ের কথা, ওদের জীবনে কি কখনও এমন দিন আসবে না যেখানে কোন না কোন ভাবে অফিসারকে আপস করে নিতে হবে না? আর আপস না করলে আর্থ সামাজিক অবস্থা কি হবে? সারা জীবন কি কারোর পক্ষে সম্ভব এই রকমের জীবন যাপন করে যাওয়া? ভারতের মত এরকম একটা দুর্নীতিতে ভরা দেশে কতদিন এই মানুষটা এই ভাবে জীবনধারণ করতে পারবে? বয়স্ক মেসোমশাই এর মৃত্যু ছাপিয়ে খানিক বিহ্বল হয়ে থাকি অফিসারের কথা ভেবে।
বেশ ক’বছর কাটিয়ে ফেলেছি এখানে। পাড়ার প্রায় সকলের সাথেই কম বেশী পরিচয় হয়েছে, শুরু হয়েছে যাতায়াতও। লক্ষ্য করেছি অফিসারের নামে সবাই এক কথায় ভরসা করে আর লোকের মুখে মুখে ওর সততার গল্প ঘুরে ফেরে, সে অগুনতি। শুধু আমাদের পাড়াই না, ওর সুখ্যাতি এই অঞ্চলের সবার মুখে মুখে ঘোরে। বিধায়ক ভোট চাইতে এসে বলেন “আমার গর্ব হয় যে এখান থেকে ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর অসংখ্য কৃতি ছাত্র ছাত্রী যেমন আছে তেমন অফিসারের মত সৎ মানুষ ও আছে যাদের উপর চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায়।” ভরসা করা যায় ঠিকই, কিন্তু এই ক’বছরে কখনো দেখিনি পাড়ার পুজা কমিটিতে যেখানে অনেক টাকা পয়সার লেনদেন হয় সেখানে অফিসারকে রাখা হয়েছে- কিন্তু পুজার জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করতে দেখেছি ওকে। ওই কমিটিতে ওকে না রাখা যে ইচ্ছাকৃত আর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সে কোন বাচ্চাও বুঝবে।
এতক্ষণে বুঝে গেছেন অফিসার কেমন এবার শেষটা শুনুন, এরপর একদিন দেশে করোনার উপদ্রব শুরু হল। টিভি খুললেই এছাড়া কোন খবর নেই। হোয়াটসাপে আসা শুরু হল হাজার হাজার মেসেজ, এবং অবশেষে শুরু হল বিশ্বজুড়ে লকডাউন। সেভাবে সংক্রমন শুরুর দিকে ছিল না বলে সাধারণ মানুষ উৎসবের মেজাজে শুরু করল লকডাউন “পালন”। আগাম আভাস পেয়ে প্রায় সবার ঘরেই মজুত করে রেখেছিল পর্যাপ্ত খাবার আর তার সাথে যোগ হল সোসাল মিডিয়া, বিভিন্ন ওটিটি প্লাটফর্মের বিভিন্ন মনোরঞ্জনকারী সিনেমা আর সিরিজ। তখনও টিভি ছাড়া অন্য কোথাও পিপিই কিট পরে কাউকে দেখার চল শুরু হয়নি। সে সময় অনেকে বুঝেই উঠতে পারেনি পিপিই কিটের আসল কাজ কি? কাদের পরা উচিৎ? যাইহোক লকডাউন এর দু তিন দিন চলছে ঘুম থেকে উঠে ব্যালকনির গায়ে লাগানো গাছ গুলিতে একটু জল দিচ্ছিলাম, এমন সময় মেয়ে হাসতে হাসতে এসে বলল “বাবা দেখে যাও, দেখে যাও, অফিসার দা আসছে”। সামনের ঘরে এসে জানলা দিয়ে নীচে উঁকি মারলাম, নীচে পরিচিত কিছু লোক দাঁড়িয়ে, কারোর চোখে ব্যঙ্গ, কার চোখে বিস্ময়, আর উপর থেকেই দেখতে পাচ্ছি, হেলমেট আর রেইন কোট পরে হাতে গোটা দশেক খবরের কাগজ নিয়ে উপরে উঠে আসছে। অবশেষে আমার দরজার বেল বাজলে দরজা খুলে দেখি মাথায় কালো হেলমেট, সামনের কাঁচ নামানো, গায়ে মেরুন রঙের রেইন কোট, পায়ে কালো গাম্বুট, হাতে গ্লাভস। জিজ্ঞেস করলাম “এসব কি পরেছ?” “চারদিকে কোরোনা স্যার। টিভিতে দেখাচ্ছে এই ড্রেসই একদম সেফ”। আমার সাধারণ জ্ঞানে বললাম “কিন্ত এটা সাধারণ মানুষের না পরলেও হয়”। “না স্যার টিভিতে যখন দেখাচ্ছে তখন নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।” মেয়ে জিজ্ঞেস করল “তোমার গরম লাগছে না? কোন অস্বস্তি হচ্ছে না?” “হ্যাঁ তা একটু হচ্ছে, কিন্তু বাঁচতে গেলেতো একটু কষ্ট সহ্য করতেই হবে”। আমরা জানি ওর সাথে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমরা ইতি টানি। অফিসার ওপরে উঠে যায়। তারপরে যতদিন কাগজ দিতে এসছে ওই হেলমেট, রেইনকোট আর গাম্বুট পরে। লকডাউন চলছিল বলে নাহলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস অফিসার ওর টোটো খানি নিয়ে বেরলেও পোশাকের নরচর হোত না।
তারপর একদিন আম্ফান এল। চারদিকে তোলপার হয়ে গেল। আমার জানলার দুটো কাঁচ ভাঙল। ঘর জলে ভরে গেল। জীবনের দেখা অন্যতম ভয়ানক ঝড় দেখলাম। রাতে লাইট ছিল না, মোবাইল ফোনে সিগনাল নেই, ফ্লাটের সবাই কেমন আছে, ঠিক আছে কিনা গিয়ে খোঁজ নিয়ে এলাম। সকালে উঠে দেখলাম আমাদের পাড়া পুরো ধ্বংস স্তুপে পরিনত হয়েছে, পাড়ার গাছ আর লাইটপোস্টের প্রায় সত্তর শতাংশ উপরে গেছে বা ভেঙ্গে পরে গেছে। বিচ্ছিন্ন ভাবে এদিক ওদিক জল জমে আছে। চারদিকে হাওয়া আর জলে বয়ে আসা নোংরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বাজার বসেনি, বাজারের ছাউনি দেওয়া ত্রিপলের কোন খোঁজ নেই, শুধু খাঁচাটা পরে আছে। অনুভব করতে পারছিলাম নিম্নবিত্ত কলকাতাবাসীর চাপা কান্না যার শুধু আওয়াজ কানে আসছিল না। সকালে খবরের কাগজ আসেনি। কিন্তু অফিসার এল। লাইট নেই, তাই দরজা ধাক্কালে দরজা খুললাম। আজও হেলমেট-রেনকোটে এসেছে। “স্যার আজ পেপার এল না, আমি গেছিলাম, কিন্তু পাইনি, দু তিন দিন লাগতে পারে”,
বললাম “আচ্ছা, তুমি বলতে না আসলেও সেটা বুঝতাম”।
“আসলে ফোনে টাওয়ার নেই, তাই ভাবলাম বলেই আসি”
“যাহোক তোমরা ঠিক আছ তো? তোমার ঘরের সামনেও তো গাছ পড়ে আছে দেখছি” সকালে উঠে দেখেছি ওঁর ঘরের সামনে এক গাছ পরে ওঁর ঘর টাকে প্রায় অদৃশ্য করে রেখেছে।
“হ্যাঁ, ল্যম্প পোস্টও একটা পড়েছে, ড্রেনের মুখটায় পাতা পরে ড্রেনটা আটকে গেছে, তাই জলটা জমেছে, এখন গিয়ে সব হাত দেব”
বললাম “বেশ। সাবধানে থেক”। অফিসার ওপরে চলে গেল।
রাতে ভাল ঘুম হয়নি, একটা নাগাদ একবার কারেণ্ট এল, আমার সোফাতে শুয়ে শুয়ে চোখ লে্গে গেছিল। মেয়ের ধাক্কায় ধরমরিয়ে উঠলাম। এরপর যা শুনলাম তাতে এই দিনটা আমার বাকি জীবনের স্মৃতিতে রয়ে যাবে। “বাবা অফিসারদা মারা গেছে”।
বয়স হয়েছে বলেই বোধহয় খবরটা সামলাতে কষ্ট হল। চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারিনি কিছুক্ষণ। গা হাত পা থর থর করে কেঁপেছে, ঘেমেওছি দরদর করে। শরীর একটু সুস্থ হলে যে জানলা দিয়ে অফিসারের বাড়ি দেখা যায় সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। লোকে লোকারন্য ওর বাড়ি থেকে শুধু কান্নার রোল শোনা যাচ্ছে। ছোট্ট বাচ্চার থেকে শুরু করে আশির বৃদ্ধ পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়েছে ওর বাড়িতে। জনপ্রিয়তায় অফিসার এই অঞ্চলে একনম্বর। তাই লোকে এই লকডাউন উপেক্ষা করে এত ভিড় জমাচ্ছে। এত মানুষের ঢল আর কান্নার চিৎকার আমার চোখ ভিজিয়ে দিল।
যেটা জানা গেল, দুপুরে বাড়ি ফিরে অফিসার দা, কুড়োল নিয়ে গাছ কেটে জমে থাকা জল সরাতে বেরিয়েছিল। কিন্তু তার আগেই পাড়ার এক উঠতি নেতা নিজের প্রভাব খাটিয়ে বন্ধ থাকা বিদ্যুৎ পরিষেবা চালু করে দেয়। সে খবর অফিসারের কাছে পৌঁছানোর আগেই অফিসার জমে থাকা জল সরাতে উদ্যোগী হয় আর ওই জলেই বিদ্যুতের তার ছুঁয়ে ছিল। বেশী সময় লাগেনি। মিনিট খানেকের মধ্যেই সব শেষ হয়ে যায়। তারপর আবার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে ওর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
পরের দিন রাতে আমাদের পাড়ায় পাকাপাকি ভাবে বিদ্যুৎ আসে। ঘরের জমে থাকা কিছু কাজ করে রাতে টিভি ছাড়লাম। খবরে অফিসারের মৃত্যু সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছিল, খবরটা দেখানোর শেষে সেই উঠতি নেতাকেও দেখাল, তিনি বললেন “ইলেক্টিক সাপ্লাই ও আমরা সবাইকে সবসময় বলি বর্ষায় কোন “ল্যাম্পপোস্ট”, “তার” এসবে হাত দেবেন না, কিন্তু মানুষের মধ্যে নিয়ম ভাঙ্গার টেন্ডেন্সি চলে এসেছে, ওর কিছুতেই ওই জায়গায় হাত দেওয়া উচিৎ হয়নি কিন্তু আমরা ওর পরিবারের পাশে আছি…।” ইত্যাদি ইত্যাদি
যে লোকটা সারাজীবন নিয়ম মানার শপথ নিয়েছিল তার জীবন কুঁড়িতেই ঝরে গেল নিয়ম ভাঙার অভিযোগ নিয়ে।
লেখক পরিচিতি : শুভ আইচ সরকার
শুভ আইচ সরকার, হাবড়ার হাটথুবায় জন্মগ্রহণ করেছন। পুরো স্কুল টাইম কেটেছে নয় এর দশকে (90's)। এরপর প্রাণীবিদ্যায় সাম্মানিক নিয়ে স্নাতক। ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন নিয়ে পড়েছেন পুনে ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট থেকে। চাকরি করেছেন বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থায় গত প্রায় পনের বছর। লেখালিখির অভ্যাস প্রায় কুড়ি বছর। বর্তমানে লেখালেখির পাশাপাশি সিনেমা নিয়েও পড়াশুনা করছেন।
খুব ভালো লেগেছে
আপনার ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগল। ধন্যবাদ।