তালাচাবির ইতিবৃত্ত

লেখক : হৃদয় হক

আজ বহুদিন পর বাসায় একটি তালাচাবি নষ্ট হলো। ভাগ্য ভালো অনেক কষ্টে খুলতে পেরেছি। তা না হলে ঘরের বাইরেই দিন কাটাতে হতো আজ।

ঘরে ঢুকে পরিস্কার হয়ে বেশ কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম। তারপর, ড্রয়ারের এক কোণে পড়ে থাকা ছোট্ট একটি তালাচাবি বাইরের দরজায় লাগিয়ে বেরোলাম – নতুন তালাচাবি কিনতে।

তালাচাবি জিনিসটা আসলেই চমৎকার। চাবি না থাকলে যে যতোই টানাটানি করুক না কেনো, খোলার উপায় নেই৷ অবশ্য ভেঙে ফেললে বা অন্যকোনো উপায় অবলম্বন করলে অন্য কথা। তবে সাধারণ মানুষের পক্ষে এ আর কতটুকই বা সম্ভব? হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে ভাবি, আচ্ছা এক্কেবারে আগেকার তালা কেমন ছিলো? কেমন ছিলো সেই তালাদের চাবি?

তখনকার দিনের তালাচাবি গুলো অবশ্যই এখনকার দিনের মতো উন্নত ছিলো না। আসলে এই তালাচাবির ইতিহাস প্রায় ৪ হাজার বছর পুরোনো। সে সময়কার একটি তালার নাম পিন থাম্বলার। মিশরে এর বহুল প্রচলন ছিলো বিধায় এদের মিশরীয় তালা বলা যায়। এখানে কাঠের আধিক্য ছিলো বেশি। আর এই তালার চাবি ছিলো দেখতে অনেকটা আমাদের দাঁত ব্রাশের মতো। আমাদের দাঁত ব্রাশের যেখানটায় ছোট নরম প্লাস্টিকের তন্তু থাকে, ওদের সেখানটার ছিলো পিন। গঠনটা মজার না? তবে শুধু মিশরেই এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিলো তেমনটি নয়!

রোমানরাই তালাচাবির জন্য ধাতুর ধার ধরে। তালার জন্য লোহা আর চাবির জন্য ব্রোঞ্জ। আসলে উনারা মিশরীয় তালাচাবির উন্নতি সাধন করে মাত্র। এসব তালাগুলো কিন্তু এখনকার মতো খুলে নিয়ে ঘোরাঘুরি করা যেতো না। অর্থাৎ সেই তালাগুলো ছিলো ফিক্সড, পোর্টেবল বা স্থানান্তরিত করা যায় তেমন তালা না। এখন প্রায় অনেক বাসাবাড়ির বাহিরের দরজায়, নানান ড্রয়ারে এসব তালার ব্যবহার লক্ষনীয়। কিন্তু রোমানরাই এখনকার মতো পোর্টেবল তালার উদ্ভাবন করেন। এদের বলা হয় প্যাডলক। চীনেও স্বাধীন ভাবে এমন তালার উদ্ভাবন হয়েছিলো। পরবর্তী যুগগুলোতে আমরা যতো উন্নত হই, তালাচাবিও ততো উন্নতি লাভ করে। তবে বর্তমানেও কিন্তু আমরা প্যাডলক ব্যবহার করি! আর এখনকার প্যাডলক গুলো স্টিলের তৈরি। বর্তমানে এসব প্যাডলকের চাবি কত বড়ো-ছোট হয় তা আমাদের প্রায় সকলেরই দেখা। কিন্তু, রোমানরাই প্রথম অনেক ছোট চাবি তৈরি করেন! কতোটা ছোট? এতোটাই ছোট যে এদের আংটি হিসেবে ব্যবহার করা যেতো! রোমানদের তালাচাবির কথা এখানেই কিন্তু শেষ নয়। উনাদের মতে চাবির জন্য একজন দেবতাও ছিলো! দেবতা পর্তুনাসকে রোমানরা চাবি-সহ আরো কিছুর দেবতা মানতো!

তালাচাবি নিয়ে ভাবাভাবি করতে গিয়ে হটাৎ একটা জিনিস মনে পড়লো। Now You See Me মুভির শেষের দিকের কথা। সেখানে নায়ক-নায়িকা একটি ব্রিজের ওপর কথা বলছিলেন। আর সেই ব্রিজের রেলিঙের মাধ্যমে কত্তো গুলো তালা! দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। তারপর উনারাও একটি তালা মেরে চাবিটি ফেলে দেয় নিচের নদীতে।

এমন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত তালাচাবিদের বলা হয় লাভ লক বা লাভ প্যাডলক। ব্রিজ, গেট এমন সব পাবলিক জায়গায় মানুষ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ এটি করে। এতে লেখা থাকে প্রিয়জনের নাম কিংবা তার সাথে সম্পর্কযুক্ত কিছু। অতঃপর তালা মেরে চাবিটি ফেলে দেয় আশেপাশের কোনো এক জায়গায়, বিশেষত নদীতে। এ যেনো তাদের চিরস্থায়ী, অভেদ্য, অবিচ্ছিন্ন ভালোবাসার প্রতীক।

মানুষের ভাবনা বেশ অদ্ভুত তাইনা? কখনো হাস্যকর, কখনো উদ্ভট, কখনো ভালোবাসাময়, কখনোবা এ-সব কিছুই একত্রে জন্ম দেয় এক অব্যক্ত অনুভূতি।

তালাচাবির দোকানে আগে আমি কখনো যাইনি। আজই প্রথম। ঢুকেই প্রথমে হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি। বর্তমানে যে কতো জাতের তালাচাবি আছে! দোকানে না গেলে জানতেই পারতাম না! ছোট তালা, বড়ো তালা, বাহারী তালার বাহারী চাবি। দামও প্রকারান্তরে রকমারি। সাধ্যের ভেতর একখানা প্যাডলক কিনে বাড়ি ফিরে আসি।


লেখক পরিচিতি : হৃদয় হক
শিক্ষার্থী। সময়ে অসময়ে প্রধানত জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে লেখালেখি করি।

2 Comments

  1. আবদুস সালাম

    তালা চাবির জন্ম কথা জানতে পারলাম। তবে আরও কিছু তথ্য সম্বলিত ছবি ও বিবরণ থাকলে ভালো লাগতো ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।