লেখক : রাজীব চক্রবর্ত্তী
মুখে যতই বড় বড় বুকনি ছাড়ুক, হাবু আসলে ভীতু স্বভাবের। পাড়ায় ঝামেলা হলে মজা দেখতে সবার আগে চলে যাবে কিন্তু থাকবে একদম পেছনে। মারপিট শুরু হওয়ার মত পরিস্থিতি দেখলে প্রথমেই পিঠটান দেবে। তবে যতক্ষণ থাকবে ভিড়ের পেছন থেকে লোককে উস্কাবে – হাত থাকতে মুখে নয়।
একদিন সবাই মিলে হাবুকে চেপে ধরলাম। আজ বলতেই হবে তুই. ‘হাত থাকতে মুখে নয়’ বলে উস্কানি দিস কেন? একটু চুপ করে থেকে হাবু গম্ভীরভাবে বলল, কারণ মুখের থেকে হাতই বড়।
আবার তোর লেকচার শুরু! আমরা সমস্বরে চিত্কার করে উঠলাম।
বিড়িতে একটা লম্বা টান দিয়ে হাবু গম্ভীরভাবে বলল , তোদের ডিটেলসে না বললে কিছুই বুঝিছ না দেখছি।
এই যে নেতা – মন্ত্রীরা এত ভাষণ দেয় তাতে কিছু কাজ হয় কি? ধর মন্ত্রীমশাই বললেন , আগামী ছমাসের মধ্যে রাস্তা পাকা হয়ে যাবে। মুখের কথায় কিছুই হবে না যতক্ষণ না হাত এগিয়ে আসবে। মন্ত্রীর কথায় ইঞ্জিনীয়াররা নক্সা বানাবেন। তারপরে শয়ে শয়ে হাত উদয়াস্ত পরিশ্রম করে গড়ে তুলবে পিচ ঢালা পাকা রাস্তা।
আমাদের চুপ করে থাকতে দেখে চোখ কুঁচকে , মাথা নাচিয়ে হাবু বলে উঠল , বুঝেছি। এত জটিল বিষয় তোদের মাথায় ঢুকবে না। আচ্ছা , সহজ করে বলি।
ক্রিকেটে শ্লেজিং এর কথা আমরা সবাই শুনেছি। উদ্দেশ্য ব্যাটসম্যানের মনোসংযোগ নষ্ট করে তাকে আউট করা। মনে কর শচীন ব্যাট করছে আর পেছন থেকে উইকেট কিপার, স্লিপ ফিল্ডাররা ক্রমাগত বিড়বিড় করে যাচ্ছে যাতে লিটল মাস্টার আউট হয়। শচীন আউট তো হবেই না উল্টে দেখা যাবে বাঁ পা বাড়িয়ে একটু মাথা ঝুঁকিয়ে হাতের ব্যাটটা দিয়ে বলটাকে আদর করবে আর বলটা আনন্দে লাফাতেই লাফাতে বাউন্ডারির বাইরে চলে যাবে। অস্ট্রেলিয়ানদের শ্লেজিঙের কথা তো আমরা সবাই জানি। এ বিষয়ে ওদের নাকি পি এইচ ডি ডিগ্রি আছে। মা-বাবা-বৌ কাউকে ছাড়ে না। উইকেটের পিছনে সেই বিখ্যাত অস্ট্রেলিয়ান শ্লেজিং আর সামনে বোলার শ্যেন ওয়ার্ন যার স্পিন আবার ইঞ্চি , ফুট ছেড়ে গজে মাপতে হয়। ক্রিজে শচীন কিন্তু শান্ত। পিছন থেকে ভেসে আসা মধুর বাণী উপেক্ষা করে হাতে ধরা ব্যাটের তান্ডবে বল পাঠিয়ে দিলেন গ্যালারিতে। তারপর কাঁধটা সামান্য ঝাঁকিয়ে বাঁ হাত দিয়ে ঠিক করে নিলেন নিজের …। হাবু থেমে গেল। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল , জানি তোরা কি ভাবছিস। কিন্ত বাজে কথা আমি বলি না। এরপর নিজের অ্যাবডোমেন গার্ডটা ঠিক করে নিয়ে শচীন আবার প্রস্তুত পরের বলটা মাঠের বাইরে ফেলার জন্য। আশা করি বুঝলি মুখে বকবক করে কোনও কাজ হয় না। হাতই আসল।
হাবুর উল্টোপাল্টা যুক্তিতে মাথা ধরে যায়। বিরক্ত হয়ে বলি , তুই থামবি এবার! যতসব ফালতু বকবকানি।
হাবু হঠাত্ আক্রমনাত্মক হয়ে ওঠে। গলা চড়িয়ে বলে , কলমের জোরের কথা তো শুনেছিস। অনেক বড় বড় লোকের হম্বিতম্বি বন্ধ হয়ে যায় কলমের একটা খোঁচায়।
আমিও চিত্কার করে বললাম , রাখ তোর কলমের কথা। মুখের একটা কথায় হাতে ধরা কলম কখনো ডানে তো কখনো বামে নাচতে থাকে।
হাবু এবার শান্ত স্বরে বলল , আহা! উত্তেজিত হচ্ছিস কেন? কলমেরও তো খিদে পায়। নাকি?
হাবু সত্যিই দূরদ্রষ্টা। আজ ওর কথাগুলোর মানে বুঝতে পারি। হাতই আসল। মুখ অকাজের। চারিদিকে কত অজানা , অচেনা ভয় তবু মুখে কোনও প্রশ্ন নেই , শুধুই হাততালি।
লেখক পরিচিতি : রাজীব চক্রবর্ত্তী
জন্ম ১৯৭০ সালের ৩০শে ডিসেম্বর, কলকাতার সিঁথিতে। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী। দৈনন্দিনতার ক্লান্তি কাটাতেই মূলত: কলম ধরা। বেশ কয়েকটি লিট্ল ম্যাগাজিনে লিখেছেন গল্প, কবিতা। ২০১৭ সালে প্রকাশিত "সংশ্লেষ" নামক গদ্য সংকলনে স্থান পেয়েছে তাঁর মুক্তগদ্য। ঐ একই বছরে সোনারপুর কাব্যমঞ্চ আয়োজিত স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান লাভ করেন তিনি। ২০১৯ সালে প্রকাশিত "অন্য গদ্য" গ্রন্থে স্থান পেয়েছে তাঁর গদ্য। জীবনের বিবিধ অনুভূতি, বাস্তবতাকে ছন্দে বাঁধার প্রয়াসে তাঁর কবিতাচর্চা।
Excellent