লেখক : অনুপম ভট্টাচার্য
গত পর্বের লিঙ্ক এখানে
শুরুতেই একটা কথা বলে নিই। তাহলে অনেকেরই অনেক কনফিউশান দূর হয়ে যাবে। আমার ঘনিষ্ঠ মেলামেশা সীমাবদ্ধ মেটিয়াবুরুজেই। আমাদের গোটা রাজ্যে মুসলিমদের সম্পর্কে আমার জানাবোঝা একেবারেই নেই। সে যোগ্যতাও আমার নেই। তাই “মালুর দল” বা “বিজেপি কোথায় কতো শতাংশ ভোট পেয়েছে, অথবা কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কেন ঘর ছাড়তে হলো, সেটা আমার লেখার প্রতিপাদ্য নয়। আমার নিত্য যাপনের মধ্যে যাদের বসত, আমি আমার সেই এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলির কথা লিখছি। আপনার চোখে যে জায়গা ” মিনি পাকিস্তান”, সেটা আমার কাছে “আমার দ্বিতীয় বাড়ি”। সবটাই আপনার দেখার ওপরে নির্ভর করছে। হাফ গ্লাস ভরা অথবা হাফ গ্লাস খালি, আপনি কোনটা দেখবেন, একান্তই আপনার নিজস্ব বিষয়। ধুলো আসার ভয়ে মনের দরজা, জানালা খুলে রাখবেন, নাকি ধুলো ঝেড়ে সাফ করবেন, সেটা একান্তই আপনার গ্রুমিংয়ের ওপরে নির্ভর করে।
“যব ছোড় চলে লখনৌ নগরী”…
মেটিয়াবুরুজ মানেই ইতিহাস এবং সংস্কৃতির পারফেক্ট ব্লেন্ডিং। কালের নিয়মে এবং বাঙালির আপন ঐতিহ্য ভুলে যাওয়ার প্রবণতার ফলে ইতিহাসের বহু চিহ্ন হারিয়ে গেছে, যাচ্ছে। মেটিয়াবুরুজও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে নবাবী ঘরানার ঐতিহ্য আজও মেটিয়াবুরুজের শিরায় ধমনীতে প্রবহমান।
গরীব হোক বা ধনী, মেটিয়াবুরুজের প্রায় সব ঘরেই আপনি নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ ঘরানা খুঁজে পাবেনই। মেটিয়াবুরুজ বিশ্বাস করে কারোর হৃদয়ে যাওয়ার সহজ রাস্তা পাকস্থলীর পথ বেয়ে। আর অতিথি আপ্যায়ন? এক কালে হিন্দু বাঙালির কাছে অতিথি ছিলেন নারায়ণ। শহুরে ফ্ল্যাট কালচারের গ্রাসে সে দিন গেছে। আজ আপনি আর কোপনি নিয়েই সব ব্যস্ত। আমরা আমাদের প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়াতে ভুলে গেছি। কিন্তু আজও মেটিয়াবুরুজ ভরসা দেয় যেন সেখানে একজন মানুষও খালি পেটে ঘুমাতে না যায়। এ যে কতো বড়ো একটা আশ্বাস, কতটা ভরসা যোগায়, তা অনুভব করার জন্য একটা মরমী মন দরকার।
আপনাকে যখন মেটিয়াবুরুজের কোনও পরিবারে দাওয়াত দেওয়া হবে, আপনি দুটো ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন। প্রথমত, আপনি যতক্ষণ পর্যন্ত না খাবার মুখে তুলছেন, পরিবারের সব থেকে ছোট বাচ্চাটাও খাওয়ার দাঁতে কাটবে না। আপনি খাওয়া শুরু করলে তবেই বাড়ির সদস্যরা খেতে শুরু করবেন। ” অতিথি দেবো ভবঃ” ভাবনার সাথে ফারাক খুঁজে পাচ্ছেন কি? মন দিয়ে খুঁজলে কোনও পার্থক্যই নজরে আসবে না। আর দ্বিতীয়ত, আপনার একটা বদ্ধমূল ধারণা বদলাবেই। আপনি আপনার কাছের কোনও বাঙালি হিন্দুকে আমন্ত্রণ জানান কোনও মুসলিম পরিবারে খাওয়ার জন্য। বহু তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের মুখে শুনবেন, “পাগল নাকি! ওরা গরু খাইয়ে জাত মেরে দেবে”। আমার জীবন বন্ধক রাখছি আপনার কাছে। মেটিয়াবুরুজ এই ভাবনা অন্তরে লালন করে না। মেটিয়াবুরুজ ভালোবাসার চাষ করে, ঘৃণার নয়। কাজেই আপনার ধর্ম এবং জাত, দুইয়ের সুরক্ষায় মেটিয়াবুরুজ কখনোই পিছিয়ে পড়বে না।
প্রথম পর্বে একজন যা বলেছেন, তার সার সংক্ষেপ করলে দাঁড়ায় “এলাকার হিন্দুরা নাকি মুসলমানদের কাছে বাধ্য হয়ে জমি জায়গা বেচে দিচ্ছেন”। সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশিরভাগ জ্ঞানই বড়ো বেশি প্রক্ষিপ্ত। অনেকটাই ভুত দেখার মতো। আসলে মেটিয়াবুরুজ, গার্ডেন রিচ, আকড়া, সন্তোষপুর, রবীন্দ্র নগর, চটা, মহেশতলা, বজবজ, একে অপরের গায়ে লেগে থাকলেও শিক্ষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, জীবন যাপন, এমনকি ডায়লেক্টের পার্থক্য অনেকটাই। তবে সে সব বুঝতে গেলে আপনাকে বিদ্বেষ দূরে রেখে মনের জানালা, দরজা খুলে দিতে হবে। নইলে “মাথা মারা” মানে যে চিন্তা করা, অথবা “কথা কয়ে নেওয়া” র সাথে যে কথা বলে নেওয়ার শত্রুতা নেই, ধরতেই পারবেন না।
“হিন্দুদের ঘরবাড়ি বেচে চলে যাওয়া” প্রসঙ্গে দু’চার কথা বলি। আজ থেকে বছর বারো আগেও গার্ডেন রিচ অঞ্চলের বেতাজ বাদশার নাম ছিলো দিলীপ সেন। বাজে লোকে বলে দিলীপ সেনের অনুমতি ছাড়া এলাকায় পাতাও নড়তো না। আজও মহেশতলা পৌরসভার মাথায় উজ্জ্বল উপস্থিতি এক হিন্দুর। তাহলে কিভাবে এই অঞ্চলে হিন্দুরা “খতরে মে” পড়লো ভাই? আর তার জন্য মুসলমানদের দায়ী করাই বা কেন?
আজ থেকে বছর কুড়ি আগেও আমার এলাকায় গোটা কুড়ি বিহারি পরিবার বাস করতো। আজ সেই সংখ্যা নিশ্চিত ভাবেই হাজার পার হয়ে গেছে। তাহলে আজ থেকে আরও বছর ত্রিশ পরে এই এলাকায় বাঙালিদের সংখ্যালঘু হওয়ার পেছনে কার দায়িত্ব ছিল বুঝতে রকেট সায়েন্স পড়বার দরকার নেই।
প্রি কনসিভড আইডিয়া নিয়ে কারোকে বুঝতে যাওয়া খুব চাপের। কারণ আপনি আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন। এখন আপনার কাজ কেবলমাত্র আপনার সিদ্ধান্তকে জাস্টিফাই করবার। কিন্তু যদি খোলা মনে কারোকে জানতে বুঝতে চান, দেখবেন আপনার ধারণা এবং বাস্তবের মধ্যে যোজন যোজন ফারাক। একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে আজকের প্যাচালে ইতি টানি। সময়টা ২০১৭ এর শুরুর দিকে। সংগঠন গড়ে তোলার কাজে জরুরি সভা ডাকা হয়েছে মেটিয়াবুরুজে। শামসুদ্দিন স্যারের স্কুলে। আমি চিরকালের লেট লতিফ। যথারীতি তারাতলায় যখন পৌঁছালাম, ঘড়ির কাঁটায় তখন মিটিং শুরু হতে অল্পই বাকি। তাই বাধ্য হয়েই উবার বুকিং। যে ড্রাইভার ক্যাব নিয়ে এলো, ইচ্ছে করেই তার নাম নিলাম না। কারণ আজও সে আমার ফ্রেন্ড লিস্টে রয়েছে। তা সেই ছেলে ক্যাবে ওঠার পর থেকেই তার মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে বলে যেতে লাগলো মোল্লারা কতটা খারাপ, কতটা নোংরা, কতটা বিপদজনক। আমি নীরবে সিগারেটের ধোঁয়া এবং ঘড়ির কাঁটার দিকেই মনোনিবেশ করে রইলাম। স্পটে পৌঁছানোর আগে একটা মসজিদ পড়ে। সেখানে একজন কেউ বক্তৃতা দিচ্ছেন। তার কথার মাঝে বারেবারেই “ইনশাআল্লাহ”, “আলহামদুলিল্লাহ” শুনে ক্যাব ড্রাইভার যেন চিড়বিড় করে উঠছিলো। “শালারা আমাদেরই খাবে আর আমাদেরই নিন্দা করবে” গোছের মন্তব্য বেশ কয়েকবার শোনা হয়ে গেছে।
অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছালাম। বিনীত ভাবেই ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম এটাই তার লাস্ট ট্রিপ। এবারে সে বাড়ি ফিরে যাবে। তাকে অনুরোধ করলাম কিছুটা সময় আমাদের সাথে কাটানোর জন্য। তা খানিকটা কৌতূহল এবং খানিকটা ভয়, দুইয়ের মাঝে পড়ে সে রাজীও হয়ে গেলো।
মেটিয়াবুরুজে মিটিং মানেই ওভার ইটিং ইজ মাস্ট। সেদিনের আয়োজনে ছিলো কেবলমাত্র মিষ্টি। শাহাজাদা স্পেশাল দুই রকমের সিমুই, আর তার সাথে ফিরনী, ছানার পায়েস, লস্যি আর বোম্বাই ফ্রুট শেক। আপনার প্রতিটি স্বাদকোরক খাদ্য সম্ভোগের তুড়িয় আনন্দ উপভোগ করে তখন ট্রা-লা-লা-লা ডান্স করছে। মিনিট পনেরো থাকার কথা যার, সেই ক্যাব ড্রাইভার স্বেচ্ছায় ঘন্টা দেড়েক কাটিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। তার চোয়ালের পেশীর সেই কঠিন ভাব বদলে লস্যির মালাইয়ের মতো। ফেরার পথে সেই ছেলের কথায় “ভাগ্যিস আপনার কথায় থেকে গেলাম। তাই অনেক ভুল ধারণা আজ বদলে গেল”।
“নিত্য ফুরোয় যাদের সাধ-আহ্লাদের শেষ তলানিটুকু
চিরকাল রাখবে তাদের পায়ের তলায় কুকুর
সেটা হয় না বাবা
সেটা হয় না বাবা বলেই থাবা বাড়ান যতেক বাবু
কার ভাগে কী কম পড়ে যায় ভাবতে থাকেন ভাবুক”….
আসলে একজন সংখ্যাগুরুর প্রতিনিধি হয়ে নয়, একজন সংখ্যালঘুর চোখে দেখতে শিখুন। চশমার রঙ বদলালে দুনিয়াও বদলে যাবে। বিশ্বাস রাখুন।
পরের পর্বের লিঙ্ক এখানে
লেখক পরিচিতি : অনুপম ভট্টাচার্য
এমন একজন, যে এখনো নিজের পরিচিতির খোঁজে রয়েছে। আশা করি জীবনের দৌড়ে ফিনিশিং পয়েন্ট আসার আগে তার অনুসন্ধান শেষ হবে।
বাহ!
অসাধারণ সাবলীল
অপেক্ষায় রইলাম..
Liberal narrative- I myself have seen Pakistani flag in Mini Pakistan, multiple times. Stop spreading nonsense. Open your eyes, BE REAL