আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ৩)

লেখক : অনুপম ভট্টাচার্য

গত পর্বের লিঙ্ক এখানে

“ভালোবেসে ডেকে দেখো না, দেখো না, আসি কি না আসি কাছে, কে তোমায় ভালোবাসে….” আমাদের ছোটবেলায় আশা ভোঁসলের গাওয়া এই গানটা বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলো। কাউকে কাছে ডেকে নিতে হলে তাকে ভালোবাসতে হবে। আর দূর থেকে দেখলে আপনার যে ধারণা হবে, বাস্তবে দেখা যাবে সেটা সম্পূর্ণ উল্টো। তাই নিঃশর্তে কাছে যেতে হবে, কাছে টেনে নিতে হবে। তবেই সে তার হৃদয়ের দরজা ধীরে ধীরে খুলবে। খুলবেই।

এশিয়ার বৃহত্তম রেডিমেড গারমেন্টস এর বাজার মেটিয়াবুরুজকে ঘিরে। কয়েক হাজার মানুষের মুখে অন্ন জোগায় মেটিয়াবুরুজের গারমেন্টস ইন্ডাস্ট্রি। শুধুমাত্র যারা গারমেন্টস ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের সাথে যুক্ত, তারাই নয়, অনুসারী শিল্প হিসেবে অজস্র মানুষের জীবন জীবিকা যুক্ত রয়েছে এই শিল্পের সাথে। তাদের অনেকেরই বাস মেটিয়াবুরুজে নয়। বছরে কয়েকশো কোটি টাকার ব্যবসা হয় জব্বার হাটকে কেন্দ্র করে। গোটা দেশের সমস্ত রাজ্য থেকে গারমেন্টস ব্যবসায়ীরা আসেন জব্বার হাটে কেনাকাটা করতে। এমনকি বিদেশেও রপ্তানি হয় মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড গারমেন্টস।

আগে এখানকার ব্যবসায়ীদের অনেকেই হাওড়ার মঙ্গলা হাটে যেতেন। কিন্তু আজকাল আর হাওড়ার হাটে প্রায় কারোকেই যেতে হয় না। বরং হাওড়া থেকে অনেকে মেটিয়াবুরুজে আসেন ব্যবসার প্রয়োজনে। আপনি শুনলে অবাক হয়ে যাবেন। এই এলাকার এবং বাইরের অনেক দুঃস্থ পরিবারের মহিলাদের স্বনির্ভরতার জন্য এই এলাকার বহু ক্লাব, ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিনে দেওয়া হয় বোতাম ঘর স্টিচিং মেশিন, পিকো করবার মেশিন। উদ্দেশ্য একটাই, যাতে পরিবারগুলো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।

দেশের গর্ব হওয়া উচিত যে এলাকার, সেই এলাকা বাইরের লোকের চোখে “মিনি পাকিস্তান”। কিন্তু কেন? আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতেও নজরে আসে চক্রান্তের এক নীল নকশা। আমরা যারা কোলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত এলাকায় থাকি, তাদের নিত্যকার অভিজ্ঞতায় অবশ্যই সকালে বাঁশি বাজিয়ে ময়লা তোলার গাড়ি চোখে পড়ে। কিংবা এক দুই দিন ছাড়া ছাড়া ভ্যাট থেকে ময়লা তুলে নিয়ে যাওয়ার লরিও নিশ্চিত চোখে পড়ে। কিন্তু শুনলে অবাক হয়ে যাবেন, মেটিয়াবুরুজ কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হলেও পুরসভার এই পরিসেবা আশ্চর্যজনকভাবে অনুপস্থিত এখানে! কিন্তু এলাকা পরিস্কার করবার জন্য নির্বাচিত কাউন্সিলারদের সক্রিয় ভূমিকা তেমন একটা চোখে পড়ে না। ফলে যেমন আমার ভালোবাসার এলাকার বদনাম হয়, পাশাপাশি এলাকার বাসিন্দাদেরও। আমি ভরসা রাখি আগামী দিনে আমার প্রিয় মেটিয়াবুরুজের মানুষ, আমার ভাই-বোন-দাদা-দিদিরা নিশ্চিত এগিয়ে আসবেন, যাতে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন বাধ্য হয় এলাকা পরিস্কার করবার জন্য। কাউন্সিলাররা তাদের ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হন।

যে কোনও বিজনেস সেন্টারকে ডেভেলপ করবার জন্য ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট জরুরি। যাতে দেশ বিদেশ থেকে ক্রেতা আসার এবং মাল পরিবহনের সমস্যা না হয়। এদিক থেকেও বঞ্চিত মেটিয়াবুরুজ। না ঝাঁ চকচকে চওড়া মেটালড রোড, না উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। শতাব্দী প্রাচীন একটা জনপদ, উন্নয়নের মানচিত্রে “গড ফরবিডেন এরিয়া”। রেডিমেড গারমেন্টস শিল্পের অনুসারী শিল্প হিসেবে শুধু কাপড়ের গোডাউন নয়, বোতাম, চেন, সুতো আরও হরেক রকমের অ্যাক্সেসারিজ প্রোডাকশন হচ্ছে। মাল পরিবহনের জন্য গড়ে উঠেছে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিগুলি, ক্যুরিয়ার কোম্পানিগুলি। বিভিন্ন দেশি বিদেশি ব্যাঙ্কের শাখা, ইনকাম ট্যাক্স, সেলস ট্যাক্স কনসালটেন্সি ফার্ম। যেখানে গোটা রাজ্য তথা দেশ বেকারত্বের বোঝা বইতে অক্ষম, সেখানে সরকারের সচেতন প্রয়াস ও প্রচেষ্টা মেটিয়াবুরুজের গারমেন্টস শিল্পে নতুন জোয়ার আনতে পারে। রাজ্যের উন্নয়নে নতুন দিশা দেখাতে পারে মেটিয়াবুরুজ। শুধুমাত্র প্রয়োজন একটা সহানুভূতিশীল মন আর দেখবার চোখটাকে বদলে ফেলা।

পরের পর্বের লিঙ্ক এখানে


আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ২)আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ৪) >>

লেখক পরিচিতি : অনুপম ভট্টাচার্য
এমন একজন, যে এখনো নিজের পরিচিতির খোঁজে রয়েছে। আশা করি জীবনের দৌড়ে ফিনিশিং পয়েন্ট আসার আগে তার অনুসন্ধান শেষ হবে।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।