আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ৪)

লেখক : অনুপম ভট্টাচার্য

গত পর্বের লিঙ্ক এখানে

কোনও এলাকার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সেখানকার মানুষ। হিউম্যান রিসোর্স ইজ দ্য বেস্ট রিসোর্স। আমাদের দুই জেনারেশন আগেও আমাদের পরিবারগুলিতে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকলেরই সন্তান সন্ততির সংখ্যা ছিলো যথেষ্ট। আমার ঠাকুরদার আটটি সন্তান জীবিত এবং একটি মৃত সন্তান ধরলে সংখ্যাটা নয়জন। এরকম সন্তান সংখ্যা বহু হিন্দু বাঙালি পরিবারেই দেখা যায়। আমার বাবা-মায়ের দুই সন্তান এবং আমাদের দুই ভাই-বোনের একটি করে সন্তান। প্রায় একই প্যাটার্ন মেটিয়াবুরুজের পরিবার গুলির ক্ষেত্রেও লক্ষ্যণীয়। এই জেনারেশানের অধিকাংশ দম্পতিরই একটি বা দুটি সন্তান।

একটা খবর প্রায়শই আমাদের চোখে পড়ে মুসলমানরা যে হারে সংখ্যায় বাড়ছে, তাতে হিন্দুরা অচিরেই সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। তখন দেখবেন এরা কি করে! সোশ্যাল মিডিয়ায় এই তথাকথিত “হিন্দু খতরে মে হ্যায়” এই ইচ্ছেকৃত অপপ্রচারের পেছনে সত্যিটা জানা খুব জরুরী। নয়ত আপনি বা আমি, যে কেউ যে কোনও সময়েই এই অপপ্রচার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারি। কারণ আমাদের অনেকেরই এখন পড়াশোনার অন্যতম মাধ্যম “হোয়াটস্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়”। আগামী ২০৫০ সাল পর্যন্ত প্রোজেক্টেড পপুলেশন অনুযায়ী মুসলিম জনসংখ্যা কোনভাবেই হিন্দু জনসংখ্যার ধারেকাছেও পৌঁছাবে না। ২০১১ সালের সেন্সাস অনুযায়ী হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৫৫ শতাংশ, অন্য দিকে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২.২ শতাংশ। শুনলে অবাক হয়ে যাবেন হিন্দুদের ক্ষেত্রে জনসংখ্যায় হ্রাসের হার ০.২৫ শতাংশ। অন্যদিকে মুসলিমদের মধ্যে জনসংখ্যায় হ্রাসের হার ০.৪ শতাংশ। অর্থাৎ এই যে আপনার ধারণা “মোল্লারা আমাগো সব দখল কইরা নিবো” নিছকই কল্পনা (আমার বক্তব্যের সমর্থনে দুটি লিংক দেওয়া রইলো। যাদের মনে হবে ফ্যাক্ট চেক করে নিতে পারেন। অনূরোধ, হোয়াটস্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ুন, বইপত্র পড়ুন)।

প্রথম পর্বে এক জায়গায় লিখেছিলাম মেটিয়াবুরুজে ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে যে কোনও পরিবারে দাওয়াত পেলে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন সেই পরিবার তাদের সেরা খাদ্য সামগ্রী আপনার সামনে হাজির করবেই। এই যে অতিথিকে তার সর্বশ্রেষ্ঠ জিনিস অফার করা, এটাই আমার কাছে ঘরানা। মেটিয়াবুরুজ আমার হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়ার অন্যতম কারণ এই “সেরা জিনিস অতিথিকে দিতে পারবার ক্ষমতা”। কলকাতা শহরে সেরা মিষ্টির কারিগর এবং দোকানের সন্ধানে বেরোলে আপনি নকুড়ের সন্দেশ থেকে গাংগুরামের দই, কে সি দাসের রসগোল্লা ইত্যাদি প্রভৃতির প্রচুর রেফারেন্স পাবেন, কিন্তু কোথাও মেটিয়াবুরুজের মিষ্টির নামও শুনবেন না। অথচ আপনি একবারও যদি মেটিয়াবুরুজের লস্যি, রাবড়ি চেখে দেখেন, গ্যারান্টি আপনি ফিদা হয়ে যাবেন। শরবতের ভ্যারাইটিই কতো ধরণের! আমার এক ভাইয়ের বিয়ের পাকা দেখায় নেমন্তন্ন খেতে গেছিলাম। ভাবতে পারবেন না শরবতই ছিল ৮ থেকে ১০ রকমের। শুধু স্টার্টার খেয়েই পেট ভরে যাওয়ার জোগাড়। মেটিয়াবুরুজের আর এক স্পেশালিটি “বোম্বে ফ্রুটশেক”। খাওয়ার পরে আপনার নিজেকে যদি নবাব বলে মনে না হয়, মূল্য ফেরত। বিরিয়ানি মেটিয়াবুরুজের আর এক ডেলিকেসি। তবে বিরিয়ানি খেতে হবে কোনও গৃহস্থের বাড়িতে। সে বিরিয়ানি খাওয়ার পরে আপনার মনে হবেই ‘Gar firdaus bar-rue zamin ast, hami ast, hamin ast, hamin ast’ স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, তবে তা এখানেই, এখানেই। গোমাংসে যদি অরুচি না থাকে, তাহলে Ideal Destination of Food Hunting মেটিয়াবুরুজ। মহম্মদী মিশনের পাশে এক রাস্তার ধারের হোটেলে যে কোয়ালিটির ভুনা, কলেজি ইত্যাদি পাওয়া যায়, তার ধারেকাছেও বারুইপুরের “আসমা” ঠাই পাবেনা। আর যদি গোমাংসে রুচি না থাকে, কুছ পরোয়া নেহি। “রাহাত ক্যাফে” বা আর একটা রেস্টুরেন্ট, যার নাম এখনি মনে পড়ছে না, সেখানকার চিকেনের বিভিন্ন আইটেম চেখে না দেখলে আপনার জীবন প্রায় ১৪ আনাই মাটি। আমার ভাই রফি সর্দারের বাড়িতে বানানো তন্দুরি চিকেনের স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে। শাহাজাদার বানানো বিরিয়ানির কাছে কোথায় লাগে অমৃত! সাবিরের বাড়িতে প্রথম ডিমের ওমলেট দিয়ে আশ্চর্য স্বাদের ঝোল খেয়েছিলাম।

মেটিয়াবুরুজের দাওয়াতের একটা বড়ো স্পেশালিটি হচ্ছে পরবর্তী আইটেম সম্পর্কে কোনও আইডিয়া করতে না পারা। যখন আপনার পেট প্রায় ভরে এসেছে, তৃপ্তির ঢেঁকুর সবে তুলবেন, হঠাৎই সামনে হাজির নতুন আইটেম। “ফাঁসির খাওয়া” শব্দবন্ধটা শোনা থাকলেও মেটিয়াবুরুজের দাওয়াত রক্ষা করতে গিয়ে সেটা মরমে পশিল।

আমি একে বাঙাল, তায় বামুন। ফলে হিউম্যান রিসোর্স দিয়ে শুরু করলেও সুযোগ বুঝে খাওয়ার গল্পে ঢুকে যাচ্ছিলাম। যাই হোক, লাইনে ফিরে আসি। আপনার কখনো কখনো মনে হবে সময় যেন থমকে গেছে এখানে এসে। শহরের অন্যান্য প্রান্তে যখন “তুমি আর আমি আর আমাদের সন্তান” রুল বহাল, মেটিয়াবুরুজের অলিতে গলিতে আপনি বহু যৌথ পরিবার, যৌথ ব্যবসার দেখা পাবেন। খুড়তুতো জ্যাঠতুতো ভাইয়েরা মিলে বাবা-কাকার ব্যবসা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এমন উদাহরণ এখানে বিরল নয়। আরও এক শহুরে রোগের ছোঁয়া আজও এই অঞ্চলে লাগেনি। আজকের দিনেও এখানকার কোনও পরিবারের বাপ-মায়ের ঠিকানা কেয়ার অফ বৃদ্ধাশ্রম হয়নি। পারিবারিক বন্ধন আজও বহুলাংশে অটুট রয়েছে মেটিয়াবুরুজের মাটিতে। ভালোবাসার সার জল পেয়ে তা বাড়তে থাকুক।

লিঙ্কঃ
https://www.indiatoday.in/fact-check/story/fact-check-viral-post-muslim-population-india-1733926-2020-10-22
https://www.newindianexpress.com/magazine/voices/2020/jan/19/the-demographic-change-hoax-2090213.html

পরের পর্বের লিঙ্ক এখানে


আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ৩)আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ৫) >>

লেখক পরিচিতি : অনুপম ভট্টাচার্য
এমন একজন, যে এখনো নিজের পরিচিতির খোঁজে রয়েছে। আশা করি জীবনের দৌড়ে ফিনিশিং পয়েন্ট আসার আগে তার অনুসন্ধান শেষ হবে।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।