লেখক : অনুপম ভট্টাচার্য
গত পর্বের লিঙ্ক এখানে
আগেও লিখেছি যে কোনও অঞ্চলের ডেভেলপমেন্ট নির্ভর করে যে রিসোর্সগুলির ওপরে, তার অন্যতম হিউম্যান রিসোর্স। মানুষ, এবং একমাত্র মানুষই পারে যে কোনও অঞ্চলের ভোল বদলে দিতে।
মেটিয়াবুরুজে পা দেওয়ার পরে প্রথমেই একটা আশ্চর্য বিষয় লক্ষ্য করলাম। উপস্থিত চরিত্রেরা সকলেই পুরুষ, নারীর উপস্থিতি শূন্য। অবাক হয়ে ভাবতাম আমাদের “অর্ধেক আকাশ” কি এখানে কেবলই মেঘে ঢাকা? মেঘের আড়াল থেকে আমার মা-বোন-দিদিরা কখনোই বেড়িয়ে আসবেন না? আমি ব্যক্তি জীবনে খুবই আশাবাদী। তাই সহজে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষায় রইলাম মেঘে ঢাকা তারাদের সামনে আসার।
আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন আমি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে যুক্ত। আমরা মূলত রক্তদান এবং থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে কাজ করি। ফলে আমাদের নিয়মিত রক্তদান শিবিরের আয়োজন করতেই হয়। সেই মতো মেটিয়াবুরুজের মাটিতে প্রথম রক্তদান শিবির ব্যাপক সাফল্য পেলেও মহিলা ডোনার বা মহিলাদের অংশগ্রহণ বিলকুল শূন্য। অথচ বর্ধমানে বা সরবেড়িয়ার ক্যাম্পে মহিলা ডোনার বা মহিলাদের অংশগ্রহণ অল্প হলেও দেখা যাচ্ছিলো ধীরে ধীরে। ব্যতিক্রম মেটিয়াবুরুজ।
বেশ অবাকই লাগতো। তবুও বুঝতাম আরও ধৈর্য আরও অপেক্ষার প্রয়োজন। একটা কমিউনিটি, একটা অঞ্চলের ওপরে দশকের পরে দশক ধরে চলে আসা অন্যায়, অবিচার, অবহেলা, ঘৃণা, অবজ্ঞার ক্ষত দূর হতে সময় লাগবে। এবং সেই সময়টা দিতেই হবে। কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো যাবে না।
দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় ক্যাম্পের থেকে পরিস্থিতি মোড় নিতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে আমার মা-বোনেরা ক্যাম্পমুখী হতে শুরু করলেন। এখনো একটা দ্বিধা, দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে মহিলা ডাক্তার এবং মহিলা টেকনিশিয়ান নিয়ে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বরফ গলছে। এখন শুধু অপেক্ষা এবং নীরবে কাজ করে যাওয়ার সময়। একদিন সূর্যের ভোর, একদিন সাম্যের ভোর আসবেই।
আমরা যদি আমাদের নিজেদের পরিবারের দিকে ফিরে তাকাই, আজ থেকে দুই বা তিন পুরুষ আগেও কি ছবিটা এমন ছিলো? ঘরে বাইরে সমান ভাবে মেয়েদের এগিয়ে আসা, ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষের জন্য কাজ করে যাওয়ার যে স্বপ্ন আজ আমাদের “অর্ধেক আকাশ” দেখতে পাচ্ছেন, সেই মুক্তি কিন্তু একদিনে মেলেনি। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই চলেছে, আজও চলছে।
আমার ঠাকুমার কথাই উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক। অসম্ভব সুন্দরী এবং গুণবতী আমার ঠাকুমা ছিলেন আমার ঠাকুর্দার দ্বিতীয় পক্ষ। প্রথম পক্ষের অকাল প্রয়াণের পরে আমাদের পরিবারে আসেন আমার ঠাকুমা। তখন তার বয়স বছর দশেক। বিয়ের পর থেকে যদ্দিন আমার ঠাকুর্দা বেঁচে ছিলেন, আমার ঠাকুমা একগলা ঘোমটা দিয়ে থাকতেন। পরপুরুষের সাথে কথা বলা তো দূর, বাইরের লোকে কেবল একটা শাড়ি পরা পুঁটলিকেই সামনে চলাফেরা করতে দেখতে পেতো। অথচ সেই ঠাকুমাই আমার ঠাকুর্দার মৃত্যুর পরে দিব্বি বাইরের লোকের সাথেও কথা বলতেন। মাঝে কিন্তু বয়ে গেছে পনেরো কুড়ি বছর। অর্থাৎ সময় দেওয়াটা, অপেক্ষা করাটা খুব জরুরি।
নারী মুক্তি, নারী স্বাধীনতা আমার লেখার প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। তবুও কিছু কথা প্রাসঙ্গিক ভাবেই এসে যায়। মানুষে মানুষে সম্পর্ককে যদি বাড়ির সাথে তুলনা করা যায়, তবে প্রথম পরিচয়ে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম বড় রাস্তায় আর বাড়ির দরজায় নক করছিলাম। বাড়ির মালিকের সাথে পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা হবার পরে তিনি হাত ধরে নিয়ে বসালেন বাইরের ঘরে। এখন এই ঘনিষ্ঠতা, সম্পর্কের গভীরতার একটা লেভেলের পরে তবেই অনুমতি মিলবে অন্দরমহলে প্রবেশ করবার। কিন্তু বাইরের দরজা থেকে অন্দরমহলে পৌঁছানোর এই দীর্ঘ জার্নি আপনাকে অপেক্ষা করতেই হবে। আজ তাই লিল্টু গাজী, বাপী মোল্লা, সাবির বা দুলালের বাড়ির অন্দরমহলের বাসিন্দারা আজ আমারও মা-বোন-দিদি।
এবারে একটা মজার কথা বলি। মেটিয়াবুরুজে আমার যারা খুব কাছের, তাদের একজন শাহাজাদা। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার জনপ্রিয়তা এবং ফ্যান ফলোয়িং প্রচুর। তা সেই ছোকরার অর্ধাঙ্গিনী আমাকে দাদা বলে। আমার কাছে সেও আমার সন্তান তুল্য ছোট বোন। তার নাম সারিকা। তা সেই মেয়ে প্রথমবার এলো আমাদের ক্যাম্পে রক্ত দিতে। বোরখা-হিজাবে আগাগোড়া মোড়া। শুধু চোখ দুটোই দেখা যাচ্ছে কেবল। বিশ্বাস করুন সেই ঘেরাটোপ থেকে বের হতে সময় লেগেছিলো আধ ঘন্টা। তারপর আমরা পেলাম বর্ষার পাহাড়ি ঝর্ণায় যখন একফালি রোদ্দুর এসে পড়ে, সেরকমই ঝলমলে একফালি রোদ্দুরকে। আজ আমার প্রিয় বোন সারিকা প্রমিস করেছে সে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসবে কাজ করবার জন্য। আমার বিশ্বাস একদিন আমার বোন সারিকার লিডারশীপে মেটিয়াবুরুজের মা-বোন-দিদিরা রক্তদান শিবিরের আয়োজন করবেন। এখন শুধুই অপেক্ষা করতে হবে।
এই সময় দেওয়াটাই আসল। এই অপেক্ষাটাই জরুরি। কারণ শেষ পর্যন্ত কেবল ভালোবাসাই জয়ী হয়। এবং একমাত্র ভালোবাসাই জয়ী হয়। তাই ভালোবাসাটা দরকার। ভালোবাসার আলোয় একদিন গোটা মেটিয়াবুরুজের সম্পূর্ণ আকাশ আলোকময় হয়ে উঠবেই। এ আমার অন্তরের বিশ্বাস।
পরের পর্বের লিঙ্ক এখানে
লেখক পরিচিতি : অনুপম ভট্টাচার্য
এমন একজন, যে এখনো নিজের পরিচিতির খোঁজে রয়েছে। আশা করি জীবনের দৌড়ে ফিনিশিং পয়েন্ট আসার আগে তার অনুসন্ধান শেষ হবে।
চমৎকার লাগে