আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ৬)

লেখক : অনুপম ভট্টাচার্য

গত পর্বের লিঙ্ক এখানে

“মিনি পাকিস্তান” নামের সন্ধানে: চাকরি জীবনের শুরুতে একটা ছোট্ট কোম্পানির সেলসম্যানের কাজ করতাম। কলেজ জীবনের শুরুর দিকে পড়াশোনায় ইতি টেনে (কেন, সে না হয় অন্য কোনও দিন হবে) টাকা রোজগারের জন্য চাকরি নেওয়া। সেই সূত্রেই প্রথম পা রাখা গার্ডেন রিচ বাঁধা বটতলা অঞ্চলে। সেখানেই ছিলো তৎকালীন চাকরির বসের বাড়ি। কাজের সূত্রেই বসের ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা। তাই কাজ মিটে যাওয়ার পরেও বহুদিন নিছক আড্ডা দেওয়ার জন্যই বেশ কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম চায়ের দোকানে।

বাজার দর, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা, রাজনীতি, ফুটবল, ক্রিকেট, সিনেমা, কী না থাকতো সেই আড্ডার টপিক। সমবয়সী আরও অনেকেই এসে জড়ো হতো সেই আড্ডায়। কিন্তু কারোর মুখে কখনোই শুনিনি “মিনি পাকিস্তান” এই শব্দবন্ধ। এই শব্দবন্ধের বয়স কিন্তু বেশি নয়। প্রথম এই শব্দবন্ধ শোনা যায় ফিরহাদ হাকিম কোলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের মেয়র হওয়ার পরে তাঁর দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। পাকিস্তানের “ডন পত্রিকা” তে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় দুই দেশের তুলনামূলক আলোচনায় ফিরহাদ হাকিম গার্ডেন রিচ – মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলের ল্যান্ডস্কেপ, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির সঙ্গে পাকিস্তানের অনেক সাদৃশ্যের কথা বলেন। এবং বলেন এই সাদৃশ্যের কারণে এই অঞ্চল কে “মিনি পাকিস্তান” বলা যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে বেরিয়েও প্রচারে এবং ফেস্টুনে তিনি “মিনি পাকিস্তান” শব্দবন্ধের প্রয়োগ করেন। ডন পত্রিকা প্রচারে ফিরহাদের সফরসঙ্গী ছিল।
(রেফারেন্স লিঙ্ক – https://www.dawn.com/news/1255178)

কিন্তু স্রেফ একটা কমিউনিটিকে বদনাম করবার জন্য, একটা অঞ্চল সম্পর্কে মানুষের মনে ঘৃণা জন্ম দেওয়ার জন্য “মিনি পাকিস্তান” এই কয়েনেজের বয়স খুব জোর বছর চারেক। আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে যেমন তাঁর সুদিনে “বাংলার অগ্নিকন্যা” এবং দুর্দিনে “কালিঘাটের অগ্নিকন্যা” বানিয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকা এবং তার তৎকালীন সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়, তেমনই মেটিয়াবুরুজকে “মিনি পাকিস্তান” নামে দাগিয়ে দেওয়ার পেছনে আছে সংবাদ প্রতিদিন এবং সেই আনন্দবাজার পত্রিকা। কীভাবে? আসুন একটু ফিরে দেখি সেই চক্রান্তের সালতামামী।

সোশ্যাল মিডিয়া তথা নেট দুনিয়ায় মেটিয়াবুরুজ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় ২০১৭ সালের জুন মাস নাগাদ। ২০১৭ সালের ৯ই জুন কোলকাতা পুরসভার সাফাই কর্মী জনৈক বিনোদ দাস অভিযোগ করেন তার নাবালিকা কন্যাকে অপহরণ করা হয়েছে। অপহরণকারী হলেন মেটিয়াবুরুজের রাজাবাগানের বাসিন্দা মিন্টু আলি এবং তার বাবা কোরবান আলি। গত আটমাস ধরে ক্ষমতাবান মিন্টু আলী এবং তার বাবা নাবালিকাকে তাদের ডেরায় আটক রেখেছে। নাবালিকার বাবা গার্ডেনরিচ থানায় অভিযোগ জানিয়েছিলেন। অভিযোগ, অপহৃত নাবালিকাকে উদ্ধারের জন্য পুলিশ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে ঝড় ওঠে নেটিজেনদের মধ্যে। 24*7 এবং সংবাদ প্রতিদিন, মূলত এই দুই নিউজ পোর্টাল তাদের উসকানিমূলক লেখা দিয়ে নেটিজেনদের ক্ষোভের আগুনে ধারাবাহিক ভাবে মশলা দিতে থাকে।

পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যায় অভিযোগকারী বিনোদ দাসের আইনজীবী উদয় চন্দ্র ঝা জানিয়েছেন পুলিশকে নির্দিষ্ট ঠিকানা ও ফোন নম্বর দেওয়া এবং মেয়েটিকে সেখানে জোর করে আটকে রাখা হয়েছে জানাবার পরেও পুলিশ কোনও পদক্ষেপ নেয়নি।

পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে নাবালিকার বাবা মেয়েকে ফিরে পেতে বাধ্য হয়ে হাইকোর্টে পিটিশন দায়ের করেছেন।

মামলাটি হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাকের এজলাসে উঠলে, তিনি অবিলম্বে কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনারকে (অপরাধ) ওই এলাকায় হানা দিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করার নির্দেশ দেন।

কিন্তু কে এই মিন্টু আলী? কি তার অপরাধ?

সংবাদ প্রতিদিন এবং 24*7 নিউজ পোর্টালের সাংবাদিকদের খবর অনুযায়ী মিন্টু আলী ওরফে শোভান আলী, বয়স ২১ বছর, মেটিয়াবুরুজের রাজাবাগান এলাকার বেতাজ বাদশা। তার “গড়ে”, তার অনুমতি ছাড়া পুলিশ ঢুকতে ভয় পায়। তার বাবা কোরবান আলী প্রবল প্রতিপত্তি সম্পন্ন একজন মানুষ। এক কথায় বলতে পারেন মিন্টু আলী রাজাবাগানের ডন। এমতো ক্ষমতাশালী মিন্টু তার ডেরায় ৮ দিন ধরে আটকে রেখেছে অভিযোগকারী বিনোদ দাস-এর নাবালিকা কন্যাকে।
( রেফারেন্স লিঙ্ক – https://www.sangbadpratidin.in/kolkata/kolkata-police-refuse-to-recuse-abducted-girl-father-moves-hc/ )

এই পর্যন্ত পড়ে আপনার বিশুদ্ধ “হিন্দু আত্মা” নিশ্চিত ছটফট করছে! ইচ্ছে করছে ওই দুই বাপ-ব্যাটার গলা টিপে খুন করতে! ইচ্ছে করছে চিৎকার করে বলতে “এভাবেই একদিন ওই কাটার বাচ্চারা আমার আপনার ঘরের মা-বোনকেও তুলে নিয়ে যাবে”!

এবারে আসুন পর্দা সরিয়ে দেখে নেওয়া যাক “চোলিকে পিছে কেয়া হ্যায়”!

“রাজাবাগানের বাদশা”, যার প্রবল ক্ষমতার ভয়ে” পুলিশ পর্যন্ত তার গড়ে রেইড করতে ভয় পায়”, সেই মিন্টু আলী আসলে পেশায় একজন সামান্য ওস্তাগর। রেডিমেড গারমেন্টস সেলাই করেই যার পেট চলে। আর তার প্রবল প্রতিপত্তি সম্পন্ন বাবা কোরবান আলী আগে ভ্যান চালাতেন। প্রথমে টিবি এবং পরে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত কোরবান প্রায়শই শয্যাশায়ী থাকেন তাঁর রোগের কারণে। মা গৃহবধু। অত্যন্ত অভাবের সংসার। মিন্টু, মিন্টুর ছোটবোন এবং বাবা-মা সকলেই থাকেন দশ বাই আটের একটি ভাড়া ঘরে।

সমাজের “চতুর্থ স্তম্ভ” সংবাদপত্রের দৌলতে সামান্য সেলাই মিস্ত্রি মিন্টু আলী হয়ে যায় “রাজাবাগানের বাদশা”, আর তার অসুস্থ প্রৌঢ় ভ্যান চালক বাবা হয়ে যায় “প্রবল প্রতিপত্তি সম্পন্ন একজন মানুষ”! দশ বাই আটের একটি ভাড়া ঘর হয়ে যায় “দুর্ভেদ্য গড়”!

“নাবালিকা অপহরণ রহস্য”: এই নাবালিকার সাথে মিন্টুর কি সম্পর্ক? তাহলে সেই পর্দার উন্মোচন করা যাক। মেয়েটির মাসীর বাড়ি গার্ডেন রিচ অঞ্চলের “মেহের মঞ্জিল”। মাসীর বাড়ি যাতায়াতের সূত্রেই চার চক্ষুর মিলন। এবং প্রেমের গল্পের শুরু। মেয়ের এই বিধর্মী প্রেম বাপের গোচরে আসার পরেই পরিবারের থেকে স্বজাতের ছেলের সাথে মেয়েটির বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা শুরু করা হয়। মেয়ে বেঁকে বসে এবং পরিস্কার জানিয়ে দেয় যে সে এখন পড়াশোনা করবে, বিয়ে করবে না।

মেয়ের আপত্তি সত্ত্বেও তাকে বিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চলতেই থাকে। আর তাই ৬ই জুন, ২০১৭ ওই নাবালিকা বাড়ি থেকে পালায় মিন্টুর সাথে। মেয়ের নিখোঁজের বিষয়ে বিনোদ দাস গার্ডেন রিচ থানায় ৭ই জুন যোগাযোগ করেন। থানায় গিয়ে তিনি জানান, মিন্টু আলির সাথে তার নাবালিকা মেয়ে চলে গেছে। অত্যন্ত তৎপরতার সাথে পুলিশ মিন্টুর বাড়ির সাথে যোগাযোগ করে। রেডও করে। কিন্তু সেখানে মিন্টু এবং নিখোঁজ নাবালিকাকে পাওয়া যায়নি। পরের দিন অর্থাৎ ৮ই জুন, মিন্টুর পরিবারের লোকেরা মহেশতলা থেকে দুজনকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যান। সাথে এলাকার লোকেরাও ছিলেন। মেয়ের জন্য বিনোদ দাস থানায় অপেক্ষা করছিলেন। মেয়েকে বাবার হাতে তুলে দেওয়া হয়।

কিন্তু তারপর? ৯ই জুন মেয়েকে ফিরে পাওয়ার পরেই মেয়ের বাবা অভিযোগ করেন যে আবার তাঁর মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। মেয়ের খোঁজে তিনি প্রথমেই চলে যান মিন্টুর বাড়িতে। সেখানে গিয়ে দেখেন, মিন্টু বাড়িতেই রয়েছে, কিন্তু মেয়ে নেই। বিনোদ দাস তার পরিবারের সদস্য ও এলাকার বন্ধুদের নিয়ে মেয়েকে খুঁজতে যে মিন্টু আলির বাড়িতে গিয়েছিলেন, একথা বিনোদ বাবু হাইকোর্টেও জানান। পরেরদিন অর্থাৎ ১০ই জুন গার্ডেন রিচ থানায় গিয়ে একটি জিডি করেন। ১০ই জুন সেই জিডির ভিত্তিতেই এফ আই আর দায়ের করা হয়।

জিডি এবং এফ আই আর পরবর্তী থানার পদক্ষেপ: ১০ই জুন ডায়েরির পরেই বিনোদ দাসকে সাথে নিয়ে পুলিশ মিন্টুর রাজাবাগানের ঘরে হানা দেয়। পুলিশ গিয়ে দেখে, মিন্টুর বাবা অক্সিজেন মাস্ক পরে বিছানায় শুয়ে রয়েছেন। অসুস্থ বাবার পাশে বসে রয়েছেন মিন্টু। তল্লাশি এবং জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে পুলিশ নিশ্চিত হয়, এবারে নাবালিকা মিন্টুর সাথে পালিয়ে যায়নি। পরবর্তীতে গার্ডেন রিচ এবং রাজাবাগান থানার পুলিশ একধিকবার মিন্টুর বাড়িতে হানা দিয়েছে। মিন্টুকে থানাতে ডাকাও হয়েছে। মিন্টু এবং তার পরিবারের লোকেরা থানায় গিয়েছেনও।

১০ই জুন ডায়েরি এবং এফ আই আর এর ভিত্তিতে পুলিশ একাধিকবার মেটিয়াবুরুজের রাজাবাগানে মিন্টুর বাড়িতে রেইড করে। মিন্টু এবং তার পরিবারকে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। রেইড এবং জিজ্ঞাসাবাদের পরে পুলিশ নিশ্চিত হয়, মিন্টুর মেটিয়াবুরুজের রাজাবাগানের বাড়িতে নাবালিকা নেই।

হাইকোর্টে মিন্টুর আইনজীবী পিনাকী ভট্টাচার্য পরিষ্কারভাবে বলেছেন, প্রথমবার মেয়ে মিন্টুর সাথে গিয়েছিল। পুলিশ এবং মিন্টুর পরিবারের উদ্যোগেই থানায় তার বাবার কাছে মেয়েকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে দিয়ে আসা হয়। কিন্তু দ্বিতীয়বার মেয়েটি মিন্টুর সাথে যায়নি। পুলিশ নিজেও একাধিকবার রেইড এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে সেই বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে। হাইকোর্টে পুলিশের আইনজীবীও একই কথা জানিয়েছেন। পুলিশ হাইকোর্টে যে কেস ডায়েরি জমা করেছে, সেখানেও এই তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে যে মেটিয়াবুরুজের রাজাবাগানে মিন্টুর বাড়িতে নাবালিকা আটক নেই। ১৭ই কোলকাতা ক্রাইম ব্রাঞ্চের জয়েন্ট সিপি টুইট করে জানিয়েছেন, নাবালিকাকে কিডন্যাপ করে মেটিয়াবুরুজের বড়িতে আটকে হয়েছে বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে প্রচার চলেছিলো, তা পুরোপুরি মিথ্যা।

কোলকাতা পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের জয়েন্ট সিপির ট্যুইটের স্ক্রিনশট

মেয়েটি আজও বাড়ি ফিরে আসেনি। কিন্তু মহামান্য হাইকোর্ট তার ইন্টারিম রায়ে মিন্টু আলী অথবা তার বাবা সম্পর্কে একটিও বিরূপ মন্তব্য করেনি। আমরা আশা করতে পারি মেয়েটি সুস্থ শরীরে দ্রুত তার পরিবারের কাছে ফিরে আসবে। তবে এই ঘটনা আমাদের সামনে একটি বিষয় পরিস্কার করে দিয়েছে। একটি কমিউনিটির বিরুদ্ধে কিভাবে গোয়েবেলসিয় কায়দায় মিথ্যা প্রচার বারবার করে চালিয়ে মানুষের মন বিষিয়ে দেওয়া যায়, এই ঘটনা তার একটা নিদর্শন মাত্র।

আজ শেষ করি অনেক দিন আগে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদের স্মৃতি উল্লেখ করে। আমার ছোটবেলায় পশ্চিমবঙ্গে ঘুর্ণিঝড়ের তাণ্ডব দেখাতে গিয়ে একটি ছবি দেওয়া হয়, যেখানে ঝড়ের দাপটে একটি গরু উড়ে গিয়ে একটি গাছে আটকে আছে দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে জানা যায় সাংবাদিক সেনসেশনাল নিউজ পরিবেশনের জন্য গরুটিকে গাছে তুলে ছবি উঠিয়ে ছিলেন। আশাকরি যাঁরা বয়স্ক নেটিজেন রয়েছেন, তাঁদেরও ঘটনাটি মনে পড়বে।

পরের পর্বের লিঙ্ক এখানে


আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ৫)আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ৭) >>

লেখক পরিচিতি : অনুপম ভট্টাচার্য
এমন একজন, যে এখনো নিজের পরিচিতির খোঁজে রয়েছে। আশা করি জীবনের দৌড়ে ফিনিশিং পয়েন্ট আসার আগে তার অনুসন্ধান শেষ হবে।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।